২০১২ সালের ১৯শে ফেব্রুয়ারি। উত্তর মেক্সিকোর মন্টেরেই শহরের ব্যস্ততম এলাকা টোপো চিকোর লোকজন তখনো ঘুমের ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে আছে। মাত্র ৫ মাইল উত্তর-পূর্বের আপোকাডা জেলখানায় ততক্ষণে নারকীয় ঘটনা ঘটে গিয়েছে। রাত দুটোর দিকে জেলখানার রক্ষীদের সহযোগিতায় লস সেতাসের সদস্যরা ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রতিপক্ষ ড্রাগ কার্টেল ‘গালফ কার্টেল’-এর সদস্যদের উপর। ঘুমিয়ে থাকা নিরস্ত্র গালফ কার্টেলের সদস্যরা কোনোরকম বাধা দেওয়ার আগেই খুন হয়ে যায় ধারালো ছুরি, পাথরের আঘাতে। সকাল ছয়টার দিকে যখন জেল কর্তৃপক্ষ জেলের নিয়ন্ত্রণে নিলো, ততক্ষণে খুন হয়ে গিয়েছে গালফ কার্টেলের ৪৪ জন; কারও মাথা নেই, কাউকে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে ফ্যানের সাথে, কারও পিঠ ক্ষতবিক্ষত হয়ে আছে ছুরির অসংখ্য আঘাতে, কাউকে স্রেফ ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে জানালা দিয়ে; উপর থেকে পড়ে গিয়ে থেতলে গিয়েছে পুরো দেহ। শুধু গালফ কার্টেলের সেরা সদস্যদের ইহলোক ত্যাগ নয়, একই সাথে জেল থেকেও পালিয়েছে লস সেতাসের ঊর্ধ্বতন ৩০ সদস্য! মেক্সিকান মাদক যুদ্ধের লাল খাতায় আরও একটি ঘটনা যোগ হলো- আপোকাডা জেলখানা দাঙ্গা; প্রতিবারের মতো এবারেও লস সেতাস তাদের বর্বরতা, চতুরতা আর ক্ষমতার চূড়ান্ত প্রয়োগটি করলো প্রতিপক্ষের উপর।
লস সেতাসকে কেন পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্ধর্ষ এবং বর্বর ড্রাগ কার্টেল বলা হয়? কেনই বা মার্কিন সরকার মন্তব্য করেছিল, “মেক্সিকোর বুকে সবচেয়ে অত্যাধুনিক, বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন, দক্ষ, হিংস্র, নির্মম এবং বিপজ্জনক কার্টেল হলো ‘Los Zetas’?” সেসব প্রশ্নেরই উত্তর খোঁজা যাক।
বিপথগামী আর্মি কমান্ডো দল এবং লস সেতাসের উদ্ভব
মাদক সম্রাট ওসিয়েল কারদেনাস ১৯৯৯ সালে যখন গালফ কার্টেলের হাল ধরলেন, তখনই নিজেকে আবিস্কার করলেন বিশৃঙ্খল এবং নিজেদের মধ্যেই কাদা ছোড়াছুড়ি করা বিশাল এক মাদক বাহিনীর প্রধান হিসেবে। এমন অবস্থাতেই দলের শৃঙ্খলা আর নিজের চামড়া বাঁচাতেই তিনি দলে ভেড়ালেন এক অবসরপ্রাপ্ত আর্মির লেফটেন্যান্টকে; এই পোড় খাওয়া কমান্ডারের নাম আর্তুরো গুজম্যান ডেসেনা। ডেসেনার ডাকে সাড়া দিয়ে মেক্সিকান আর্মির স্পেশাল ফোর্স ‘Cuerpo de Fuerzas Especiales’ এর ৩১ জন প্রথম সারির সদস্য একসাথে যোগ দিলেন কারদেনাসের বিশেষ দেহরক্ষী হিসেবে! আর এভাবেই শুরু হলো লস সেতাসের গল্প।
নব্বইয়ের দশকে মার্কিন সেনাবাহিনীর স্পেশাল ফোর্সের কাছে বিশেষভাবে ট্রেনিং নেওয়া এই সাবেক আর্মি কমান্ডো যেকোনো পরিস্থিতেই যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো ক্ষমতা রাখে। আরবান ওয়ারফেয়ারের উপর বিশেষভাবে ট্রেনিংপ্রাপ্ত এই সাবেক স্পেশাল ফোর্স সদস্যদের দায়িত্ব ছিলো মাদকমুক্ত মেক্সিকো তৈরি এবং সেনা অভ্যুত্থান থেকে মেক্সিকোকে মুক্ত রাখা। কিন্তু ‘Everything For Mexico’ মূলমন্ত্রে বিশ্বাসী এই কমান্ডোদেরকে দলে ভেড়াতে কারদেনাসকে খুব একটা কষ্ট করতে হয়নি। কারণ, গালফ কার্টেলের এই বিশেষ দল অন্য যেকোনো ব্যক্তির চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিলো এবং তাদের বেতনটাও ছিলো স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি।
২০০১ সালের নভেম্বরে ডেসেনা (Z-1) মেক্সিকান সেনাবাহিনীর সাথে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হলে, এই প্যারামিলিটারি কার্টেলের নেতৃত্ব দেওয়া শুরু করেন সেকেন্ড ইন কমান্ড হারবার্তো লাজকানো (Z-3)। তারপর ২০০৩ সালে কারদেনাসের গ্রেফতারের পর ২০০৭ সালে মেক্সিকো সরকার কারদেনাসকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিলে, কার্টেলের উপর বেশ ভালোভাবেই প্রভাব বিস্তার শুরু করে লস সেতাস। কার্টেলের গুরুত্বপূর্ণ মিশন থেকে রেভিনিউ, সবকিছুতেই গালফ কার্টেলের অন্যান্য গ্রুপের চেয়ে অনেক এগিয়ে ছিলো লস সেতাস। এরূপ প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করেই গালফ কার্টেল এবং লস সেতাসের সদস্যদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হয়। দলের নেতৃত্ব নিয়েও শুরু হয় দ্বন্দ্বযুদ্ধ।
গালফ কার্টেল শুধুমাত্র মাদক পাচার নিয়েই সন্তুষ্ট ছিলো, কিন্তু লস সেতাস শুধু মাদক পাচার কিংবা উৎপাদন নয়; অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের জন্য চুরি-ডাকাতি থেকে শুরু করে অপহরণ এমনকি খুনের সাথেও জড়িয়ে পড়ে। ফলে লস সেতাসের নিয়ম-নীতির সাথে সাংঘর্ষিক হয়ে পড়ায় গালফ কার্টেলের সাথে মতবিরোধে আলাদা হয়ে যায় দুই গ্রুপ। শুরু হয় গালফ কার্টেল বনাম লস সেতাস যুদ্ধ!
মেক্সিকান ড্রাগ ওয়ার এবং লস সেতাসের বর্বরতা
আলাদা হয়ে যাওয়ার পর লস সেতাসকে শায়েস্তা করতে নিজেদের সাবেক প্রতিদ্বন্দ্বী ‘সিনালোয়া কার্টেল’ এর সাথেই হাত মেলায় গালফ কার্টেল, সাথে নেয় মেক্সিকোর মিকোহাকানা রাজ্যের লা ফ্যামিলিয়া কার্টেলকে। অন্যদিকে লস সেতাসকে সাহায্য করতে একমত হয় মেক্সিকোর আরও ৩টি বড় ড্রাগ কার্টেল; টিজুয়ানা, বেলট্র্যান-লেভিয়া এবং জুয়ারেজ কার্টেল।
এদিকে লস সেতাসের নেতৃত্ব নিয়েও শুরু হয় গোলমাল। একদিকে দীর্ঘদিনের নেতা লাজকানোর লক্ষ্য হলো ঠাণ্ডা মাথায় দলের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা এবং সরকারের সাথে কোনোরূপ গোলমালে জড়িয়ে না পড়া; অন্যদিকে দলের সেকেন্ড ইন কমান্ড মিগুয়েল মোরালেস ছিলো সম্পূর্ণ বিপরীত- বর্বর পন্থায় যতভাবে মেক্সিকোতে ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করা যায় ততই তার মতে লস সেতাসের জন্য ভালো। এরুপ পরিস্থিতিতে লাজকানোও তার নেতার পদ ছেড়ে দেয় মোরালেসের কাছে, শুরু হয় লস সেতাসের নিষ্ঠুরতার চূড়ান্ত ধাপ।
২০১০ সালে স্যান ফার্নান্দোতে উদয় হয় ৭২ জন নতুন অধিবাসী। গালফ কার্টেলের লোক মনে করে সেখানেই তাদের ইহলীলা সাঙ্গ করে দেয় লস সেতাস। মেক্সিকান সেনাবাহিনী ৭২ জনের গণকবর খুঁজে পায় স্যান ফার্নান্দোতে। পরের বছরও একই ঘটনা ঘটে ঠিক একই জায়গাতে। স্যান ফার্নান্দোতে যাওয়ার সময় মাঝপথেই বাস থামিয়ে ১৯৩ জনকে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে মেক্সিকোর বর্বরতম ড্রাগ কার্টেল।
মন্টেরেই শহরের কথা মনে আছে? আপোকাডা জেলখানাতে ৪৪ জন গালফ কার্টেল সদস্যকে খুন করার আগেও সাধারণ লোকজনের উপরেও গণহত্যা চালিয়েছে লস সেতাস। মন্টেরেই এর এক ক্যাসিনোতে আগুন ধরিয়ে দিয়ে ৫২ জনকে পুড়িয়ে মারে তারা। এর ঠিক এক বছরের মাথায় সিনালোয়া কার্টেলের ৪৯ জনের লাশ পাওয়া যায় শহরের ময়লার স্তূপে!
অপরাধ এবং প্রভাব বিস্তার
নামের সাথে ড্রাগ কার্টেল শব্দটি লেগে থাকলেও লস সেতাস শুধু মাদক পাচারের সাথে জড়িত নয়। বোমাবাজি, ধর্ষণ, মানব পাচার, সন্ত্রাস, অপহরণ, ডাকাতি, অস্ত্র পাচার থেকে শুরু করে সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তাদেরকে ঘুষ দেওয়া পর্যন্ত ছোট-বড় সব ধরনের অপরাধের নামই রয়েছে লস সেতাসের খাতায়।
সাধারণত মেক্সিকোর ড্রাগ কার্টেলগুলো মেক্সিকোর ভেতরে থেকেই মাদক উৎপাদন করে কিংবা মধ্য আমেরিকার অনুন্নত দেশগুলোর ক্ষেত-খামারের দিকে হাত বাড়ায়। কিন্তু লস সেতাস সাধারণ কোনো ড্রাগ কার্টেল নয়, মেক্সিকোর সীমান্তবর্তী যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসেই তারা তৈরি করে রেখেছে মারিজুয়ানার বিশাল ক্ষেত, যার আর্থিক মূল্য প্রায় ১০১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার! মেক্সিকোর ১৭টি রাজ্যসহ বিশ্বের ৪৭টি দেশে নিজেদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে লস সেতাসের মতো ড্রাগ কার্টেল।
মেক্সিকোর বুকে লস সেতাসের দুর্ধর্ষ হয়ে ওঠার আরেকটি মূল কারণ হচ্ছে রাজনীতিবিদদের সাথে সখ্যতা। এই রাজনীতিবিদদেরকে ঘুষ দেওয়ার বিনিময়ে তারা কিনে নিচ্ছে সরকারী সাহায্য, যার কারণে অপরাধ করা সত্ত্বেও তারা অনায়াসেই পার পেয়ে যাচ্ছে। তামাউলিপাস রাজ্যের গভর্নর স্বয়ং টোমাস ইয়ারিংটনই একাধিকবার প্রমাণ সহ হাতেনাতে ধরা পড়েছেন ঘুষ নেওয়ার সময়!
পুলিশের সহযোগিতাও লস সেতাসকে করেছে আরও শক্তিশালী। আপোকাডা দাঙ্গাতে জেল কর্তৃপক্ষের প্রত্যক্ষ হাত তো ছিলোই, এমনকি সাধারণ পুলিশেরাও টাকার বিনিময়ে অভিবাসীদেরকে তুলে দেয় লস সেতাসের হাতে! স্যান ফার্নান্দো গণহত্যাতেও অভিবাসীদের বাস থামিয়ে অপহরণ করতে লস সেতাসকে সহযোগিতা করেছিলো পুলিশেরা!
প্রযুক্তি এবং লস সেতাস
২০০৮ সাল থেকে ২০১২ সালের মধ্যবর্তী সময়ে কম করে হলেও ৩৬ জন ইঞ্জিনিয়ারকে অপহরণ করেছে লস সেতাস! এবং তাদের একজনকেও মুক্তিপণের জন্য নয়! তাহলে? নিজেদের আড়ালকে আরও সুরক্ষা দিতেই প্রযুক্তিকে বেছে নিয়েছে লস সেতাস, তৈরি করেছে অত্যাধুনিক রেডিও নেটওয়ার্ক; আর এজন্য তাদের প্রয়োজন আইবিএম-এর কর্মকর্তার মতো দক্ষ ইঞ্জিনিয়ার।
মেক্সিকান সেনাবাহিনী অনেক চেষ্টা করেও এই রেডিও নেটওয়ার্ক ভাঙতে পারেনি। কারণ রেডিও নেটওয়ার্কটি খুব সহজেই প্রতিস্থাপনযোগ্য, তার উপর লস সেতাসের সাথে রয়েছে দক্ষ ইঞ্জিনিয়ার। তাছাড়া মিলিটারি কমান্ডোদেরও রেডিও ইকুইপমেন্ট ব্যবহার করার অভিজ্ঞতাও কম নয়। আর এই প্রযুক্তির সাহায্যেই সবসময়ই আইন প্রয়োগকারীদের চেয়ে একধাপ এগিয়ে থাকছে লস সেতাস।
মেক্সিকোর সর্ববৃহৎ এই ড্রাগ কার্টেলকে পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে নির্মম ড্রাগ কার্টেল বলা হয়। নৃসংশভাবে অজস্র মানুষ হত্যার নমুনা দেখানোর পরও এখনও যে তারা বহাল তবিয়তে টিকে আছে পৃথিবীর বুকে, তার দায় এবং কলঙ্ক মানব সমাজেরই।