
১৯১৪ এর শেষের দিক। পুরো পৃথিবী বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতায় ধুঁকছে। আর সব দেশের মতো সমরাস্ত্রের টানাপোড়েনে আছে যুক্তরাজ্যের নৌবিভাগও। আর্নেস্ট শ্যাকলটন নামের একজন ক্যাপ্টেন এ অবস্থা দেখে সিদ্ধান্ত নিলেন নিজের সমুদ্র অভিযান বাতিল করে সরকারকে এন্ডুরান্স নামের জাহাজটি দান করে দেবার। কিন্তু শেষ মুহূর্তে এসে বাদ সাধলো সরকারি এক নির্দেশনা।
ফার্স্ট সি লর্ড, উইনস্টন চার্চিল স্বয়ং নির্দেশনা পাঠালেন শ্যাকলটনের কাছে যেন এই অভিযান বাতিল না করা হয়। বিচক্ষণ ক্যাপ্টেন বুঝতে পারলেন- তার এই অভিযানের সাথে আসলে জড়িয়ে আছে অনেক স্বপ্ন। মূলত, বরফঢাকা অজানা মহাদেশ অ্যান্টার্কটিকায় যাবার পথ খুঁজে বের করতে, আর সেখানে অনুসন্ধান চালাতে এই অভিযান চালানোর নির্দেশ দেয়া হয় তাকে। চার্চিলের নির্দেশানুযায়ী দ্রুততার সাথে দক্ষ নাবিকের দল আর জাহাজের রসদ গোছাতে লেগে পড়েন ক্যাপ্টেন শ্যাকলটন।

শ্যাকলটন ছিলেন একজন অ্যাংলো-আইরিশ অভিযানকারী। নৌবাহিনীতে চাকরি করার সুবাদে সমুদ্রের সাথে সখ্য অনেকদিনের। সব সময় স্বপ্ন দেখতেন তুষারশুভ্র রহস্যে ঢাকা মহাদেশ অ্যান্টার্কটিকায় নিজের পায়ের ছাপ ফেলবেন কোনো একদিন। ১৯০৬ সালে হুট করেই অ্যান্টার্কটিকা অভিযানের ডাক আসে তার। কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার কারণে দুর্ভাগ্যক্রমে সেই অভিযানে যাওয়া হয়নি শ্যাকলটনের। তবে সেই সুযোগ আবার তিনি পেয়ে যান ১৯০৮ সালে। দক্ষিণের সফল মেরু অভিযান শেষে বীরের বেশে দেশে ফেরেন তিনি। ১৯০৯ সালে সেই সাহসিকতার জন্য তাকে ‘স্যার’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
অভিযানের জন্য নির্বাচন করা জাহাজটি ছিল সেই সময়ের অন্যতম সেরা। নরওয়েতে তৈরি জাহাজটি প্রথম পানিতে ভাসে ১৯১২ সালের ১৭ ডিসেম্বর। জাহাজটির প্রাথমিক নাম ছিল পোলারিস, যা পরবর্তীতে বদলে এন্ডুরান্স করা হয়। প্রবল প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সাথে লড়াইয়ের মতো করেই তৈরি করা হয়েছিল কাঠের হাল আর তিনটি মাস্তুল সমেত পালতোলা জাহাজটি। তবে এতে যুক্ত ছিল বাষ্পীয় ইঞ্জিন। বরফঢাকা অঞ্চলে জমাট জল ভেদ করে সামনে এগোবার মতো সরঞ্জাম যুক্ত ছিল এন্ডুরান্সে।
মেরু অভিযানে অংশ নেয়া বা অসীম সাহসী শক্তিশালী ২৭ জন নাবিক নিয়ে এন্ডুরান্সের অভিযানকারী দল প্রস্তুত করলেন ক্যাপ্টেন শ্যাকলটন। শীতল এলাকায় কাজে লাগার মতো পোষাক, খাবার, ব্যবহার্য সরঞ্জাম ইত্যাদি সবই নেয়া হলো। অবশেষে ১৯১৪ সালের আগস্টে ইংল্যান্ড থেকে যাত্রা করে এন্ডুরান্স। সেখান থেকে ১৯১৪ সালের ৫ ডিসেম্বর গ্রিটভিকেন তিমি স্টেশনে এসে পৌঁছায় দলটি। সামনে বহু পথ বাকি, ওয়েডেল সাগর পাড়ি দিয়ে দক্ষিণ মেরুর পুরো অংশ পার করে রস সাগরে যাবার পথ বের করার জন্যই এন্ডুরান্সের পথচলা।

শুরুর দিকে অভিযানের পথ নির্ণয়ে বেশ সাফল্য দেখাতে সক্ষম হন শ্যাকলটন। কিন্তু যতই তারা সাগর ধরে এগোতে থাকেন, প্রকৃতি যেন আরও বিরূপ হয়ে উঠতে থাকে তাদের প্রতি। সেই বছর সমুদ্রে বরফ জমার পরিমাণ অন্যান্য বছরের তুলনায় বেশি ছিল। বরফ ভেঙে কিছুদিন এগোতে সক্ষম হন শ্যাকলটন। তিনি ধারণা করেছিলেন, গ্রীষ্মের শুরুতে বরফ গলে গেলে তাদের এগোতে আর সমস্যা হবে না। কিন্তু সেই ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো, এবং বরফের পরিমাণ দিন দিন বাড়তেই থাকলো। ১৯১৫ সালের ৮ জানুয়ারি এন্ডুরান্স বরফে পুরোপুরি আটকে গেলে সেই সময়ের জন্য অভিযান সাময়িকভাবে স্থগিত করেন শ্যাকলটন।
জাহাজ যেখানে আটকে গিয়েছিল, সেখানেই একটি অস্থায়ী ল্যান্ড স্টেশন প্রতিষ্ঠা করে জাহাজের সদস্যরা। এন্ডুরান্স থেকে নাবিকদের সাথে নামিয়ে আনা হয় থাকার জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম, খাবার, লাইফবোট, এমনকি সাথে থাকা পোষা প্রাণীগুলোও। বিচক্ষণ ক্যাপ্টেন ও দক্ষ নাবিকদের মনে উৎকণ্ঠা কাজ করলেও নিয়মের বাইরে কেউ গেল না। আর সেজন্যই এত বড় বিপদের মাঝেও কোনো নাবিককে হারাতে হলো না এন্ডুরান্সের অভিযানকারীদের।
একঘেয়েমি এড়াতে নিজেদের ভেতর প্রতিযোগিতামূলক ফুটবল এবং হকি ম্যাচের আয়োজন করা, সময় বুঝে রসিকতা করা, সেই সাথে বিশেষ দিনগুলোতে সামাজিক অনুষ্ঠান উদযাপন করে বরফ গলার অপেক্ষা করতে থাকে অভিযানকারী দলটি। অক্টোবরের ২৭ তারিখে বরফের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এন্ডুরেন্সের হাল। ধীরে ধীরে বরফশীতল পানি প্রবেশ করতে থাকে জাহাজের ভেতরে। কোনোভাবেই জাহাজকে রক্ষা করা যাবে না বুঝতে পেরে এন্ডুরান্সকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করেন শ্যাকলটন। ১৯১৫ সালের ২১ নভেম্বর সমুদ্রের গভীরে চিরনিদ্রায় শায়িত হয় এন্ডুরান্স।

ক্যাপ্টেন আর নাবিকদের উৎকণ্ঠা তখন চরমে পৌঁছে গেলেও স্রোতযুক্ত পানির অভাবে কোথাও যাত্রার উপায় ছিল না তাদের। তিনটি লাইফবোট সাথে নিয়ে সবচেয়ে কাছের স্থলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিতে তাদের অপেক্ষা করতে হয় ১৯১৬ সালের এপ্রিল পর্যন্ত। বরফ গলে সমুদ্রে চলাচলের অবস্থা তৈরি হওয়াতে আর বিলম্ব না করে দ্রুত স্থলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয় দলটি। জাহাজ ডুবে যাওয়ায় অভিযানের আর কোনো উদ্দেশ্য না থাকলেও নিজের দলের সবাইকে নিরাপদে লোকালয়ে পৌঁছে দেয়াই মূল কাজ হয়ে ওঠে ক্যাপ্টেন শ্যাকলটনের।
১১ এপ্রিল যাত্রা শুরু করে ১৬ তারিখে মানবশূন্য এলিফ্যান্ট আইল্যান্ডে পৌঁছায় অভিযাত্রী দলটি। উত্তাল শীতল সমুদ্রের ঢেউয়ের সাথে পাল্লা দিয়ে, প্রয়োজনের চেয়ে অনেক কম জায়গায় নিজেদের মানিয়ে, ক্ষুধা-তৃষ্ণা উপেক্ষা করে অবশেষে যখন তারা সেখানে পৌঁছায়, সবার কাছে মনে হতে থাকে- তারা হয়তো বিশ্ব জয় করেছে। কিন্তু সেই উৎসবে যোগ দিতে পারেননি শ্যাকলটন। কারণ, তিনি ভালোভাবেই জানেন যে সেখান থেকে জনবসতি আর সাহায্য তখনও অনেক দূরে।
মাত্র আট দিন বিরতি নিয়ে ২৪ এপ্রিল এই অভিযানের সবচেয়ে বিপদজনক পথ পাড়ি দিতে প্রস্তুত হন শ্যাকলটন। উদ্দেশ্য দক্ষিণ জর্জিয়ার তিমি স্টেশনে পৌঁছানো। সেখান থেকে সাহায্য নিয়ে এলিফ্যান্ট দ্বীপে ফিরে আসা। ক্যাপ্টেনের উপর চরম আস্থা আর নিজেদের মনোবলের কারণে টিকে থাকা নাবিকদলের মাঝেও কিছুটা অনিশ্চয়তা দেখা দেয় এই অভিযান নিয়ে। কিন্তু এর বেশি আসলে কিছু করারও ছিল না তাদের।

২২ ফুটের একটি লাইফবোট সাথে নিয়ে ৮০০ মাইল সমুদ্রপথ পাড়ি দিতে নিজের সবচেয়ে সেরা সদস্যদের বেছে নেন শ্যাকলটন। সহযোগী অধিনায়ক ওয়ারসলি, ছুতার হ্যারি ম্যাকনিশসহ চারজন নাবিক নিয়ে যাত্রা করেন তিনি। ১৬ দিনের অমানুষিক যাত্রাপথে সি-সিকনেস, হিমশীতল জলে সারাক্ষণ ভিজে থাকা, দিকনির্দেশনার অভাব, খাবার আর পানির অভাব- সবকিছু ছাপিয়ে নিজেদের লক্ষ্য ঠিক রাখেন অসামান্য মানসিক শক্তির অধিকারী এই দলের সদস্যরা।
১৯১৬ সালের ১০ মে যখন তারা কাঙ্ক্ষিত দ্বীপে পৌঁছান, তখন তারা আবিষ্কার করেন- ভাগ্য এখনও পুরোপুরি তাদের অনুকূলে নেই। তারা তিমি স্টেশনের অপরপাশে এসে পৌঁছেছে। সেখান থেকে নৌপথে ঘুরে তিমি স্টেশনে যাবার মতো অবস্থা তাদের ছিল না। স্থলপথে যেতে হলে তাদের পেরোতে হবে ৩,০০০ ফুট শৈলশিলা, বরফে ঢাকা গিরিখাদ, আর গভীর বনাঞ্চল। চরম অবস্থার মুখোমুখি হয়েও দমে গেলেন না শ্যাকলটন।
দুজনকে সেখানে নৌকা পাহারায় রেখে বাকিদের নিয়ে স্ট্রমনেস বে-তে তিমি শিকার স্টেশনের উদ্দেশ্যে রওনা হন তিনি। ১৯১৬ সালে ২০ মে তিমি স্টেশনে যখন তারা পৌঁছলেন, তাদের গায়ে আর কোনো শক্তি অবশিষ্ট ছিল না। স্টেশনের ম্যানেজার লাফ সোর্ল বিলম্ব না করে দ্রুত অভিযাত্রীদের খাবার এবং গরম আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে দেন।

কিছুটা থিতু হয়ে বসে নিজেদের অবিশ্বাস্য অভিযান কাহিনী বর্ণনা করেন ক্যাপ্টেন আর তার সঙ্গীরা। একই দ্বীপের বিপরীত পাশে আটকা পড়া দুই সঙ্গীকে পরদিনই উদ্ধারে সক্ষম হন তারা। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় এলিফ্যান্ট আইল্যান্ডে অভিযানে যাওয়া নিয়ে। বৈরি আবহাওয়ার কারণে বার বার তাদের উদ্ধার অভিযান বাধা পেতে থাকে।
১৯১৬ সালের ৩০ আগস্ট অবশেষে উদ্ধারকারী জাহাজ নিয়ে এলিফ্যান্ট আইল্যান্ডে পা রাখেন ক্যাপ্টেন শ্যাকলটন। তার আস্থাভাজন সেকেন্ড-ইন-কমান্ড ফ্র্যাঙ্ক ওয়াইল্ডসহ ২২ জন নাবিক তখন সত্যিই জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে ছিল। কারণ তাদের সাথের খাবার সব শেষ হয়ে এসেছিল, এবং বৈরি আবহাওয়ায় নতুন করে খাবারের সন্ধান করা তাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না।
এন্ডুরান্সের অ্যান্টার্কটিকা অভিযান ব্যর্থ হলেও ক্যাপ্টেন হিসেবে শ্যাকলেটন সফল ছিলেন। কারণ এত বিপর্যয়ের পরও তিনি নিজের দলের কাউকে হারাতে দেননি, নিজে হারেননি, এবং শেষ পর্যন্ত সবাইকে বহাল তবিয়েতে দেশে ফেরাতেও সক্ষম হন। ১৯১৬ সালের ৩ সেপ্টেম্বর অভিযানকারী দলটি দীর্ঘ যাত্রা শেষে চিলির পুন্টা অ্যারেনাসে পৌঁছালে সবাই তাদের অভিনন্দন জানায়।