১৮৮১ সালের ২৫ অক্টোবর জন্ম এবং ১৯৭৩ সালের ৮ এপ্রিল ৯১ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। একের পর এক কালজয়ী চিত্রকর্মের জন্য বিশ্বব্যাপী সমাদৃত সেই মহান শিল্পী। প্রণয়ের সম্পর্কে লিপ্ত ছিলেন একাধিক নারীর সাথে। বলা হচ্ছিলো পাবলো পিকাসোর কথা। তার জীবনী নিয়ে নতুন করে বলার আর কিছু নেই। তবে তার জীবনের অজানা একটি দিক নিয়ে ২০০৯ সালে একটি আর্টিকেল প্রকাশ করেন মার্ক হাডসন। ‘পিকাসোঃ চ্যালেঞ্জিং দ্য পাস্ট’ শিরোনামে ন্যাশনাল গ্যালারিতে একটি প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। এই প্রদর্শনীতে নারীদের সাথে পিকাসোর ‘কমপ্লিকেটেড রিলেশনশিপ’ বা জটিল সম্পর্কের দিকটিতে আলোকপাত করা হয়। কীর্তিমান এই শিল্পীর মৃত্যুর এতো বছর পরে অভিযোগ উঠেছে, পিকাসো নাকি তার চিত্রকর্মের জন্য নারীদের শুধু ‘ব্যবহার’ করতেন।
আধুনিক শিল্পকলার এক অনন্য নাম পিকাসো, কিউবিজমের জনক তিনি। বলা হয়, স্থাপত্য থেকে শুরু করে আধুনিক ফ্যাশন পর্যন্ত ভিজ্যুয়াল আর্টের প্রায় সব মাধ্যমেই রয়েছে এই কালজয়ী শিল্পীর প্রভাব। প্রতিটি শিল্পীই কিন্তু কিছু না কিছু থেকে প্রভাবিত হয়ে তাঁর শিল্পকে সমৃদ্ধ করেন। স্বভাবতই তাই প্রশ্ন এসে যায়, কীসের প্রভাব পিকাসোর অন্তরে তাড়না জাগায় সাধারণ পর্যবেক্ষণকে ভেঙেচুরে একেবারে নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে একটি বিষয়কে ক্যানভাসে বন্দী করার? এই প্রশ্নের অনুসন্ধান থেকেই জানা যায়, বৈচিত্র্যময় পিকাসোর জীবনে অনুপ্রেরণা ছিলেন তাঁর জীবনে আসা নারীরা। তাদের একেক জনের একেক রকম বৈশিষ্ট্যের প্রভাব পড়ে তাঁর কাজের মধ্যে। পিকাসোর জীবনে আসা বহু নারীর প্রভাবেই হয়তো পিকাসোর চিত্রকর্মের স্টাইলেও দেখা মেলে বৈচিত্র্যের। তাঁর একেকটি কাজের স্টাইল এবং পর্যায়কালকে তাঁর প্রেমিকাদের নামে নামকরণ করলেও হয়তো ভুল হবে না।
পিকাসো নাকি কথা বলার আগে আঁকা শুরু করেছিলেন। আর দশটি শিশুর মতো মা-বাবা নয়, বরং তাঁর মুখে প্রথম যে শব্দটি শোনা যায় তা হলো ‘লাপিয’, স্প্যানিশ ভাষায় যার অর্থ ‘পেন্সিল’। সেই একই ব্যক্তির মধ্যে বেশ বড় ধরনের একটি পরিবর্তন দেখা যায় নারীঘটিত সম্পর্কগুলোকে কেন্দ্র করে। “নারীরা যন্ত্রণা সৃষ্টির যন্ত্র”, ১৯৪৩ সালে পিকাসো তার রক্ষিতা ফ্রাসোয়া গিলতকে বলেন এ কথা। ৯ বছর ধরে চলা এই সম্পর্কের শেষে ৬১ বছর বয়সী পিকাসো তার এই ২১ বছর বয়সী ছাত্রীকে বলেন, “আমার জীবনে নারীরা কেবল দুই রূপে স্থান পায়, দেবী অথবা পাপোশ”।
রেমব্র্যান্ডট এবং গয়া থেকে শুরু করে বনার্ড এবং স্ট্যানলি স্পেনসারের মতো পুরুষ শিল্পীরা অবচেতনভাবে, অত্যন্ত যত্নের সাথে তাদের শিল্পকর্মে স্ত্রী কিংবা প্রেমিকাদের মুখ ও তনুর প্রতিকৃতি তুলে ধরেছেন। তবে বিংশ শতাব্দীর সেরা শিল্পী পাবলো পিকাসোর মতো করে কেউই তাদের সাথে সংশ্লিষ্ট নারীদের ব্যবহার কিংবা অপব্যবহার করতে পারেননি বলে জোর দাবি উঠেছে।
২০১৬ সালের এপ্রিল মাসে লন্ডনের জাতীয় গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত এক প্রদর্শনীতে পিকাসোর আঁকা নারীদের কিছু বিকৃত ছবি দেখলে আপনার মনে হতেই পারে নারীরা শুধুই পিকাসোর ‘শিল্পদাসী’ ছিলেন। ক্যানভাসের উপর ফুটে ওঠা নারী প্রতিকৃতিগুলোর সারা শরীরে বিকৃতির চিহ্ন স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। পিকাসোর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সাত নারীর মধ্যে দুজন আত্মহত্যা করেছেন, দুজন মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলেন। কয়েক ডজন নারীর সাথে তার সম্পর্ক ছিল, মতান্তরে সংখ্যাটি শতের ঘরও ছাড়িয়ে যায়! শিল্পের জন্য, ছবি আঁকার জন্য এই নারীদের উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল ছিলেন পিকাসো। তার জীবনের শেষ ভালোবাসা দেমর জ্যাকলিন রোককে ঘিরেই ৪০০টি পোট্রেট এঁকেছিলেন তিনি। এবার তাহলে তার জীবনে আসা নারীদের সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে একটু জেনে নেয়া যাক।
ফার্নান্দে অলিভিয়ার (১৮৮১-১৯৬৬; পিকাসোর সাথে ছিলেন ১৯০৪-১৯১১)
শৈশবের দুঃসহ স্মৃতি আর কৈশোরের ভুল মানুষকে বিয়ে করার যন্ত্রণার হাত থেকে মুক্তি পেতে প্যারিসের বোহেমিয়ান জীবনে আশ্রয় নেয় অলিভিয়ার। সেখানেই তার সাথে পরিচয় ঘটে পিকাসোর। মডেল ফার্নান্দে অলিভিয়ারের সাথেই সবচেয়ে দীর্ঘকালীন প্রণয়ের সম্পর্কে আবদ্ধ ছিলেন পিকাসো। প্রায় ৮ বছরের এই সময়টিতে অলিভিয়ারকে নিয়ে অসংখ্য ছবি আঁকেন পিকাসো। কিউবিজম বিপ্লবের সময়টিতে পিকাসোর সাথেই ছিল এই মডেল, কিন্তু কখনো পিকাসোর শিল্পসত্ত্বা তাকে স্পর্শ করেনি বলেই জানা যায়। বিবাহিতা ফার্নান্দের সাথে ১৯০৪ সালে পিকাসোর দেখা হওয়ার পর থেকে আর অন্য কারো জন্য তাকে মডেলিং করতে দেননি পিকাসো। ১৯৮৮ সালে পিকাসোর সাথে সম্পর্ক থাকাকালীন স্মৃতি নিয়ে তাঁর বই বের হয় যার নাম ‘Loving Picasso’।
ইভা গোয়েল (১৮৮৫-১৯১৫; পিকাসোর সাথে ছিলেন ১৯১১-১৯১৫)
শৈশবে তার নাম মার্সেলে হাম্বার্ট রাখা হলেও পরবর্তীতে তিনি ইভা গোয়েল নামেই বেশি পরিচিতি লাভ করেন। ১৯১১ সাল পর্যন্ত তিনি জুনিয়র শিল্পী লুই মারক্যুসের সাথে প্রণয়ের সম্পর্কে আবদ্ধ ছিলেন। ১৯১২ সালে ফার্নান্দের সাথে পিকাসোর সম্পর্কের অবসান হওয়ার পর মার্সেলে হাম্বার্ট তথা ইভা গোয়েলের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন পিকাসো। ক্ষণজন্মা ইভা সম্পর্কে খুব কমই জানা গেছে। ১৯১৫ সালে যক্ষ্মারোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান ইভা। তার অকাল মৃত্যুতে ভেঙে পড়েন পিকাসো। পরবর্তীতে ‘I Love Eva’ পেইন্টিংয়ে তাঁর প্রতি পিকাসোর ভালোবাসা উঠে আসে।
ওলগা খোখলোভা (১৮৯১-১৯৫৪; পিকাসোর সাথে ছিলেন ১৯১৭-১৯৩৫)
পিকাসোর প্রথম স্ত্রী, তার প্রথম সন্তান পাউলোর জননী ইউক্রেনিয়ার নৃত্যশিল্পী ওলগা খোখলোভা। শিল্পী যখন রোমে ব্যালে প্যারেড ডিজাইন করছিলেন, তখন এই ব্যালে শিল্পীর সাথে তাঁর প্রেম হয়। তারা ১৯১৮ সালে রাশিয়ায় বিয়েও করেন। তাদের বৈবাহিক জীবন কলহপূর্ণ ছিল। ওলগা একদিকে ছিলেন সম্ভ্রান্ত পরিবারের উচ্চবিত্ত সমাজের আনুষ্ঠানিকতাপ্রিয় মেয়ে, অন্যদিকে পিকাসো ছিলেন সম্পূর্ণ বোহেমিয়ান। কাজেই তাদের মধ্যকার এই দ্বন্দ্বের কারণ সহজেই অনুমেয়। ১৯২১ সালে তাঁদের একটি পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করে। ১৯৩৫ সালে তারা আলাদা হয়ে যাওয়ার পরে ওলগা পিকাসোর নামে একের পর এক অভিযোগের তীর নিক্ষেপ করেন। পিকাসো অবশ্য ওলগার সাথে সম্পত্তি ভাগাভাগি করে নিতে কোনোমতেই রাজি হননি। কাজেই ফরাসি আইন অনুযায়ী তাদের বিবাহবিচ্ছেদ কার্যকর হয়নি।
মারি থেরেস ওয়াল্টার (১৯০৯-১৯৭৭; পিকাসোর সাথে ছিলেন ১৯২৭-১৯৩৬)
১৯২৭ সালে মারি ওয়াল্টারের সাথে যখন পিকাসোর প্রেম হয়, তখন তাঁর বয়স মাত্র ১৭। পিকাসো-ওলগার ফ্ল্যাটের খুব কাছেই তিনি থাকতেন। ১৯২৭ সালে স্বর্ণকেশী এই নারীর সাথে আর্ট গ্যালারির বাইরে দেখা হয় পিকাসোর, সেখান থেকে ধীরে ধীরে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন তারা। ব্যাপারটা মারি অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার আগ পর্যন্ত ওলগার অজানা ছিল, পিকাসো প্রায় আট বছর লুকিয়ে রেখেছিলেন এই সম্পর্কটির কথা। মায়া নামে মারি আর পিকাসোর এক কন্যাসন্তান জন্ম হয়। এই মায়ার পুত্রই অলিভিয়ার ওয়িদমায়ার ‘Picasso : The Real Family History’ নামে একটা বই লেখেন। মায়া জন্মের এক বছর পরেই পিকাসো আবার দোরে মারের সাথে সম্পর্কে আবদ্ধ হোন। এই কষ্ট সহ্য করতে না পেরে ১৯৭৭ সালে আত্মহত্যা করেন মারি।
দোরে মার (১৯০৭-১৯৯৭; পিকাসোর সাথে ছিলেন ১৯৩৬-১৯৪৪)
জন্মগতভাবে ক্রোয়েশিয়া এবং ফরাসি মিশ্র রক্তের হেনরিটা থিওডরা মার্কোভিচ, যিনি দোরে মার নামেই বেশি পরিচিত, একাধারে আলোকচিত্রী, চিত্রশিল্পী এবং কবি ছিলেন। গ্যের্নিকার ছবি তোলার সূত্রে ১৯৩৬ সালে ৫৪ বছর বয়সী পিকাসো যুগোস্লাভিয়ান আলোকচিত্রী দোরে মারের সাথে মিলিত হন। ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত তিনি পিকাসোর সবসময়ের সঙ্গী ছিলেন। পিকাসো প্রায়ই তাকে ‘Private Muse’ বলে ডাকতেন। পিকাসো বিশ্বাস করতেন, শক্তিমান এই নারী শিল্পীর কখনো মা হওয়ার ক্ষমতা ছিল না। পিকাসো তাঁর পরবর্তী প্রেমিকা ফ্রাসোয়ার জন্য দোরে মারকে ছেড়ে যান। দোরে মার তার জীবনের শেষ দিনগুলো পিকাসোর সাথে কাটানো সুসময়ের কথা ভেবে অতিবাহিত করেন।
ফ্রাসোয়া গিলত (১৯২১-; পিকাসোর সাথে ছিলেন ১৯৪৪-১৯৫৩)
পরিবারের চাপে আইন বিষয়ে পড়তে যাওয়া গিলত সুযোগ পেয়েই ভালোবাসার বিষয় শিল্পকলায় ভর্তি হয়ে যান। ১৯৪৩ সালে এই শিল্পকলার এই ছাত্রীর সাথে পিকাসোর প্রেম হয়। তাঁদের ঘরে ক্লদ ও পালোমা নামে দুটি সন্তানের জন্ম হয়। শিশুদের নামকরণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য পিকাসোর আঁকা শান্তির পায়রা অনুযায়ী হয়। গিলতের সাথে সম্পর্কের নয় বছর পিকাসোর জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় ছিল বলেও শোনা যায়। গিলত পরবর্তীতে মার্কিন মুল্লুকের অগ্রগামী প্রতিষেধক আবিষ্কারক জোনাস সাল্ককে বিয়ে করেন। এখনো ছবি আঁকেন গিলত।
জ্যাকলিন রোক (১৯২৭-১৯৮৬; পিকাসোর সাথে ছিলেন ১৯৫৪-১৯৭৩)
ভ্যালারিসের মাদুরা পটারি স্টুডিওতে সহকারী বিক্রেতা ছিলেন জ্যাকলিন, এখানেই পিকাসো তার সিরামিকসের কাজগুলো করাতেন। ১৯৫৪ সালে হতাশ নিঃসঙ্গ পিকাসো ২৭ বছর বয়সী জ্যাকলিনের সাথে পরিচিত হন। ১৯৬১ সালে তিনি তাকে বিয়ে করেন। এ সময় পিকাসোর বয়স ৭৯। অন্যান্য প্রেমিকাদের তুলনায় জ্যাকলিনকে নিয়ে তাঁর সবচেয়ে বেশি চিত্রকর্ম রয়েছে। পিকাসোর প্রেমিকাদের মধ্যে শুধুমাত্র ওলগা এবং জ্যাকলিনই মাদাম পিকাসো হতে পেরেছিলেন অর্থাৎ তাঁর স্ত্রীর মর্যাদা পেয়েছিলেন, কারণ স্প্যানিশদের মধ্যে স্ত্রী জীবিত থাকাকালীন অন্য কাউকে বিয়ে করার রীতি ছিল না। ১৯৮৬ সালে গুলি করে আত্মহত্যা করেন জ্যাকলিন।