![](https://assets.roar.media/assets/hx3KSxJEJtAVTMPu_gray_dark_council_hooded_robed_abstract_figures_hd-wallpaper-746000-585x306-1.jpg?w=1200)
আলকেমিস্টদের লক্ষ্য ছিল দীর্ঘায়ু অর্জন সম্ভব কি না সেটা নিয়ে গবেষণা করা, নিকোলাস ফ্লামেলও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। তিনি কি পেরেছিলেন সেটা নিয়ে সফল গবেষণা চালাতে? পেরেছিলেন সেই সুধা তৈরি করতে? এলিক্সির অফ লাইফ?
তবে একটা ব্যাপার তাকে সবসময় খেয়াল রাখতে হতো, তিনি যে কাজ করছিলেন, অর্থাৎ কাব্বালার সহায়তায় আলকেমি, সেটা দেশের আইনে নিষিদ্ধ ছিল। যেকোনো রকমের জাদুবিদ্যাসংক্রান্ত কিছুই নিষিদ্ধ এবং দণ্ডনীয় অপরাধ তখন। তাই তিনি খুবই সতর্ক থাকতেন। কেউ এলেও যেন কিছু খুঁজে না পায় সে ব্যবস্থা তিনি করে রেখেছিলেন।
![](https://assets.roar.media/assets/iRBXtKnmc66yTl1h_pok1-640x360.jpg)
নিকোলাস ফ্লামেল তার দরদী মনের কারণে অনেককেই অনেক উপহার পাঠাতেন। এ উপহারগুলোর কারণে তার সমসাময়িক ধনীরা ঈর্ষান্বিত হয়ে ওঠেন। তারা সন্দেহ ছড়াতে থাকেন, একজন সামান্য বই-দোকানী এত টাকা পাবে কীভাবে?
গুজব অবশেষে রাজা ষষ্ঠ চার্লসের কানেও এসে পৌঁছে। তিনি স্টেট কাউন্সিলের সদস্য ক্রামইসিকে নির্দেশ দিলেন ব্যাপারটা তদন্ত করে দেখতে। কিন্তু চতুর আর সাবধানী নিকোলাসের ব্যাপারে কিছুই তিনি খুঁজে পেলেন না। তদন্তকাজ ফ্লামেলের অনুকূলেই গেল।
![](https://assets.roar.media/assets/3sQBXv4TnrGTdykK_23727-004-BDFDF08C.jpg)
লোকচক্ষুর অন্তরালে ফ্লামেল কী করলেন সেটা আমরা না জানলেও, এটুকু আমরা জানি, ফ্লামেলের বাকি জীবনটা নির্বিঘ্নে কেটে যায়। গবেষণা, দোকান থেকে বাসা, বাসা থেকে দোকান- একজন বিদ্বানের জীবন যেমন হবার কথা আর কী। রাসায়নিক উপাদান নিয়ে নাড়াচাড়া, পুরোনো সব পাণ্ডুলিপি নিয়ে গবেষণা আর বৃদ্ধা স্ত্রীর সেবা।
স্ত্রী পেরেনেল মারা গেলেন আগে, ১৩৯৭ সালে। তখন নিকোলাসের বয়স হয়েছিলো ৮০; শেষ ক’টা দিন ফ্লামেল আলকেমির বই লিখেই কাটালেন; আর কবরস্থানে ঘুরে বেড়াতেন। তিনি খুব স্পষ্ট করে লিখে দিলেন, তাকে কোথায় কীভাবে কবর দিতে হবে। সেইন্ট ক্যাক্স লা বশেরির শেষ মাথায়। তার কবরের ফলক আর সেই ফলকে কী লিখা থাকবে সেটাও প্রস্তুত করে ফেললেন তিনি। সেই পাথরের ফলকে থাকবে অনেক অনেক চিহ্ন, আর একটি সূর্যের ছবি, একটি চাবির ছবি আর একটি বন্ধ বইয়ের ছবি। প্যারিসের Musee de Cluny-তে আজও সেটা দেখা যায়।
![](https://assets.roar.media/assets/P1vgsOx2J5JC1XMk_Flamel.jpg)
নিকোলাসের একটা অভ্যাস ছিল, যখনই তিনি নতুন কোনো চার্চ বা হাসপাতাল বা কবরস্থান স্থাপন করতেন, সেখানেই তিনি নিজের একটা ছবি আঁকিয়ে নিতেন, হাঁটু গেড়ে আছেন এমন অবস্থায়, প্রার্থনারত একটি ভঙ্গি। এমনকি তিনি দুটো ভাস্কর্য বানিয়ে নেন, একটা তরুণ বয়সের, আরেকটা বৃদ্ধ বয়সের।
![](https://assets.roar.media/assets/WSOaFX32tPBoSO2w_220px-Nicolas_Flamel_Histoire_critique.jpg)
সেকালে অনেক সময়ই এমন হতো যে, মর্যাদাবান বা সাধু গোত্রের কারও মৃত্যু হলে তার কিছু জিনিসপত্র সাথে কবর দেয়া হতো, মূল্যবান জিনিসপত্র। আর সেই জিনিস চুরি করতে আসতো কবরচোরেরা। তাই নিকোলাস বলে যান, তার স্মরণে যেন বছরে ১২ বার ধর্মীয় অনুষ্ঠান করা হয়। অর্থাৎ তিনি চেয়েছিলেন, তার কবর যেন থাকে মুখরিত, কেউ তার কবরে হামলা করতে না আসে। তিনি খুব পাকা আর ভারি কবরফলক অর্ডার করেন।
অবশেষে, ২২ মার্চ ১৪১৮ তারিখে ফ্লামেল মারাই গেলেন। তবে তার মৃতদেহ বাইরের মানুষকে দেখানো হলো না।
কিন্তু, মজার ব্যাপার, তিনি মারা যাবার আগেই, তার আলকেমির সাধনার কথা কীভাবে যেন প্রচার হয়ে যায়। রটে যায়, তিনি সোনা বানিয়েছেন, তার কাছে অমরত্বের সুধা আছে, কিন্তু তিনি ব্যবহার করেন না। তার কাছে পরশমণি তৈরির ফর্মুলা আছে। সেই ফর্মুলার লোভে দূরদূরান্ত থেকে লোভী মানুষ জড়ো হতে লাগলো। কারণ, তারা শুনেছে সেই ‘বুড়ো ধনী আলকেমিস্ট’ মরতে বসেছেন। এমন ধারণাও রটে গেল যে, তার কবরের উপর আঁকা সেই চিহ্নগুলো সমাধান করতে পারলেই পাওয়া যাবে সেই ফর্মুলা। কে পারবে সমাধান করতে? সকল আলকেমিস্টের তীর্থস্থান হয়ে দাঁড়াল এই প্যারিস। নিকোলাসের করা সকল মূর্তি আর ফলক রাতের আঁধারে মানুষ ভেঙে নিয়ে যেতে লাগলো। পাছে ক্লু মিস হয়ে যায়!
যা-ই হোক, এভাবে দুটো শতক পার হয়ে গেল। চলুন প্রবেশ করি ষোড়শ শতকে।
একজন ‘সম্ভ্রান্ত’ লোক এসে প্রমাণ করলেন, তিনি একজন বিখ্যাত আলকেমিস্টের বন্ধু, যিনি মারা গেছেন মাত্র। মারা যাবার আগে তিনি নাকি উইল করে গেছেন তার সমস্ত টাকা দিয়ে যেন ফ্লামেলের পরিত্যক্ত বাড়ি মেরামত করা হয়। সেই কাজটাই তিনি করতে এসেছেন মৃত বন্ধুর স্মরণে। জ্যাক্স লা বশেলির বোর্ড তাঁর কথা মেনে নিল আর বাড়ি মেরামতের অনুমোদন দিল। সেই লোক বাড়িতে ঢুকে পড়লেন অনেক শ্রমিক নিয়ে। বাড়ি তন্ন তন্ন করে খুঁজে বেড়ান তিনি, কিন্তু উল্লেখযোগ্য কিছুই খুঁজে পেলেন না। কিন্তু এক জায়গায় হায়ারোগ্লিফিকে কিছু আঁকা দেখলেন, আর কিছুই না। এই কি একজন আলকেমিস্টের বাড়ি? কোনো চিহ্নই নেই কিছুর! শেষপর্যন্ত তিনি চলে যান, শ্রমিকদের কোনো বেতন না দিয়েই। তখন বোর্ড বুঝতে পারে সে আসলে ভণ্ড ছিল।
![](https://assets.roar.media/assets/Vkq21wVc60u7ROVN_W1siZiIsInVwbG9hZHMvcGxhY2VfaW1hZ2VzLzEwMWYwOGRjMjJiNjE2Yjk4M19uaWNvbGFzZmxhbWVsNi5qcGciXSxbInAiLCJ0aHVtYiIsIngzOTA-Il0sWyJwIiwiY29udmVydCIsIi1xdWFsaXR5IDgxIC1hdXRvLW9yaWVudCJdXQ.jpg)
কিছুদিন পর জানা গেল, এক জার্মান ব্যারন নাকি বাড়িতে কিছু টেস্টটিউবে লাল পাউডার আবিষ্কার করেছেন যেটা লোককথায় বর্ণিত পরশমণির পূর্বরূপের অনুরূপ। তবে, এর ক্ষমতা কম। খুব কম ধাতুকেই এটা রূপান্তর করতে পারে।
মজার ব্যাপার, সেই পাউডার ব্যবহারের আগেই ‘হাতছাড়া’ হয়ে যায়। আর বাকি বাড়ি দেখে মনে হলো, কেউ যেন আগে থেকেই সুকৌশলে সব কোথাও সরিয়ে নিয়েছেন, যেন তিনি জানতেন, সবাই কী খুঁজতে আসবে।
সপ্তদশ শতক আসতে আসতে সেই বাড়ির চার দেয়াল ছাড়া বলতে গেলে আর কিছুই থাকলো না।
কিন্তু, সেই ইহুদী আব্রাহামের বইয়ের কী হলো? নিকোলাস তার গবেষণার জিনিস দিয়ে যান তার ভাগ্নে পেরিয়ারকে। পেরিয়ার এরপর আত্মগোপনে চলে যান আর এরপর তার সম্পর্কে কিছুই জানা যায় না। তবে তিনি নিশ্চয়ই সেই পাণ্ডুলিপি হস্তান্তর করেছিলেন কাউকে না কাউকে। কারণ, আবারও, রাজা ত্রয়োদশ লুই-এর সময় কিছু পৃষ্ঠা খুঁজে পাওয়া যায়।
![](https://assets.roar.media/assets/ySCTwlcuRCtHaug4_220px-Louis_XIII.jpg)
শোনা যায়, ‘দুবো’ নামের এক লোক রাজার দরবারে এসে সবার উপস্থিতিতে একটা সীসার বলকে সোনা বানিয়ে দিয়ে সবাইকে তাক করে দেয়! সাথে সাথে তাকে কার্ডিনাল রিশেলিও ডেকে নেন। এবং তার কাছে সেই বইয়ের পৃষ্ঠা আর কিছু কিছু কাগজ পাওয়া যায়। তবে, সে বলে সে আসলে কিছুই বোঝেনি এ বইয়ের। সে কিছু লাল গুঁড়ো ‘পেয়েছিল’ যেটা দিয়ে এমন রূপান্তর করা যায়। পরে তদন্ত করে দেখা যায়, এ লোকের অতীতে অনেক অপরাধ আছে, তাই তার সকল সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়। ভিঞ্চেনেসের কারাগারে তার যাবজ্জীবন দণ্ড হয়।
![](https://assets.roar.media/assets/OorlrEz9LMhdlLD4_Cardinal_de_Richelieu_mg_0053.jpg)
ঠিক এ সময়, এ ঘটনা প্রচার হবার পরেই, ডাকাতেরা ২০০ বছর আগের লোককথা শুনে উজ্জীবিত হয়ে নিকোলাসের কবরে আক্রমণ করে চুরি করার জন্য। কিন্তু, সমস্যা হলো অন্য জায়গায়। কী দেখা গেল জানেন?
কবরের ভিতরে কফিন ছিল একদম ফাঁকা!
কোনোকালেই নাকি এখানে কোনো দেহ ছিল না। নিকোলাস যদি সেদিনই মারা গিয়ে থাকেন, তবে তার কবর এখানে হয়নি। এটা ছিল নিকোলাসেরই একটি চতুর প্রদর্শনী।
নিকোলাসের অস্তিত্ব নিয়ে কিছু জানতে পারলো না মানুষ। কে সুকৌশলে তার সব জিনিসপত্র নিয়ে গেল বাড়ি থেকে? সেগুলো কোথায়ই বা রাখল? আর কেনই বা এমন করা হল? কোথা থেকে নিকোলাস এত টাকা পেলেন? আর কেন তিনি এমন কবর দেয়ার নাটক করালেন? তার উত্তরাধিকারী কে হলো? সেই বইয়ের বাকি অংশ কে বা কাদের তিনি দিয়েছিলেন?
জানা যায়, সেই বইয়ের কিছু পৃষ্ঠা কার্ডিনাল রিশেলিও নিজের কাছে রাখেন, তিনি একটা গবেষণাগার বানান। কিন্তু তিনি কি পেরেছিলেন কিছু করতে? আপনি ভাবছেন, নিকোলাসের কথা এখানেই শেষ? কিন্তু এরপরও যে চমক রয়ে যায়, তা জানেন কি? আর সবচেয়ে বড় কথা, আমাদের সবার পরিচিত মহাবিজ্ঞানী আইজ্যাক নিউটন কেন পরশমণি নিয়ে বই লিখে গেলেন? কী লিখেছিলেন? নিউটনের কথা আপাতত শুরু করা যাক তবে।
লোককথা আর ইতিহাসের মিশেল আমাদের আরও কিছু জানায়। কিন্তু সব তো এক পর্বে লিখে ফেললে হয় না। চলবে পঞ্চম পর্বে!
পড়তে ক্লিক করুন:
অতিপ্রাকৃতের সন্ধানে-৫: যুগের শেষ ‘জাদুকর’ স্যার আইজ্যাক নিউটন
অতিপ্রাকৃতের সন্ধানে-৬: স্যার আইজ্যাক নিউটনের বাইতুল মুকাদ্দাস গবেষণা
অতিপ্রাকৃতের সন্ধানে-৭: অমরত্বের সুধার খোঁজে
আগের পর্ব:
অতিপ্রাকৃতের সন্ধানে-১: আলকেমি আর পরশমণি
অতিপ্রাকৃতের সন্ধানে-২: পরশমণির খোঁজে আলকেমিস্ট নিকোলাস ফ্লামেল
অতিপ্রাকৃতের সন্ধানে-৩: নিকোলাস ফ্লামেলের রহস্যময় জীবন