মধ্যযুগীয় পুরাণের অন্যতম জনপ্রিয় এবং পরিচিত চরিত্র উইলিয়াম টেল। সুইজারল্যান্ডের মানুষের কাছে তিনি জাতীয় বীর হিসেবেই পরিচিত, তাদের ধারণা- স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে সুইজারল্যান্ডের অভ্যুদয়ের পেছনে রয়েছে তার বলিষ্ঠ ভূমিকা। উইলিয়াম টেলকে নিয়ে কবিতা আর গান বেধেছেন বহু শিল্পী। তবে সত্যিকারেই এই নামে কেউ ছিলেন কিনা তা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে যথেষ্ট সন্দেহ আছে, তবে তাতে সাধারণ মানুষের কিছু যায়-আসে না।
ঠিক কবে থেকে উইলিয়াম টেলের কাহিনীর শুরু তা নিয়ে বিতর্ক আছে। তবে অধিকাংশই মনে করেন- ১৪৮২ সালে মেলচিওর রাস নামে এক গল্পকার প্রথমে তার অবতারণা করেন। ১৭৩৪-৩৬ সালে সুইস ঐতিহাসিক গিল্গ শুডি (Gilg Tschudi) তার এক গ্রন্থে (Chronicon Helveticum) উইলিয়াম টেলের ঘটনা সাজিয়ে তুলে ধরেন। তিনি টেলকে ঐতিহাসিক চরিত্র বলে উল্লেখ করে তার কাহিনী ১৩০৭ সালের বলে উল্লেখ করেন।
উইলিয়াম টেলের গল্প
একসময় সুইজারল্যান্ড বলে আলাদা কোনো রাষ্ট্র ছিল না। পার্শ্ববর্তী বড় শক্তিগুলো তাদের নিয়ন্ত্রণ করত। এমনই এক শক্তি ছিল হাবসবুর্গ শাসিত অস্ট্রিয়া। তাদের হাতে সুইজারল্যান্ড তিনটি প্রধান প্রশাসনিক অঞ্চল বা ক্যান্টনে ভাগ হয়ে শাসিত হতো- উরি, সোয়েইজ আর উন্টারওয়াল্ডেন।
যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে তখন অস্ট্রিয়ানদের পক্ষ থেকে সুইজারল্যান্ড শাসন করতেন অ্যালব্রেখট গেস্লার নামে এক ব্যক্তি। তার কেন্দ্র ছিল উরির অ্যাল্টডর্ফে। দাম্ভিক আর অত্যাচারী গেস্লার সুইসদের মানুষই মনে করতেন না। শহরের প্রধান চত্বরে বড় এক খুঁটির মাথায় তিনি নিজের মাথার টুপি ঝুলিয়ে দেন। নির্দেশ ছিল- শহরে প্রবেশ করার পর প্রত্যেক সুইসকে টুপির সামনে মাথা নত করে কুর্নিশ করতে হবে।
একদিন পাহাড়ি এলাকা থেকে নেমে এলেন এক সুইস, উইলিয়াম টেল তার নাম। তীরন্দাজি আর নৌকা চালনায় তার দক্ষতার জন্য সুবিদিত ছিলেন তিনি। অনেকে বলত তিনি নাকি গেস্লারকে উৎখাত করতে বিদ্রোহীদের সাথে জড়িত ছিলেন। যা-ই হোক না কেন, উইলিয়াম টেল গেস্লারের টুপির সামনে মাথা নত করতে অস্বীকৃতি জানালেন।
গেস্লারের কানে এ কথা পৌঁছতে তিনি তো ক্ষেপে আগুন। অস্ট্রিয়ান শাসক বুঝতে পারলেন টেলকে উপযুক্ত শাস্তি দেয়া না হলে খুব শীঘ্রই লোকে তাকে উপহাস করা শুরু করবে, ফলে ক্ষমতার লাগাম আলগা হয়ে যাবে। তীরন্দাজ হিসেবে টেলের খুব নাম ছিল, তাই গেস্লার ফন্দি আঁটলেন। পাইক-পেয়াদা পাঠিয়ে ধরে আনলেন টেল আর তার ছেলেকে, ঘোষণা দিলেন- ছেলের মাথার আপেল তীর নিক্ষেপ করে ফেলতে পারলেই কেবল মুক্তি মিলবে তার।
নির্দিষ্ট দিনে টেলের ছেলেকে আপেল মাথায় নিয়ে শহরের চত্বরে দাঁড় করিয়ে দেয়া হলো। গেস্লার জানিয়ে দিলেন- একটিমাত্র তীর মারার সুযোগ পাবেন তিনি, সফল না হলে মৃত্যু নিশ্চিত দুজনেরই। উইলিয়াম টেল কয়েকবার গেস্লারকে অনুরোধ করলেন নিষ্ঠুর এই খেলা না খেলতে, তবে গেস্লার তার কথায় কান দিলেন না। ফলে ক্রসবো তাক করে তীর ছুড়লেন তিনি, উড়িয়ে দিলেন ছেলের মাথার আপেল।
গেস্লার তার কথামতো টেল আর তার ছেলেকে চলে যেতে দেন। তারা যখন বিদায় নিচ্ছিলেন, তখন টেলের পোশাকের আড়াল থেকে খসে পড়লো একটি তীর। গেস্লার কৌতূহলী হয়ে উঠলেন, দ্বিতীয় তীরটির উদ্দেশ্য কী? টেল অকপটে জবাব দিলেন- যদি তিনি প্রথম তীরে দুর্ঘটনাক্রমে ছেলেকে হত্যা করে ফেলতেন, তখন দ্বিতীয় তীরটি ব্যবহার করতেন গেস্লারের উপর।
আর যায় কোথায়! গেস্লার তো রেগে আগুন! তৎক্ষণাৎ টেলকে গ্রেফতার করা হলো। শৃঙ্খলিত করে তাকে তুলে দেয়া হলো এক নৌকায়, উদ্দেশ্য কুশনাখট (Küssnacht) দুর্গের কারাগারে নিয়ে যাওয়া। লেক লুসার্নে নৌকা চলতে চলতে হঠাৎ প্রচণ্ড ঝড় শুরু হয়। দক্ষ মাঝি হিসেবেও লোকমুখে টেলের সুনাম ছিল, তাই বাঁচার জন্য প্রহরীরা তাকে মুক্ত করে দেয়।
সুযোগ দু’হাতে লুফে নিলেন টেল। দ্রুত নৌকা চালিয়ে তীরে উঠিয়ে দিলেন তিনি। রক্ষীরা যখন এদিক-সেদিক ছিটকে পড়ল তখন টেল তার ধনুক নিয়ে কেটে পড়লেন। যেখানে তিনি নৌকা তীরে উঠিয়ে দেন, সেই জায়গা পরে পরিচিত হয় ‘টেলসপ্লাট’ (Tellsplatte/ Tell’s ledge) নামে।
গেস্লার নিজেও তখন কুশনাখট দুর্গের পথে। তার আবির্ভাবের অপেক্ষায় টেল রাস্তায় এক গাছের আড়ালে লুকিয়ে বসে রইলেন। গেস্লারকে দেখা মাত্রই তীর ছুড়ে তাকে হত্যা করলেন তিনি।
বলা হয়, এরপর টেল তিন ক্যান্টনের প্রধান সুইস ব্যক্তিদের সাথে দেখা করে অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরুর অনুরোধ করেন। রুটলি বনে তারা সবাই স্বাধীনতার শপথ নেন (oath of Rütli), যদিও গবেষকদের বড় একটা অংশ একে লোককথা বলেই মনে করেন। লোকমুখে জানা যায়, এই শপথের সময় ১৩০৭ সাল। এর মধ্য দিয়েই নাকি স্বাধীন সুইজারল্যান্ডের ভিত্তি রচিত হয়, প্রতিষ্ঠিত হয় সুইস কনফেডারেসি।
জনশ্রুতি আছে, অস্ট্রিয়ানদের তাড়িয়ে দেবার পর জনগণ টেলকে রাজা হবার অনুরোধ জানায়, কিন্তু বিনয়ের সাথে সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন তিনি। ফিরে যান পাহাড়ের উপর নিজের নিরিবিলি আবাসে।
ইতিহাস নাকি উপকথা মাত্র
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, অনেক মধ্যযুগীয় লেখক উইলিয়াম টেলের গল্প বর্ণনা করেছেন বটে, কিন্তু তাদের ঘটনার পাত্র ঠিক থাকলেও স্থান-কালের মধ্যে বিশাল ফারাক। আগেই বলা হয়েছে, উইলিয়াম টেলের চরিত্র প্রথম পাওয়া যায় ১৪৮২ সালের এক গল্পে, যেখানে তার ঘটনার কাল বর্ণনা করা হয়েছে ১২৯৬। সেই হিসেবে টেলের কীর্তির পর পার হয়ে গেছে প্রায় ১৮৬ বছর। সত্যিই যদি ঐতিহাসিক চরিত্র হয়ে থাকেন তিনি, তাহলে এই দীর্ঘ সময়ে একটিবারের মতো কেন অন্য কেউ তার কথা বললেন না? গেস্লারের মতো একজন শাসকের কোনো উল্লেখও কোনো রেকর্ডপত্রে নেই?
শুডিই প্রথমে টেলের পুরো গল্প বিবৃত করেন, তা-ও ১৫৬৯-৭০ সালে। এখানেই প্রথম তিনি ঘটনার কাল ১৩০৭ বলে জানান, যদিও পূর্ববর্তী গল্পে টেলকে আরো প্রাচীন হিসেবে বলা হয়েছে। মনে করা হয়, রুটলির বনের কিংবদন্তীর শপথের সাথে সমসাময়িক করতে এই কাজ করেন তিনি। মূল উদ্দেশ্য ছিল সুইজারল্যান্ডের স্বাধীনতার প্রতীক হিসেবে একজন নায়ককে দাঁড়া করানো। যদিও এই রুটলির শপথ কতটা ঐতিহাসিক তা নিয়েও প্রচুর বিতর্ক আছে। বলা হয়, ১৭৫৮ সালে রুটলির শপথের একটি কপি প্রকাশ্যে আনা হয়েছিল, যদিও কেউ এর সত্যতা প্রতিপাদন করতে সক্ষম হননি। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই কাগজে স্বাক্ষরকারীদের মাঝে উইলিয়াম টেল নামে কারো উল্লেখ ছিল না।
টেলের প্রসঙ্গে গবেষণা করতে অনেকেই রেফারেন্স হিসেবে টেনে আনেন জন অফ উইন্টারথুরকে। মধ্যযুগীয় কাহিনীকারদের মধ্যে তার লেখাকেই মোটামুটি বিশ্বাসযোগ্য বলে ধরে নেয়া হয়। ১৩১৫ সালে সংঘটিত ব্যাটল অব মর্গারটেনে সুইস বাহিনী অস্ট্রিয়ানদের পরাজিত করে, যা দখলদারদের বিরুদ্ধে তাদের প্রথম বড় বিজয় ছিল। উইন্টারহির সেই সময় জীবিত, তার বাবাও যুদ্ধে অংশ নেন। টেলের মতো কেউ যদি ১৩০৮ সালে অস্ট্রিয়ানদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতেন এবং তাদের বিপক্ষে বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিতেন, তাহলে তারই তো ভালো জানার কথা। অথচ তার লেখার কোথাও এর বিন্দুমাত্র উল্লেখ পাওয়া যায় না।
গুইল্ম্যান নামে একজন ঐতিহাসিক ১৫৯৮ সালে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে দাবি করেন উইলিয়াম টেলের পুরো কাহিনীই বানোয়াট। কিন্তু তিনিই আবার জনপ্রিয়তার জন্য এই গল্পকে অস্বীকার করার বিপক্ষে দাঁড়ান। হয়তো বুদ্ধিদীপ্ত সিদ্ধান্তই ছিল সেটা, কারণ জনশ্রুতি আছে- ১৭৬০ সালে টেলের গল্পকে ডেনমার্ক থেকে আমদানি করা বলার দায়ে উরিয়েল ফ্রিউডেন নামে এক সুইস ব্যক্তিকে পুড়িয়ে মারা হয়।
উরিয়েল কিন্তু খুব একটা ভুল বলেননি। ড্যানিশ ইতিহাসবিদ স্যাক্সো গ্রামাটিকাস দশম শতকে পালনাটোকি বলে এক লোকের কথা বলে গেছেন। ফিন দ্বীপের বসবাসরত পালনাটোকি নাকি ছিল ড্যানিশ রাজা হ্যারল্ডের দেহরক্ষী। একবার বড়াই করে তিনি বলে বসেন তিরন্দাজিতে তার সমকক্ষ কেউ নেই। রাজা পরীক্ষার আয়োজন করলেন, পালনাটোকির ছেলের মাথায় আপেল বসিয়ে দূরে দাঁড়া করিয়ে দেয়া হলো। খুব স্বাভাবিকভাবেই পালনাটোকি লক্ষ্যভেদে সক্ষম হন। টেলের কাহিনীর সাথে এর মিল কিন্তু আশ্চর্যজনক, এবং ড্যানিশ এই গল্প টেলের অনেক আগেরও বটে।
অষ্টাদশ শতকে ড্যানিশ ইতিহাসে উল্লিখিত একটি ঘটনা প্রকাশ করেন এক গবেষক। তার গল্পের ভিলেনও রাজা হ্যারল্ড। হ্যারল্ড কিন্তু ঐতিহাসিক চরিত্র, ৯৩৬-৯৮৭ সাল অবধি ডেনমার্ক শাসন করেন তিনি। তার এক ভাইকিং সেনাপতি, টোকো একরাতে মাতাল হয়ে নিজের ধনুর্বিদ্যা নিয়ে বহু বড় বড় কথা বলতে থাকলে তিনি টোকোর ছেলেকে আপেল মাথায় দিয়ে দাঁড় করিয়ে দেন। এর পরের ঘটনা হুবহু উইলিয়াম টেলের মতো।
সেই সময়েই ঐতিহাসিক ডি হ্যালার উইলিয়াম টেলকে ড্যানিশ রূপকথা হিসেবে চিহ্নিত করে তথ্যপ্রমাণ সংযুক্ত একটি বই লিখেছিলেন। জনতা তার উপর প্রচণ্ড ক্ষেপে ওঠে, আদালতে মামলা হয়। প্রকাশ্যে পোড়ানো হয় হ্যালারের বই, লেখক বাধ্য হন ক্ষমা চাইতে।
একেবারে একই না হলেও টেলের মতো কাহিনী ইংল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, রাশিয়া, ইরান, এমনকি ভারতের উপকথাতেও পাওয়া যায়। তবে সত্যাসত্য যা-ই হোক, সুইজারল্যান্ডের সাধারণ মানুষের মনে উইলিয়াম টেলের স্থান অবিকৃত রয়ে গেছে।