১৭ জুন, ১৯৮৫। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় অবস্থিত কেনেডি স্পেস সেন্টারের এলসি-৩৯ বা লঞ্চ কমপ্লেক্স ৩৯ এ নাসার স্পেস শাটল প্রোগ্রামের ১৮ তম ফ্লাইটের প্রস্তুতি চলছে। এটি অবশ্য নাসার স্পেস শাটল ডিসকাভারির পঞ্চম ফ্লাইটও ছিল। এই ফ্লাইটটির নাম দেয়া হয়েছিল এসটিএস-৫১-জি বা এসটিএস-২৫ নামে। ফ্লাইটটিতে ছিল মোট সাতজন আন্তর্জাতিক নভোচারী। পাঁচজন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নভোচারীর সঙ্গে ছিলেন দুজন পে-লোড বিশেষজ্ঞ, যাদের মধ্যে একজন ফরাসি এবং অন্যজন সৌদি রাজ পরিবারের সন্তান।
অবশ্য সৌদি যুবরাজ আরব স্যাটেলাইট কমিউনিকেশনস অর্গানাইজেশন (সংক্ষেপে আরবসাত) উপগ্রহ আরবসাত-১বি স্থাপন করার জন্য প্রতিনিধি হিসেবেও নিযুক্ত ছিলেন। যুবরাজের বয়স ছিল তখন ২৮। স্পেস শাটল অভিযানের ইতিহাসে তিনিই ছিলেন সবচেয়ে কমবয়সী নভোচারী। প্রথম আরব, মধ্যপ্রাচ্যের প্রথম বাসিন্দা, প্রথম রাজ পরিবারের ব্যক্তি এবং সর্বোপরি বিশ্বের প্রথম মুসলিম হিসেবে মহাকাশে বিচরণ করেন তিনি। তার নাম সুলতান বিন সালমান আল সৌদ।
পুরো নাম সুলতান বিন সালমান বিন আবদুল আজিজ আল সৌদ (سلطان بن سلمان بن عبد العزيز آل سعود)। ১৯৫৬ সালের ২৭ জুন সৌদি রাজ পরিবারে তার জন্ম। সৌদি আরবের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রথম বাদশাহ আবদুল আজিজ ইবনে সৌদের নাতি সুলতান। তার বাবা যুবরাজ সালমান বিন আবদুল আল আজিজ ১৯৬২ সাল থেকে রিয়াদ প্রদেশের গর্ভনর হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন।
প্রাথমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পড়াশোনার পাঠ চুকান তিনি রিয়াদেই। পরবর্তীতে উচ্চশিক্ষার জন্য পাড়ি জমান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডোতে। সেখানে ইউনিভার্সিটি অফ ডেনভার থেকে ম্যাস কমিউনিকেশন বিষয়ে স্নাতক সম্পন্ন করেন। পরবর্তীতে নিউ ইয়র্কের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত সিরাকিউজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স বা স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন সোশ্যাল ও পলিটিক্যাল সায়েন্স বিষয়ে। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার পাঠ পুরোপুরি চুকিয়ে নিজের দেশে ফিরে আসেন সুলতান বিন সালমান।
১৯৮২ সালে সৌদি আরবের তথ্য মন্ত্রণালয়ের আন্তর্জাতিক যোগাযোগ বিভাগে একজন গবেষক হিসেবে নিজের কর্মজীবনের সূচনা করেন সুলতান। পরবর্তীতে ১৯৮৪ সালে লস অ্যাঞ্জেলসে অনুষ্ঠিতব্য গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকে অংশ নেওয়া সৌদি ক্রীড়াবিদদের জন্য তিনি সৌদি মিডিয়া কমিটির ডেপুটি ডিরেক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
একই বছরের শেষের দিকে তিনি পুনরায় ফিরে যান তথ্য মন্ত্রণালয়ে। সেই বছরই তথ্য মন্ত্রণালয়ে নতুন একটি বিভাগ যুক্ত করা হয়- বিজ্ঞাপন বিভাগ। সুলতান বিন সালমানকে এই নতুন বিভাগের ভারপ্রাপ্ত পরিচালকের দায়িত্ব গ্রহণের অনুরোধ জানান হয়। তিনি উক্ত বিভাগের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক পদে নিযুক্ত হন। তবে তা কেবল বছরখানেক স্থায়ী হয়। কেননা, ১৯৮৫ সালে সুলতান বিন সালমান মহাকাশ জয় শেষে দেশে ফিরলে তাকে রাজকীয় সম্বর্ধনা দেয়া হয়। ফিরে আসার কিছুদিন পরই তিনি একটি বাণিজ্যিক বার্তা রেকর্ড করান যা এমটিভিতে লাইভ এইড কনসার্ট ইভেন্ট চলাকালে প্রচার করা হয়। তার সেই বার্তায় স্পেস শাটলে তার ভ্রমণ অভিজ্ঞতা নিয়ে খানিকটা আলোকপাত করা হয়।
মিশন থেকে ফিরে অ্যাসোসিয়েশন অফ স্পেস এক্সপ্লোরার্স সংগঠনে যোগ দেন তিনি। এটি এমন একটি সংস্থা যার সদস্যপদ বিশ্বের সমস্ত প্রাক্তন নভোচারী এবং মহাকাশচারীদের জন্য উন্মুক্ত। এমনকি সুলতান এই সংস্থার পরিচালনা পর্ষদেও দায়িত্ব পালন করেন।
এই অর্জনই তাকে রয়্যাল সৌদি এয়ার ফোর্সে দায়িত্ব পালনের সুযোগ করে দেয়। তাকে লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদবি দেয়া হয়। ১৯৯৬ সালে তিনি অবসর নেন কর্নেল পদে আসীন হয়ে।
১৯৯১-৯৯ সাল অবধি সৌদি কম্পিউটার সোসাইটির চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি। একইসাথে ১৯৯৩ সাল থেকে ২০০০ সাল অবধি আল-উমরান সৌদি অ্যাসোসিয়েশন এর চেয়ারম্যানও ছিলেন। এই প্রতিষ্ঠানটি মূলত স্থাপত্য, ঐতিহাসিক সংরক্ষণ এবং পরিবেশ নিয়ে কাজ করে থাকে। একই বছর সুপ্রীম কমিশন ফর ট্যুরিজম অ্যান্ড অ্যান্টিকুইটিস (এসসিটিএ) প্রতিষ্ঠা পেলে সুলতান বিন সালমানকে সেখানকার সেক্রেটারি-জেনারেলের পদ দেয়া হয়। টানা চার বছর এই পদে বহাল ছিলেন তিনি।
তার কাজের যোগ্য প্রতিদান হিসেবে পরবর্তীতে তাকে দ্বিতীয় মেয়াদেও এই পদে রাখা হয়। প্রকাশ্যেই দাবী করা হয় যে, এসসিটিএ গঠন হবার পর এবং সুলতান বিন সালমান এর দায়িত্ব নেয়ার পর, সৌদি আরব পর্যটনখাতে ব্যাপক উন্নতি লাভ করেছে।
১৯৮৫ সালের ১৭-২৪ জুন ইতিহাসের পাতায় নাম লেখান এই সৌদি যুবরাজ। এসটিএস-৫১-জি ডিসকভারি মহাকাশযানে চড়ে বিশ্বের প্রথম মুসলিম নভোচারী হন তিনি। এই মহাকাশযাত্রায় তিনি একজন পে-লোড বিশেষজ্ঞ হিসেবে ছিলেন। মূলত তিনি আরব উপগ্রহ, সংক্ষেপে যা আরবস্যাট নামেই পরিচিত, সেই আরবস্যাট-১বি স্থাপনের একজন প্রতিনিধি হিসেবে মহাকাশে পাড়ি জমান। সাত সদস্যের আন্তর্জাতিক দলের পাঁচজন নভোচারী ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের, একজন ফ্রান্সের এবং একজন সৌদি আরবের।
মহাকাশে সৌদি যুবরাজ ৭ দিন, ১ ঘণ্টা, ৩৮ মিনিট এবং ৫২ সেকেন্ড ছিলেন। এই সময় তাদের মহাকাশযান পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে মোট ১১১ বার। এর মাঝে তিনি তিনটি গবেষণা চালান এবং দুটি দূরবর্তী পর্যবেক্ষণ কার্যও সম্পাদন করেন। এ সময় তিনি সৌদির বাদশাহ ফাহাদের সঙ্গেও ফোনে কথা বলেন। মহাকাশের শূন্যতায় তিনি মুসলিমদের নিয়মানুসারে নামাজ আদায় করেন এবং পবিত্র গ্রন্থ কোরআন তেলাওয়াত করেন।
কেমন যেন একটা তাড়া ছিল; অদ্ভুত এক প্রাণশক্তি ভর করেছিল যেন। সৌদি আরব এবং আরব বিশ্বের অন্যান্য দেশের জন্যেও এটা ছিল স্মরণীয় একটা মুহূর্ত। কেননা, বেশ বড় একটা পরিকল্পনা ছিল এর পেছনে। আর এই দুইয়ের মধ্যবর্তী অবস্থানে ছিলাম আমি। মানবজাতির সঙ্গে মহাকাশের যে নিবিড় এক সম্পর্ক তা স্পষ্ট উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম আমি।
অবশ্য, এক জীবনে সুলতান বিন সালমান শুধুমাত্র নভোচারী কিংবা সেক্রেটারি জেনারেল হয়েই কাটিয়ে দেননি। অলাভজনক সংস্থা, এবং বিশেষ করে প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য নিজেকে উজাড় করে দিয়েছিলেন তিনি। সেজন্যই ১৯৯৭ সালে সৌদি সরকার তাকে জাতীয় প্রতিবন্ধী আইন পরিচালনা কমিটির সভাপতি হিসেবে নিযুক্ত করে। আর তাই বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পদবীতে আসীন ছিলেন তিনি। যার মধ্যে কিং সৌদ বিশ্ববিদ্যালয়ের সোসাইটি ফর আর্কিওলজিক্যাল স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট, কিং সৌদ বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ অফ ট্যুরিজম অ্যান্ড অ্যান্টিকুইটিসের উপদেষ্টা কমিটির প্রতিষ্ঠাতা, পরিচালনা পর্ষদ ও নির্বাহী কমিটির সদস্য, রিয়াদ কিং খালেদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর (কেকেআইএ) উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান – সিভিল এভিয়েশন জেনারেল অথরিটি (জিএসিএ) অন্যতম।
ব্যক্তিগত জীবনে সুলতান বিন সালমান সৌদি আরবের পররাষ্ট্র মন্ত্রী, সৌদ বিন ফয়সালের মেয়ের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ। তিন সন্তানের জনক তিনি। অবসরে তার পছন্দ গ্লাইডিং এবং স্কিয়িংয়ের মতো ক্রীড়া বিনোদন। এছাড়া, ঘোড়ায় চড়া এবং জগিং করাও তার নিত্যদিনের অভ্যাস। আর তাই তিনি বেশ সুস্বাস্থ্যেরও অধিকারী। লম্বায় ৬ ফুট ১ ইঞ্চি এবং ওজনে ১৮০ পাউন্ড। সৌদি আরবের দিরিয়াতে যুবরাজ সুলতান বিন সালমানের একটি খামার রয়েছে; যা ঐতিহাসিক গ্রামে নির্মিত হলেও আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত।
সুলতান বিন সালমান রাজপরিবারের সন্তান হওয়া সত্ত্বেও তার রাজনৈতিক চিন্তাধারা ভিন্নধর্মী। রাষ্ট্র আর নাগরিক যে একে অপরের পরিপূরক, তা তার উক্তিতেই প্রকাশ পায়। আজকের আয়োজনের ইতি টানা হলো তারই উক্তি পেশের মধ্য দিয়েই,
রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকই একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি। হোক তা রাষ্ট্রের স্বার্থে কিংবা ব্যক্তিস্বার্থে। এখানে, রাষ্ট্রই নাগরিক এবং নাগরিকই রাষ্ট্র। এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, নেতৃত্ব আর নাগরিকদের মধ্যে আদতে কোনো বিভাজন নেই। থাকা উচিতও নয়।