কানো ক্রিস্টেলস প্রকৃতির বুকে সাজানো এক রহস্যময় নদী। অপরূপ তুলির ছোঁয়ায় রংধনুর সাতটি রং যেন এই নদীর বুকে প্রতিনিয়ত এঁকে চলেছে রঙিন ঢেউয়ের খেলা। প্রকৃতি যেন তার নানা রূপের পসরা ঢেলে সাজিয়েছে এই নদীকে। দুর্গম এই নদীর সৌন্দর্য উপভোগ করতে প্রতি বছর ভিড় করে দেশ-বিদেশের অসংখ্য পর্যটক। চলুন তাহলে বৈচিত্র্যময় কানো ক্রিস্টেলস নদীর অনিবর্চনীয় সৌন্দর্যের পিছনে কী রহস্য লুকিয়ে আছে, তা জানার চেষ্টা করা যাক।
ব্যতিক্রমী এক নদী
পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর নদীগুলোর একটি হলো কানো ক্রিস্টেলস, যেখানে সবসময় দেখতে পাওয়া যায় রংধনুর সাতরঙা মিশ্রণ। তাই এই নদীকে অনেকে বলে থাকেন ‘River of Five Colors’, আবার অনেকে বলে থাকেন ‘The Liquid Rainbow’। তবে নদীটির অফিসিয়াল নাম হলো ‘Cano Cristales’ বা ‘Rio Cano Castales’। কলম্বিয়ায় অবস্থিত নদীটি অন্য আর পাঁচটি নদীর সাথে মিলিয়ে ফেললে কিন্তু খুব বড়সর ভুল হয়ে যাবে। স্থানীয়রা এই নদী সম্পর্কে বলে থাকেন, স্বর্গ হতে উৎপত্তি হওয়া নদীটি নাকি ভুলক্রমে পৃথিবীর বুকে চলে এসেছে!
কানো ক্রিস্টেলস এখনো পর্যন্ত আবিস্কৃত পৃথিবীর একমাত্র রঙিন নদী। বিস্ময়ে ভরপুর এই নদীটি কিন্তু সবসময় এমন রঙিন থাকে না। বছরের একটি বিশেষ সময়ে এটি এই রূপ পায়। সেসময় নদীর সাথে সাথে তার চারপাশের প্রকৃতিও রঙিন হয়ে ওঠে, মেতে উঠে উচ্ছলতার খেলায়। জীববৈচিত্র্য আর প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের মাখামাখিতে পূর্ণ নদীটিকে দেখলে মনে হবে, সৃষ্টিকর্তা যেন তার নিপুণ হাতে পৃথিবীর এক কোণে রঙতুলি নিয়ে বসেছেন নদীটিকে সাজাতে।
ভূ-প্রকৃতিগত অবস্থান
কানো ক্রিস্টেলস নদীটি কলম্বিয়ার সেরেনিয়া দি লা মাকারেনা রাজ্যের এক দুর্গম পাহাড়ি পথ বেয়ে নিরন্তর বয়ে চলেছে। কলম্বিয়া এবং ভেনেজুয়েলার সীমান্তবর্তী এলাকায় অবস্থিত এই নদীটি দুই দেশের অসংখ্য বহমান ঝর্ণার পানি থেকে সৃষ্ট। নদীটি প্রায় ১০০ কিলোমিটার লম্বা আর ২০ মিটার চওড়া।
বিভিন্ন জলজ উদ্ভিদ থাকলেও কানো ক্রিস্টেলস নদীর সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো, নদীতে কোনো জলজ প্রাণী, মাছ বা সরীসৃপ জাতীয় প্রাণীর অনুপস্থিতি। বালুকণার পরিমাণ কম হওয়ায় এর পানি বেশ স্বচ্ছ, যেন নিজের প্রতিচ্ছবি দেখা যাবে এমন। আর এজন্য নদীটির প্রতিটি রংই আলাদা আলাদা করে চেনা যায়। নদীর চারপাশের পাহাড়ে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি, উভচর প্রাণী, সরীসৃপ এবং অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণীদের এক নিরাপদ আবাসস্থল গড়ে উঠেছে।
নদীর কাছে যাওয়ার পথটি দুর্গম হওয়ার কারণে এই নদীতে ভ্রমণ করতে যাওয়া খুব একটা সহজ নয়। এখনো পর্যন্ত নদীর কাছাকাছি যাওয়ার জন্য যান চলাচলের কোনো সুগম রাস্তা তৈরি হয়নি। এরপরও নদীটি দেখতে নানা বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের দুঃসাহসী সব অভিযাত্রী সেখানে গিয়ে পৌঁছান। দু’চোখ ভরে মন-প্রাণ দিয়ে তারা উপভোগ করেন কানো ক্রিস্টেলসের স্বর্গীয় সৌন্দর্য। এখন অবশ্য পার্শ্ববর্তী শহর লা মাকারিনা থেকে আকাশপথে বা ঘোড়ায় চড়ে নদীর ধারে যাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে।
কখন শুরু হয় নদীতে রঙের উৎসব?
বছরের অধিকাংশ সময়েই নদীর স্বাভাবিক অবস্থা বজায় থাকে, তখন আর পাঁচটা বয়ে চলা নদীর মতোই থাকে তার আচরণ। কঠিন পাললিক শিলায় তৈরি নদীর নিচের ধূসর তলদেশ আর অবিশ্রান্ত বয়ে চলা ঝকঝকে পানির স্রোত যেন নদীটির পৃথক কোনো বৈশিষ্ট্যের খুব একটা পরিচয় দেয় না। কিন্তু নদী তার উদ্দামতা ফিরে পায় যখন শুকনো মৌসুম শেষ হয়ে বর্ষা মৌসুম শুরু হয় তখন। অন্য সব নদীর মতোই এই নদীও বর্ষার পানি পেয়ে তার যৌবন ফিরে পায়। আর অন্য নদীগুলোতে যা হয় না সেটাই ঘটে এ নদীর ক্ষেত্রে, বর্ষার পানিতে মেতে ওঠে তার অদ্ভুত রঙিন ডানা মেলা প্রজাপতির খেলা।
জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত নদীটি মেতে থাকে জাদুর খেলায়। নদীর স্ফটিক জলের নিচে শুরু হতে থাকে রঙের বিস্ফোরণ। এই সময়টাতে নদীর নিচের জলজ উদ্ভিদ, মস, প্রবাল এবং নানারকমের গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ বর্ষার পানি পেয়ে দ্রুত বাড়তে থাকে। তার ফলে নদীতে ঘটতে থাকে অপূর্ব এক রঙের সম্মিলন।
বর্ষার পানি পেয়ে নদীর তলদেশে মাকারেনিয়া ক্লাভিগেরা নামক এক বিচিত্র গুল্মের দ্রুত বৃদ্ধি ঘটে। এই লাল রঙের গুল্ম লতাগুলো নদীর স্রোতের সাথে দুলতে থাকে। নদীর যে অঞ্চলে স্রোতের মাত্রা বেশি, সেখানে লাল রঙের গুল্মটি সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। আর এ কারণেই তখন এই নদীর পানির রঙ লালচে দেখায়। নদীটির বিভিন্ন স্থানে দিনের বেলায় ভিন্ন ভিন্ন সময়ে, সূর্যালোকের তারতম্যের ওপর নির্ভর করে মাকারেনিয়া ক্লাভিগেরা গুল্মের উদ্ভিদটি কোথাও ম্যাজেন্টা, কোথাও বা উজ্জ্বল লাল বর্ণ থেকে গভীর বেগুনী পর্যন্ত রং ধারণ করতে পারে।
কালো শিলার কারণে নদীর কোনো কোনো অংশে নীল রঙ প্রকট হয়ে দেখা দেয়। আবার নদীর পাদদেশেও পাথরের গায়ে জন্মে থাকা সবুজ গুল্ম ও শ্যাওলার কারণে অনেক জায়গায় সবুজ রঙের মেলা বসে। আর নদীর যে অংশে সূর্যের আলো পৌঁছায় না, সেখানে নদীর নীল জলরাশি এবং কালো শিলার কারণে নীল রং আরো প্রকট হয়ে দেখা দেয়।
নদীর নিচে যেসব জায়গায় গুল্ম লতা জন্মাতে পারে না, সেসব জায়গার হলুদ বালির কারণে নদীর পানি হলুদ রং দেখায়। এভাবে নদীর কোথাও লাল রঙের বর্ণচ্ছটা, কোথাও সবুজ, নীল, হলুদের এক অদ্ভুত মিশ্রণে মোহনীয় জলধারার সৃষ্টি হয়। কানো নদীর এই বৈচিত্রময় রঙের খেলা দেখার উপযুক্ত সময় হলো সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বরের মাত্র কয়েক সপ্তাহ। নদীতে যখন পানির গভীরতা একটি নির্দিষ্ট মাত্রার কমও নয় আবার বেশিও নয় এরূপ থাকে, তখনই কানোর এই সৌন্দর্য সবচেয়ে বেশি মাত্রায় পরিস্ফুটিত হয়।
নদীর চারপাশের অন্যান্য দর্শনীয় স্থানসমূহ
কানো ক্রিস্টেলস নদীটি শুধু যে তার বৈচিত্র্যময় রঙের কারণেই পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে, তা কিন্তু নয়। নদীর চারপাশের প্রকৃতিও পর্যটকদের ব্যাপকভাবে আকৃষ্ট করার মতো। নদীটির আশেপাশের পাহাড়গুলোতে বয়ে চলেছে অ্যাঙ্গুসতরার মতো অজস্র ঝর্ণাধারা, আছে পাথুরে পাহাড়ে ঘেরা কানো কাফ্রি নদী আর সবুজ গাছগাছালি। এখানে-সেখানে অগভীর জলাশয়ের উষ্ণ শীতল জলধারায় চাইলেই নিশ্চিন্তে সাঁতার কাটতে নেমে পড়া যায় এবং দেখা যায় পাহাড়ের আড়ালে ছড়িয়ে থাকা কত শত গুহা! সবই যেন অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় পর্যটকদের সম্মোহনের মতোই টেনে নিয়ে আসে এখানে। প্রকৃতির এসব অনির্বচনীয় সৌন্দর্য রহস্যময় এই নদীর নান্দনিকতাকে বাড়িয়ে দিয়েছে আরো শতগুণে।
এছাড়াও নদীটির চারপাশে প্রায় ১৬ মিলিয়ন হেক্টর নিয়ে পাহাড় আর সমতল জায়গা বিদ্যমান, যা কলম্বিয়ার মোট সমতল জায়গার প্রায় এক-চতুর্থাংশ। এই সমতল জায়গাটি লস ল্যালনস নামে পরিচিত। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে এটি বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ সবুজ ঘেরা সমতলভূমি। এখানে শিকারী পাখি থেকে শুরু করে এনাকোন্ডার মতো বিশাল সাপেদের বসবাস রয়েছে। নানা ধরনের বিপণ্ন প্রজাতির প্রাণীর আবাসস্থল হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে এখানকার পরিবেশ। লস ল্যালনসের মাত্র ২৫৫ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় পর্যটকদের ভ্রমণের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে।
অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় পর্যটকদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা
মে মাসের মাঝামাঝি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত পর্যটকদের জন্য খুলে দেওয়া হয় এখানকার সংরক্ষিত এলাকা। কানো ক্রিস্টেলস নদী এবং একে ঘিরে থাকা পাহাড় সহ এলাকা সংরক্ষিত জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করার পর থেকে প্রতি বছর এই নদী ও তার চারপাশের প্রকৃতি দেখার জন্য বিপুল সংখ্যক দর্শণার্থীর আগমন ঘটে কলম্বিয়ার এই অঞ্চলটিতে। কিন্তু হঠাৎই কলম্বিয়ার রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠায় এবং গেরিলা আক্রমণের আশঙ্কায় কলম্বিয়া সরকার বেশ কিছুদিন এলাকাটি পর্যটকদের জন্য নিষিদ্ধ করে রেখেছিল।
২০০৯ সালের পর আবার পর্যটকদের জন্য এলাকাটি উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। তবে জলবায়ু এবং পরিবেশের বিপর্যয় থেকে এলাকাটিকে রক্ষার জন্য দিনে ২০০ এর বেশি পর্যটককে এলাকাটিতে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয় না। ফলে নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে নানা পর্যটন সংস্থা। এসব সংস্থা পর্যটকদেরকে নদী এবং নদীর চারপাশের প্রকৃতি ঘুরে দেখানোর ব্যবস্থা করে। পর্যটকদের রাতে থাকার জন্য নদীর ধারে বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে। বনের মধ্যে সবাইকে নিয়ে বনভোজনেরও সুব্যবস্থা রয়েছে। জোছনা রাতে নদীর পাশ্ববর্তী এলাকাজুড়ে প্রকৃতি যেন এক স্বর্গীয় খেলায় মেতে উঠে, তাই পূনির্মার দিনগুলোতেও অন্যান্য দিনের চেয়ে তুলনামূলক বেশি ভিড় দেখা যায়।
প্রকৃতির অপরূপ সৃষ্টিশীলতা এবং নয়নাভিরাম সৌন্দর্য উপভোগ করতে চাইলে আপনাকে একবার হলেও কানো ক্রিস্টেলস ঘুরে আসতে হবে, না হলে জীবনে কিছুটা হলেও অসম্পূর্ণতা রয়েই যাবে হয়তো!