Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

হৈমন্তী শুক্লা: কয়েক দশক থেকে বয়ে চলা এক সুরযাত্রা

কিন্নর কণ্ঠে তিনি বৃষ্টিকে ডাকছেন, “ওগো বৃষ্টি আমার চোখের পাতা ছুঁয়ো না…আমার এত সাধের কান্নার দাগ ধুয়ো না/ সে যেন এসে দেখে…”। মনকে ভরে তোলা তার কণ্ঠের বীণা সময়ের ফ্রেমে বন্দী নয়। হারানো দিনের গান ভাবা হলেও আসলে এসব গান হারিয়ে যায় না, মাটির সোঁদা গন্ধের মতো তারা আজো আমাদের আকুল করে তোলে। দিনশেষে সন্ধ্যাবাতির সাথে স্বপ্নে জাগা ক্লান্ত প্রদীপ জ্বালানোর মতোই এক শান্তির পরশ বোলানো এক শিল্পী হৈমন্তী শুক্লা। তার সাথে অনায়াসে ভাগ করে নেওয়া যায় কিশোরীমনের প্রথম প্রেমের আনন্দ, তার সাথে বলা যায় বিরহী হৃদয়ের দুঃখ। সদা হাস্যোজ্জ্বল আন্তরিক একটা চেহারা, বড় লাল টিপ, বেশিরভাগ সময়ই মোটা লাল পাড়ের সাদা শাড়ি- একটা চেনা মুখ, হৈমন্তী শুক্লা। সময় বইছে, বয়স বাড়ছে, তবু সঙ্গীতজগতের লোকজনের কাছে হৈমন্তী পুরনো হননি একেবারেই। তার উপর জন্মায়নি সময়ের শ্যাওলা, বরং বেড়েছে সুরের মহিমা। হৈমন্তী শুক্লা ১৯৪৯ সালের ২রা ফেব্রুয়ারি কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে এম এ. সম্পন্ন করেছেন। তার কর্মজীবন ও বসবাস কলকাতাতেই।

হৈমন্তী শুক্লা; Source: youtube.com

গান নিয়ে ক্যারিয়ারের শুরুটা হয়েছিল ১৯৭২ সালে ‘এতো কান্না নয় আমার’ গানটি রেকর্ডের মাধ্যমে। কিন্তু এরও বহু বছর আগে তার সঙ্গীতজীবনের শুরু। তার পিতা সঙ্গীতশিল্পী পণ্ডিত হরিহর শুক্লা, হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ক্ষেত্রে তার বিচরণ ছিল। পিতার কাছেই প্রথম তালিম নিয়েছিলেন হৈমন্তী। বাবা শেখাতে ভালোবাসতেন আর মেয়ে শিখতে। এই করেই খুব তাড়াতাড়ি উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে খুব ভালো করেই হাতেখড়ি হয়ে গিয়েছিল তার। তখন থেকেই বহু প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠানে মঞ্চে ‘খেয়াল’ গাইবার অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল। তানপুরার আকার যখন তার সামনে অনেক বিশাল হয়ে দেখা দিতো, তখন থেকেই তানপুরার সাথে সখ্য জমে উঠেছিল তার। সেই থেকে চলছে আজ অবধি তার সঙ্গীতযাত্রা। তার জীবনে শিক্ষক হয়ে আসেন প্রখ্যাত শাস্ত্রীয় সঙ্গীতশিল্পী চিন্ময় লাহিড়ীও।

১৯৭১ সালে তিনি ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের উপর বৃত্তি পেয়েছিলেন। এবং এরও আগে তিনি অল ইন্ডিয়া রেডিও’র একজন নিয়মিত শিল্পী ছিলেন। ১৯৭৫ সালে তাকে ভূষিত করা হয় মিয়া তানসেন পুরস্কারে।

উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে সবচেয়ে বেশি শিক্ষা এবং অনুশীলনের পরও গানের জগতে হৈমন্তির নেই ঠিক কোনো নির্দিষ্ট পথ, বরং তিনি সব অলিগলিতেই প্রচণ্ড স্বচ্ছন্দ। ভজন কিংবা গজল, খেয়াল কিংবা ঠুমরি, বিভিন্ন রাগের নিখুঁত স্বরে তিনি যেমন নির্ভুল, তেমনি আধুনিক গানের মঞ্চেও তিনি সিদ্ধকণ্ঠ। তার বহুমাত্রিক বিচরণ তাকে এনে দিয়েছে সর্বস্তরের জনপ্রিয়তা। মোটামুটি সবধরনের শ্রোতাই তার সুরে মজেছে। বিভিন্ন শৈলীতে তিনি নিজের কণ্ঠকে সাজাতে পেরেছেন বলেই হয়তো তার সঙ্গীত এত পরিপক্ব। বাংলা ছাড়াও তিনি গেয়েছেন ওড়িয়া, গুজরাটি, পাঞ্জাবি, আসামি ও ভোজপুরি ভাষায়।

হৈমন্তী শুক্লা সম্পর্কে সত্যজিৎ রায়ের শুভেচ্ছা বাণী; Source: haimantisukla.in

সবসময় হাস্যোজ্জ্বল হৈমন্তীর সঙ্গে সমসাময়িক সহশিল্পীদের অনেক আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে সবসময়। এ তালিকায় রয়েছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, মান্না দে প্রমুখ। প্রজন্মের পর প্রজন্ম পর্যন্ত চলছে তার পথচলা। এখনকার মধ্যে তিনি জিৎ গাঙ্গুলীর গান পছন্দ করেন।

তার জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘আমার বলার কিছু ছিল না’, ‘এখনো সারেঙ্গিটা বাজছে’, ‘ডাকে পাখি খোলো আঁখি’, ‘ঠিকানা না রেখে’, ‘আমি অবুঝের মতো’, ‘ওগো বৃষ্টি আমার’ ইত্যাদি।

মান্না দে এই শিল্পী সম্পর্কে বলেছিলেন,

“একথা মানতেই হবে সঙ্গীতজগতে হৈমন্তী শুক্লার একটি বিশেষ স্থান রয়েছে। অত্যন্ত সাবলীল ভঙ্গিতে হেসে খেলে হৈমন্তী গান করে এটা আমার খুব ভালো লাগে।”

শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের কঠোর নিয়মের সাথে তার প্রাণবন্ততা যেন অন্য এক সুরের ঝঙ্কার তোলে। সবসময় নিজেকে আরেকটু ভালো করে তোলার তার প্রয়াস তার সুরের মহিমা ম্লান হতে দেয় না কখনোই। অজানাকে জানবার ইচ্ছা, গাইবার বাসনা তাকে যেন চালিত করে অদেখার পথে। তার গায়কীর পরিপক্বতার পথে সবসময়ই ভিন্ন পথের স্বাদ ছিল, আছে। সুরসাধনায় তিনি নিজেকে সেই ছোটবেলা থেকেই নিয়োজিত করে রেখেছেন। বাবার বলা একটি কথাই তাকে এই অনুপ্রেরণা দেয়, তিনি হৈমন্তীকে বলেছিলেন, “কখনো নিজের প্রতি অত বিশ্বাস রেখো না যে যা গাইছি সব ভালো হচ্ছে”। লতা মুঙ্গেশকরের কাছ থেকেও সুরসাধনার ক্ষেত্রে অনেক অনুপ্রেরণা পেয়েছেন হৈমন্তী।

ওস্তাদ আল্লা রাখা ও নওশাদের সুরেও গাইবার অভিজ্ঞতা রয়েছে হৈমন্তীর। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সলিল চৌধুরী, মান্না দে’র সাথে তো তার বহু পথই একসাথে হাঁটা হয়েছে। ভূপেন হাজারিকার লেখা বেশ কয়েকটি মৌলিক ও সিনেমার গান গাওয়া হয়েছে তার। ‘চশমে বাদুর’ সিনেমায় ‘কঁহা সে আয়া বদরা’ গান গাইবার জন্য ১৯৮১ সালে তিনি ভূষিত হয়েছেন সুর শৃঙ্গার পুরস্কারে। ১৯৭৫ সালে তার প্রাপ্তির ঝুলিতে এসেছে মিয়া তানসেন পুরস্কার। এছাড়াও তিনি পেয়েছেন প্রমথেশ বড়ুয়া পুরস্কার ও কলাকার পুরস্কার ।

শিল্পী মঞ্চে ডুবে আছেন সুরসাধনায়; Source: youtube.com

‘আমার বলার কিছু ছিল না’ গানটির মাধ্যমে হৈমন্তীর ঝলমলে সাফল্যময় দিনগুলোর শুরু হয়েছিল। এরপর আর থেমে থাকা হয়নি। এই গানটি বের হবার সাথে সাথেই জনপ্রিয় হয়েছিলো এখনও এর জনপ্রিয়তা ফুরিয়ে যায়নি, ফুরিয়ে যায়নি হৈমন্তীর কণ্ঠের আবেদনও। এই গায়িকা কয়েক দশক ধরে আজো সদর্পে বিরাজ করছেন শ্রোতামনে। ওস্তাদ আকবর আলী খান, পণ্ডিত রবীশঙ্কর, পণ্ডিত ভীমসেন জোশি, ওস্তাদ আল্লা রাখা, নওশাদ- এদের সবার প্রিয় গায়িকার তালিকায় হৈমন্তী অনেকটা জায়গা জুড়ে রয়েছেন। সিনেমার গান ও মৌলিক গান- উভয় ক্ষেত্রেই হৈমন্তীর জনপ্রিয়তা তুমুল। তিনি যেসব বাংলা সিনেমায় গান গেয়েছেন, সেগুলো হলো ‘আমি সে ও সখা’ (১৯৭৭), ‘সিস্টার’ (১৯৭৭), ‘অসাধারণ’ (১৯৭৭), ‘দর্পচূর্ণ’ (১৯৮০), ‘ভক্তের ভগবান’ (১৯৯৭), ‘গান্ধর্বী’ (২০০২), ‘অন্তরতম’ (২০০৮), ‘১ নম্বর প্লাম ভিলা’ (২০০৯), ‘আরোহণ’ (২০১০), ‘মুসলমানীর গল্প’ (২০১০) ও ‘অমৃতা’ (২০১২)। এছাড়া হিন্দি কিছু সিনেমায়ও তিনি গান গেয়েছেন। হিন্দি সিনেমায় তার গাওয়া প্রথম গান ছিল ‘আমাবস কা চাঁন্দ’ সিনেমার ‘জীবন কি কিতাবো পার’।

এখনো সারেঙ্গিটা বাজছে; Source: youtube.com

গানের ধারার পরিবর্তন সম্পর্কে হৈমন্তী কোনো কট্টর ধারণা পোষণ করেন না। তিনি মনে করেন, পরিবর্তন মানেই সবসময় খারাপ নয়। তার বাবার সময় যারা গান করতেন তাদের মধ্যে নাকি সুরে গান গাইবার একটা প্রচলন ছিল বলে তিনি মনে করেন এবং ধীরে ধীরে সে ধারা পাল্টেছে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়দের সময়ে এসে। এরপর হৈমন্তীরা এলেন, ধারাটা আরো পাল্টাতে থাকলো। কিন্তু তারপরও হৈমন্তী মনে করেন যে গানের সেই প্রথম দিকের ধারা পুরোটা পাল্টাতে তারা পারেননি। তাদের মধ্যে অনেকটাই আগের রেশ রয়ে গিয়েছিল। বরং সেই পরিবর্তনের জোয়ার এনেছে বর্তমানের শিল্পীরা। এখন অনেক বেশি কথ্য ভাষার সাথে, কথার সাথে মিল রেখে গান গাওয়া হচ্ছে বলে তার মনে হয়। বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে তিনি একটি মিশ্র মনোভাব পোষণ করেন। সব গান যে সবাই গাইতে পারলেই ভালো, এমনটা তিনি ভাবেন না। কারণ এরকম গান খুব সহজে আসে এবং খুব সহজে চলে যায়। এই ট্রেন্ডটাকে তার কালজয়ী হবার পথে বাধা বলেই মনে হয়। তারা যে ধরনের গান করতেন, তা যে আজো রয়ে গেছে এবং আরো পরেও থেকে যাবে, এর কারণ হিসেবে তিনি আজকালকার গানের সাথে পার্থক্যটাকেই চিহ্নিত করেন। তিনি মনে করেন ঠিক এ কারণেই, ‘এখনো সারেঙ্গিটা বাজছে’।

ফিচার ইমেজ: youtube.com

Related Articles