‘স্পর্শের বাইরে’ নাটকের কথা মনে আছে? নাটকের শুরুতে এক তরুণী সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে, আর ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজছে- “ভালোবাসার স্পর্শ কোথা পাই…”। অথবা এই সেদিনের ‘হাওয়া বদল’ মুভিটা? জানলায় বৃষ্টি দেখতে দেখতে ইনকা নামের দুখী মেয়েটার “মোর ভাবনারে কী হাওয়ায় মাতালো…” গানটা। দুটো গানেরই নেপথ্যে কন্ঠটা সাহানা বাজপেয়ীর। বলছি দুই বাংলায় সমানভাবে জনপ্রিয় রবীন্দ্র সঙ্গীতশিল্পী সাহানা বাজপেয়ীর কথা।
সাহানা, নামটা বাবা দিয়েছিলেন পুরোনো দিনের রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী সাহানা দেবীর নামানুসারে। দার্জিলিঙের নর্থ বেঙ্গল বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৭৯ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি জন্ম তার। রবি ঠাকুরের নিজ হাতে গড়া শান্তি নিকেতনে তার বেড়ে ওঠা। রোজকার রবীন্দ্র চর্চার এই পরিবেশে অজান্তেই তার জড়িয়ে যাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীতের সাথে। গানকে ভালোবেসে, কখনোই পেশাদারিত্বের খাতিরে গানের চর্চা করেননি তিনি।
তের বছর বয়স থেকেই সাহানার গান গাওয়া শুরু। বাবা বিমল বাজপেয়ীর অনুপ্রেরণাটাই মূলত ছিল তার রবীন্দ্রনাথে হাতেখড়ির উৎস। সাহানার বাবা-মা দু’জনেই ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের ইউনিভার্সিটি অব নর্থ বেঙ্গলে পলিটিক্যাল সায়েন্সের শিক্ষক। বাবা প্রফেসর বিমল বাজপেয়ী নিজে একজন রবীন্দ্র বিদ্বান ছিলেন। মাত্র তিন বছর বয়সেই সাহানা গলায় তুলে নেন “সকাতরে ঐ কাঁদিছে সকলে”। বাল্যকালে সাহানা যে পাড়ায় থাকতেন, সেখানে অনেক বাউল থাকতেন। চায়ের দোকানে বা পৌষ মেলার আখড়ায় প্রায়ই তাদের কাছে গিয়ে ছোট্ট সাহানা বায়না ধরতেন “এটা শেখাও, ওটা শেখাও” বলে। এদিকে তার বাবার রেকর্ড প্লেয়ার তো আছেই! তাতে অমর পাল, আব্বাসউদ্দিন আহমেদ, জসিমউদ্দিনের লেখা গান, নির্মলেন্দু চৌধুরী মগ্ন হয়ে শুনতেন সাহানা।
স্বাভাবিকভাবেই শান্তিনিকেতনে বেড়ে ওঠার অভিজ্ঞতাটা সাহানার জন্য জ্ঞানদায়ক ছিল। শান্তিনিকেতনের আলো বাতাস ছাড়া আদৌ তার সুপ্ত প্রতিভার পরিস্ফুটন সম্ভব হতো কিনা, তা তিনি নিজেও নিশ্চিত নন। এখানে তিনি নামকরা সব সঙ্গীতজ্ঞের কাছে রবীন্দ্র সঙ্গীতের তালিম পান। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন বিজয় সিনহা, মধুমতি রায়, চিত্রা রায়, শ্যামলী বন্দোপাধ্যায়, চন্দন মুন্সী, মিতা হক (বাংলাদেশ) প্রমুখ। এছাড়া যাদের গান শুনে শুনে তার বেড়ে ওঠা, তাদের মধ্যে রয়েছেন সাহানা দেবী, রাজেশ্বরী দত্ত, সুচিত্রা মিত্র, কে এল সায়গাল, কণিকা বন্দোপাধ্যায়, পান্নালাল দাশগুপ্ত, পন্ডিত ভীমসেন যোশি, ওস্তাদ আলী আকবর খাঁ, মল্লিকার্জুন মনসুর, শান্তিদেব ঘোষ, জ্যাকসন ব্রাউনি, জনি মিশেল, ব্রুস স্প্রিংস্টন, বব ডিলান, লেনার্ড কোহেন, জেমস টেইলর, পল সাইমনসহ আরও অনেকে। অর্থাৎ একই সাথে সাহানা ক্লাসিক্যাল ভারতীয় সঙ্গীতের সাথে পাশ্চাত্য রক ঘরানার গানেরও সংস্পর্শে আসেন।
সাহানার সাথে যে নামটি অবধারিতভাবেই চলে আসে তা হলো অর্ণব। বাংলাদেশের বিখ্যাত গায়ক ও সঙ্গীত পরিচালক শায়ান চৌধুরী অর্ণবের সাথে সাহানার পরিচয় শান্তি নিকেতনের ‘পাঠ ভবনে’ সেকেন্ডারি লেভেলে পড়ার সময় থেকেই। ক্লাস টুয়েলভে পড়ার সময় বন্ধুরা মিলে ঠিক করেন গিটার বাজিয়ে একটু নতুনভাবে বাউল গান করার। কয়েকজন মিলে গড়ে তোলেন সুফি আর বাউলিয়ানার ফিউশনে এক নতুন ধাঁচের ব্যান্ড। তাদেরই একজন এই ব্যান্ডের নাম দেয় ‘বাংলা’। অর্ণব ছিলেন এই ব্যান্ডের মাথা। সাহানা আর অর্ণব যুগলের সৃষ্টিতে একটা ‘ম্যাজিক’ কাজ করতো সবসময়। সেই সময় বাংলার হয়ে যাদবপুরে ও প্রসিডেন্সি কলেজে উৎসবে গেয়েছেন সাহানা। অর্ণবের ঢাকার বান্ধবী আনুশেহ আনাদিল একদিন শান্তিনিকেতনে বেড়াতে গিয়ে ভিড়ে গেলেন তাদের গান-বাজনার দলে। এরপর বাংলাদেশেও অনুষ্ঠান হলো তাদের। তখন থেকেই বাংলাদেশের সাথে সম্পর্কের শুরু সাহানার। অর্ণবের জনপ্রিয় সব সলো অ্যালবাম ‘চাইনা ভাবিস’ (২০০৬), ‘হোক কলরব’ (২০০৭), ‘ডুব’ (২০০৮), ‘খুব ডুব’ (২০১৫)- এ সাহানা বেশকিছু গান লিখেছেন, কন্ঠও দিয়েছেন।
২০০০ সালের দিকে বাংলাদেশে আসেন সাহানা বাজপেয়ী। লোকসঙ্গীতের প্রতি টানটা বরাবরই ছিল তার। বাংলাদেশে এসে কুষ্টিয়ার রব ফকির, শাহজাহান মুন্সি, নজরুল ইসলাম বয়াতিদের মতো ফকিরদের সঙ্গে তার আলাপ হয়। তাদের কাছ থেকে গান লিখে লিখে শিখে নিতেন তিনি। তখন যে খুব সিরিয়াসভাবে লোকগান গাইতেন তা নয়। বরং রবীন্দ্রসঙ্গীতের পাশাপাশি স্বাদ বদলের জন্য গাইতে শুরু করলেন। তার ভাষ্যমতে, এলিটীয় গতে বাঁধা যায় না বলে খুবই মুক্তির স্বাদ পান তিনি লোকসঙ্গীতের মধ্যে। একটা আলাদা টান অনুভব করেন সবসময়।
আধুনিক কালে যে কয়জন শিল্পী বা সঙ্গীতজ্ঞ রবীন্দ্র সঙ্গীতকে সফলভাবে সর্বস্তরের শ্রোতার উপযোগী করে উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম সাহানা বাজপেয়ী। রবীন্দ্র সঙ্গীত বরাবরই একটা অভিজাত শ্রেণীর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। চিরাচরিত ধারার রবীন্দ্র সঙ্গীত, যাতে শুধু রবি ঠাকুরের অপ্রিয় বাদ্যযন্ত্র হারমোনিয়াম দিয়েই সুর তোলা হতো, তাতে সাহানা কিছু পরিবর্তন আনার প্রয়াসী ছিলেন। রবীন্দ্র সঙ্গীত সর্বস্তরের শ্রোতার গ্রহণযোগ্যতা পাবার মূল বাধা ছিল ঐতিহ্যবাহী ধারায় শিল্পীদের মাতম করার সুরে রবীন্দ্র সঙ্গীত গাওয়া। সাহানার ভাষ্যমতে, শান্তি নিকেতনের পাঠ ভবনে অধ্যয়নের সময় তাদের শেখানো হয়েছে রবীন্দ্র সঙ্গীত আনন্দের সাথে গাইতে। সাহানা চেয়েছেন কবিগুরুর শব্দগুলোকে সময়োপযোগী এক স্বরব্যঞ্জনার সাথে যুক্ত করতে, বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহারেও তিনি প্রাধান্য দিয়েছেন এমন কিছু যন্ত্রের, যা তরুণ প্রজন্মের মাঝে তুলনামূলক অধিক অনুরণন তৈরি করবে।
২০০৭ সালে ঢাকার বেঙ্গল মিউজিক কোম্পানি থেকে সাহানার প্রথম রবীন্দ্র সঙ্গীতের অ্যালবাম ‘নতুন করে পাবো বলে’ প্রকাশিত হয়। প্রথম অ্যালবামেই দুই বাংলার সঙ্গীত জগৎ কাঁপিয়ে দেন তিনি। দ্বিতীয় অ্যালবাম ‘যা বলো তাই বলো’ বের হয় ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে। এরপর লোকগীতি নিয়ে তার তৃতীয় অ্যালবাম ‘মন বান্ধিবি কেমনে’ বেরোয় ২০১৬ সালে। সিনেমায় সাহানা গলা দিয়েছেন ‘হাওয়া বদল’-এর ‘মোর ভাবনারে’, ‘তাসের দেশ’-এর ‘বলো সখী বলো’, ‘ফ্যামিলি অ্যালবাম’-এর ‘প্যারালাইজড’ গানগুলোতে। এছাড়া মুক্তির অপেক্ষায় থাকা ‘আন্ডার কনস্ট্রাকশন’ ছবিটিতে সম্প্রতি ‘তোমায় গান শোনাবো’ গানটি গেয়েছেন তিনি।
২০০০ সালে সাহানা আর অর্ণব বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। সাত বছর সংসার করার পরে ২০০৮-এ তাদের বিচ্ছেদ হয়। সুরের সহযাত্রী হিসেবে অর্ণব তাকে অনেক সমৃদ্ধ করেছেন বলে মনে করেন সাহানা। তার ভাষায়, “মিউজিক অনুভব করার ক্ষমতায় ওর তুলনা নেই”। গান বাঁধার ব্যাপারে তাদের উদ্যোগটা কখনো এক তরফা ছিল না। তাই লেনদেনটাও যথেষ্ট সুন্দর ছিল। একটা দীর্ঘ সময় বাংলাদেশের মানুষ অনেকে সাহানাকে এ দেশের বলেই মনে করতো। ‘ঢাকার বউ’ পরিচয়টা তার চুকে গেছে অনেক আগেই। কিন্তু টুটেনি এদেশের মানুষের সাথে তার টান। যখনই কন্ঠ ছেড়েছেন, চিরচেনা বাংলা গানের অসম্ভব মোহনীয় স্নিগ্ধতার বাঁধনে জড়িয়ে ফেলেছেন উভয় বাংলার শ্রোতাদের।
সাহানা মনে করেন, শিল্পী হিসেবে যে শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা তিনি অর্জন করেছেন, তার পুরোটাই বাংলাদেশের মানুষের দান। এর পেছনে অবশ্য যুক্তিও আছে। ওপার বাংলায় যখন ফিরে গিয়ে নতুন করে গান শুরু করবেন, ততদিনে তিনি প্রবাসের পথ বেছে নিয়েছেন। উড়ে এসে গান করেছেন, আবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ফিরে গেছেন। এক জায়গায় অবস্থান করে সেখানকার মানুষের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে কাজ না করতে পারলে তাদের ভালোবাসাটা পাওয়া হয়ে ওঠে না, এটা তিনিও মানেন। ২০০৫-এ বাংলাদেশের ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে ইংরেজির লেকচারার হিসেবে যোগ দেন সাহানা। পরে ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনে এসওএএস-এ যোগ দেন।
অর্ণবের সাথে বিচ্ছেদের পর সাহানা পরবর্তীতে রিচার্ড হ্যারেট নামে এক ব্রিটিশ নাগরিককে বিয়ে করেন। রোহিনি এলিজাবেথ নামে তার একটি কন্যাসন্তান রয়েছে। বর্তমানে তিনি ইংল্যান্ডেই অবস্থান করছেন। ৩৮ বছর বয়সী সাহানা এখনও শিখছেন। শিখছেন সঙ্গীত, সাহিত্য, এমনকি জীবনটাও। তার ভবিষ্যৎ লক্ষ্য হলো কম খ্যাত ও কম গাওয়া রবীন্দ্র সঙ্গীতগুলো নতুনভাবে মানুষের সামনে নিয়ে আসা; রবীন্দ্র সঙ্গীতকে ঘুমপাড়ানি সুরে শুধু বুড়োদের পাতের রসনা করে না রেখে এর সজীবতাকে সকল শ্রেণীর, সকল বয়সের মানুষের হৃদয়ের সংস্পর্শে এনে দেয়া। ভক্তদের জন্য তার উক্তি, “সকল ধরনের গান শুনতে থাকুন। পৃথিবীতে এই একটাই মাত্র আরোগ্যকারী শক্তি বাকি রয়েছে”। বেঁচে থাকুন সাহানা, আর জাদুকরী কন্ঠ দিয়ে অকারণ হরষে শ্রোতাদের মন দোলাতে থাকুন।