Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ওয়্যারউলফ: কল্পনা নাকি বাস্তব?

নিশুতি রাতে ঝোপের আড়ালে মানুষ শিকারের লোভে লুকিয়ে রয়েছে এক ভয়ংকর প্রাণী, রক্ত হিম করা তার হুংকার। তীক্ষ্ণ নখবিশিষ্ট লোমশ এই প্রাণীটি মানুষের কাছে রীতিমতো এক আতঙ্কের নাম। মানুষ সামনে পড়লেই তার রক্ত-মাংস দিয়ে ভোজনটা যে সারতে হবে! তাই রাতের বেলা কেউ ঘরের বাইরে যাওয়ার খুব একটা সাহস দেখায় না। ভাবছেন এ আবার কোন প্রাণী? ওয়্যারউলফ বা নেকড়েমানব নিয়েই আমাদের আজকের আয়োজন।

ওয়্যারউলফ দেখতে অনেকটা নেকড়ের মতো। তাহলে নেকড়ে আর নেকড়েমানবের মধ্যে পার্থক্যটা কোথায়? এই দুই প্রাণীই অসম্ভব রকমের শক্তি, তীব্র গতিবেগ এবং তীক্ষ্ণ অনুভূতিসম্পন্ন। উভয়েই রাতের বেলা শিকার করে। পার্থক্যটা হলো, শুধুমাত্র ওয়্যারউলফ কিছু কিছু সময়ে পশু থেকে মানুষে রূপান্তরিত হতে পারে। অসংখ্য বই, চলচ্চিত্র এবং টেলিভিশনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমরা নেকড়েমানবের কাল্পনিক চিত্রায়ণ দেখেছি। দ্য ওলফ ম্যান, টোয়াইলাইট বা আন্ডারওয়ার্ল্ড এর মতো বিখ্যাত কিছু সিনেমায় আমরা নেকড়েমানবের কল্পিত অবয়ব এবং তাদের জীবনযাপন সম্পর্কে জানতে পারি। ওয়্যারউলফ রাতের বেলায় তার স্বরূপে ফিরে আসে আর দিনের বেলায় সে মানুষ রূপেই লোকালয়ে বিচরণ করে।

দ্য ওলফ ম্যান; Source: itunes.apple.com

একজন মানুষ আবার নেকড়েমানবে রূপান্তরিত হয় নাকি? প্রাচীন গ্রীসের ইতিহাস নিয়ে একটু ঘাঁটাঘাটি করলেই এর উত্তর পাওয়া যাবে। গ্রীসবাসীরা বিশ্বাস করতেন, কোনো মানুষ যদি নেকড়ের মাংস খেয়ে ফেলে তাহলে সে রূপান্তরিত হয়ে নেকড়েমানবে পরিণত হবে এবং তার মানুষরূপে ফেরা আর সম্ভবপর নয়।

পূর্ণচন্দ্র দেখেও হতে পারে এই রূপান্তর! Source: namingthefishes.wordpress.com

এছাড়াও আরো কিছু প্রচলিত ধারণা রয়েছে; যেমন আকাশে পূর্ণ চন্দ্র থাকবে এমন কোনো শুক্রবার রাতে কেউ যদি খোলা আকাশের নিচে ঘুমিয়ে পড়ে বা নেকড়ে যে পানিকে ছুঁয়েছে, এমন পানি পান করলেও মানুষের নেকড়েমানবে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বলা হয়ে থাকে, যারা এমন রূপান্তরিত হয়ে থাকেন, তাদের শরীরে একধরনের বিশেষ বেল্ট আবির্ভূত হয়, যা শরীর থেকে খুলে ফেললেই দিনের আলোতে আবার মানুষরূপে ফিরে আসা যায়। ওয়্যারউলফদের প্রধান খাদ্য ভেড়া বা অন্যান্য গৃহপালিত পশু এবং মানুষের রক্তমাংস।

রাজা লাইসিওন এবং গ্রীক দেবতা জিউস; Source: greeklegendsandmyths.com

গ্রীক সাহিত্য থেকে পৃথিবীর প্রথম নেকড়েমানবের অস্তিত্ব সম্পর্কে জানা যায়। একদা গ্রীক দেবতা জিউস আর্কাডিয়া সাম্রাজ্যের অধিপতি রাজা লাইসিওনের নিমন্ত্রণে তার প্রাসাদ ভ্রমণে আসেন। সর্ব বিষয়ে অবগত এবং মহান দেবতা জিউসের প্রতি রাজা লাইসিওনের পূর্ণ আস্থা এবং বিশ্বাসের কমতি ছিল। তার বিশ্বাসের ভিত কতটা মজবুত তা যাচাই করার জন্য তিনি দেবতার পরীক্ষা নিতে চাইলেন। খাবারদাবারের রাজকীয় আয়োজন করা হল এবং সুকৌশলে তিনি নরমাংস দিয়ে তৈরি একটি খাবারও রেখে দিলেন একইসাথে। জেনে অবাক হবেন, রাজা তার নিজ পুত্রসন্তান নিকটিমাসকে হত্যা করে তারই মাংস পরিবেশন করেছিলেন। রাজা খুব ভালো করেই জানতেন, গ্রীক ধর্মমতে হত্যা এবং নরমাংস ভক্ষণ উভয়ই ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। অতঃপর দেবতা আহারকক্ষে এসে অনুভব করলেন সেখানে নরমাংসের তৈরি কোনো খাবার পরিবেশন করা হয়েছে এবং রাজার এমন হীন কাজ তার কাছে খুব সহজেই ধরা পড়ে গেল। দেবতা বুঝলেন, এই ব্যক্তির হয়তো নরমাংসের প্রতি আহারপ্রীতি রয়েছে এবং সাথে সাথে এমন নোংরা কাজের জন্য তিনি রাজাকে নেকড়েমানবে রূপান্তরিত করে দিলেন। আর রাজার ছেলে নিকটিমাসকে পুনরায় জীবন দান করলেন।

কেমন হতে পারে এই রূপান্তর প্রক্রিয়া? Source: adrianlilly.com

নেকড়েমানব কি শুধুই একটি পৌরাণিক গল্পকাহিনী নাকি এর বাস্তবিক কোনো অস্তিত্ব রয়েছে? আসুন বিজ্ঞানের আলোকে এর সত্যতা যাচাই করা যাক। বাস্তবিক অর্থে নেকড়েমানব বলে কিছু নেই। বিভিন্ন শারীরিক বা মানসিক রোগের কারণে মানুষ ভাবে যে সে ধীরে ধীরে একটি নেকড়েতে পরিণত হচ্ছে, তার শরীরে বড় বড় লোম গজিয়ে উঠছে, তার হাত-পায়ের নখগুলো বড় হয়ে যাচ্ছে, তার কাঁচা মাংস খাওয়ার ইচ্ছে জেগে উঠেছে।

চিকিৎসাবিজ্ঞানের কিছু শারীরিক রোগের কথা আপনাদের এখন জানানো হবে যার কারণে অনেকে মনে করে থাকেন যে তিনি নেকড়েমানবে পরিণত হচ্ছেন।

দ্যা ওয়ার্ল্ড’স হেয়ারিয়েস্ট চাইল্ড; Source: livescience.com

  • হাইপারট্রাইকোসিস– অনেকে এই রোগটিকে ওয়্যারউলফ সিনড্রোমও বলে থাকেন। এ ধরনের অসুখে মানুষের মুখ সহ সারা শরীরে লম্বা এবং ঘন লোমে ভরে যায়। এমন অবস্থার জন্য জেনেটিক মিউটেশনকে দায়ী করা হয়ে থাকে। এটি একটি বিরল অসুখ। পুরো বিশ্বে প্রায় ১০০টিরও কম রেকর্ড রয়েছে এমন অসুখের। আক্রান্ত পুরুষদের ক্ষেত্রে মুখমন্ডল এবং চোখের পাতায় ঘন লোমে ছেয়ে যায়। আর নারীদের ক্ষেত্রে পুরো শরীরে জায়গায় জায়গায় গুচ্ছ গুচ্ছ লোম গজিয়ে ওঠে। ১৯৯৫ সালে ১১ বছর বয়সী এক থাই বালিকার নাম গিনেজ বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে (দ্য ওয়ার্ল্ড’স হেয়ারিয়েস্ট চাইল্ড হিসেবে) অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

এ রোগীরা আলো সহ্য করতে পারেন না; Source: mymonline.com

  • পরফাইরিয়া– এটি একধরনের মেটাবলিক ডিসঅর্ডার এবং বংশগত রোগ। যখন শরীরে পর্যাপ্ত পরিমাণে হিম (যা থেকে লোহিত রক্তকণিকা উৎপন্ন হয়) তৈরি হয় না, তখন শরীরে বিশেষ কিছু প্রোটিন তৈরিও ব্যাহত হয়। ফলশ্রুতিতে শরীরে কিছু অসামঞ্জস্যতা দেখা দেয়, যেমন- এসব রোগীরা আলো সহ্য করতে পারেন না এবং খিঁচুনি, উদ্বিগ্নতা সহ নানা ধরনের উপসর্গ দেখা দেয়। এক গবেষণায় দেখা যায়, যুক্তরাজ্যে প্রায় ২৫,০০০ জনে প্রতি একজন এই রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকেন।

এ তো গেল শারীরিক ব্যাধির কথা, এবার বলা হবে একটি মানসিক রোগের কথা, যার দরুন একজন ব্যক্তি নিজেকে নেকড়েমানব বলে ভাবতে শুরু করে।

রোগীরা নিজেদেরকে তীব্রভাবে ওয়্যারউলফ মনে করতে শুরু করে; Source: storyteller-skgregory.weebly.com

  • লাইকেনথ্রপি– এটি একধরনের মানসিক রোগ। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা নিজেদেরকে প্রাণী ভাবতে শুরু করে এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই রোগীরা নিজেদেরকে তীব্রভাবে ওয়্যারউলফ মনে করতে শুরু করে। যারা পুনর্জন্মে বিশ্বাস করে থাকেন, তাদের ক্ষেত্রে এমন ডিলুশ্যনে ভোগার আশংকা সবচেয়ে বেশি থাকে।

১৫৮৯ সালে পিটার স্টাব নামক এক জার্মান নাগরিক দাবি করেন, তার শরীরে নেকড়ের চামড়ার তৈরি একধরনের বেল্ট রয়েছে, যার দরুন তিনি নেকড়েতে পরিণত হতে পারেন। বেল্টটি পরলেই তার শরীর একটি নেকড়ের ন্যায় আকার ধারণ করে, তার মুখের ভেতর থেকে লম্বা কিছু দাঁত বেরিয়ে আসে এবং তিনি রক্তপিপাসু হয়ে উঠেন। তিনি স্বীকার করেন, নেকড়েরূপে বিগত ২৫ বছরে তিনি প্রায় ডজনখানেক মানুষকে হত্যা করেছেন। তার এমন স্বীকারোক্তির অবশ্য বাস্তব কোনো প্রমাণ ছিল না এবং মনে করা হয় স্টাব মানসিকভাবে একজন বিকারগ্রস্ত ব্যক্তি ছিলেন ও ডিলুশ্যনে ভুগতেন। তথাপি তার শিরচ্ছেদ করা হয় এবং মস্তকবিহীন শরীরকে পুড়িয়ে ফেলা হয় জনসম্মুখে।

১৮৫০ সালে নেদারল্যান্ডে অবস্থিত ইউনিভার্সিটি অফ গ্রোনিঞ্জেনের মনোরোগবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. জ্যান ড্রিক ব্লুম নিজেদের নেকড়েমানব ভাবা মানুষদের নিয়ে গবেষণা করেন। তিনি প্রায় ৫৬ জন এমন মানুষের সন্ধান পান, যারা কিনা বিশ্বাস করেন যে তারা ধীরে ধীরে একটি পশুতে পরিণত হচ্ছে। এই ৫৬ জনের মধ্যে ১৩ জনের ক্ষেত্রে লাইকেনথ্রপি এবং ডিলুশ্যনের উপসর্গ ব্যাপকভাবে বিদ্যমান ছিল। বাকিদের ক্ষেত্রে নানা রকম ডিলুশ্যন, ডিপ্রেশন, স্কিৎজোফ্রেনিয়া এবং বাই পোলার ডিসঅর্ডার কাজ করত, যেমন কেউ কেউ নিজেকে কুকুর, সাপ, ব্যাঙ অথবা মৌমাছি ভাবতে শুরু করেছিল।

ব্লুমের এই গবেষণায় ৫৬ জনের মধ্যে শতকরা ২৫ জন স্কিৎজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত ছিল, শতকরা ২৩ জন মানসিকভাবে বিষণ্ণ ছিল এবং শতকরা ২০ জন বাইপোলার ডিসঅর্ডারে ভুগছিল। এর মধ্যে ৩৪ জন ছিলেন পুরুষ এবং ২২ জন নারী। তাদের এই মানসিক রোগটি ব্যক্তিভেদে ঘন্টাকাল থেকে শুরু করে দশকের পর দশক পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল।

১৮৫২ সালে ফ্রান্সে এমন একটি ঘটনার কথা শোনা যায়। ন্যান্সি নামক এক ব্যক্তিকে তার আত্মীয়স্বজন একটি পাগলাগারদে ভর্তি করে দেন। ভর্তির কারণ সম্পর্কে তারা কর্তৃপক্ষকে জানান, “ন্যান্সি নানা রকম পাগলামি শুরু করেছে এবং ইদানিং সে নিজেকে একটি নেকড়ে বলে ভাবতে শুরু করেছে”। পাগলাগারদে আসার পর থেকেই তিনি কাঁচা মাংস খাবেন বলে বায়না করতে থাকেন। অতঃপর তাকে যখন কাঁচা মাংস খেতে দেয়া হয় তিনি খেতে অস্বীকৃতি জানান। ব্লুম ওই পাগলাগারদ পরিদর্শনে গিয়ে ন্যান্সির সাথে কথা বলেন। কথা বলার একপর্যায়ে ন্যান্সি তার ঠোঁট উল্টিয়ে দেখাতে থাকে তার মুখের ভেতরে নেকড়ের ন্যায় দাঁত গজিয়েছে, যদিও তার মুখের ভেতরে সেরকম কোনো দাঁত ছিল না। তবে ব্লুম বলেন, তার শরীর বেশ লোমশ ছিল।

মানুষের এমন মানসিক রোগের সমস্যা সমাধানে বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন যাবত মস্তিষ্কের বিশেষ কিছু অংশ, যেমন কর্টেক্স (যা মানুষের চলাফেরা এবং সংবেদনশীলতা নিয়ন্ত্রণ করে) নিয়ে গবেষণা করে চলেছেন। মনোবিজ্ঞানীরা ইলেক্ট্রোএনসেফালোগ্রামের (ইইজি) মাধ্যমে মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশ স্ক্রিনিংয়ের মাধ্যমে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখার চেষ্টা করছেন এমন অস্বাভাবিকতার মূল কারণকে।

ফিচার ইমেজ: raynfall.com

Related Articles