গ্রিক পুরাণের অফুরন্ত রত্নভান্ডার থেকে গল্প আহরণ করে পাশ্চাত্য দেশগুলো তাদের নিজেদের ভাষায়, নিজস্ব আঙ্গিকে পুনর্ব্যক্ত করে অসংখ্য বই লিখে পাঠকদের উপহার দিয়েছে। প্রাচ্যে বসবাসরত আমরাও কিন্তু গ্রিক ক্লাসিকের সাথে অল্পবিস্তর পরিচিত। জেনে-না জেনে বেশ কিছু প্রবাদ বা বাগধারা আমরাও ব্যবহার করে থাকি। এমনই একটি বহুল প্রচলিত প্রবাদ হলো ‘অ্যাকিলিস হিল’। কীভাবে এলো এই বাগধারাটি তা নিয়েই আমাদের আজকের আয়োজন।
গ্রিক পুরাণের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বীর অ্যাকিলিস। ট্রয় যুদ্ধের পটভূমিকায় রচিত হোমারের ‘ইলিয়াড’ মহাকাব্যের কেন্দ্রীয় চরিত্র অ্যাকিলিস সেই যুদ্ধের শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা হিসেবে সর্বজনবিদিত। বলা হয়, ট্রয়ের বিরুদ্ধে সম্মিলিত যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা যোদ্ধাবর্গের মধ্যে সবচেয়ে সুদর্শন ছিলেন অ্যাকিলিস। অপরাজেয় এই যোদ্ধার জীবনাবসানের কারণ হয়ে দাঁড়ায় তার গোড়ালি। শরীরের ছোট একটি অঙ্গকে ঘিরে সৃষ্ট জটিলতায় প্রাণ হারান অ্যাকিলিস আর অ্যাকিলিসের গোড়ালি পরিণত হয় প্রবাদ বাক্যে।
গ্রিক পুরাণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও বিচারের ভার ছিল থেমিসের ওপর। তবে থেমিস ছিলেন টাইটান, যে কারণে তিনি দেবীর মর্যাদা পাননি। কিন্তু দেবী না হয়েও সারাক্ষণ স্বর্গ, মর্ত্য, আকাশ আর বায়ুমণ্ডলের একচ্ছত্র অধিপতি, গ্রিকদের প্রধান দেবতা জিউসের ধারেকাছেই থাকতেন তিনি। থেমিসের পরামর্শেই জিউস পেলেউসের সাথে সাগরপরী থেটিসের বিয়ে দেন। তবে কেউ কেউ বলেন অন্যতম প্রধান ও স্মরণীয় টাইটান প্রমিথিউস নিজে জিউসকে জানিয়েছিলেন, থেটিস এমন এক সন্তানের জন্ম দেবে যে জ্ঞানে-গুণে তার বাবাকেও ছাড়িয়ে যাবে। তখন জিউস তার প্রতিদ্বন্দ্বী সাগর দেবতা পোসাইডনের সাথে বিরোধ ভুলে গিয়ে আয়োলকাসের রাজা পেলেউসের সাথে থেটিসের বিয়ে দেন। এই পেলেউস-থেটিসের ঘরেই জন্ম নেন মহাবীর অ্যাকিলিস।
পেলেউস এবং থেটিসের বিবাহে আমন্ত্রিত না হওয়ায় কলহদেবী এরিস ‘শ্রেষ্ঠ সুন্দরীর প্রাপ্য’ বাক্যখচিত স্বর্ণ আপেল বিবাহসভায় নিমন্ত্রিত তিন দেবী- হেরা, অ্যাথেনা এবং আফ্রোদিতির মাঝখানে ছুঁড়ে দিয়ে গ্রিক ও ট্রয়ের যুদ্ধের বীজ বপন করেন। অ্যাকিলিসের জন্মের পরে ভাগ্যদেবীরা থেটিসকে জানিয়েছিলেন, অ্যাকিলিস হয় নিরুপদ্রব দীর্ঘজীবন লাভ করবে আর নাহয় ট্রয়ের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে বীরের মতো মৃত্যুবরণ করবে। পুত্রস্নেহে কাতর থেটিস দ্বিতীয় সম্ভবনার ভয়ে রীতিমতো ভীত হয়ে পড়েন। ছেলেকে নিয়তির হাত থেকে বাঁচাতে কোনো চেষ্টাই বাকি রাখেননি তিনি। নিয়তি বদলানোর প্রথম প্রচেষ্টা হিসেবে ছোট্ট ছেলেকে নিয়ে তিনি ছুটে যান স্টিক্স নদীতে। অ্যাকিলিসকে আঘাতের অসাধ্য, চিরঞ্জীব বীরে পরিণত করার জন্য এই নদীকেই তিনি বেছে নেন আশ্রয়স্থল হিসেবে।
স্টিক্স হলো স্বর্গ আর মর্ত্যের মধ্য দিয়ে বয়ে চলা পবিত্র একটি নদী। এমনকি দেবতারাও এই নদীকে পবিত্র হিসেবে মানেন। এই নদীর পানি শরীরের যেখানে যেখানে স্পর্শ করানো হয়, সে জায়গাগুলোতে কোনো ব্যথা কিংবা জরা স্পর্শ করতে পারে না। থেটিস তার ছেলের সম্পূর্ণ শরীর এই নদীর পানিতে ডুবিয়ে দেন। ফলে অ্যাকিলিসের শরীরেও ব্যথা বা জরা স্পর্শ করতে পারেনি কোনোদিন। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল অ্যাকিলিসের গোড়ালি। কারণ পানিতে ডুবানোর সময় থেটিস অ্যাকিলিসের গোড়ালি ধরে রেখেছিলেন। কাজেই স্টিক্স নদীর জলে ভিজতে পারেনি অ্যাকিলিসের গোড়ালির টেনডন, যার কারণে তার গোড়ালির টেনডন আঘাতসাধ্য থেকে যায় আর সেটিই ছিল অ্যাকিলিসের একমাত্র দুর্বলতা। আর এই দুর্বলতার কারণেই মৃত্যু অ্যাকিলিসকে আলিঙ্গন করে নিষ্ঠুরভাবে।
অ্যাকিলিস যুদ্ধবিদ্যা শেখেন বিখ্যাত কাইরনের কাছ থেকে। ছোটবেলা থেকেই সাহস আর শক্তির সঙ্গে সঙ্গে অদম্য অহংকার আর ক্রোধাবেগ তার চরিত্রের সাথে ওতপ্রোতভাবে মিশে যায়। ভাগ্যদেবীদের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী ট্রয়ের যুদ্ধে অ্যাকিলিসের বীরের মৃত্যু বরণ করার সম্ভাবনা রয়েছে। কোন মা জেনে-শুনে তার ছেলেকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে পারে? তা সে যতই বীরের মতো হোক না কেন। কাজেই ট্রয়ের যুদ্ধ সমাগত হলে থেটিস অ্যাকিলিসকে স্কাইরসে পাঠিয়ে দেন এবং অ্যাকিলিসকে যেন কেউ খুঁজে না পায় সেজন্য থেটিস তাকে নারীর ছদ্মবেশ পরিয়ে দেন। কিন্তু অডিসিউস আর প্যালামিডিস কৌশলে অ্যাকিলিসকে খুঁজে বের করে ফেলেন। থেটিস বাধ্য হয়ে ছেলেকে যুদ্ধে পাঠান এবং হেফেস্টাস নির্মিত স্বর্গীয় অস্ত্র, বর্ম ও ঢাল পরিয়ে তাকে রণসাজে সজ্জিত করেন।
বীরত্বের মোহেই ট্রয়ের যুদ্ধে যোগ দেন অ্যাকিলিস। গ্রীস আর ট্রয়ের মধ্যে এই যুদ্ধের মূল কারণ ছিল ট্রয়ের রাজপুত্র প্যারিসের একটি হঠকারী সিদ্ধান্ত। আফ্রোদিতি তাকে বর দিয়েছিলেন, মর্ত্যের শ্রেষ্ঠ সুন্দরী হেলেনের সাথে তার প্রেম করিয়ে দেবেন। আফ্রোদিতি তার কথা রাখেন। কিন্তু গণ্ডগোল বাধে অন্য জায়গায়। এই হেলেন ছিলেন গ্রীকদের অন্যতম প্রধান রাজ্য স্পার্টার রাজা মেনেলাউসের স্ত্রী। সর্বনাশা রূপ তাকে গ্রিক ও রোমান পুরাণের সর্বাধিক আলোচিত নারী চরিত্রে পরিণত করে। হেলেনের প্রেমের টানে প্যারিস ছুটে যান স্পার্টায়। আতিথ্য গ্রহণ করেন মেনেলাউসের। তার স্ত্রীর সাথে প্রেম তো করেনই, পরে মেনেলাউসের অবর্তমানে হেলেনকে নিয়ে পালিয়েও আসেন। এই ঘটনার পটপরিক্রমায় গ্রীস ও ট্রয়ের মধ্যে শুরু হয় ভয়ংকর এক যুদ্ধ যা ইতিহাসে ট্রয়ের যুদ্ধ নামে পরিচিত। সে যুদ্ধে অসাধারণ বীরত্ব দেখান অ্যাকিলিস। ইতিহাসের পাতায় নিজের নাম সোনার অক্ষরে লিখিয়ে নেন তিনি। ট্রয়ের সেরা বীর হেক্টরকে মুখোমুখি লড়াইয়ে পরাস্ত করেন এই বীর যোদ্ধা।
হোমারের ইলিয়াড মহাকাব্য শুরু হয়েছে অ্যাকিলিসের প্রিয় দাসী ব্রিসেইসকে কেন্দ্র করে আগামেমনন আর অ্যাকিলিসের মধ্যকার বিরোধ এবং অ্যাকিলিসের ক্রোধ থেকে। আগামেমনন ব্রিসেইসকে নিয়ে যাওয়ায় অ্যাকিলিস ক্রুব্ধ হয়ে প্রতিজ্ঞা করেন যে, আগামেমনন স্বীয় কৃতকর্মের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা না করলে তিনি ট্রয় যুদ্ধে অংশগ্রহণ করবেন না। কিন্তু যুদ্ধে প্রিয় সহচর প্যাট্রোক্লাস নিহত হলে অ্যাকিলিস প্রতিজ্ঞা ভুলে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। ঘোরতর যুদ্ধে আমাজনীয় রানী পেন্থিসিলী আর ট্রয়ের শ্রেষ্ঠ বীর হেক্টরকে হত্যা করে ট্রোজান বাহিনীকে পর্যুদস্ত করেন তিনি। মৃত হেক্টরকে রথের পেছনে বেঁধে গোটা ট্রয় জুড়ে উন্মত্তের মতো ছুটে বেড়ান। অবশেষে মা থেটিসের অনুরোধে বৃদ্ধ ট্রয়রাজ প্রায়ামের নিকট হেক্টরের মৃতদেহ সমর্পণের মধ্য দিয়েই ইলিয়াডের পরিসমাপ্তি ঘটে।
যুদ্ধশেষে গ্রীকরা জয়ী হয় ঠিকই, কিন্তু জয়ের প্রাক্কালে প্রাণ হারান অ্যাকিলিস। মারা যান ঐ প্যারিসের হাতেই। যুদ্ধবিদ্যায় তেমন পারদর্শী না হলেও ধনুর্বিদ্যা ভালোই জানতেন প্যারিস। তার ছোঁড়া একটি বিষমাখা তীর এসে লাগে অ্যাকিলিসের ঠিক গোড়ালিতে, তার শরীরের যে জায়গাটিতে স্টিক্স নদীর পানি লাগেনি। ভিন্ন একটি মত অনুযায়ী, ট্রয় যুদ্ধ চলাকালে প্যারিসের বেশ নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হন স্বয়ং অ্যাপোলো। অ্যাপোলোর নিক্ষিপ্ত শর অ্যাকিলিসের টেনডনে বিদ্ধ হলে অ্যাকিলিস মৃত্যুবরণ করেন।
এভাবে প্রায় পুরো শরীর ব্যথা-জরামুক্ত হলেও শরীরের ছোট্ট একটি অংশের দুর্বলতা দিয়েই মৃত্যু অ্যাকিলিসের দেহে প্রবেশ করে। গ্রিক পুরাণের এই ঘটনা থেকেই পরবর্তীতে ইংরেজিসহ ইউরোপের অনেকগুলো ভাষাতে ‘অ্যাকিলিস হিল’ নামক একটি বাগধারা প্রচলিত হয় যার অর্থ দুর্বলতা বা দুর্বল স্থান। জানা যায়, ট্রয় যুদ্ধ চলাকালে অ্যাকিলিস তার মা থেটিসকে অনুরোধ করেন যেন একটিবারের জন্য হলেও তিনি হেলেনের সঙ্গে মিলিত হতে পারেন। যুদ্ধকালীন সময়ে এই অনুরোধ রক্ষা করা এক প্রকার দুঃসাধ্য ব্যাপার হলেও মা থেটিস অন্যভাবে পুত্রের আবদার মেটান। স্বপ্নের মধ্যে মিলিত হন অ্যাকিলিস আর হেলেন। এ কারণে গ্রিক পুরাণে হেলেনের পঞ্চস্বামীর মধ্যে অ্যাকিলিসকেও গণ্য করা হয়। তবে হেলেন নয়, লাইকোমেডিসের কন্যা ডাইডামিয়ার গর্ভে জন্মগ্রহণ করে অ্যাকিলিস পুত্র নিওপ্টলেমাস।
তথ্যসূত্রঃ প্রতীচ্য পুরাণ, ফরহাদ খান, (প্রতীক, ১৯৮৪), পৃষ্ঠা-৩৭-৩৮
ফিচার ইমেজ- banglatribune.com