Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

রবার্ট ফ্যালকন স্কট: দক্ষিণ মেরুজয়ী এক দুঃখী রাজকুমারের গল্প

“বৃহস্পতিবার, ২৯ শে মার্চ
এগারো দিন ধরে তাঁবুর মধ্যে আটকা পড়ে আছি, বের হবার চেষ্টা করছি কিন্তু পারছি না। বুঝতে পারছি আমাদের সব আশা শেষ হয়ে গিয়েছে। আমার শক্তি শেষ হয়ে আসছে তবুও লিখতে হবে। আমার জন্য নয়, আমার বীর বন্ধুরা মেরুর তুষারাবৃত প্রান্তরে যে চরম বীরত্বের পরিচয় দিয়েছে, পৃথিবীর মানুষকে সে কাহিনী জানানো প্রয়োজন।”

চারদিকে মৃত্যুর হিমশীতল নীরবতা আর প্রচণ্ড তুষারঝড় ব্লিজার্ড। শারীরিক শক্তিটুকুও প্রায় নিঃশেষ হয়ে এসেছে। আছে শুধু মনের তীব্র জোর। সেই মনের জোর নিয়েই এক অদম্য অভিযাত্রী তার অভিযানের এবং নিজের জীবনের শেষ দিনগুলোর কথা লিপিবদ্ধ করে যাচ্ছেন ডায়েরির পাতায়। জিতে গিয়েও হেরে যাওয়ার হতাশা, প্রচণ্ড খাদ্যাভাব কিংবা দক্ষিণ মেরুর সাদা বরফে ঢাকা ভয়াল মৃত্যু উপত্যকা কোনোকিছুই থামাতে পারেনি মানুষটিকে। মৃত্যুর করাল থাবা এসে গ্রাস করার আগমুহূর্ত পর্যন্ত জীবন নিয়ে স্বপ্ন দেখে গেছেন স্কট। রবার্ট ফ্যালকন স্কট, দক্ষিণ মেরু জয়ের ২য় অভিযানের দলনেতা।

১৮৬৮ সালের ৬ জুন  ইংল্যান্ডের ডেভনপোর্টের প্লাইমাউথে স্কটের জন্ম। স্কটের বাবা ছিলেন চিররুগ্ন। ঘরে বসেই কাজকর্মের দেখাশোনা করতেন। এক কাকা ছিলেন নৌবাহিনীতে। স্বপ্নটা শুরু হয় কাকাকে দেখেই। ভাবতেন একদিন তিনিও কাকার মত সমুদ্রে ভেসে বেড়াবেন। সেই স্বপ্ন থেকেই বড় হয়ে যোগ দিলেন ইংল্যান্ড নৌবাহিনীতে। যোগ্যতা আর সাহসের পরিচয় দিয়ে খুব অল্প সময়েই পদোন্নতি করলেন।

নৌবাহিনীর পোশাকে স্কট; সোর্স: Scottss-last-expedition

সেসময় রয়াল জিওগ্রাফিকাল সোসাইটির সভাপতি ছিলেন স্যার ক্লিমেন্ট মারখাম। ১৮৯৫ সালে ভূগোল বিশারদদের এক সম্মেলনে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো যে, দক্ষিণ মেরুতে গবেষণার উদ্দেশ্যে অভিযান পরিচালনা করা হবে। কিন্তু সেজন্য চাই যোগ্য দলনেতা। তাই এমন অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়ার মত সাহসী এবং বিচক্ষণ কাউকে খুঁজছিলেন ক্লিমেন্ট। ভাগ্যক্রমে ওয়েস্ট ইন্ডিজে নৌবাহিনীর দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় স্কটের সাথে তার দেখা হয়। স্কটের বুদ্ধিমত্তা আর সাহস ক্লিমেন্টকে মুগ্ধ করে। কিছুদিনের মধ্যেই স্যার ক্লিমেন্ট বুঝতে পারলেন, দক্ষিণ মেরু অভিযানের জন্য যে নেতার সন্ধান তিনি করছেন সে নেতা হবার সমস্ত গুণ স্কটের মাঝে আছে। স্কটকে অভিযাত্রী দলের নেতা ঘোষণা করা হলো। এজন্য সামরিক বিভাগ থেকে স্কট ছুটিও পেলেন।

অ্যান্টার্কটিকা বা দক্ষিণ মেরু অঞ্চল সারা বছর বরফে ঢাকা থাকে। চিরবরফের এই রাজ্যে সবুজের দেখা মেলা ভার। প্রাণের চিহ্ন সেখানে নেই বললেই চলে। যতদূর চোখ যায় শুধু সাদা ধবধবে বরফ। কখনো কখনো উঁচু উঁচু বরফের পর্বত। দেখে মনে হবে, প্রকৃতি যেন খুব সচেতনভাবেই মানুষের জয়যাত্রাকে প্রতিরোধ করার জন্য এসব বাধার প্রাচীর তুলে দিয়েছে। আছে ‘এরেবাস’ এবং ‘টেরর’ সহ ভয়ঙ্কর সব জীবন্ত আগ্নেয়গিরি। ভেতরে গলন্ত আগুনের লাভা অথচ মুখটি ঢাকা বরফ আর তুষারে। এর আগে বেশ কয়েকটি অভিযাত্রী দল দক্ষিণ মেরু অভিযানে গেলেও বেশিদূর এগোতে পারেনি। অভিযাত্রীদের অধিকাংশই সেখানকার প্রতিকূল পরিবেশে মারা যান। হাতেগোনা অল্প কয়েকজন অর্ধমৃত অবস্থায় ফেরত আসতে পেরেছিলেন। কিন্তু এইসব বাধা-বিপত্তি কোনো কিছুকেই ভয় পেলেন না স্কট।

ডিসকভারিতে স্কট এবং অন্যান্য অভিযাত্রীরা; সোর্স: Cool-Antarctica

১৯০১ সালে শুরু হলো স্কটের প্রথম দক্ষিণ মেরু অভিযান। স্কটের বয়স তখন ৩২। সঙ্গী ছিলেন আর্নেস্ট হেনরি শ্যাকলটন, ডাক্তার উইলসন, আলবার্ট আর্মিটেজ, লুইস বারনাচ্চি সহ আরো কয়েকজন সাহসী অভিযাত্রী। এই অভিযানের জন্য ‘ডিসকভারি’ নামক একটি  শক্ত আর মজবুত জাহাজ তৈরি করা হয়েছিলো। প্রায় ১৭২ ফুট লম্বা আর ৩৪ ফুট চওড়া এই জাহাজটি ৪৮৫ টন ভার বইতে পারতো। খাবার সরবরাহ, গুদামঘর আর গভীর সমুদ্রে গতি প্রকৃতি নির্ণয়ের দায়িত্ব ছিল শ্যাকলটনের উপর।

প্রথমেই স্কট আর তার দল এসে পৌঁছুলেন রস আইসল্যান্ডের টেরর পাহাড়ের কাছের এক জায়গায়। এরপর জাহাজ সোজা পূর্বদিকে চলতে শুরু করলো। যাত্রাপথে একটি নতুন স্থান দেখতে পেয়ে তার নাম দিলেন ‘কিং অ্যাডওয়ার্ড দ্য সেভেন্থ ল্যান্ড’। উঁচু নিচু বরফের পথ পাড়ি দিয়ে চলতে চলতে একসময় সাউথ ভিক্টোরিয়াল্যান্ডের দক্ষিণে অবস্থিত পর্বতমালার কাছাকাছি এসে পৌঁছালেন। হঠাৎ করেই শ্যাকলটনের মারাত্মক স্কার্ভি দেখা দিল। এদিকে খাবারও ফুরিয়ে আসছিলো। তাদের সাথে ছিল মেরু অঞ্চলের কিছু কুকুর। কিন্তু পথের মধ্যে স্লেজ টানার ক্লান্তিতে এবং বৈরি আবহাওয়ায় বেশিরভাগ কুকুরই মারা পড়লো। তারা ফিরে আসতে বাধ্য হলেন। এবারের অভিযান থেকে স্কট দক্ষিণ মেরু যাবার পথটি খুঁজে বের করলেন। পরের বছর তিনি ভিক্টোরিয়াল্যান্ড থেকে আরও পশ্চিম দিকে প্রায় ৪১৮ কিলোমিটার পর্যন্ত গিয়েছিলেন। অবশেষে অভিযাত্রীদলটি ১৯০৪ সালে ইংল্যান্ড ফিরে আসে। এর সাথে সাথে শেষ হয় স্কটের প্রথম দক্ষিণ মেরু অভিযান। বিখ্যাত টাইমস পত্রিকার একটি শিরোনাম –

“স্কটের নেতৃত্বে যে অভিযান পরিচালিত হলো, তা এ যাবৎকালের সকল উত্তর ও দক্ষিণ মেরু অভিযানের মাঝে শ্রেষ্ঠ।”

স্কটের অভিযান মূলত শেষ করতে হয়েছিল খাদ্যাভাব, বৈরি আবহাওয়া আর প্রয়োজনীয় রসদের অভাবের জন্য। খাদ্যাভাব এতটাই প্রকট ছিল যে, তারা এক পর্যায়ে সাথে থাকা কুকুরগুলোকে মেরে মাংস খেয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন। এই দুঃসহ দিনগুলোর কথা মনে করে স্কট লিখেছেন –

“এর চেয়ে বীভৎস আর করুণ কিছুই হতে পারে না। আজও কানে বাজে সেই মেরু নির্জনতার মধ্যে নিহত কুকুরের অন্তিম আর্তনাদ।”

তুষারশুভ্র দক্ষিণ মেরু; সোর্স: pixabay

মাতৃভূমিতে ফিরে আসার কিছুদিন পরেই স্কট অনুভব করলেন, দক্ষিণ মেরু তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। অ্যাডভেঞ্চারের নেশা যার রক্তে, সে কি আর থেমে থাকতে পারে? মনস্থির করলেন, আবার অভিযানে বেরোবেন। দক্ষিণ মেরু যে এখনো অজেয় রয়ে গেছে! এরই মধ্যে ১৯০৮ সালের সেপ্টেম্বরে বিয়ে করলেন দীর্ঘদিনের প্রেমিকা ক্যাথলিন ব্রুসিকে। ক্যাথলিন ছিলেন তার যোগ্য সঙ্গী। সবসময় তিনি স্কটকে সাহস আর প্রেরণা দিতেন। বিয়ের মাসেই সংবাদপত্রে স্কট ঘোষণা করলেন দক্ষিণ অভিযানের কথা। জানালেন, ইংল্যান্ডের প্রতিনিধি হিসেবে দক্ষিণ মেরুতে জাতীয় পতাকা স্থাপন করতে চান। সবাই বেশ উৎসাহ দিলেও সরকারের তরফ থেকে কোনো সাড়া পেলেন না।

স্কট তার আগের অভিজ্ঞতা থেকে স্পষ্টই বুঝতে পেরেছিলেন, এই অভিযান তার জন্য সহজ হবে না। এমনকি মৃত্যুও হতে পারে। আর প্রয়োজন ব্যাপক প্রস্তুতির। সেই প্রস্তুতির জন্য দরকার প্রচুর অর্থ। প্রস্তুতির জন্য নৌবাহিনী থেকে অর্ধবেতনে ছয় মাসের ছুটি নিলেন। ইংল্যান্ডের এ প্রান্ত থেকে ও’ প্রান্তে ঘুরে ঘুরে অর্থ সংগ্রহ করলেন। এবার সরকারি তরফ থেকেও অর্থ সাহায্য পেলেন। রানী ঘোষণা দিলেন, দক্ষিণ মেরুজয়ের প্রতীক হিসেবে যে পতাকা স্থাপন করা হবে তা তিনি নিজ হাতে বানাবেন। অভিযানের জন্য প্রস্তুত হলো জাহাজ ‘টেরা নোভা’।

সকল প্রস্তুতি শেষে ১৯১০ সালের ১৫ জুন টেরা নোভার যাত্রা শুরু হলো। হাজার হাজার মানুষ এলো অভিনন্দন জানাতে। ১২ই অক্টোবর মেলবোর্ন গিয়ে পৌঁছতেই একটি টেলিগ্রাম পেলেন। টেলিগ্রাম মারফত জানতে পারলেন, নরওয়ের অভিযাত্রী রোয়াল্ড আমানসেনও দক্ষিণ মেরু অভিযানে যাত্রা শুরু করেছেন। এ খবর শুনে যতটা না অবাক হয়েছেন, তার চেয়ে বেশি হতাশ হয়েছেন। কারণ আমানসেন যদি স্কটের আগে দক্ষিণ মেরু জয় করেন এবং নরওয়ের পতাকা স্থাপন করেন তবে সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যাবে। তবুও নিজের মাঝে উদ্যম ফিরিয়ে আনলেন স্কট। যা-ই হোক না কেন, এখান থেকে তিনি ফিরে যাবেন না। জিততে তাকে হবেই।

২৯ নভেম্বর নিউজিল্যান্ডের ডানেডিন বন্দর থেকে দক্ষিণ মেরু অভিমুখে যাত্রা শুরু করলো স্কটের জাহাজ। যাত্রার তৃতীয় দিনেই শুরু হলো প্রচণ্ড ঝড়। ঝড়ের তোড়ে জাহাজের একপাশে ফাটল দেখা দিলো। ঢেউয়ের তাণ্ডবে ক্ষতিগ্রস্ত হলো সঙ্গে থাকা রসদ। মারা গেলো দুটি ঘোড়া। একসময় ঝড় থামলো। চলতে চলতে দেখা মিললো মেরু অঞ্চলের পাখি আলবাট্রসের। বুঝতে পারলেন মেরু অঞ্চলের সীমানায় এসে গেছেন। শুরু হলো দুর্গম অভিযান। স্কটের নেতৃত্বে এই অভিযানে যাত্রী হয়েছিলেন ডাক্তার উইলসন, বাওয়ারস এবং ওটস। বহু চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে অবশেষে ১৯১২ সালের ১৮ই জানুয়ারী বহু সাধনার দক্ষিণ মেরুতে গিয়ে পৌঁছলেন। কিন্তু সেখানেও তাদের জন্য অপেক্ষা করছিলো দুর্ভাগ্য। সেখানে পৌঁছে দেখলেন, তারা পৌঁছার ১ মাস ৬ দিন আগেই আমানসেন পৌঁছে গিয়েছিলেন। হতাশ মনে স্কট দেশে ফেরার পথ ধরলেন।

দক্ষিণমেরু জয়ী প্রথম ব্যক্তি নরওয়ের আমানসেন; সোর্স: Scottss-last-expedition

ফিরতি পথে দেখা দিলো চরম খাদ্যাভাব। আবহাওয়াও ক্রমশ খারাপ হতে লাগলো। ওটস অসুস্থ হয়ে যাবার পর ইচ্ছে করেই নিখোঁজ হলেন। উইলসন, বাওয়ারস এবং স্কট আশ্রয় নিলেন তাঁবুতে। সেখানেই বরফের নিচে চাপা পড়ে মৃত্যু হয় তিনজনের। স্কট মারা যান সবার শেষে। মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি তার অভিযানের সমস্ত কাহিনী লিখে রেখে গেছেন। স্কটের লেখা ডায়েরি, আমানসেনের চিঠি এবং তাদের মৃতদেহ সবকিছু তাদের মৃত্যুর আট মাস পর সেই তাঁবু থেকে উদ্ধার করা হয়।

একবার ভাবুন তো সেই মানুষটার কথা, যিনি জিতে গিয়েও ভাগ্যের নির্মমতার কাছে হেরে গিয়েছিলেন! নিশ্চিত মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে করতে ডায়েরি লিখতে কেমন লেগেছিলো তার! মৃত্যুর আগে স্ত্রীকে লিখেছিলেন, একমাত্র সন্তান যেন প্রকৃতি নিয়ে পড়াশোনা করে। পিটার স্কট তার পিতার শেষ ইচ্ছা পূরণ করেছিলেন। বড় হয়ে বিখ্যাত এই প্রকৃতিবিদ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন WWT

প্রকৃতিবিদ পিটার স্কট; সোর্স: Pinterest

স্কটের মতন মানুষেরা হয়তো অকালেই মারা যান, কিন্তু তারা জন্ম দেন আরও অসংখ্য উদ্যমী প্রাণের। তাদের বীরত্বগাঁথা আমাদের উদ্বুদ্ধ করে, অনুপ্রেরণা যোগায়। আর সাহস দেয় অসম্ভবকে সম্ভব করার, অজানাকে জানার এবং বাধাকে পদদলিত করার। মৃত্যুর পরও তারা অমর।

তথ্যসূত্র:

ছোটোদের বুক অব নলেজ (প্রকাশক: কলকাতা দেবসাহিত্য কুটির)

পৃষ্ঠা নম্বর: ২০৬-২১০

Related Articles