Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

গ্রিক পুরাণের বারোজন অলিম্পিয়ান দেবতা

প্রাচীন গ্রিসের পৌরাণিক কাহিনিগুলোর মূল কাহিনি গড়ে উঠেছে দেবতাদের কেন্দ্র করে। পুরোটা জুড়েই আধিপত্য বিস্তার করেছে বারোজন অলিম্পিয়ান দেবতা। একেকসময় তাদের হুঙ্কারে কম্পিত হয়েছে আকাশ-পাতাল, কখনো বা তারা মানবজাতির জন্য বয়ে এনেছে হানাহানি বা ধ্বংস। কখনো তাদের আশীর্বাদেই কোনো সম্রাট আসীন হয়েছে গ্রিস অঞ্চলের কোনো মসনদে। উপকথা অনুযায়ী, দেব-দেবীদের অলৌকিক শক্তি বিদ্যমান থাকলেও, মননে ও গড়নে এরা ছিল মানুষের মতোই। কারণ, দেবরাজ জিউস প্রমিথিউসকে মানুষ তৈরির আদেশ দিয়েছিলেন দেবতাদের আদলেই। মানুষের মতোই দেবতারা মনে পোষণ করতেন লোভ, লালসা, কামক্ষুধা, আবেগ, ভালোবাসা, হিংসা, ঈর্ষাপরায়ণতা ইত্যাদি। মানুষের মতো জন্ম নিয়ে বেড়ে উঠলেও মানুষের সাথে ছিল তাদের একটাই ফারাক। দেবতারা ছিলেন অমর। সোজা ভাষায়, গড়নে এরা মানুষের মতো হলেও, শক্তিমত্তা এবং সৌন্দর্যে এরা মানুষের চেয়ে উৎকৃষ্ট।

অলিম্পিয়ানদের পরিবারবর্গ; Image Source: Colin Quartermain/Wikimedia Commons.

প্রথম টাইটানদের পরাজিত করার পর বারোজন দেবতা সংঘবদ্ধ হয়ে তৈরি করেন একটি দল। অলিম্পাসের পাহাড়ে নির্মিত বিশাল এক স্বর্গীয় অট্টালিকায় ছিল তাদের বাস। এখানে নির্মিত দেবসভাতে বসেই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড পরিচালনা করতেন তারা। সাইক্লপদের দিন-রাত অক্লান্ত পরিশ্রমেই তিলে তিলে গড়ে উঠেছে এই অট্টালিকা। সাথে দক্ষ হাতে প্রাসাদের প্রতিটি দেওয়ালে শৈল্পিক কারুকার্য ফুটিয়ে তুলিয়েছিলেন স্বর্গের সব্যসাচী কামার হেফাস্টাস। বারোজন অলিম্পিয়ানদের মধ্যে প্রথম ছয়জন যথাক্রমে হেস্টিয়া, পসাইডন, হেডিস, ডিমিটার, হেরা এবং জিউস। এরা হলেন প্রথম যুগের টাইটান ক্রোনাস এবং রিয়ার সন্তান। বাকিদের মধ্যে অনেকেই দেবরাজ জিউসের ঔরসজাত।

তবে কিছু দেবতাদের অলিম্পিয়ান পরিচিতি নিয়ে পুরাণকর্তাদের মধ্যে মতভেদ বিদ্যমান ছিল। যেমন- জিউসের ভাই হেডিসকে অলিম্পিয়ান হিসেবে স্বীকার করতে রাজি নন অনেকে। কারণ, পাতালপুরীর এই দেবতা বাস করতে করতেন অলিম্পাস থেকে বহু ক্রোশ দূরে, অধোলোকে। তারা হেডিসের পরিবর্তে ডিমিটারের কথা উল্লেখ করে থাকেন। যা-ই হোক, হেডিসকে তালিকার বাইরে রেখে বারোজন প্রধান অলিম্পিয়ান দেবতা নিয়েই আজকের আলোচনা।

অলিম্পাসের দেব-দেবীগণ; Image Source: Angelika/Pixabay.

জিউস

বারোজন প্রধান অলিম্পিয়ানের মধ্যে সর্বশক্তিমান, এবং অলিম্পাস পর্বতের অধীশ্বর ছিলেন দেবরাজ জিউস। টাইটানদের সাথে যুদ্ধজয়ের পর জিউস নিজেকে স্বর্গের একচ্ছত্র অধিপতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে আসীন হন দেবরাজের সিংহাসনে। স্বর্গলোকের সকল দেবতাও তাকে বিনাবাক্যে শ্রেষ্ঠ হিসেবে মেনে নিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন ক্রোনাস এবং রিয়ার সর্বকনিষ্ঠ সন্তান। গ্রিক উপকথানুযায়ী, জিউস ছিলেন সকল দেবতা ও মানবের পিতা, আকাশ, বজ্র, আইন, ও ন্যায়বিচারের দেবতা। জিউসের নিকট সবচেয়ে পবিত্র হিসেবে গণ্য ছিল সোনালী ঈগল, যা তিনি সবসময় পাশে রাখতেন। এছাড়া জলপাই গাছও ছিল তার নিকট পবিত্র। রোমান মিথে তিনি জুপিটার হিসেবে পরিচিত। জিউসের প্রথম প্রেমে পড়েছিলেন টাইটান ওসেনাস এবং টাইটানেস টেথিসের কন্যা মেটিসের। এছাড়াও জিউস স্বর্গের দেবীদের মধ্যে থেমিস, লেটো, হেরা আফ্রোদাইতির সাথেও সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করেছেন। প্রায় সকল মিথেই উল্লেখ আছে, মেটিসের ঘটনার পর স্বর্গীয় আড়ম্বরে, ধুমধামে তিনি বিয়ে করেছিলেন নিজ বোন হেরাকে। মর্ত্যের নারীদের প্রতিও জিউসের ছিল অফুরন্ত ভালোবাসা। এদের মধ্যে এন্টিওপে, আল্কমিনা, সেমেলি, লেডা, ইউরোপা, আইও, ক্যালিস্টো, ড্যানি উল্লেখযোগ্য।

দেবরাজ জিউস; Image Source: David Roterberg.

হেরা

যেহেতু হেরা ছিলেন জিউসের বোন, অর্ধাঙ্গিনী, এবং প্রচণ্ড ক্ষমতাশালী, তাই তাকে অলিম্পিয়ান রানি হিসেবেও অভিহিত করা হয়। তিনি হলেন পরিবার, বিয়ে এবং জন্মের দেবী। গরু, কোকিল এবং ময়ূর তার নিকট পবিত্র প্রাণী হিসেবে বিবেচিত। ঈর্ষাপরায়ণ এই দেবী তার প্রতিহিংসামূলক আচরণের জন্য গ্রিক উপকথায় সুপরিচিত। জিউসের অন্যান্য প্রেমিকা, এবং তাদের গর্ভ থেকে জন্ম নেওয়া জিউসের সন্তানদের বিনাশ করার জন্য তিনি উঠে-পড়ে লেগেছিলেন। প্যারিসের সৌন্দর্য বিচারের সময় তিনি রেগে গিয়ে গ্রিস এবং ট্রয়ের মধ্যে এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষই বইয়ে দিয়েছিলেন, তা স্থায়ী ছিল দীর্ঘ ১০ বছর।

প্যারিস সৌন্দর্য বিচার নিয়ে জানতে পড়ুন: প্যারিসের সৌন্দর্য বিচার: গ্রিস ও ট্রয়ের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ সূচনার শুরু যেখানে

কিংবদন্তি অনুযায়ী, জিউসের সন্তান হেরাক্লিস হেরার দুধ পানের সময় স্তনের বোটায় কামড় বসিয়েছিলেন। হেরাক্লিসের মুখ থেকে বোটা অবমুক্ত করণের সময় স্তনের দুধ স্বর্গ থেকে ছিটকে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে ছড়িয়ে পড়ে। সেটা থেকেই জন্ম হয় মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির। রোমান উপকথায় হেরা জুনো নামে পরিচিত।

সিংহাসনে বসে আসেন দেবরাজ জিউস। পাশে স্ত্রী হেরা; Image Source: Joshua Bermudez.

পসাইডন

গ্রিক উপকথার বিশাল জায়গা-জুড়ে নিজেকে বিস্তীর্ণ জলরাশির মতো ছড়িয়ে রেখেছেন পসাইডন। পদ ও বিশিষ্টতা অনুসারে, দেবরাজ জিউসের পরই তার অবস্থান। সমুদ্রের একচ্ছত্র অধিপতি হিসেবে অথৈ জলের ঢেউ ভেঙে নিজের রাজত্ব কায়েম রাখেন পসাইডন। দেবতাদের মধ্যে তিনিই প্রথম ঘোড়াকে পোষ মানিয়েছিলেন বলে তাকে ঘোড়ার দেবতা বলেও ডাকা হয়। এছাড়াও, গ্রিক পুরাণে তিনি বন্যা, খরা, ও ভূমিকম্পের দেবতা হিসেবেও সুপরিচিত।

অধিকাংশ পুরাণেই পসাইডনকে বর্ণনা করা হয়েছে কলহপ্রিয়, ঝগড়াটে, অস্থিরচিত্তের একজন দেবতা হিসেবে। তিনি অনেক জায়গাতেই প্রধান দেবতা হতে চাইতেন। এজন্য অনেক দেবতার সাথে সবসময় তার ঝগড়া-ফ্যাসাদ লেগেই থাকত। এর মধ্যে সূর্যের আদি দেবতা হেলিয়াসের সঙ্গে, জিউসপত্নী হেরার সঙ্গে আর্গস এলাকা নিয়ে, জ্ঞানের দেবী অ্যাথেনার সাথে ট্রোয়েজেন শহর নিয়ে বিবাদে জড়ান তিনি। পরকীয়া ও বহু ভালোবাসায় জিউসের থেকে কোনো অংশেই কম ছিলেন না তার ভাই পসাইডন। প্রিয়তমার তালিকায় রয়েছেন এম্ফিট্রিটে, ডিমিটার, আফ্রোদাইতি, মেডুসা, থিওফানেসহ বহু রমণী।

অলিম্পাস বিদ্রোহের পর জিউস পসাইডনকে এক বছরের জন্য অলিম্পাসের চূড়া থেকে নির্বাসিত করে দিয়েছিলেন। ফলে মর্ত্যলোকে এসে ঠাঁই নেন তিনি। তৎকালীন ট্রয় সম্রাট লাওমেডন পসাইডনকে ট্রয়ের প্রাচীর নির্মাণের দায়িত্ব অর্পিত করেন। রোমান পুরাণে তিনি নেপচুন হিসেবে খ্যাত।

নিজ সাম্রাজ্য সমুদ্রের গহীনে দেবতা পসাইডোন; Image Source: Luciano Neves.

হেস্টিয়া

বারোজন অলিম্পিয়ান দেবতার মধ্যে দেবী হেস্টিয়ার জনপ্রিয়তার পাল্লা ছিল সবচেয়ে হালকা। অন্য দেবতাদের নিয়ে গ্রিক উপকথার আনাচে-কানাচে কাহিনি ছড়িয়ে থাকলেও তিনি আলোচনায় এসেছেন বেশ কম। কারণ, তিনি যুদ্ধ-বিগ্রহ বা ঝগড়া-ফ্যাসাদকে প্রশ্রয় দেননি। অত্যন্ত অমায়িক ও কোমল হৃদয়ের হেস্টিয়া ছিলেন চুল্লীর দেবী। কোনো দেবতা বা মরণশীল মানুষের সাথে তিনি কখনও সম্পর্কে জড়াননি। এজন্য তিনি ছিলেন কুমারী। তার সবচেয়ে বড় পরিচয় হলো, তিনি ক্রোনাস এবং রিয়ার প্রথম সন্তান।

অত্যন্ত রূপবতী এই দেবীকে কাছে পেতে চেয়েছিলেন পসাইডোন, হেডিস এবং জিউসপুত্র অ্যাপোলো। কিন্তু তিনি জিউসের মাথা ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, তিনি জীবনে কোনোদিন বিয়ে করবেন না, এবং কুমারী থাকবেন। তাই ওই পাণিপ্রার্থীদের কেউই তখন তার দিকে হাত বাড়াতে সাহস পাননি। কারণ, তারা এই লোভ দেখালে জিউস তাদের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়াতেন। এছাড়াও, হেস্টিয়া ছিলেন ওই তিন দেবীর একজন, যাদের উপর আফ্রোদাইতির ভালোবাসার মন্ত্র কর্তৃত্ব ফলাতে পারত না। বাকি দুজন হলে অ্যাথেনা এবং আর্টেমিস। রোমান মিথে তিনি ভেস্টা নামে পরিচিত।

ডিমিটার

ডিমিটার ছিলেন ক্রোনাস ও রিয়ার দ্বিতীয় সন্তান। তিনি ছিলেন শস্য, খাদ্য, উর্বরতা ও কৃষি দেবী। জিউস এবং পসাইডনের এই প্রেমিকা জন্ম দিয়েছিল পার্সিফোন, ডেসপোইনি, এবং অরিয়নকে। শস্যদানা, গম, মশাল, এবং শূকর ছিল তার নিকট পবিত্র হিসেবে বিবেচ্য। তিনি ডেমোফন ইলিয়াসিনার রাজকুমার ডেমোফনকে পালক হিসেবে গ্রহণ করেন, যিনি মানবজাতিকে কৃষিকাজে সহায়তার জন্য লাঙল উপহার দেন। পাতাল দেবতা হেডিসের দ্বারা তার কন্যা পার্সিফোন অপহরণের কাহিনি গ্রিক পুরাণে বিখ্যাত হয়ে আছে। রোমান মিথে তিনি সেরেস নামে পরিচিত।

অ্যাথেনা

অ্যাথেনাকে রোমান উপকথায় মিনার্ভা নামে ডাকা হতো। জিউস এবং সমুদ্রকন্যা মেটিসের গভীর প্রণয়ের ফলে স্বর্গের আলো দেখে অ্যাথেনা। নিজ ঔরসজাত সন্তান হিসেবে জিউস অ্যাথেনাকে সবকিছুতেই যথেষ্ট প্রশ্রয় দিয়েছেন বলে অ্যাথেনা নিজের খেয়ালখুশি মতো চলতেন। তবে প্রথমে তিনি অ্যাথেনাকে জন্মই দিতে চাননি। কারণ এক ভবিষ্যদ্বাণীতে বলা ছিল, মেটিসের গর্ভে জিউসের যে কন্যাসন্তান বড় হবে, বুদ্ধিমত্তায় সে জিউসকে টেক্কা দিতে পারবে। সেজন্য অন্তঃসত্ত্বা মেটিসকে গিলে ফেলেছিলেন তিনি। পরবর্তীতে জিউসের মাথা থেকে যুদ্ধপোশাক আর শিরস্ত্রাণ পরা অবস্থায় জন্ম হয়েছিল অ্যাথেনার। তিনি ছিলেন জ্ঞান, শিল্পকর্ম, এবং যুদ্ধক্ষেত্রের দেবী। পেঁচা এবং জলপাই গাছ ছিল তার প্রতীক।

অ্যাথেনার জন্ম; Image Source: René Antoin.

অ্যাপোলো

দেবতা অ্যাপোলো ছিলেন তরুণ দেবতাদের মধ্যে অন্যতম। জিউস আর লেটোর কোল আলোর করে জন্ম নেওয়া এই অ্যাপোলো ছিলেন আর্টেমিসের যমজ ভাই। সুদর্শন এই দেবতার মাঝে প্রভূত গুণ বিদ্যমান ছিল। এই সুর কারিগর আপন মহিমায় সোনালি বীণা বাজিয়ে মাতিয়ে তুলতেন অলিম্পাস পর্বত। তিনি ছিলেন রূপালি ধনুকের প্রভু, সুদক্ষ তীরন্দাজ, আরোগ্য, আলো, সততা, ও ধনুর্বিদ্যার দেবতা। মানুষকে শিখিয়েছিলেন নিরাময়বিদ্যা।

দেবতা অ্যাপোলো; Image Source: Caraid Art/Art Station.

এছাড়াও তিনি ছিলেন কবিতা, সঙ্গীত, চিত্রকর্মের এক সব্যসাচী রূপকার। তবে, গ্রিক উপকথায়, অ্যাপোলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতেন দৈববাণীর দেবতা হিসেবে। ডেলফির মন্দিরে যাজিকার মাধ্যমে তিনি মানুষের জন্য দৈববাণী প্রকাশ করতেন। তার প্রতীকসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সূর্য, তীর-ধনুক, রাজহাঁস, এবং ইঁদুর। প্রাচীন গ্রিকবাসীরা সম্ভবত সবচেয়ে বেশি এবং অকৃত্রিম শ্রদ্ধা-ভক্তিতে অ্যাপোলোর পূজা করত বিধায় তাকে দেবতার মধ্যে ‘সবচেয়ে খাঁটি গ্রিক’ অভিহিত করা হয়।

আর্টেমিস

জিউস ও লেটোর কন্যা আর্টেমিস যমজ হিসেবে অ্যাপোলোর কিছু মুহূর্ত পূর্বে জন্ম নিয়েছিলেন, ওরটাইগিয়া দ্বীপে। গ্রিক পুরাণের শিকারি দেবী হিসেবে অধিক পরিচিত পেলেও কুমারিত্ব, বন্যপ্রাণী, এবং নারী-শিশু চিকিৎসার দেবী হিসেবেও বেশ খ্যাতি আছে তার। পুরাণমতে, প্লেগ বিস্তারের পেছনে যমজ ভাই অ্যাপোলোর সাথে তারও ভূমিকা বিদ্যমান। তিনি হচ্ছেন স্বর্গলোকের তিন কুমারী দেবীর একজন। আফ্রোদাইতি ভালোবাসার দেবী হলেও তিনি আর্টেমিসের উপর কোনো সময়ই ভালোবাসার কোনো প্রভাব খাটাতে পারেননি। চাঁদ, ঘোড়া, সাপ, তীর-ধনুক, সাইপ্রাস বৃক্ষ, বনের সকল প্রাণী (হরিণ) তার কাছে অধিক পবিত্র। রোমানরা আর্টেমিসকে ডায়ানা নামে চিনত।

আর্টেমিস; Image Source: Pompeo Batoni.

অ্যারিস

অ্যারিস হলেন গ্রিক পুরাণের হিংস্রতা, রক্তপাত, খুনোখুনি এবং যুদ্ধের দেবতা। তিনি ছিলেন জিউস এবং হেরার সন্তান। নিজ সন্তান হলেও জিউসের নিকট অ্যারিস তেমন পছন্দের পাত্র ছিলেন না। এর কারণ হচ্ছে, অ্যারিস সর্বদা হানাহানি, কলহ, বিবাদ, যুদ্ধ, হত্যাযজ্ঞ নিয়েই মেতে থাকতেন। এবং, অ্যারিসের জন্মে জিউসের কোনো ভূমিকা ছিল না। হেরা সন্তানসম্ভবা হয়েছিলেন এক জাদুকরী ভেষজের মাধ্যমে। প্রাচীন গ্রিক ভাষায় এই পদ্ধতিকে বলা হতো ‘পার্থেনোজেনেসিস’। যুদ্ধের দেবতা হলেও, যুদ্ধক্ষেত্রে তার সমরকৌশল ও বীরত্ব নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। গ্রিস ও ট্রয়ের যুদ্ধে তিনি ট্রয়ের পক্ষ নিয়ে তাদের যুদ্ধের উন্মাদনায় মাতোয়ারা বানিয়েছিলেন। দীর্ঘ দশ ধরে এই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে পতন ঘটে তার পক্ষের, অর্থাৎ ট্রয় নগরীর। অ্যারিসকে সবসময় দেখা যায় অস্ত্রসজ্জিত যোদ্ধা হিসেবে। কঠোর প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধবিদ্যায় দীক্ষিত হলেও দক্ষ যোদ্ধা হিসেবে কখনোই অ্যারিসের তেমন নাম-ডাক ছিল না। বন্য শূকর, সাপ, কুকুর, শকুন, বর্শা ও ঢাল ছিল তার প্রতীক। এছাড়াও কলকিয়ান ড্রাগনের সাথে অ্যারিসের নাম আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। রোমান পুরাণে তিনি মার্স নামে পরিচিত। গ্রিকরা অ্যারিসের প্রতি যতটা ক্ষুব্ধ ছিলেন, রোমানরা ঠিক ততটাই ভালোবাসতেন তাকে। রোমানদের কাছে তিনি বর্ণিল সমরসাজে সজ্জিত তুখোড় এবং দুর্ধর্ষ এক যোদ্ধা, যাকে দেখে রোমান যোদ্ধারা যারপরনাই অনুপ্রাণিত হতেন।

অ্যারিস; Image Source: Zhuopeng Zhu/Deviant Art.

আফ্রোদাইতি

অলিম্পিয়ান আফ্রোদাইতিকে বলা হয় গ্রিস-ট্রয়ের যুদ্ধের পেছনে অন্যতম নিয়ামক। জিউসের পর সবচেয়ে বর্ণিল অলিম্পিয়ান অভিহিত করা হয় তাকে। অমর দেবতা থেকে মরণশীল মানুষ, স্বর্গ থেকে মর্ত্য, সবখানেই ভালোবাসার অদৃশ্য মোহজাল ছড়িয়ে রেখেছিলেন তিনি। কখনও প্রেমিকা, কখনও আবেদনময়ী, কখনও ছলনাময়ী, কখনো বা প্রতিশোধ-পরায়ণার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন তিনি।

প্যারিসের সৌন্দর্য বিচারে তিনি ছিলেন তিন দেবীর মধ্য অন্যতম। তার জন্ম নিয়ে দুটো কাহিনি চালু আছে। প্রথমটা হলো, তিনি জিউস এবং ডাইওনির সন্তান। দ্বিতীয় কাহিনি মতে, ক্রোনাস টাইটান ইউরেনাসের গোপনাঙ্গ কেটে সমুদ্রে ফেলে দিলে সেই রক্তের ফোঁটা থেকে ফেনার সৃষ্টি হয়েছিল। সেই ফেনা থেকে জন্ম হয়েছিল আফ্রোদাইতির। হেসিয়ডের বর্ণনা মতে, আফ্রোদাইতি হলেন সবচেয়ে প্রাচীন অলিম্পিয়ান। আফ্রোদাইতি, অ্যারিস, এবং হেফাস্টাসের ত্রিমুখী প্রেমাখ্যান গ্রিক পুরাণে বিখ্যাত। ঘুঘু, আপেল, মৌমাছি, রাজহাঁস, গোলাপ ফুল ছিল তার প্রতীক। রোমান উপকথায় তিনি ভেনাস নামে পরিচিত।

আফ্রোদাইতি; Image Source: Dušan/Pixabay.

হেফাস্টাস

স্বর্গের সমস্ত দেবতারা সুদর্শন হলেও এর একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন অলিম্পাসের কামার দেবতা হেফাস্টাস। তিনি ছিলেন কুৎসিত, এবং খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতেন। অলিম্পাসের চূড়ায় দেবতাদের ধবধবে প্রাসাদ নির্মাণে তার উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। তার জন্ম নিয়ে প্রচলিত রয়েছে নানা মত। হোমার উল্লেখ করেছেন, জিউস আর হেরার সন্তান হচ্ছেন হেফাস্টাস। কিন্তু ভিন্ন সুর তুলে হেসিয়ড জানিয়েছেন, ক্রোধের বশবর্তী হয়ে জিউসের সাথে মিলন ছাড়া পার্থেনোজেনেসিস প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিজেই হেফাস্টাসকে জন্ম দেন হেরা। মূল উদ্দেশ্য, জিউসের সমকক্ষ হিসেবে কাউকে গড়ে তোলা। হেফাস্টাসের কুৎসিত অবয়ব দেখে ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন জিউস। অগ্নিমূর্তির রূপ ধারণ করে হেফাস্টাসকে ছুড়ে মারেন পৃথিবীর সমুদ্রে। সমুদ্রের অথৈ জলরাশি থেকে তাকে উদ্ধার করেন ইউরিনোমে এবং থেটিস। তাদের কাছে নয় বছর অবস্থান করে কামার শিল্পে নিজের হাত পাকিয়ে নেন তিনি। সাথে শিখে ফেলেন আগুন, শিল্পবিদ্যা এবং ভাস্কর্যের নিখুঁত কাজ।

হেফাস্টাস; Image Source: Pompeo Batoni.

কামারশিল্পে তিনি অসাধারণ নৈপুণ্য দেখিয়েছেন। আগুনের সাহায্যে তামা, লোহা, সোনা, রুপা ইত্যাদি ধাতু গলিয়ে যেকোনো আকার দিতে পারতেন। খানিকটা রগচটা হলেও তিনি ঝগড়াঝাঁটি ও কলহ তেমন পছন্দ করতেন না। ছিলেন দয়ালু এবং শান্তিপ্রিয়। লেমনস দ্বীপ তার প্রধান উপাসনা স্থল হলেও গ্রিসের শিল্প এলাকাগুলোতে তিনি বেশ জনপ্রিয় ছিলেন। হেফাস্টাস একাধারে কামারশালা, শিল্প-কুশলতা, উদ্ভাবন, আগুন এবং আগ্নেয়গিরির দেবতা ছিলেন। তার প্রতীক ছিল আগুন, নেহাই, কুঠার, গাধা, হাতুড়ি এবং সাঁড়াশি। রোমান সভ্যতায় তিনি ভালকান নামে জনপ্রিয় ছিলেন।

কামারশালায় হেফাস্টাস; Image Source: Werner Schuch.

হার্মিস

গ্রিক অলিম্পিয়ান হার্মিসকে তুলনা করা যায় ডাক বিভাগের রানারের সাথে। আলোর গতিতে ছুটতে পারা এই দেবতা প্রধানত জিউসের সংবাদবাহক হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল তিন জায়গাতেই ছিল তার অবাধ বিচরণ। তিনি ছিলেন জিউস এবং অ্যাটলাস কন্যা নিম্ফ মাইয়ার সন্তান। সংবাদ বাহকের পাশাপাশি, ব্যবসা-বাণিজ্য, চৌর্যবৃত্তি, পশুপালন, ব্যায়াম, উদ্ভাবনী শক্তি, বাগ্মিতা, বর্ণমালা শিক্ষা, ভাগ্যের সাথে জড়িত সকল খেলাধুলার দেবতা হিসেবেও তিনি পরিচিত। এছাড়াও তিনি মৃত আত্মাকে পথ দেখাতে সহায়তা করতেন। দেখতে সুদর্শন তরুণ এই দেবতা কর্মে ছিলেন দারুণ উৎসাহী। তার টুপি এবং জুতোয় ডানা লাগানো ছিল। দেবতা অ্যাপোলো তাকে ক্যাডুসিয়াস নামক এক সোনালী জাদুর দণ্ড উপহার দিয়েছিলেন। স্বর্গের নারীদের মধ্যে তিনি আফ্রোদাইতি, হার্মাফ্রোডিটাসের প্রেমে এবং মর্ত্যলোকে ডেওডালিয়ন কন্যা কিওনে, অটোলাইকাস, এবং হেরসের সঙ্গে ভালোবাসায় যুক্ত হয়েছিলেন। ডিওক্যালিয়নের মহাপ্লাবনের পর পুনরায় পৃথিবীতে মানবসৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন হার্মিস। রোমান মিথে তিনি মার্কারি নামে পরিচিত।

হার্মিস; Image Source: Fall Fox.

ডিওক্যালিয়নের মহাপ্লাবন সম্পর্কে জানতে পড়ুন: ডিওক্যালিয়নের প্লাবন: গ্রিক পুরাণে বর্ণিত মহাপ্লাবনের আখ্যান

তালিকাভুক্ত বারো প্রধান অলিম্পিয়ান ছাড়াও অলিম্পাসের আরও অনেক বাসিন্দা ছিল, যাদেরকে গৌণ অলিম্পিয়ান দেবতা হিসাবে বিবেচনা করা যেতে পারে। যেমন, অ্যাক্লেপিয়াস, এরোস, কিউপিড, হেবে, আইরিস, এরিস, মিউজ, হোরাই, মোরাই, হাইজিয়া, নেমেসিস প্রমুখ।

Related Articles