“আরে, তোর মনে নেই, ছোটবেলায় আমরা রূপসা নদীতে কত ঘুরতাম!”, বন্ধু সাজিদকে খুব উৎসাহ নিয়ে কথাগুলো বলছিল বলছিল রাশেদ। “ধুর! কোন মান্ধাতার আমলের কথা। ওসব কী আর মনে থাকে?” পাত্তাই দিল না সাজিদ। দুই বন্ধুর পরস্পরকে পাত্তা দেয়া বা না দেয়া নিয়ে আমাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। কিন্তু কথা হলো পুরনো দিনের কথা বলতে গিয়ে রাশেদ কেন মান্ধাতার আমলের কথাটি উল্লেখ করলো? শুধু রাশেদই নয়, এই শব্দযুগল আমাদের অনেকেরই প্রাত্যহিক জীবনে বহুল ব্যবহৃত শব্দে পরিণত হয়েছে। প্রশ্ন আসতেই পারে, কে এই মান্ধাতা? কী এমন হয়েছিল তার আমলে যে তিনি এত বিখ্যাত হয়ে গেলেন? চলুন তবে জেনে আসা যাক মান্ধাতার আমলের বৃত্তান্ত।
মান্ধাতা এক রাজার নাম। তিনি ছিলেন সূর্য বংশের রাজা যুবনাশ্বের ছেলে। রামও এই সূর্য বংশেরই রাজা ছিলেন। মান্ধাতার জন্মের ইতিহাসটাও বেশ অবাক করা। তার বাবা যুবনাশ্বের কোনো ছেলে হচ্ছিল না। তখন তিনি একটি পুত্র সন্তান লাভের আশায় মুনীদের আশ্রমে গিয়ে যোগ সাধনা করতে শুরু করলেন। দিনের পর দিন নিষ্ঠার সাথে সাধনা করার পর এক সময় মুনীরা তার সাধনায় সন্তুষ্ট হলেন। যুবনাশ্বের পুত্র লাভের জন্য মুনীরা এক যজ্ঞ আরম্ভ করলেন। ভোরের দিকে শুরু হওয়া সেই যজ্ঞ শেষ হলো মধ্যরাতে। কলসি ভর্তি মন্ত্রপূত জল বেদীতে রেখে তারা গেলেন ঘুমাতে। যাওয়ার আগে নিজেরা নিজেরা বলাবলি করলেন, এই কলসির জল যুবনাশ্বের স্ত্রী খেলে তাদের ছেলে সন্তান হবে।
সে কথা অবশ্য যুবনাশ্ব জানতেন না। রাতে তার খুব তৃষ্ণা পেল। তখন তিনি নিজেই সেই কলসির পানি পান করে ফেললেন। সকালে ঘুম থেকে উঠে কলসিতে পানির পরিমাণ কমে যাওয়া দেখে অবাক হয়ে গেলেন তারা। যুবনাশ্বকে জিজ্ঞেস করতেই রাতের ঘটনা পুরোটা খুলে বললেন তিনি। সবটা শুনে মুচকি হেসে ফেললেন মুনীরা। বললেন, সন্তান তাহলে যুবনাশ্বের পেট থেকেই হবে। তবে তারা যুবনাশ্বকে গর্ভধারণের কষ্ট থেকে মুক্তি দিতে এক উপায় বের করলেন। একশ বছর পূর্ণ হলে যুবনাশ্বের পেটের বাম দিক বিদীর্ণ করে ভূমিষ্ঠ হলেন মান্ধাতা। পৌরাণিক এই ঘটনাটিকে কেন্দ্র করে বেশ কিছু গল্প লেখা হয়েছে, যেখানে যুবনাশ্বকে বলা হয়েছে ‘দ্য প্রেগনেন্ট কিং’। একই নামে দেবদূত পৌত্তনিকের একটি বইও আছে।
সে যা-ই হোক, ছেলে হয়ে যাওয়ার পরে এবার দেখা দিল আরেক সমস্যা। মান্ধাতাকে তো কোনো মা গর্ভে ধারণ করেনি। ফলে বুকের দুধ সে কোথায় পাবে? এখন বুকের দুধ ছাড়া মান্ধাতা বাঁচবেই বা কী করে? জটিল এই সমস্যার সমাধান দিতে এগিয়ে এলেন স্বয়ং ইন্দ্র। তিনি নিজে মান্ধাতাকে খাওয়ানোর দায়িত্ব নিলেন। তার মুখে নিজের তর্জনী পুরে দিয়ে বললেন, “মাম ধাস্যতি”, মানে আমাকে পান করো। সেখান থেকেই পুত্রটির নাম রাখা হয় মাম-ধাতা বা মান্ধাতা। ইন্দ্রের সেই আঙুল ছিল অমৃতক্ষরা। মানে সেই আঙুল দিয়ে অমৃত ঝরত। ইন্দ্রের সেই আঙুলের গুণে মান্ধাতা এক দিনেই দেহসৌষ্ঠবের দিক থেকে তারুণ্যে পদার্পণ করে। পড়াশোনা এবং অস্ত্রবিদ্যায় বেশ পারদর্শিতা অর্জন করে মান্ধাতা।
পরবর্তীতে বিন্দুমতীর সাথে বিয়ে হয় মান্ধাতার। চন্দ্রবংশীয় রাজকন্যা বিন্দুমতী ছিলেন শশবিন্দুর মেয়ে। মান্ধাতা-বিন্দুমতীর ঘর আলো করে জন্ম নেয় তিন পুত্র- পুরুকুৎসু, অম্বরীষ এবং মুচুকুন্দ। আর ছিল তাদের ৫০ মেয়ে। এই মেয়েদের তারা বিয়ে দিয়েছিলেন ঋষি সৌভরির সঙ্গে। যুবনাশ্বের মৃত্যুর পর রাজা হন মান্ধাতা। তিনি ছিলেন নিরামিষাশী। রাজা হিসেবেও ছিলেন বেশ ভালো। একবার তার রাজ্যে অনাবৃষ্টি দেখা দিয়েছিল। তখন তিনি মুনীদের কাছে এর কারণ জানতে চাইলেন। মুনীরা জানালেন, তার রাজ্যে এক শূদ্র তপস্যা করছেন। এমনিতেই ব্রাহ্মণ ছাড়া আর কারো তপস্যা করার নিয়ম নেই। তার উপর আবার সত্যযুগ চলছিল। সে যুগে পাপ-অনাচারের ফল হাতেনাতে মিলত। এই অধর্মের কারণেই মান্ধাতার রাজ্যে অনাবৃষ্টি হচ্ছিল বলে জানান মুনীরা। সেই শূদ্রকে হত্যা করলেই অনাবৃষ্টি দূর হবে বলে মতামত দিলেন তারা।
কিন্তু মান্ধাতা তাতে রাজি হলেন না। সৃষ্টিকর্তার তপস্যা করার কারণে জীবন কেড়ে নেয়ার কথাটি তার মনঃপুত হলো না। তবে রাজ্য থেকে অনাবৃষ্টি দূর করাও তো রাজার প্রধান একটি কাজ। আর কোনো উপায় খুঁজে বের করা যায় কিনা জানতে মুনীদের কাছে আবারও ধর্না দিলেন মান্ধাতা। তখন মুনীরা তাকে জানালেন, তাহলে রাজা মান্ধাতাকেই ভাদ্র মাসে শুক্লা একাদশী পালন করতে হবে। প্রজাদের মুখের দিকে তাকিয়ে খুশিমনেই রাজি হয়ে গেলেন তিনি। তারপর তার রাজ্যে বৃষ্টি হলো।
এরপর তিনি বের হলেন পৃথিবী বিজয়ে। যুদ্ধ করতে করতে মান্ধাতা প্রায় সারা বিশ্বই জয় করে ফেললেন। তিনি কেবল জিততে পারলেন না রাবণের সাথে। সুমেরু পর্বতে রাবণের সঙ্গে মান্ধাতার যুদ্ধ হলো। যুদ্ধে কেউই জিততে পারছিল না। যাকে বলে, একেবারে সমানে সমানে লড়াই, সেটাই চলছিল। শেষে তারা যুদ্ধ বাদ দিয়ে সন্ধি করলেন। আর সেই সন্ধির মধ্য দিয়ে রাবণের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপিত হলো মান্ধাতার। এরপর মান্ধাতা পাতাল ছেড়ে স্বর্গরাজ্য জয় করার অভিযানে বের হলেন। তখন দেবরাজ ইন্দ্র তাকে থামালেন। বললেন, তুমি তো এখনও পুরো পৃথিবী জয় করতে পারোনি। লবণাসুর এখনো তোমার অধীনতা স্বীকার করেননি। আগে তাকে পরাজিত করে এসো, তারপর না হয় স্বর্গ জয়ের কথা ভেবে দেখ।
এই লবণাসুর ছিলেন রাজা মধুর ছেলে। তিনি ছিলেন ব্রাহ্মণভক্ত। তার উপর সন্তুষ্ট হয়ে শব তাকে নিজের ত্রিশূলের একটি শূল দিয়েছিলেন। এই শূল শত্রুদের ভস্ম করে আবার মধুর হাতেই ফিরে আসতো। সাথে অবশ্য শিব এটাও বলে দিয়েছিলেন, দেবতা বা ব্রাহ্মণদের বিরোধিতা করলে এই শূলের কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যাবে। মধু আবার উপযাচক হয়ে আরেকটি বর চেয়ে নিয়েছিলেন। এই শূল যেন উত্তরাধিকার সূত্রে তার বংশের সবাই ব্যবহার করতে পারে, সেই অনুমতিও চেয়ে নেন মধু। শিব অবশ্য তাকে এতটা স্বাধীনতা দেননি। কেবল তার ছেলে লবণকে এই শূল ব্যবহারের অধিকার দেন শিব।
এই বাবা-ছেলের মধ্যে বাবা মধুর সঙ্গে লড়াই হয় রাবণের। আর ছেলে লবণের সাথে যুদ্ধ হয় মান্ধাতার। মধু-রাবণের যুদ্ধে জয়ী হয় রাবণ। তার হাতে মারা পড়েন মধু। কিন্তু মান্ধাতা লবণকে হারাতে পারেননি। উল্টো লবণের হাতে মারা পড়েন মান্ধাতা। পরবর্তীতে অবশ্য মান্ধাতারই বংশধর শত্রুঘ্ন লবণকে পরাজিত ও নিহত করেছিলেন। এই রাজা মান্ধাতা ছিলেন সত্যযুগের রাজা। একেকটা দৈবযুগকে যে চারটি ভাগে ভাগ করা হয় তার প্রথমটি ছিল এই সত্যযুগ। তারপর ত্রেতাযুগ, দ্বাপরযুগ পার হয়ে এখন চলছে কলিযুগ।
মানুষের বা পৃথিবীর বছরের হিসেবে একেকটা দৈবযুগের মেয়াদকাল ৪৩ লক্ষ ২০ হাজার বছর। এর মধ্যে প্রথম ১৭ লক্ষ ২৮ হাজার বছর হলো সত্যযুগ। তার পরের ১২ লক্ষ ৯৬ হাজার বছর জুড়ে চলে ত্রেতাযুগ। পরের ৮ লক্ষ ৬৪ হাজার বছর ব্যাপী বিরাজ করে দ্বাপরযুগ। আর শেষ ৪ লক্ষ ৩২ হাজার বছর ধরে চলছে, চলবে কলিযুগ। সব মিলিয়ে, এই রাজা মান্ধাতা কম করে হলেও এখন থেকে প্রায় ৩৫ লক্ষ বছর আগেরকার রাজা। অর্থাৎ, মান্ধাতার আমল মানে যে বহুদিনের পুরনো কিছুই হবে তা আর আলাদা করে বলাই বাহুল্য। এ কারণেই আমরা অনেক পুরনো কিছু বোঝাতে গিয়ে মান্ধাতার আমলের কথা উল্লেখ করি।
তথ্যসূত্র: অনুসূর্য নাবীল, ‘পৌরাণিক বাগধারা’, অবসর প্রকাশনী, ২০১৭, পৃষ্ঠা নং: ৩২-৩৪
ফিচার ইমেজ- lifeberrys.com