বাংলা সাহিত্যের একটি বিশেষ স্থান জুড়ে অবস্থান করেন তিনি, রসের হাঁড়ি যেন সত্যিই উপচে পড়ে তার গল্পে। তিনি কি শুধুই লোককাহিনীর একটি চরিত্র, নাকি সত্যি সত্যি একদিন প্রবল অস্তিত্বে বিরাজ করতেন মধ্যযুগের সেই নদীয়া রাজসভায়?
বলছি গোপাল ভাঁড়ের কথা, যার নাম নিলে সবার চোখের সামনে ভেসে ওঠে গোলগাল মুখ, হেলতে দুলতে চলছেন একজন ভুঁড়িওয়ালা লোক, আর মুখের দিকে চাইলেই যাতে দেদীপ্যমান প্রখর বুদ্ধির জ্যোতি। আশেপাশের সবাই যার বুদ্ধির তীক্ষ্ণতায় কখনো না কখনো পরাজিত হয়েছিলেন, এমনকি রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ও! তবে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র বস্তুতই গুণীর কদর করতেন, গোপাল ভাঁড়ের সম্পূর্ণ পৃষ্ঠপোষক হিসেবে তাই তিনিও ভাস্বর হয়ে আছেন গল্পগুলোতে।
ঠিকঠাক জবাব দিতে কখনো পিছু হটতেন না গোপাল, তাই একদিন রাজা যখন গোপালকে অনামুখো বা অপয়া ঠাউরালেন, গোপাল ঠিকই রাজাকে বুঝিয়ে দিলেন রাজার ভুল।
ঘটনাটি ঘটেছিলো অনেকটা এমন যে, সকালে ঘুম থেকে উঠেই মহারাজ গোপালের মুখ দেখলেন আর সেদিনই নাপিতের কাছে নখ কাটতে গিয়ে মহারাজের কড়ে আঙুলের কিছুটা মাংসও কেটে গেলো। নাপিত নিজের পিঠ বাঁচাবার জন্য বললো, “হুজুর, এতদিন ধরে আপনার নখ, দাড়ি ও চুল কাটছি- কই একদিনও তো একটু আঁচড় লাগেনি! আজ নিশ্চয়ই আপনি কোনো অনামুখোর মুখ দেখেছেন”।
তারপর রাজা বলে কথা! ভাবতে লাগলেন, “আজ সকালে কার মুখ দেখেছি যে আজ এই অনাসৃষ্টি হলো? আরে হ্যাঁ, আজ তো গোপালকেই দেখলাম সবার আগে! সে কি তবে অনামুখো?” ভাবতে দেরি হলো, মৃত্যুদণ্ড জারি করতে দেরি হলো না! কিন্তু গোপাল এই দণ্ডাদেশ শুনে একটুও বিচলিত হলো না। অবিচলিতভাবে রাজাকে বললো, “মহারাজ, ঘুম থেকে উঠে সবার আগে আপনি আমার মুখ দেখেছেন বলে আপনার কড়ে আঙুলের সামান্য মাংস কেটে গেছে। আর ঘুম থেকে উঠে সবার আগে আমি আপনার মুখ দেখেছি বলে আজ আমার মৃত্যুদণ্ড হচ্ছে। ভাবছি মহারাজ, কে বেশি অনামুখো- আপনি না আমি?”
প্রভু নয়, রাজা নয়, একজন সত্যিকারের বন্ধু হিসেবেই দেখতে পাই কৃষ্ণচন্দ্রকে। হাজারবার জব্দ হয়েও যিনি বলতেন, “একবার গোপালকে ডেকে পাঠাও দিকি!” গোপাল ভাঁড়ের উপস্থিতি ছাড়া জমে উঠতো না নদীয়ার সে রাজসভা। অষ্টাদশ শতাব্দীতে নদীয়ার মানুষের মুখে মুখে ছিলো গোপাল ভাঁড়ের নাম, প্রতিদিনই কিছু না কিছু কান্ড ঘটিয়ে লোককে জব্দ করতেন তিনি আর সে গল্প বিভিন্ন লোকের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়তো আশেপাশের সমগ্র অঞ্চলেও।
গোপাল ভাঁড় সম্পর্কে প্রাপ্ত তথ্য, অতঃপর বিতর্ক
সাহিত্যে তার বুদ্ধিদীপ্ততা আর হাস্যরস সম্পর্কে গল্প যত বেশি প্রচলিত, তার সম্পর্কে কিন্তু ততটা তথ্য নেই ইতিহাসে। অনেকটাই অস্পষ্ট তার বংশ কিংবা পরিবারের কথাও। এতটাই অস্পষ্ট যে তিনি ছিলেন, কি ছিলেন না তা নিয়েও রয়েছে মতান্তর।
গোপাল ভাঁড়ের জন্ম, জন্মস্থান এমনকি মৃত্যু সম্পর্কে কোনো তথ্য মেলে নি। তার কোনো জমি কিংবা সম্পত্তিরও হদিস পাওয়া যায় নি সে অঞ্চলে। গোপাল ভাঁড় সম্পর্কে কিছুটা তথ্য পাওয়া গিয়েছে ১৯২৯ সালে নগেন্দ্রনাথ রচিত ‘নবদ্বীপ কাহিনী’ গ্রন্থে। এই গ্রন্থানুসারে, গোপাল ভাঁড় জাতিতে নাপিত ছিলেন, কিন্তু তার গল্পের কোথাও এটি লক্ষ্য করা যায় না। নগেন্দ্রনাথ নিজেকে গোপাল ভাঁড়ের বংশের সদস্য বলে দাবি করেন এবং একটি বংশলতিকাও তৈরি করেন। সেই তালিকায় গোপাল ভাঁড়ের পিতামহ, পিতা ও বড় ভাইয়ের নাম পাওয়া যায়। বংশলতিকাটিতে গোপালের বাবার নাম জানা গেলেও তার মা ও স্ত্রী সম্পর্কে কিছু জানা যায় নি। কিন্তু তার গল্পগুলো থেকে বোঝা যায় তিনি বিবাহিত ছিলেন। গোপালের এক ছেলে ও এক মেয়ে ছিল। মেয়ের নাম রাধারানী। তার দুই পুত্র রমেশ ও উমেশ। কিন্তু তার এক পুত্রের খুব অল্প বয়সেই মৃত্যু হয়।
নগেন্দ্রনাথ দাস এটাও বলেন যে, গোপাল ভাঁড় আসলে ছিলেন গোপালচন্দ্র নাই, অর্থাৎ জাতিতে নাপিত। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র তাকে রাজভাণ্ডারি হিসেবে নিয়োগ দিয়ে গোপালচন্দ্র ভাণ্ডারি হাস্যার্ণব উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। ওই ভাণ্ডারি শব্দটিরই অপভ্রংশ থেকে ভাঁড় হয়ে গেছে।
গোপাল ভাঁড় সম্পর্কে তথ্য না পাওয়া গেলেও ইতিহাসে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র সম্পর্কে বেশ ভালই তথ্য আছে এবং গোপাল ভাঁড় নামে তার কোনো সভাসদ ছিলেন বলে জানা যায় নি।
মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের পঞ্চরত্নসভার একজন কি গোপাল ভাঁড় ছিলেন? খুব সম্ভব না, কারণ মঙ্গলকাব্যের অন্যতম কবি ভারতচন্দ্র রায় গুণাকরের নাম সে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত থাকলেও গোপাল নামের কেউই এই তালিকায় ছিলেন না। তবে কৃষ্ণচন্দ্রের দরবারে একজন প্রখর বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তির কথা পাওয়া যায়; তিনি কোনো সভাসদ নন, একজন দেহরক্ষী। এই দেহরক্ষীর নাম ছিলো শঙ্কর তরঙ্গ, হয়তো তারই রূপান্তরিত চরিত্র গোপাল ভাঁড়।
ঐতিহাসিক ও ভাষাবিদেরা যা বলেন গোপাল ভাঁড়কে নিয়ে
প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ও ভাষাবিদ সুকুমার সেন বলেছেন “গোপাল ভাঁড় সম্পর্কে আধুনিক বাঙালির কৌতুহল থাকার ফলে বাস্তব অথবা কল্পিত ব্যক্তিটির সম্পর্কে যে জনশ্রুতি জাতীয় ঐতিহ্য গজিয়ে উঠেছে ও উঠছে, তার বীজ হচ্ছে ভাঁড় নামের অংশটি, গোপাল ভাঁড়ের ভাঁড়টুকু সংস্কৃত শব্দ ভাণ্ডারের ‘ভাণ্ড’-জাত মনে করে অনেক গোপালের জাতি নির্ণয় করেছেন।” সুকুমার সেনের মতে, গোপাল বলে হয়তো কেউ ছিলেন না, লোকমুখে সৃষ্ট হয়েছেন এই ‘গোপাল ভাঁড়’।
২৮০ বছর পর গোপাল ভাঁড় নিয়ে একটি সংবাদ!
deshinewsbd.com এ একটি খবর পাওয়া যায় ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসেই। এবারের কলকাতা বইমেলায় গোপাল ভাঁড় সংক্রান্ত একটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচনকে কেন্দ্র করেই নাকি ২৮০ বছর পর মুখোমুখি হলেন রাজা কৃষ্ণচন্দ্র ও গোপাল ভাঁড়ের বংশধরেরা! এখানে গোপাল ভাঁড়ের বংশধর বলতে মূলত নগেন্দ্রনাথ দাসের বংশধরদের কথাই বলা হয়েছে। তাই নগেন্দ্রনাথের তৈরিকৃত বংশলতিকা কিংবা তার নিজেকে গোপাল ভাঁড়ের আত্মীয় বলার বিষয়টি বিতর্কিত হয়, নিঃসন্দেহে এই সংবাদটিও খুব বিশ্বাসযোগ্য হবে না!
সে যাই হোক, এই বংশধরেরা রাজসভার মতোই নিয়ম করে বসেছিলেন এবং সেই কৃষ্ণচন্দ্রের রাজসভার মতো আবহাওয়া সৃষ্টি করাই তাদের ইচ্ছা ছিলো। কিন্তু সেই রাজাও নেই, নেই সেই তীক্ষ্ণবুদ্ধির গোপালও! আছেন যারা তারা শুধুই আজকের কর্পোরেট সমাজের একেকটি চরিত্র।
গোপাল ভাঁড়ের স্ত্রীর বুদ্ধিও দেখি গল্পগুলোয়!
শুধু কি গোপালই সব রসের উৎস ছিলেন তার গল্পে? তার স্ত্রীর চরিত্রটিও পার্শ্বরস যুগিয়েছে সবসময়ই। তিল থেকে তালের গল্পটি তো বেশ পরিচিতই।
একবার হয়েছে কী, গোপাল তিলের নাড়ু বানাবার জন্য এক হাঁড়ি তিল কিনে এনেছিলো। কোনো এক কারণে নাড়ু আর বানানো হয় নি, আর হাঁড়িটিও গেছে খোয়া। বকুনি থেকে বাঁচতে গোপালের স্ত্রী করলো কী, তিলের নাড়ুর বদলে তালের বড়া হাজির করলো গোপালের পাতে! গোপাল তো অবাক, “তিলের নাড়ু কই? এ তো দেখছি তালের বড়া!” প্রত্যুৎপন্নমতি তার স্ত্রী জবাব দিলো, “তিল থেকেই তো তাল হয় গো!”
আজকের দিনে গোপাল ভাঁড়
এটি খুবই আনন্দের কথা যে, লোকসাহিত্যের আরো অনেক চরিত্রের মতো গোপাল ভাঁড় হারিয়ে যান নি। এন্ড্রয়েড অ্যাপ হোক, কমিকস কিংবা টিভি সিরিয়াল- ছোট-বড় সবার বিনোদনের কোনো না কোনো জায়গায় গোপাল ভাঁড় এখনো সগৌরবেই বিরাজ করছেন। হয়তো এজন্যই তাকে চিরায়ত একটি চরিত্র মনে করা হয়।
‘গোপাল ভাঁড়’ শুধু একটি নাম নয়, একটি সময়ের প্রতিচ্ছবি। একটি নির্দিষ্ট সময়ে মানুষের জীবনযাপনকেও প্রতিফলিত করে তার গল্পগুলো। বাংলা সাহিত্যই বলি আর লোককাহিনীই বলি, গোপাল ভাঁড় এর একটি চিরায়ত ও অবিচ্ছেদ্য চরিত্র।