Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ: ভীষ্ম পর্বের সারসংক্ষেপ || পর্ব–৩

[২য় পর্ব পড়ুন]

যুদ্ধের চতুর্থ দিন: ভীমের তাণ্ডব, ঘটোৎকচের ইন্দ্রজাল এবং পাণ্ডবদের বিজয়

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের চতুর্থ দিনে ভীষ্ম ও অর্জুন যথারীতি তাদের নিজ নিজ সৈন্যদের সমন্বয়ে ব্যূহ গঠন করেন এবং উভয় পক্ষের মধ্যে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ আরম্ভ হয়ে যায়।

যুদ্ধের প্রথম পর্যায়েই ভীষ্ম অর্জুনের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন, এবং দ্রোণাচার্য, কৃপাচার্য, ভুরিশ্রবা, শল্য, দুর্যোধন ও বিবিংশতি ভীষ্মের সঙ্গে যোগ দেন। অভিমন্যু অর্জুনকে সহায়তা করার জন্য সেদিকে অগ্রসর হন। ভীষ্ম অভিমন্যুকে এড়িয়ে অর্জুনের বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন, এবং অশ্বত্থামা, ভুরিশ্রবা, শল্য ও সাম্যমানীর ছেলে একযোগে অভিমন্যুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন। অভিমন্যুর তীরের আঘাতে শল্যের রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো নিহত হয় এবং অশ্বত্থামা, ভুরিশ্রবা, শল্য ও সাম্যমানীর ছেলে সকলেই ক্ষতবিক্ষত হন। শেষ পর্যন্ত তারা চারজনই পশ্চাৎপসরণ করতে বাধ্য হন। অর্থাৎ, অভিমন্যু একাকী অশ্বত্থামা, ভুরিশ্রবা, শল্য ও সাম্যমানীর ছেলেকে একত্রে পরাজিত করেন।

এরপর দুর্যোধনের নির্দেশে হাজার হাজার কৌরব সৈন্য অর্জুন ও অভিমন্যুকে চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলে, কিন্তু ধৃষ্টদ্যুম্ন একটি বড় সৈন্যদল নিয়ে তাদেরকে সহায়তা করার জন্য অগ্রসর হন। ধৃষ্টদ্যুম্নের তীরে কৃপাচার্য ও শল্য বিদ্ধ হন, কৃতবর্মার রথের পার্শ্বনী নিহত হয় এবং রাজা পৌরবের ছেলে দমন নিহত হন। এরপর ধৃষ্টদ্যুম্ন সাম্যমানীর ছেলের সঙ্গে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন। শীঘ্রই ধৃষ্টদ্যুম্নের তীরের আঘাতে সাম্যমানীর ছেলের ধনুক কাটা পড়ে এবং তার রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো ও রথের দুই পার্শ্বনী নিহত হয়। তখন সাম্যমানীর ছেলে একটি ঢাল ও একটি তলোয়ার উঠিয়ে তার বিকল রথ থেকে নেমে পড়েন এবং ধৃষ্টদ্যুম্নের রথের দিকে ছুটে যান, কিন্তু তিনি কাছাকাছি পৌঁছানো মাত্র ধৃষ্টদ্যুম্ন গদা হাতে রথ থেকে নেমে পড়েন এবং গদার আঘাতে সাম্যমানীর ছেলের মাথা চূর্ণ করে দেন।

ধৃষ্টদ্যুম্নের হাতে সাম্যমানীর ছেলে নিহত হওয়ার পর শল্য তার বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন। একটি সংক্ষিপ্ত যুদ্ধের পর শল্যের তীরের আঘাতে ধৃষ্টদ্যুম্নের ধনুক কাটা পড়ে এবং তিনি নিজেও ক্ষতবিক্ষত হন। এসময় অভিমন্যু ধৃষ্টদ্যুম্নকে সহায়তা করার জন্য সেদিকে অগ্রসর হন এবং তার তীরের আঘাতে শল্য আহত হন। এটি দেখে দুর্যোধন ও তার আট ভাই শল্যকে সহায়তা করার জন্য অগ্রসর হন এবং তার রথের আশেপাশে অবস্থান নেন। তাদের ১০ জনের বিরুদ্ধে পাণ্ডব বাহিনীর ১০ শীর্ষ যোদ্ধা (ভীম, নকুল, সহদেব, অভিমন্যু, ধৃষ্টদ্যুম্ন ও উপপাণ্ডবগণ) অগ্রসর হয়ে একে অপরের ওপর তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করতে থাকেন। ধৃষ্টদ্যুম্ন দুর্যোধন ও তার ছয় ভাইয়ের বিরুদ্ধে, অভিমন্যু দুর্যোধনের দুই ভাই সত্যব্রত ও পুরুমিত্রের বিরুদ্ধে এবং নকুল ও সহদেব শল্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন।

মধ্যযুগীয় চিত্রকর্মে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ; Source: Medium

এ সময় ভীম ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে গদা হাতে নিয়ে দুর্যোধন ও তার ভাইদের দিকে রথে চড়ে অগ্রসর হন, এবং তার রুদ্রমূর্তি দেখে আতঙ্কিত হয়ে দুর্যোধনের ভাইরা পশ্চাৎপসরণ করেন। কিন্তু দুর্যোধন সেখানেই অবস্থান করতে থাকেন এবং তার নির্দেশে মগধের রাজা একটি বিরাট হস্তীবাহিনী নিয়ে ভীমের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। ভীম উক্ত সৈন্যদলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন এবং তার গদার আঘাতে বহুসংখ্যক হাতি নিহত হয়। এরপর ধৃষ্টদ্যুম্ন, নকুল, সহদেব, অভিমন্যু ও উপপাণ্ডবগণ ভীমকে সহায়তা করার জন্য অগ্রসর হন এবং মগধের সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন। মগধের রাজা একটি হাতিতে চড়ে অভিমন্যুর রথের দিকে অগ্রসর হন, কিন্তু অভিমন্যুর তীরের আঘাতে প্রথমে হাতিটির এবং পরে মগধের রাজার মৃত্যু ঘটে। ভীম তার গদার সাহায্যে উক্ত হস্তীবাহিনীর ধ্বংসসাধন অব্যাহত রাখেন এবং শেষ পর্যন্ত মগধের সৈন্যরা রণে ভঙ্গ দিয়ে পশ্চাৎপসরণ করে।

মগধের সৈন্যদের পরাজয়ের পর দুর্যোধনের নির্দেশে তার অধীনস্থ পুরো সৈন্যদল ভীমের ওপর আক্রমণ চালায়। কিন্তু ভীম তার গদার আঘাতে অসংখ্য কৌরব সৈন্যকে হত্যা করেন এবং ধৃষ্টদ্যুম্ন, নকুল, সহদেব, অভিমন্যু ও উপপাণ্ডবগণ ভীমকে সহায়তা করতে থাকেন। ভীমের ধ্বংসযজ্ঞ রোধ করার জন্য ভীষ্ম ভীমের দিকে অগ্রসর হন, কিন্তু তাকে রোধ করার জন্য সাত্যকি তার দিকে ছুটে যান। ভুরিশ্রবা সাত্যকির গতিরোধ করেন এবং তার বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন। দুর্যোধন ও তার ভাইয়েরা ভুরিশ্রবার সুরক্ষার জন্য তার রথের চারপাশে অবস্থান গ্রহণ করেন, এবং পাণ্ডবরা সাত্যকির সুরক্ষার জন্য তার রথের চারদিকে অবস্থান গ্রহণ করেন।

এ সময় ভীম দুর্যোধন ও তার ভাইদের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন এবং দুর্যোধনের বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন। একটি সংক্ষিপ্ত যুদ্ধের পর দুর্যোধনের তীরের আঘাতে ভীমের ধনুক কাটা পড়ে, কিন্তু ভীম আরেকটি ধনুক উঠিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকেন এবং তার তীরের আঘাতে দুর্যোধনের ধনুক কাটা পড়ে। তখন দুর্যোধন আরেকটি ধনুক উঠিয়ে ভীমের দিকে একটি বিশেষ তীর নিক্ষেপ করেন এবং উক্ত তীরের আঘাতে ভীম কিছুক্ষণের জন্য সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেন। ভীমের অবস্থা দেখে অভিমন্যু ক্ষিপ্ত হন এবং দুর্যোধন ও তার ভাইদের ওপর তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন। অবশ্য ভীম শীঘ্রই সংজ্ঞা ফিরে পান এবং শল্যের বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন। ভীমের তীরের আঘাতে শল্য আহত হন এবং সেখান থেকে পশ্চাৎপসরণ করেন। অর্থাৎ, ভীমের কাছে শল্য পরাজিত হন।

এরপর দুর্যোধনের ১৪ জন ভাই (সেনাপতি, সুসেন, জলাসন্ধ, সুলোচন, উগ্র, ভীমরথ, ভীম, বীরবাহু, অলুপ, দুর্মুখ, দুষ্প্রদর্শ, বিবিৎসু, বিকট ও সাম) একযোগে ভীমকে আক্রমণ করেন এবং ভীমের ওপর তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন। কিন্তু শীঘ্রই ভীমের তীরের আঘাতে সেনাপতি, জলাসন্ধ, সুসেন, উগ্র, বীরবাহু, ভীম, ভীমরথ ও সুলোচন নিহত হন, এবং দুর্যোধনের বাকি ছয় ভাই আতঙ্কিত হয়ে সেখান থেকে পশ্চাৎপসরণ করেন। (উল্লেখ্য, টেলিভিশনে প্রচারিত সিরিয়ালগুলোতে দেখানো হয় যে, ভীষ্মের সেনাপতিত্বের সময় দুর্যোধনের কোনো ভাই নিহত হয়নি, কিন্তু এর সঙ্গে মহাভারতের বর্ণনার সাদৃশ্য নেই। আরেকটি উল্লেখ্য বিষয় হচ্ছে, দুর্যোধনের এক ভাইয়েরও নাম ছিল ভীম, যিনি যুদ্ধের চতুর্থ দিনে পাণ্ডব ভীমের হাতে নিহত হন)

চিত্রকর্মে ভীমের হাতে দুর্যোধনের ভাইদের নিহত হওয়ার দৃশ্য; Source: Ramanarayanadatta Shastri/Wikimedia Commons

ভীমের হাতে দুর্যোধনের আট ভাই নিহত হওয়ার পর ভীষ্ম তার অধীনস্থ সকল সৈন্যকে ভীমের বিরুদ্ধে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দেন এবং তার সৈন্যরা ভীমের দিকে ধাবিত হয়। প্রাগজ্যোতিষের রাজা ভগদত্ত তার অতিকায় হাতিতে চড়ে ভীমের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন এবং ভীমের ওপর তীরবর্ষণ করেন। পাণ্ডব বাহিনীর শীর্ষ যোদ্ধারা ভীমকে সহায়তা করার উদ্দেশ্যে ভগদত্তকে আক্রমণ করেন এবং তার ও তার হাতির ওপর তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন। কিন্তু ভগদত্তের হাতিটি তীরবিদ্ধ হওয়ার পর দ্বিগুণ গতিতে ভীমের দিকে অগ্রসর হতে থাকে এবং এটি দেখে পাণ্ডব সৈন্যদের মধ্যে আতঙ্কের সঞ্চার হয়। এরপর ভগদত্ত ভীমকে লক্ষ্য করে একটি বিশেষ তীর নিক্ষেপ করেন এবং সেটির আঘাতে ভীম সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেন। অর্থাৎ, ভগদত্তের নিকট ভীম পরাজিত হন।

ভগদত্তের কাছে ভীমের পরাজয়ের পর ভীমের ছেলে রাক্ষস ঘটোৎকচ ক্ষিপ্ত হয়ে ভগদত্তের দিকে অগ্রসর হন। তিনি ইন্দ্রজালের সাহায্যে চারটি অতিকায় হাতির সৃষ্টি করেন এবং এগুলোর একটির ওপর তিনি এবং বাকি তিনটির ওপর অন্য তিন রাক্ষস আরোহণ করে। এরপর তারা সম্মিলিতভাবে ভগদত্তের ওপর আক্রমণ চালায় এবং তাদের হাতিগুলো ভগদত্তের হাতিকে আক্রমণ করে। ভগদত্ত ক্ষিপ্ত হয়ে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন, কিন্তু ভীষ্ম আশঙ্কা করতে থাকেন যে, ঘটোৎকচ ও রাক্ষসদের হাতে ভগদত্ত নিহত হবেন। এজন্য তিনি দ্রোণাচার্যকে ভগদত্তের সহায়তার জন্য অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দেন এবং দ্রোণাচার্য তার অধীনস্থ সৈন্যদল নিয়ে সেদিকে অগ্রসর হন।

কিন্তু ঘটোৎকচের ইন্দ্রজাল দেখে ভীষ্ম তার মত পরিবর্তন করেন এবং দ্রোণাচার্যকে থামার নির্দেশ দেন। তখন সূর্যাস্তের সময় হয়ে এসেছিল। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ভীষ্ম সেদিনের মতো যুদ্ধ সমাপ্ত করেন এবং কৌরব বাহিনীকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে প্রত্যাহার করে নিতে শুরু করেন। সেদিনের যুদ্ধে পাণ্ডবদের তুলনায় কৌরবদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল বহুগুণ বেশি, সুতরাং কৌরবদের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের চতুর্থ দিনের অবসান ঘটে।

চিত্রকর্মে ঘটোৎকচ ও তার রথ; Source: Ramanarayanadatta Shastri/Wikimedia Commons

যুদ্ধের চতুর্থ দিনের অবসানের পর কৌরব বাহিনীর পরিস্থিতি ছিল হতাশাব্যঞ্জক। ঘটোৎকচের ইন্দ্রজাল কৌরব সৈন্যদের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি করেছিল, এবং নিজের আট ভাইয়ের মৃত্যুতে দুর্যোধন শোকগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। ভীষ্ম দুর্যোধনকে সান্ত্বনা প্রদান করেন, কিন্তু সেই সঙ্গে তাকে এই বলে সতর্ক করে দেন যে, কৃষ্ণের বিরোধিতা করতে থাকলে তার ধ্বংস অনিবার্য। দুর্যোধন এই প্রসঙ্গে কোনো মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকেন, কিন্তু তিনি যুদ্ধ করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন এবং যুদ্ধক্ষেত্রে ভাইদের মৃত্যু তার সংকল্পকে আরো কঠোর করে তোলে।

যুদ্ধের পঞ্চম দিন: বিভ্রান্তিকর সংঘাত এবং ফলাফলবিহীন পরিসমাপ্তি

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পঞ্চম দিনে ভীষ্ম কৌরব সৈন্যদেরকে নিয়ে ‘মকরব্যূহ’ গঠন করেন, অর্থাৎ কৌরব বাহিনীকে একটি মকর/কুমিরের আকারে সজ্জিত করেন। একে প্রতিহত করার জন্য পাণ্ডবরা নিজেদের সৈন্যদের নিয়ে ‘শ্যেনব্যূহ’ গঠন করেন, অর্থাৎ পাণ্ডব বাহিনীকে একটি শ্যেন/বাজপাখির আকারে সজ্জিত করেন।

যুদ্ধের শুরুতেই ভীম কৌরবদের ব্যূহে প্রবেশ করেন এবং দূর থেকে ব্যূহের সর্বাগ্রে থাকা ভীষ্মের ওপর তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন। ভীষ্মের তীরের আঘাতে বহুসংখ্যক পাণ্ডব সৈন্য নিহত হয়, এবং এটি দেখে অর্জুন ভীষ্মের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। তিনি ভীষ্মকে তীরবিদ্ধ করেন এবং ভীষ্মের অস্ত্রগুলোকে প্রতিহত করেন। দুর্যোধনের নির্দেশে দ্রোণাচার্য পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন, কিন্তু সাত্যকি তার গতিরোধ করেন এবং তার বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন। ভীম সাত্যকিকে সহায়তা করার জন্য অগ্রসর হন এবং দ্রোণাচার্যের ওপর তীর নিক্ষেপ করেন। প্রত্যুত্তরে ভীষ্ম, দ্রোণাচার্য ও শল্য ভীমের ওপর তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন, এবং অভিমন্যু, শিখণ্ডী ও উপপাণ্ডবগণ ভীমকে সহায়তা করার জন্য তাদের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। শিখণ্ডীকে দেখেই ভীষ্ম তাকে এড়িয়ে যান।

শিখণ্ডীর কাহিনী ছিল সংক্ষেপে এরকম: অতীতে ভীষ্ম তার ভাই ও কুরু রাজ্যের রাজা বিচিত্রবীর্যের জন্য কাশী রাজ্যের তিন রাজকন্যা অম্বা, অম্বিকা ও অম্বালিকাকে তাদের স্বয়ংবর সভা থেকে হরণ করে এনেছিলেন। অম্বিকা ও অম্বালিকা বিচিত্রবীর্যকে বিয়ে করতে সম্মত হন, কিন্তু অম্বা তাতে অস্বীকৃতি জানান। তিনি রাজা শাল্বকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন, এবং এটি জানার পর তাকে শাল্বের কাছে যেতে দেয়া হয়। কিন্তু স্বয়ংবর সভায় ভীষ্মের কাছে পরাজিত হয়ে শাল্ব খুবই ক্ষিপ্ত ছিলেন এবং তিনি অম্বাকে গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানান। এরপর অম্বা ভীষ্মের গুরু মহর্ষি পরশুরামের কাছে শরণ নেন এবং পরশুরাম ভীষ্মকে ডেকে অম্বাকে বিয়ে করার নির্দেশ দেন। কিন্তু ভীষ্মের প্রতিজ্ঞার কারণে তার পক্ষে অম্বাকে বিয়ে করা সম্ভব ছিল না। এরপর পরশুরাম ভীষ্মের বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন, কিন্তু প্রচণ্ড যুদ্ধের পর পরশুরাম পরাজিত হন। এরপর অম্বা আগুনে আত্মাহুতি দেন এবং পরবর্তী জন্মে শিখণ্ডী হিসেবে জন্ম নেন।

চিত্রকর্মে ভীষ্ম কর্তৃক কাশীর তিন রাজকন্যাকে হরণের দৃশ্য; Source: Ramanarayanadatta Shastri/Wikimedia Commons

মহাভারতে প্রদত্ত বিবরণ অনুসারে, শিখণ্ডী ছিলেন পুরুষ, কিন্তু তার প্রজননতন্ত্র ছিল নারীর। পরবর্তীতে এক যক্ষ তাকে পুরুষের প্রজননতন্ত্র প্রদান করেন। সুতরাং কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ চলাকালে শিখণ্ডী ছিলেন পুরুষ এবং তার ছেলেও এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। কিন্তু ভীষ্ম শিখণ্ডীর পূর্বজন্মের ঘটনাবলি জানতেন। এজন্য তিনি শিখণ্ডীকে নারী হিসেবেই বিবেচনা করতেন এবং যুদ্ধ শুরুর আগেই তিনি দুর্যোধনকে জানিয়েছিলেন যে, তিনি শিখণ্ডীর বিরুদ্ধে অস্ত্র প্রয়োগ করবেন না। এজন্য যুদ্ধের পঞ্চম দিনে শিখণ্ডীকে দেখেই ভীষ্ম তাকে এড়িয়ে অন্যত্র চলে যান।

এরপর উভয় পক্ষের মধ্যে প্রচণ্ড যুদ্ধ শুরু হয়। ভীষ্মের তীরের আঘাতে বহুসংখ্যক পাণ্ডব সৈন্য নিহত হয়, এবং অর্জুনের তীরের আঘাতে বহুসংখ্যক কৌরব সৈন্য নিহত হয়। এরপর উভয় পক্ষের শীর্ষ যোদ্ধারা একে অপরের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন এবং দূর থেকে যুদ্ধে লিপ্ত হন। ভীষ্ম অর্জুনের বিরুদ্ধে, দ্রোণাচার্য ও অশ্বত্থামা সাত্যকি, দ্রুপদ ও চেকিতনের বিরুদ্ধে, জয়দ্রথ ভীমের বিরুদ্ধে, শল্য যুধিষ্ঠির ও তার ছেলে প্রতিবিন্ধ্যের বিরুদ্ধে, দুর্যোধন ও শকুনি বিরাটের বিরুদ্ধে, বিকর্ণ সহদেবের বিরুদ্ধে, দুর্যোধনের ভাই চিত্রসেন শিখণ্ডীর বিরুদ্ধে এবং অবন্তীর রাজা কাশীর রাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়েন, কিন্তু এই যুদ্ধগুলো ছিল বিভ্রান্তিকর এবং এগুলোর চূড়ান্ত কোনো ফলাফল ছিল না। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখা যায় যে, ভীষ্ম বিরাটের বিরুদ্ধে, দ্রোণাচার্য, কৃপাচার্য, বিকর্ণ, জয়দ্রথ ও আরো বহুসংখ্যক রাজা অর্জুনের বিরুদ্ধে, দুর্যোধন ও তার ভাই দুঃসহ ভীমের বিরুদ্ধে এবং শকুনি ও তার ছেলে উলুক সহদেবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছেন। কিন্তু শীঘ্রই যুদ্ধের পরিস্থিতি আরো বিভ্রান্তিকর হয়ে ওঠে এবং যুদ্ধ আরো তীব্র রূপ ধারণ করে।

সেদিন দুপুরে ভীষ্ম ভীমের বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন, কিন্তু তাদের মধ্যে একটি সংক্ষিপ্ত যুদ্ধের পরেই ভীষ্মের তীরের আঘাতে ভীমের ধনুক কাটা পড়ে। সাত্যকি ভীমকে সহায়তা করার জন্য অগ্রসর হন এবং ভীষ্মকে আক্রমণ করেন, কিন্তু ভীষ্মের তীরের আঘাতে সাত্যকির রথের সারথি নিহত হন এবং সাত্যকির রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে রথটিকে সেখান থেকে দূরে টেনে নিয়ে যায়। অর্থাৎ, ভীষ্মের কাছে ভীম ও সাত্যকি উভয়েই পরাজিত হন। এরপর ভীষ্ম পাণ্ডব সৈন্যদের ওপর তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করতে থাকেন এবং তার তীরের আঘাতে পাণ্ডব বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত পাঞ্চাল ও সোমক রাজ্যের বহুসংখ্যক সৈন্য নিহত হয়। এমতাবস্থায় ধৃষ্টদ্যুম্নের নেতৃত্বে পাণ্ডব সৈন্যরা ভীষ্মের সৈন্যদলের দিকে অগ্রসর হয় এবং উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধের মাত্রা আরো তীব্র হয়ে ওঠে।

এই পর্যায়ে এসে বিরাট ভীষ্মের বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন। অশ্বত্থামা ও অর্জুনের মধ্যে একটি তিক্ত দ্বৈরথ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। অর্জুনের তীরে অশ্বত্থামার ধনুক কাটা পড়ে এবং অশ্বত্থামা নিজেও ক্ষতবিক্ষত হন, কিন্তু তিনি অর্জুনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে থাকেন এবং শেষ পর্যন্ত অর্জুন নিজেই অশ্বত্থামাকে এড়িয়ে কৌরব সৈন্যদের হত্যা করতে শুরু করেন। দুর্যোধন ও ভীম অনুরূপভাবে একটি তিক্ত দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন এবং একে অপরকে তীরের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করতে থাকেন। অভিমন্যুর নিকট দুর্যোধনের ভাই চিত্রসেন, পুরুমিত্র ও সত্যব্রত পরাজিত হন এবং এরপর অভিমন্যুর তীরের আঘাতে বহুসংখ্যক কৌরব সৈন্য নিহত হয়। লক্ষ্মণ অভিমন্যুর বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন, কিন্তু একটি সংক্ষিপ্ত যুদ্ধের পর অভিমন্যুর তীরের আঘাতে লক্ষ্মণের রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো ও রথের সারথি নিহত হয়, এবং এরপর কৃপাচার্য লক্ষ্মণকে নিজের রথে তুলে সেখান থেকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেন।

যুদ্ধের পঞ্চম দিনে উভয় পক্ষেরই বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়; Source: IndiaFacts

এরপর ভীষ্ম পাণ্ডব বাহিনীর বিরুদ্ধে দিব্যাস্ত্র প্রয়োগ করেন। এর ফলে পাণ্ডব বাহিনীর অসংখ্য রথী, অশ্বারোহী ও পদাতিক সৈন্য এবং হাতি নিহত হয়, এবং শীঘ্রই যুদ্ধক্ষেত্র লাশে পরিপূর্ণ হয়ে যায়। যুদ্ধক্ষেত্রের আরেক প্রান্তে সাত্যকি কৌরব বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন এবং তার তীরের আঘাতে বহুসংখ্যক কৌরব সৈন্য নিহত হয়। এমতাবস্থায় দুর্যোধনের নির্দেশে ১০,০০০ রথী সাত্যকির ওপর আক্রমণ চালায়, কিন্তু সাত্যকি তাদের বিরুদ্ধে দিব্যাস্ত্র প্রয়োগ করেন এবং তাদের সকলেই সাত্যকির হাতে নিহত হয়।

দুর্যোধনের প্রেরিত রথীদের হত্যা করার পর সাত্যকি ভুরিশ্রবার দিকে অগ্রসর হন এবং তাকে দেখে ভুরিশ্রবাও তার দিকে ছুটে আসেন। ভুরিশ্রবার তীরের আঘাতে সাত্যকির সৈন্যদলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় এবং তারা সাত্যকিকে রেখে পশ্চাৎপসরণ করে। এটি দেখে সাত্যকির দশ ছেলে একত্রে ভুরিশ্রবাকে আক্রমণ করেন, কিন্তু শীঘ্রই ভুরিশ্রবার তীরের আঘাতে তাদের সকলেই নিহত হন। নিজের ছেলেদের নিহত হতে দেখে সাত্যকি ক্রোধান্বিত হয়ে ভুরিশ্রবার বিরুদ্ধে অগ্রসর হন এবং তার বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন। তাদের রথ দুইটি পরস্পরের এত কাছে চলে এসেছিল যে, সেগুলো একে অপরের সঙ্গে ধাক্কা খাচ্ছিল। এমতাবস্থায় সাত্যকির তীরের আঘাতে ভুরিশ্রবার রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো ও ভুরিশ্রবার তীরের আঘাতে সাত্যকির রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো নিহত হয়, এবং এরপর উভয়েই তলোয়ার হাতে তাদের বিকল রথ থেকে নেমে একে অপরের বিরুদ্ধে তলোয়ার‍যুদ্ধে লিপ্ত হন। অবশেষে ভীম এসে সাত্যকিকে নিজের রথে তুলে নেন এবং সেখান থেকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেন। অনুরূপভাবে, দুর্যোধন এসে ভুরিশ্রবাকে নিজের রথে তুলে নেন।

এসময় ভীষ্মের তীরের আঘাতে বহুসংখ্যক পাণ্ডব সৈন্য এবং অর্জুনের তীরের আঘাতে বহুসংখ্যক কৌরব সৈন্য নিহত হয়। দুর্যোধনের নির্দেশে ২৫,০০০ রথী অর্জুনকে আক্রমণ করে, কিন্তু অর্জুনের তীরবৃষ্টির নিকট তারা পরাজিত হয় এবং পাণ্ডব বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত মৎস্য ও কৈকেয়া রাজ্যের সৈন্যরা অর্জুনের সুরক্ষার জন্য তাকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে। এই পরিস্থিতিতে সূর্যাস্ত হয় এবং অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছিল যে, উভয় পক্ষের সৈন্যরাই যেন সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলছে। সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে উভয় পক্ষ যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নিতে শুরু করে। এই দিনে উভয় পক্ষেরই প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়, এবং যুদ্ধ শেষে উভয় পক্ষের সৈন্যরাই আতঙ্কিত ও উদ্বিগ্ন ছিল। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পঞ্চম দিনে কার্যত কোনো পক্ষই বিজয়ী হতে পারেনি।

Related Articles