চীন, রাশিয়া, আম্নক ও তুমেন নদী এবং দক্ষিণ কোরিয়া দিয়ে ঘেরা পূর্ব এশিয়ার দেশ উত্তর কোরিয়া। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে দেশটির বিরোধের নানা খবর নিয়ে এখন প্রায় প্রতিদিনই সরগরম থাকছে পত্রিকার পাতা, টেলিভিশন চ্যানেল আর সোশ্যাল মিডিয়াগুলো।
আমাদের আজকের আলোচনা অবশ্য দেশ দুটোর বিরোধ নিয়ে নয়, বরং পর্যটন নিয়ে। উত্তর কোরিয়ায় কেউ ঘুরতে গেলে তাকে যত অদ্ভুত নিয়ম-কানুনের মুখোমুখি হতে হয়, তা সত্যিই বিস্ময়কর। খাওয়া-দাওয়া, চলাফেরা, ছবি তোলা, এমনকি আপনি কার সাথে কথা বলবেন- সবই কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হবে সেখানে। অদ্ভুত সেই নিয়মগুলো পাঠকদের সামনে তুলে ধরতেই আজকের এ আয়োজন।
যেকোনো দেশে যেতে গেলেই আপনাকে সেখানকার নিয়ম মেনে চলতে হবে, সেটাই স্বাভাবিক। তবে উত্তর কোরিয়ার নিয়মগুলো জানলে আশ্চর্য হওয়া ছাড়া উপায় নেই। আর এসব নিয়ে যে কারো সাথে তর্কে যাবেন, সে উপায়ও নেই। কারণ আপনাকে সেগুলো মানতেই হবে। না মানলে জেলে যাওয়া থেকে শুরু করে মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত জুটতে পারে আপনার কপালে!
সেখানে আপনার প্রতিটি পদক্ষেপই দেশটির সরকার কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ ও পর্যবেক্ষণ করে চলেছে। এমনকি কোথায় কোথায় আপনি ঘুরবেন, সেই সিদ্ধান্তও আপনার না, সরকারের। অধিকাংশ ট্যুর পরিচালনার দায়িত্বে থাকে কোরিয়ান ইন্টারন্যাশনাল ট্রাভেল কোম্পানি। তাদের গাইডই আপনার ঘোরাঘুরির যাবতীয় ব্যাপার দেখাশোনা করবে।
কোথাও ঘুরতে গেলে ভ্রমণ স্বাধীনতা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি ব্যাপার। জায়গাটি অপরিচিত হলে গাইডের সাহায্য নেয়া লাগলেও মাঝে মাঝেই আপনার ইচ্ছা হতে পারে হোটেল থেকে বেরিয়ে নিজের মতো করে অপরিচিত জায়গাটিকে চেনার। তবে এমন আশা উত্তর কোরিয়ায় করা বৃথা। অ্যাডভেঞ্চার কিংবা একা একা ঘোরাঘুরির মতো বিষয়গুলোর কথা সেখানে ভুলেও চিন্তা করা যাবে না। আপনার সকল ঘোরাঘুরিই একজন গাইডের সাথে হতে হবে, এমনকি তাকে ছাড়া আপনার হোটেল থেকে বেরোনোর অনুমতি পর্যন্ত নেই। পাবলিক ট্রান্সপোর্টে করে ঘুরে বেড়ানোর অনুমতিও আপনার মিলবে না। এসব নিয়মের কোনোরুপ এদিক-সেদিক করলে কিছুদিন কারাবাসের অভিজ্ঞতাও হয়ে যেতে পারে আপনার!
এখন প্রশ্ন আসতে পারে, যেকোনো দেশের নাগরিকই কি উত্তর কোরিয়ায় ঘুরতে যেতে পারবে কিনা। উত্তর অবশ্যই ‘না বোধক’। দক্ষিণ কোরিয়ার পর্যটকদের সেখানে প্রবেশের অনুমতি নেই। ইসরায়েল, আমেরিকা, যুক্তরাজ্য ও জাপানের নাগরিকদেরও বেশ কড়াকড়ির মধ্য দিয়ে যেতে হয়। ২০১০ সালের জানুয়ারির আগপর্যন্ত দেশটিতে ভ্রমণের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা ছিলো যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের বেলায়।
আপনি উত্তর কোরিয়ায় পৌঁছামাত্রই আপনার পাসপোর্টটি নিয়ে নেবে আপনার গাইড, কারণ হিসেবে বলা হবে ‘নিরাপত্তা ইস্যু’। এমনকি আপনার সাধের মুঠোফোনটিও রেখে দেবে তারা। যেদিন দেশ ছাড়বেন, সেদিনই আবার ফিরিয়ে দেয়া হবে সাধের মুঠোসঙ্গীকে। তবে মুঠোফোনের এ নিয়মটি ইদানীং শিথিল করা হয়েছে বলে শোনা যায়। ফোন নিয়ে গেলে কাজ চালানোর জন্য দেশটির ভেতরে গিয়ে নতুন আরেকটি ফোন আর সিমকার্ড কেনা ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না।
আপনার ট্যুরের অন্তর্ভুক্ত নয় এমন কোনো জায়গায় যেতে চাওয়া কিংবা এমন কোনো ব্যক্তির সাথে কথা বলার চিন্তা না করাই শ্রেয়। সাধারণ জনগণের সাথে কথা বলে যে তাদের দৈনন্দিন জীবনযাপন সম্পর্কে কিছু ধারণা নেবেন, সেই অনুমতিও নেই। উত্তর কোরিয়ায় আপনার ভ্রমণ সংক্রান্ত সবকিছুই হবে ছকেবাঁধা- নির্দিষ্ট জায়গাতে ঘুরতে পারবেন, নির্দিষ্ট কিছু শপিং মল থেকে কেনাকাটা করতে পারবেন এবং গল্পগুজব করতে পারবেন কেবলমাত্র অফিসিয়াল গাইডদের সাথেই।
এবার আসা যাক ইলেকট্রনিক ডিভাইসের কথায়। বর্তমান যুগটাই এমন যে, কোথাও গেলে মুঠোফোন ছাড়া এক কদম চলার কথা চিন্তা করাই দায়। সেই সাথে ল্যাপটপ, ক্যামেরা, ট্যাবলেট, ইউএসবি ড্রাইভ, নানা রকম সিডি-ডিভিডি নিয়েও বের হন অনেকে। তবে উত্তর কোরিয়ায় যাওয়ার আগে এসব ব্যাপারে আরো সতর্ক হওয়া লাগবে। কারণ দেশটির বিমানবন্দরে কাস্টমস কর্মকর্তারা আপনার সাথে থাকা প্রতিটি ইলেকট্রনিক ডিভাইস ভালো করেই চেক করবেন। এমনকি চাইলে আপনার নেট ব্রাউজিং হিস্টোরিও তারা ঘাটাতে পারেন!
তারা সেখানে কী খুঁজবেন? মূলত উত্তর কোরিয়ার সরকার বিরোধী কোনোকিছু, কোনো পর্নোগ্রাফিক কন্টেন্ট, এমনকি ধর্মীয় কোনো কন্টেন্টও আছে কিনা সেটা তারা খুঁজে দেখবেন। কারণ এগুলোর সবই সে দেশে নিষিদ্ধ। পাশাপাশি পশ্চিমা দেশের লেখকদের রচিত উত্তর কোরিয়া সংক্রান্ত কোনো বই এবং দক্ষিণ কোরিয়ার কোনো গান, ভিডিও কিংবা বই নিয়ে সেখানে প্রবেশ করাটাও হবে বেশ ঝুঁকিপূর্ণ পদক্ষেপ। জিপিএস ট্র্যাকার, স্যাটেলাইট ফোনের পাশাপাশি ১৫০ মিলিমিটারের বেশি ক্যামেরা লেন্স নিয়েও সেখানে প্রবেশ নিষেধ।
ক্যামেরা নিয়ে যেহেতু কথা উঠলো, তাহলে ছবি তোলার ব্যাপারে কড়াকড়ির মাত্রা সম্পর্কেই নাহয় কিছু বলা যাক। যেকোনো জায়গায় ঘুরতে গেলেই একজন পর্যটক চাইবেন সেখানকার মুহূর্তগুলোকে ক্যামেরাবন্দী করে রাখতে, যাতে পরবর্তীতে অবসর সময়ে সেই ছবি বা ভিডিওগুলো দেখে অতীতের সুখস্মৃতিতে ক্ষণিকের জন্য হলেও ডুব দেয়া যায়। তবে উত্তর কোরিয়ায় গিয়ে এমন চিন্তা বোধহয় শিকলাবদ্ধই রাখা লাগবে। কেন? কারণ দেশটিতে ছবি তোলার ব্যাপারে মারাত্মক কড়া নিয়মকানুন রয়েছে। দেশটির সরকার তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারগুলো বহির্বিশ্বের কাছে তুলে ধরতে আগ্রহী নয়। এজন্য রাস্তা দিয়ে সে দেশের নাগরিকদের হেঁটে যাওয়ার মতো সাধারণ ছবি তোলাকেও দেখা হতে পারে মারাত্মক অপরাধ হিসেবে।
পর্যটকদের পরামর্শ দেয়া হয় তারা যেন দেশটির সামরিক বাহিনী সংক্রান্ত কোনো কিছু, সেখানকার জনগণের দারিদ্র্যপীড়িত জীবন, কোনো নির্মানাধীন ভবন ইত্যাদির ছবি না তোলেন। বিনা অনুমতিতে কারো ছবি তুলতেও মানা আছে। আবার কোনো ভাষ্কর্য দেখে ভালো লাগলে সেটার ছবি তুলতে গেলেও আছে নিয়ম-কানুনের বালাই। পুরো ভাষ্কর্যের ছবি আপনাকে সামনে থেকে (পেছন থেকে মানা) তুলতে হবে; ভাষ্কর্যের অংশবিশেষ, যেমন- মাথার খুব ক্লোজ-আপ শট নেয়া যাবে না।
ধর্মচর্চা নিয়েও উত্তর কোরিয়ায় বেশ ঝামেলা পোহানোর সম্ভাবনা রয়েছে। ২০১৬ সালে প্রকাশিত কোরিয়া স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনফরমেশন সার্ভিস থেকে জানা যায়, দেশটির প্রায় ছাপ্পান্ন ভাগ জনগণ এথিস্ট। একই বছর প্রকাশিত অ্যানুয়াল রিপোর্ট অন ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডম অনুসারে, দেশটিতে ধর্ম বিশ্বাসীদের বিভিন্ন সময়ই গ্রেফতার, নির্যাতন, এমনকি মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত দেয়া হয়েছে।
১৯৪৮ থেকে ১৯৯৪ সালে মৃত্যুর আগপর্যন্ত দীর্ঘ প্রায় ছেচল্লিশ বছর উত্তর কোরিয়ার নেতা ছিলেন কিম ইল-সুং। তার মৃত্যুর পর নেতার আসনে আসীন হন তারই পুত্র কিম জং-ইল। তিনি ক্ষমতায় ছিলেন প্রায় দেড় যুগ, ১৯৯৪ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত। অবশেষে তিনি পরপারে পাড়ি জমালে ক্ষমতায় আসেন তার তৃতীয় পুত্র কিম জং-উন। জং-উনই এখন দেশটির শাসনভার পরিচালনা করছেন। একজন পর্যটক হিসেবে গেলে এই তিনজনকে তাদের জন্য নির্ধারিত সম্মানসূচক পদবী উল্লেখ করেই আপনাকে ডাকতে হবে। এর মাঝে কিম ইল-সুংকে ‘দ্য গ্রেট লিডার’, কিম জং-ইলকে ‘দ্য ডিয়ার লিডার’ এবং কিম জং-উনকে ‘দ্য মার্শাল’ নামে ডাকতে হবে।
এ তো গেলো কেবল নামের ব্যাপার। বিভিন্ন জায়গায় কিম ইল-সুং ও কিম জং-ইলের ভাষ্কর্যে আপনাকে পুষ্প নিবেদন করতে হবে, সময়ে সময়ে মাথা নত করে সম্মান প্রদর্শন পর্যন্ত করা লাগতে পারে। দেশটির নেতাদের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শনের অভিযোগে বিভিন্ন সময়ই পর্যটকদেরকে কঠোর শাস্তির মুখোমুখি হবার কথা শোনা গেছে। এ ব্যাপারে সেখানকার আইন আসলেই বেশ কড়া।
যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি ব্যতীত কোনো কাজ করলে সেটাকে গুপ্তচরবৃত্তির প্রচেষ্টা হিসেবে দেখা হতে পারে, এমনকি সেটা হয়ও। গাইড ছাড়া কোথাও ঘুরতে কিংবা দেশটির একজন সাধারণ নাগরিকের সাথে কথা বলতে চাচ্ছেন? মনে রাখবেন, আপনার-আমার চোখে নির্দোষ এ কর্মটিও আপনাকে উত্তর কোরীয় কর্তৃপক্ষের চোখে গুপ্তচর হিসেবে চিহ্নিত করতে পারে। এজন্য বলা হয় সবসময় একজন গাইডের সাথে থাকতে, এমন কিছু না করতে যাতে স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মনোযোগ আপনার উপর এসে পড়ে। অননুমোদিত অর্থের লেনদেন কিংবা পর্যটকদের জন্য নির্ধারিত শপিং মলের বাইরে অন্য কোথাও থেকে কেনাকাটা করলে আপনাকে জরিমানা করা থেকে শুরু করে গ্রেফতার পর্যন্ত করা হতে পারে। খাবারদাবারের ব্যাপারেও আছে বেশ কড়াকড়ি। কোনোরুপ স্ট্রিট ফুড চেখে দেখার আশা না করাই ভালো।
যদি কোনোদিন উত্তর কোরিয়ায় আপনি ঘুরতে যান, তাহলে অবশ্যই উপরের নিয়মগুলো মেনে চলতে চেষ্টা করবেন। আপনার নিজের জানের মায়া না থাকলে অন্তত আপনার সাথে থাকা নির্দোষ গাইডের কথা ভেবে হলেও আপনার উচিত হবে নিয়মগুলো মেনে চলা। কারণ আপনি আইন ভেঙে স্বদেশে চলে আসলেও সেই দেশে বসে ভোগান্তির শিকার হবে বেচারা গাইড। আপনাকে গুপ্তচরবৃত্তিতে সহায়তার অভিযোগে তাকে টানতে হবে জেলের ঘানি, সইতে হবে অমানবিক অত্যাচার!