প্রাচীন মিশরের দিকে তাকালে অবাক না হয়ে থাকা যায় না। হোক বস্তুগত উন্নতিতে কিংবা জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিকাশে, উভয় ক্ষেত্রেই প্রধান অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছে তাদের ধর্ম। বস্তুত মিশরীয় ধর্ম ছিল অনেকগুলো বিশ্বাস আর চর্চার সম্মিলিত রূপ। হাল আমলে মিশরীয় পুরাণ, বিজ্ঞান, চিকিৎসাশাস্ত্র, জাদু, আধ্যাত্মিকতাকে আলাদাভাবে সংজ্ঞায়িত করা গেলেও সেই সময়ে এগুলো মিশরীয় ধর্মের ভেতরেই অঙ্গীভূত ছিল। উপরন্তু তাদের সাথে যুক্ত ছিল মৃত্যু পরবর্তী বিশ্বাস ব্যবস্থা।
মিশরীয় জীবনে ধর্মের গুরুত্ব ছিল ব্যাপক। দুনিয়াবি জীবন সেখানে অনন্ত জীবনেরই একটা অংশ। মৃত্যুর পরে বেঁচে থাকতে হলে তাই যথাযোগ্য ধর্মকর্ম ও আচার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। বেঁচে থাকা দিনগুলোতে এজন্য প্রত্যেক ব্যক্তিকে সৃষ্টিজগতের ভারসম্য বুঝে জীবন যাপন করতে হয়। এই ভারসম্যকে বলা হয় মাত। মানুষকে একে অপরের উপর নির্ভর করতে হয় সমাজে বসবাস করতে গেলে। মাত হলো পরস্পরের উপর নির্ভরশীলতার মধ্য দিয়ে সকলের জন্য সর্বোচ্চ সুখের পরিবেশ সৃষ্টির উপায়। দেবতারাও মানুষের মাধ্যমে সেটাই চান। মাত তাই সত্য, সুন্দর এবং শৃঙ্খলাপূর্ণ জীবন।
দেবতাগণ
মিশরীয় ধর্মে জাদু এবং চিকিৎসার দেবতা হেকা। তার শক্তি অবশ্য আরো পরিব্যপ্ত। অন্য দেবতাদের কর্ম সম্পাদনের পেছনে থাকেন হেকা। সম্ভব করেন মানুষ এবং দেবতাদের মধ্যকার যোগাযোগকে। মিশরীয় দৈনন্দিন জীবনের সাথে জাদু আর চিকিৎসা মিশে গিয়েছিল। ফলে হেকার ব্যাপ্তি সহজেই অনুমেয়।
শুরুতে কিছুই ছিল না। কেবল বিশৃঙ্খলা ও অনন্ত অন্ধকারময় পানি বা নু ছাড়া। সেই বিশৃঙ্খলাপূর্ণ পানি থেকে জন্ম লাভ করে মাটি; যার নাম বেনবেন। বেনবেনের উপর সমাসীন ছিলেন পরম দেবতা আতুম-রা। দেবতা সেই সীমাহীন শূন্যতার মাঝখানে একাকিত্ব অনুভব করলেন। ফলে তিনি থুথু ফেললেন, যা থেকে জন্ম নেয় বাতাসের দেবতা শু। বমি করলেন, যা থেকে জন্ম নেয় আর্দ্রতার দেবী তেফনুত। একবার সেই সন্তানেরা কোথায় যেন হারিয়ে গেল। দেবতা তাদের অনুসন্ধানেই নিজের একটা চোখ খুলে পাঠালেন। নিজে বসে রইলেন সেই বেনবেনের উপর। শীঘ্রই প্রত্যাবর্তন করে শু আর তেফনুত। সন্তানদের ফিরে আসায় আনন্দে আতুম-রার সে কী কান্না! চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ে পানি। সেই পানি থেকে জন্ম লাভ করে মানুষ। নারী আর পুরুষ।
তখনো মানুষের জন্য কোনো আবাস নেই। শু আর তেফনুত পরস্পরের সাথে মিলিত হলে জন্ম নেয় দুই সন্তান। পৃথিবী দেবতা গেব এবং আকাশ দেবী নুত। শুনতে অন্যরকম মনে হলেও প্রাচীন মিশরে রক্তের বিশুদ্ধতা রক্ষার জন্য উচ্চবংশীয়দের মধ্যে ভাইবোনের বিয়ে প্রচলিত ছিল। তার ছাপই ধর্ম ও পুরানে এসেছে।
গেব আর নুতের থেকে জন্ম লাভ করে আইসিস, ওসিরিস, নেপথিস এবং সেথ। আবার আইসিস এবং ওসিরিসের পুত্র হোরাস। প্রত্যেক দেবতারই বিশেষ ক্ষেত্রে পারদর্শীতা ছিল। গৃহস্থালি জীবন এবং নারীর স্বাস্থ্যের দেবী বাসতেত। দয়া, মাতৃত্ব, ভদ্রতা আর ভালোবাসার দেবী হাথোর। সন্তান প্রসবের দেবী ছিলেন তিনেনেত। প্রাচীন যুগে শরাবকে গণ্য করা হতো দৈব পানীয় রূপে। প্রায় দেবতা এবং দেবীগণই এর সাথে জড়িত। যদিও বেশি সম্পৃক্ত করা হয় ওসিরিসের সাথে। ওসিরিসের মৃত্যু এবং ফিরে আসা নিয়েও আসে দীর্ঘ আখ্যান।
থিবিসে ছিল তিনজন উপাস্যের প্রাধান্য; আমুন, মওত এবং খনসু। স্থানীয় উর্বরতার দেবতা আমুন। পরবর্তীতে অবশ্য তাকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে সূর্যের সাথে। মওত তার স্ত্রী; প্রতীকায়িত করে সূর্যের আলোর সাথে। সূর্যের আলোর মতোই মওতের চোখ সকলকে দেখতে পায়। আরোগ্য এবং অশুভ বিনাশকারী দেবতা খনসু তাদের পুত্র। এছাড়া আমুন এবং আমুনেত, হেহ এবং হাউহেত, কেক এবং কাউকেত, নুন এবং নাউনেত- এই চার জোড়া দেবদেবীকে এক সাথে বলা হতো ওগদোয়াদ। দেবতা হিসেবে পতাহ কম গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন না। সমকালীন গ্রিকদের কাছে মিশর পরিচিত হতো ইজিপ্টস নামে; ইজিপ্ট নামের অর্থই পতাহ দেবতার দেশ।
ভারসম্য
মিশরীয় বিশ্বাস অনুসারে, পৃথিবী এবং বিশেষ করে মিশরই মহাবিশ্বের প্রতিনিধিত্ব করে। অস্তিত্বশীল সকল কিছুর কেন্দ্র মানুষ। আকাশের তারার গতিপথ কিংবা অবস্থানও তাই সরাসরি মানুষের ব্যক্তিত্ব ও ভবিষ্যতের সাথে যুক্ত। তাদের মধ্য দিয়েই দেবতারা প্রতিদিন যোগাযোগ করে মানুষের সাথে। দেবতাদের সুদৃষ্টি পাবার জন্য মানুষকে প্রতিদিনকার জীবন বিশ্বজগতের নিয়মকানুনের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হয়। ভারসম্যহীন জীবন নিজের জন্য ক্ষতিকর; অন্যদের জন্যও। সমস্ত পাপের শিকড় হলো অকৃতজ্ঞতা। এর মধ্য দিয়েই মানুষ অবাধ্য আর তার আত্মা বিষাক্ত হতে শুরু করে।
এই বিশ্বাস থেকে জন্ম নিয়েছিল নানা রকম উপাসনা। ঈশ্বরের উপসনা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য তার অনুগ্রহ বুঝতে ও চিনতে পারাও জরুরি। দেবী হাথোরের পাঁচ উপহারের কথা এইক্ষেত্রে সামনে আনা যেতে পারে। যখন কোন ব্যক্তি মন্দিরে আসতো; মন্দিরের যাজক বা যাজিকা তার বাম হাত সামনে টেনে নিতো। তারপর জিজ্ঞাসা করতো,
‘সেই পাঁচটি জিনিসের নাম বলো, এই মুহূর্তে মারা গেলে যাদের অভাব তোমাকে সবচাইতে বেশি কাঁদাবে।’
উত্তরে মানুষের প্রিয় পাঁচটি নাম বলতো। যেমন, স্ত্রী, সন্তান, মদ, কুকুর এবং নদী। তখন যাজক ওই ব্যক্তির বাম হাতের পাঁচটি আঙুলকেই ওই ব্যক্তির সামনে ধরে বলতো,
‘এই হলো হাথোরের পাঁচটি উপহার তোমার জন্য। প্রতিদিন অন্তত এই পাঁচটি দয়ার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে। যদি এদের কোন একটা হারিয়ে যায়, অন্য একটা দিয়ে দেবী তা পূরণ করে দেবেন। ফলে পাঁচ আঙুলের মতো পাঁচটি উপহারও স্থির থাকবে আমৃত্যু।’
এভাবেই আচার শুরু হতো। বিশ্বাসীদের উপর এই বিশ্বাসের ফলাফলও ছিল দরুণ। মানুষ সকল অবস্থাতেই তার হাতের পাঁচটি আঙুলের সাথেই থাকে। তার অর্থ মানুষ যে অবস্থাতেই থাক, তার প্রতি ঈশ্বরের করুণাকে মনে রাখে। হতাশ না হয়ে কৃতজ্ঞ হবার চেষ্টা করে। চেষ্টা করে ভারসম্যপূর্ণ জীবন যাপনের।
আত্মা
মানুষ মাত্রই মৃত্যু পরবর্তী অনিশ্চয়তাকে ভয় পায়। মিশরীয় সভ্যতাতেও তার উপস্থিতি লক্ষনীয়। মৃত্যুকে পরিগণিত করা হতো অনন্ত জীবনের দরজা হিসেবে। ফলে মৃত্যু আনুষ্ঠানিকতা বিহীন থাকেনি। তার চিহ্ন লেগে আছে আধুনিক মিশরীয় বিভিন্ন স্তম্ভ, সমাধি এবং পিরামিডের আদলে। ব্যক্তিকে সেখানে বিশেষ অংশের সমষ্টি বলেই গণ্য করা হতো। মানব সত্তার নশ্বর শরীরের নাম খাত, যেখানে অমর অংশের নাম আখ। ভালো এবং মন্দের উৎস হৃদয়কে বলা হতো আব। রেন ব্যক্তির গোপন পরিচয় এবং কা দ্বৈত অস্তিত্ব। স্বর্গ-মর্ত্যে যোগাযোগকারী পাখিরূপ মানবাংশের নাম বা, যেখানে ব্যক্তির ছায়াসত্তার নাম শুয়েত।
মৃত্যুর পরে ব্যক্তি দেবতা ওসিরিসের সামনে হাজির হয়। সেখানে দাঁড়িপাল্লায় পরিমাপ করা হয় তার শুদ্ধাশুদ্ধি। পাল্লার অপর পাশে থাকে সাদা পালক। সামনে থাকে জ্ঞানের দেবী থত। যদি জীবিত অবস্থায় ব্যক্তির মন্দকর্মের পরিমাণ খুব কম হয় অর্থাৎ সাদা পালকের চেয়ে হালকা হয়; তাহলে তার প্রতি থাকে সন্তুষ্টি। অন্যদিকে ব্যক্তির মন্দকর্মই যদি ভারী হয়ে উঠে; তাহলে সিদ্ধান্ত বিপরীত। ছুড়ে ফেলা হয় শাস্তি দানের জন্য। সেখানে তাকে ছিন্নভিন্ন করে ভয়ানক দানব আমমুত। ওসিরিসের দাঁড়িপাল্লা অতিক্রম করতে পারা আত্মারা নৌকা করে চলে যায় প্রত্যাশিত জগতে। যেখানে মৃত্যু নেই, হতাশা নেই, নেই কোনো অসুস্থতা। সেখানে তারা সুখে বসবাস করবে অনন্তকাল। দুনিয়ায় অতীতে গত হওয়া প্রিয়জনদের সাথে এবং পরবর্তীতে দুনিয়া থেকে ফিরে আসা প্রিয়জনদের অপেক্ষায়।
মন্দির-যাজক
যদিও গ্রিক ঐতিহাসিক হিরোডোটাস দাবি করেছেন, কেবল পুরুষেরাই যাজক হতে পারতো প্রাচীন মিশরে। পরবর্তী গবেষণা প্রমাণিত হয় অনেক নারীও ছিলেন ধর্মীয় উচ্চ পদবীগুলোতে। প্রাচীন রাজবংশের শাসনামল থেকেই দেবী রূপে দেখা যায় নারীর উপস্থিতি। উদাহরণ হিসেবে দেবী হাথোরের মুখপাত্র হিসেবে সবসময় কোনো নারীই ভূমিকা পালন করতেন। অবশ্য যাজক যাজিকাগণের বিয়ে ও পারিবারিক জীবনে কোনো বাঁধা ছিল না। যাজকদের থেকেই প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠতো বিভিন্ন শ্রেণি।
ধর্মবাণী লেখার জন্য অক্ষরজ্ঞান, উপাসনাকে সঠিক পদ্ধতিতে পালনের জন্য ধর্মতত্ত্ব, ভবিষ্যত ইঙ্গিতের জন্য জ্যোতিষবিদ্যা ও নক্ষত্রপাঠ, আগত প্রার্থীদের রোগ দেখার স্বার্থে চিকিৎসাবিদ্যার চর্চা গড়ে উঠেছে। একইভাবে তৈরি হয়েছে জ্ঞানচর্চার অন্যান্য শাখার পাটাতন। অর্থাৎ জ্ঞান বিস্তারে মিশরের অবদান বলতে অনেকাংশেই মিশরীয় ধর্মের অবদানকেই ইঙ্গিত করা যেতে পারে। কারণ তাদের প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল দেবতাদের তুষ্টি এবং তাদের সাথে মানুষের মধ্যস্থতা করা।
মিশরীয় সভ্যতায় মন্দিরকে গণ্য করা হতো আক্ষরিক অর্থেই দেবতাদের ঘর হিসেবে। প্রতি সকালে যাজক-যাজিকাগণ গোসলের পর সাদা লিনেন কাপড় পরিধান করে মন্দিরে হাজির হতেন। অর্ঘ্য দিতেন দেবতাদের। দরজা জানালা খোলা রাখা হতো সকালের আলো বাতাস প্রবেশ করতে দেয়ার জন্য। দেবতাদের মূর্তি থাকতো মন্দিরের ঠিক কেন্দ্রবিন্দুতে। প্রধান যাজক ছাড়া তাদের খুব কাছাকাছি কেউ যেতে পারতো না। সাধারণ মানুষকে অপেক্ষাকৃত দূর থেকে উপাসনা করতে হতো। নিজেদের প্রয়োজন এবং উপঢৌকন জানাতে হতো অপেক্ষাকৃত নিম্নপদস্থ যাজকদের কাছে।
সংগঠিত ধর্মগ্রন্থ বলতে যা বুঝায়, মিশরীয় ধর্মে তা ছিল না। তবে পিরামিড লিপি, কফিন লিপি এবং বুক অব ডেড-এ উদ্ধৃত বাণী থেকে তাদের নমুনা পাওয়া যায়। বুক অব ডেডকে তো প্রাচীন মিশরীয় বাইবেলই বলা হয়ে থাকে। বয়সের দিক থেকে সবচেয়ে প্রাচীন পিরামিড লিপি। তিনটা লিপিতেই মৃত্যু পরবর্তী জীবন এবং আত্মার বিভিন্ন অবস্থা নিয়ে বলা হয়েছে। ঐতিহাসিকরা বোধ হয় এইজন্যই বলেন, ‘মিশরীয় সংস্কৃতি যখন মৃত্যুর পরবর্তী জীবন নিয়ে ব্যস্ত, মিশরের মানুষ ব্যস্ত পার্থিব জীবন নিয়ে।’
তারপর
ধর্মীয় আচার আচরণ এবং উৎসবই মূলত বিশ্বাসকে প্রমাণিত করে। মিশরীয় ধর্মবিশ্বাসও তার ব্যতিক্রম ছিল না। যাজকরাই সেখানে সকল ধরনের উৎসবের নীতি নির্ধারণ করতো। উৎসবের মধ্যে দেবতাদেরকেও মন্দিরের ভেতর থেকে বের করা হতো জনসম্মুখে। বিশেষ দিনে দেবমূর্তি নৌকায় বহন করে নামানো হতো নীল নদে। ছোট পরিসরে পালিত হতো জন্ম এবং মৃত্যু। বিয়ের সময় দুই পক্ষের পরিবার বর এবং কনেকে নিয়ে হাজির হতো মন্দিরে।
দেবতারা কেবল মানুষের সৃষ্টিকর্তাই না; তাদের বন্ধু এবং অভিভাবকও। তারা পৃথিবী থেকে অন্যায় দমন করে ন্যায়কে প্রতিষ্ঠিত করেন। সুন্দরকে সাহায্য করেন অসুন্দরকে পদদলিত করে। পৃথিবীকে মানুষের জন্য করেন বাসযোগ্য। মিশরীয়রা তাদের দেশের সাথে সম্পৃক্ত ছিল গভীরভাবে। বিদেশ ভূমিতে মৃত্যু হতে পারে, তখন যথাযথ সৎকার জুটবে না এবং মৃত্যু পরবর্তী জীবন জটিল হবে; এই ভয়ে তারা পারতপক্ষে বহির্দেশে সামরিক অভিযানে আগ্রহী হতো না। মিশরীয় সম্রাটেরা তাদের কন্যাদের বিদেশে বিয়ে দিতে সহজে রাজি হতো না একই কারণে। মনে করা হতো দেবতারা মিশরকে সমস্ত দয়া ও অনুগ্রহে আচ্ছাদিত করে দিয়েছেন; তাদের নিজেদেরকে সেই মর্যাদা দেয়া উচিত। সত্যিকার অর্থেই মিশর কেবল তার জনগণকেই সমৃদ্ধ করেনি; সকল দিক থেকে সমৃদ্ধ করেছে পরবর্তী পৃথিবীকেও।