মরুভূমিতে দাঁড়িয়ে সূর্যের আলোর গতিবিধি লক্ষ্য করছিলেন ড. এমা মায়ান ফ্যানার। হঠাৎ করেই চোখে পড়ল যিশুখ্রিস্টের মুখ। হাইফা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিল্প ইতিহাসবিদ এমার পড়ালেখার বিষয় ছিল যিশুর ক্রুশবিদ্ধকরণ এবং প্রাচীন গির্জার পাথুরে চৌকাঠের মোটিফ ও সে সময়কার ইসরায়েলের ঘরবাড়ির নকশার ধরন। ইসরায়েলের নেগেভ মরুভূমির ধ্বংসপ্রাপ্ত শহর শিভতা নিয়েই মূলত কাজ করছিলেন তিনি।
ক্যালেন্ডারের পাতায় ফেব্রুয়ারি মাস চললেও মরুভূমি তখন বেশ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। প্রখর সূর্যের আলোতে চলমান প্রত্নতাত্ত্বিক কাজের সাইটে কয়েকটা ভেঙে যাওয়া বাড়ির ছাদে কীসের যেন ছায়া পড়ছে। প্রাচীন শহরের তিনটি বিখ্যাত চার্চের মধ্যে এটি ছিল সবচেয়ে উত্তরের ব্যাপ্টিজম চর্চার কেন্দ্র। পাথুরে ঘরবাড়ির মধ্যে ভিন্ন কিছু খুঁজছিল এমার চোখ। খুব বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না তার। হঠাৎ চোখে পড়ে গেল জর্ডান নদীর তীরে যিশুখ্রিস্টের ব্যাপ্টিজমে আঁকা প্রায় ঝাপসা হয়ে আসা যিশুর একটি পোট্রেট।
আজ থেকে প্রায় ১,৫০০ বছর আগে ভবনটির সিলিং জুড়ে আঁকা হয়েছিল ছবিটি।
সবাই বলছিল এটা একটা ভীষণ অলৌকিক ঘটনা। এক মুহূর্তের জন্য আমারও তা-ই মনে হচ্ছিল।
লাইভ সাইন্সকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে জানান এমা। এ সময় শিভতা শহরে ইসরায়েলের অ্যাকাডেমিক দল নিয়ে ফটোগ্রাফি করছিলেন ড্রর মায়ান, এমার স্বামী। এমার ডাকে ছুটে আসেন তিনি। দল নিয়ে চার্চের ব্যাপ্টিজম অংশের ছাদে আঁকা ঐ পোট্রেটের অসংখ্য ছবি তোলেন ড্রর। ২০১৭ সালে করা তাদের এ কাজগুলো সম্প্রতি জার্নাল অ্যান্টিকুইটিতে স্থান পেয়েছে। ভীষণভাবে ক্ষয়িষ্ণু এই ছবিটিকে মনে করা হচ্ছে, ইসরায়েলে আবিষ্কৃত যিশুখ্রিস্টের সবচেয়ে পুরনো প্রতিকৃতি। তার মুখাবয়বের এমন বিস্তারিত উপস্থাপন খুব কমই দেখা গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, প্রাচীন এই মরু শহর থেকে খ্রিস্টানদের যেসব চিহ্ন পাওয়া যাচ্ছে, তার সময়কাল চতুর্থ থেকে ষষ্ঠ খ্রিস্টাব্দ হতে পারে।
শিভতা শহরের ধ্বংসাবশেষ প্রথম আবিষ্কৃত হয় ১৮৭১ সালে। ভাষাতত্ত্ববিদ ও অনুসন্ধানকারী এডওয়ার্ড হেনরি পামার ছিলেন এর আবিষ্কারক। আবিষ্কারের পর থেকে প্রত্নতাত্ত্বিক সাইট হিসেবে দারুণ সমাদর ছিল শিভতার। কিন্তু কোনো এক অদ্ভুত কারণে প্রাচীন প্রত্নতত্ত্ববিদরা কেবল সেখানকার চার্চগুলোর ব্যাপারেই উৎসাহী ছিলেন। এখন শিভতা পরিদর্শন করলে মনে হতেই পারে, তাদের আগ্রহ ছিল কেবল ধ্বংসপ্রাপ্ত শহর আর তার ঘরবাড়ি নিয়ে, কিন্তু তাদের চোখ এড়িয়ে গেছে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ সব ম্যুরাল।
চার্চগুলো আবিষ্কৃত হলো, অনুসন্ধানকারীরা সেসবের রেকর্ড রাখলেন, তারপরও প্রায় এক শতক ধরে পেইন্টিংগুলো কীভাবে অনাবিষ্কৃত রয়ে গেল? এর কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টা করেছেন এমা। দেয়াল ছবিগুলো একেবারে যাচ্ছেতাইভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তার উপর পড়েছে কয়েক শতাব্দীর ধুলোর প্রলেপ। তাছাড়া প্রাচীনত্বের সন্ধানকারীদের জন্য এটি খুঁজে পাওয়াও খুব একটা সহজসাধ্য কাজ ছিল না। কেননা এই চিত্রকর্ম দেখতে হলে ঘাড় উঁচু করে তাকাতে হবে উপরের দিকে। যারা চার্চ বা ঘরবাড়ি খুঁজতে গেছেন, তাদের এত খুঁটিনাটি দেখার সময় বা প্রয়োজন কোনোটিই ছিল না বলে এমা ধারণা করছেন।
১৯২০ সালের প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে, তারা প্রত্নতত্ত্ব সাইটে গিয়ে কিছু একটা দেখেছেন বলে দাবী করেন। কিন্তু যথাযথ প্রমাণের অভাবে তাদের সেই দাবীকে খুব একটা আমলে নেয়া হয়নি, হারিৎজকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এমনটাই জানান শিল্প ইতিহাসবিদ এমা মায়ান ফ্যানার। তিনি নিজেও এর আগে বেশ কয়েকবার এই সাইটে এসেছেন, কিন্তু কখনোই কিছু চোখে পড়েনি। তারপরই একদিন-
সৌভাগ্যবশত সঠিক সময়ে, সঠিক জায়গায় দাঁড়িয়ে, আলোর একদম সঠিক কোন থেকে ছাদের দিকে তাকিয়েই দেখতে পেলাম এক জোড়া চোখ। নিজের ব্যাপ্টিজমে আঁকা যিশুর মুখটা চোখে পড়ল, যেন সরাসরি আমাদের দিকে তাকিয়ে আছেন তিনি।
যিশুর ছবি
যিশুখ্রিস্ট প্রকৃতপক্ষে দেখতে কেমন ছিলেন তা নিয়ে বিতর্কের কোনো শেষ নেই। কিন্তু সেই বিতর্ক এখন ভিত্তিহীন। কেননা সমসাময়িক কারো পক্ষে যিশুখ্রিস্টের চেহারা বর্ণনা করা এখন একেবারেই অসম্ভব। যিশুকে সাধারণত উপস্থাপন করা হয় আজ থেকে প্রায় ২,০০০ বছর আগের মধ্যপ্রাচ্যবাসী বাদামি চোখের আর দশজন মানুষের মতো করে। আর তার চুলের ব্যাপারটি একদমই সময় আর স্থানের উপর নির্ভর করেছে। চুলের কোনো কমতি ছিল না যিশুর। খ্রিস্টধর্মের উত্থানের সময় যিশুর ছবি আঁকা হতো সম্ভাব্য সব উপায়ে- লম্বা চুল, খাটো চুল, চুল ছাড়া, দাড়ি সহ, দাড়ি ছাড়া; বাদ যায়নি কোনোকিছুই।
যিশুর ছবির রয়েছে প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের ভিন্ন ভিন্ন ফ্লেভার। সিরিয়ার ডুরা শহরে আজ থেকে ১,৮০০ বছর আগের অর্থাৎ ২৩৩ থেকে ২৫৬ খ্রিস্টাব্দের যে ছবিটি পাওয়া গেছে, সেটিকে ধরা হয় যিশুর প্রথম ছবি হিসেবে। ডুরা শহরটিকে বলা যায় বহু সংস্কৃতির এক মহানগর, যেখানে ইহুদী, পৌত্তলিক, খ্রিস্টানসহ বিভিন্ন ধর্মের মানুষ বসবাস করতো এবং শহর জুড়ে প্রত্যেক ধর্মের পৃথক উপসনালয় ছিল। সেখানকার এক ম্যুরাল অনুযায়ী যিশুকে এক বিশ্বস্ত রাখাল হিসেবে উপস্থাপন করা হয়, যেখানে তার কাঁধে ছিল একটি ভেড়া। এই চিত্রটি গতানুগতিক প্রাচ্যের স্বাদ বহন করছে।
ত্রিশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে ধ্বংস হয়ে যায় ডুরা। ম্যুরালগুলো বালির নিচে চাপা পড়ে ছিল বলে একদমই অক্ষত অবস্থায় তা উদ্ধার করা যায়। শিভতার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। এমার দলের অন্যতম এক সদস্য ড. র্যাভিট লিন ছবিটির দিকে তাকিয়ে বলেন, এই চিত্রকর্ম পুনরুদ্ধার করে সংরক্ষণ করতে বেশ সময় এবং অর্থ খরচ হবে। হঠাৎ করে তাকালে ছবিটির অস্তিত্বই বোঝা যায় না। লাল কিছু সরলরেখা ছাড়া আর কিছুই দেখার উপায় নেই। আধুনিক প্রযুক্তি ও আলোকসজ্জা ব্যবহার করে ড্রর ও তার দল সেখান থেকে যিশুর পাশাপাশি জন দ্য ব্যাপ্টিস্টের ছবিও উদ্ধার করেছেন।
প্রাচীন চিত্রকর্ম
শিভতায় কয়েক বছর আগে আবিষ্কৃত হয়েছিল আরেকটি বহু বছর পুরনো চিত্রকর্ম। প্রাচীন শহরের তিনটি বিখ্যাত চার্চের মধ্যে সবচেয়ে দক্ষিণের ব্যাপ্টিজম চর্চার কেন্দ্র থেকে খুঁজে পাওয়া যায় সেই ছবিটি যেখানে উপস্থাপিত হয়েছে যিশুর রূপান্তর। খ্রিস্টান গসপেলে উল্লেখিত অন্যতম একটি ঘটনা ‘যিশুর রূপান্তর’ নিয়ে প্রথম লিখিত কোনো তথ্য পাওয়া যায় যিশুখ্রিস্টের মৃত্যুর প্রায় ১০০ বছর পরে। সেই চিত্রকর্মটিও প্রায় ক্ষয়ে গেছে। ওখানে একটি আউটলাইন বা রূপরেখার মাধ্যমে যিশুখ্রিস্টের ফিগার এবং কেবলমাত্র একটি ভ্রু আঁকা হয়েছিল।
কিন্তু উত্তর ব্যাপ্টিস্টের ছাদ থেকে যে পেইন্টিংটি পাওয়া গেছে, সেখানে যিশুখ্রিস্টের মুখের পূর্ণাঙ্গ বিবরণ ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। ছোট, কোঁকড়ান চুলের তরুণ যিশুর শান্ত, সুস্থির মুখশ্রী খুব যত্ন নিয়ে আঁকা হয়েছে। বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের পূর্বাংশে, বিশেষত মিশর আর সিরিয়া-ফিলিস্তিন অংশে, যিশুর ছোট চুলের আইকনোগ্রাফি বা মূর্তিশিল্প খুব জনপ্রিয় ছিল বলে জানান এমা। কিন্তু পরবর্তীতে যিশুর লম্বা চুলের মূল বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য থেকে ছড়িয়ে পড়া চিত্রটিই সবার কাছে বেশি পরিচিত হয়ে ওঠে। এখনো পর্যন্ত যিশুর ছবি বলতে আমরা লম্বা চুলের একটি প্রতিকৃতিকেই ধরে নেই।
এমা জানান, এই ছবিটিতে যিশুকে একদমই যুবক রূপে চিত্রায়িত করা হয়েছে। কারণ জর্ডানে তার ব্যাপ্টিজম চর্চাকে মনে করা হতো ‘নতুন জন্মের’ প্রতীক হিসেবে। ঐ একই কারণে জন দ্য ব্যাপ্টিস্টের চেয়ে এই ফিগারটিকে বড় করে আঁকা হয়েছে। খ্রিস্টান গসপেল অনুযায়ী, জন দ্য ব্যাপ্টিস্টকে খ্রিস্টান ব্যাপ্টিজমের প্রধান বলে মনে করা হতো। ব্যাপ্টিস্ট শিল্পকর্ম নিয়ে গবেষণা করে এমা ও তার সহযোগীরা বলেছেন, তরুণ যিশুর মুখাবয়বের বর্ণনায় এসেছে ছোট কোঁকড়ানো চুল, লম্বাটে মুখ আর দীর্ঘায়িত নাকের কথা।
উত্তরাংশের চার্চের মোজাইকের দিকে আলোকপাত করেন দলের আরেক সদস্য টেপার। মোজাইকের ধরন দেখে তিনি ধারণা করেন, এটি ষষ্ঠ শতাব্দীর দিকে নির্মিত। মিশরের গ্রামগুলোর সাথে এখানকার গ্রামের জীবনযাপন রীতি থেকে শুরু করে বাড়ি নির্মাণের পদ্ধতির অনেকটাই মিল রয়েছে। দক্ষিণ ইসরায়েলি শহর বিরসেবার দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে প্রায় ২৫ মাইল দূরে অবস্থিত শিভতা, ধ্বংসপ্রাপ্ত একটি নগরী। জায়গাটিকে এখন একটি জাতীয় উদ্যানে পরিণত করা হয়েছে এবং এটি ইসরায়েলের অন্যতম ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের মর্যাদা পেয়েছে।
ভালো ক্যামেরা আর ভালো ফটোগ্রাফার না থাকলে কিছুই দেখা যাবে না।
ছবিটি সম্পর্কে বলছিলেন ড্রর। আধুনিক সংরক্ষণ কৌশল মেনে যথাসম্ভব চেষ্টা করা হচ্ছে চিত্রকর্মটি পুনরুদ্ধার করার।
ছবিটি খুব সংবেদনশীল অবস্থায় আছে, অনেক সতর্কতার সাথে উদ্ধার কাজ চালাতে হবে।
মতামত দেন এমা।
এখনো অনেক কিছু লুকিয়ে আছে ছাদের গহীনে। ছবিটির পূর্ণাঙ্গ বর্ণনা পাওয়া জরুরী।