প্রাচীন গ্রিসের পৌরাণিক কাহিনিগুলোর মূল স্তম্ভ গড়ে উঠেছে দেব-দেবীদের কেন্দ্র করে। উপাখ্যানের পুরোটা জুড়েই আধিপত্য বিস্তার করেছে বারোজন অলিম্পিয়ান দেবতা। একেকসময় তাদের হুঙ্কারে কম্পিত হয়েছে আকাশ-পাতাল, কখনো বা তারা মানবজাতির জন্য বয়ে এনেছে হানাহানি বা ধ্বংস। কখনো তাদের আশীর্বাদেই কোনো সম্রাট আসীন হয়েছে গ্রিস অঞ্চলের মসনদে। গ্রিক উপকথার প্রধান বারো দেবতার একজন হচ্ছেন অলিম্পাসের কামার দেবতা হেফাস্টাস। স্বর্গের সমস্ত দেবতারা সুদর্শন হলেও এর একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন হেফাস্টাস। তিনি দেখতে ছিলেন কুৎসিত, এবং খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতেন।
অলিম্পাসের চূড়ায় দেবতাদের ধবধবে প্রাসাদ নির্মাণে তার উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। খানিকটা রগচটা স্বভাবের হলেও, তার মন ছিল দয়ায় ভরপুর। হেফাস্টাস সবসময় ঝগড়া-বিবাদ এড়িয়ে চলতেন। প্রাচীন গ্রিক কবি হোমার জানিয়েছেন, হেফাস্টাস ধাতুর একটি স্বয়ংচল যন্ত্র তৈরি করেছিলেন। তেপায়া এই বস্তুতে স্বর্ণনির্মিত চাকা জুড়ে দেওয়া হয়েছিল, যা হেফাস্টাসের নির্দেশ পেলেই হাওয়ার গতিতে ছুটত। আলকিনস প্রাসাদের সামনে তিনি কুকুর এবং সিংহের প্রতিমূর্তি তৈরি করে রেখেছিলেন, যা শত্রু চিহ্নিত করতে পারলেই কামড়ানোর ক্ষমতা রাখত।
তার জন্ম নিয়ে প্রচলিত রয়েছে নানা মত। হোমার উল্লেখ করেছেন, জিউস আর হেরার সন্তান হচ্ছেন হেফাস্টাস। কিন্তু ভিন্ন সুর তুলে হেসিয়ড জানিয়েছেন, ক্রোধের বশবর্তী হয়ে জিউসের সাথে মিলন ছাড়া পার্থেনোজেনেসিস প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিজেই হেফাস্টাসকে জন্ম দেন হেরা। মূল উদ্দেশ্য, জিউসের সমকক্ষ হিসেবে কাউকে গড়ে তোলা। হেফাস্টাসের কুৎসিত অবয়ব দেখে ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন জিউস। অগ্নিমূর্তির রূপ ধারণ করে হেফাস্টাসকে ছুড়ে মারেন পৃথিবীর সমুদ্রে। সমুদ্রের অথৈ জলরাশি থেকে তাকে উদ্ধার করেন ইউরিনোমে এবং থেটিস। তাদের কাছে নয় বছর অবস্থান করে কামার শিল্পে নিজের হাত পাকিয়ে নেন তিনি। সাথে শিখে ফেলেন আগুন, শিল্পবিদ্যা এবং ভাস্কর্যের নিখুঁত কাজ।
গয়না-অলঙ্কার তৈরিতে ছিল হেফাস্টাসের জুড়ি মেলা ভার। তিনি দৃষ্টিনন্দন সকল গয়না তৈরি করে দিতেন থেটিসকে। থেটিসের সাথে হেরার ভালো সম্পর্ক থাকায়, তারা প্রায়সময়ই বসে খোশগল্প করতেন। একদিন হেরা লক্ষ্য করেন, থেটিসের শরীরে গয়না খুব সুন্দর মানিয়েছে। দূর থেকেই তা ঔজ্জ্বল্যে চকচক করছিল। বিমুগ্ধ হেরা জিজ্ঞেস করলেন, এই গয়না তিনি কোথা থেকে সংগ্রহ করেছেন। থেটিস প্রথমে সে কথা পাশ কাটিয়ে অন্য প্রসঙ্গের সুর তুললেও, হেরা ছিলেন নাছোড়বান্দা। তিনি বার বার তা জানার জন্য থেটিসকে জোর করতে লাগলেন। অনন্যোপায় হয়ে অগত্যা হেফাস্টাসের ব্যাপারে মুখ খুলতেই হলো থেটিসকে। অলঙ্কার বানানোর জন্য দ্বীপ থেকে নিয়ে এসে হেফাস্টাসকে স্বর্গে স্থান দেন হেরা।
আরেক বর্ণনায় পাওয়া যায়, গ্রিক বীর হেরাক্লেসকে থামানোর জন্য জিউসপত্নী হেরা এক ঘূর্ণিঝড় পাঠিয়েছিলেন। এর ফলে হেরার উপর বেজায় চটেছিলেন জিউস। ক্রোধের বশবর্তী হয়ে নিজ অর্ধাঙ্গিনীকে তিনি শিকলে বন্দি করে রেখেছিলেন। নিজ মায়ের এমন দুর্দশা সহ্য হলো না হেফাস্টাসের। তাই তিনি হেরাকে এই বন্দিদশা থেকে উদ্ধার করেন। সন্তানের অতি বাড় দেখে তাকে পৃথিবীতে ছুড়ে মারলেন জিউস। এতে মর্ত্যলোকের লেমনস দ্বীপে এসে পতিত হন হেফাস্টাস। ওখানে সমুদ্র-দেবী থেটিসের সেবা-শুশ্রূষায় সুস্থ হয়ে উঠেন তিনি। এই কাহিনি সংযুক্ত আছে গ্রিস-ট্রয়ের বিখ্যাত যুদ্ধের সাথে। যুদ্ধের সময় থেটিসপুত্র অ্যাকিলিসের জন্য তিনি স্বর্গীয় উপাদানের মিশেলে অভেদ্য এক বর্ম তৈরি করেছিলেন।
নির্বাসিত হবার পর যেসকল দেবতা অলিম্পাসে ফিরে আসতে পেরেছেন হেফাস্টাস তাদের মধ্যে অন্যতম। একবার যেকোনো এক বিশেষ কারণে মা হেরার আচরণে ক্ষুব্ধ হন হেফাস্টাস। তিনি ভাবলেন যেভাবেই হোক এর প্রতিশোধ নিতে হবে। সেজন্য তিনি কূটকৌশলের আশ্রয়ে অলিম্পিয়দের জন্য বিভিন্ন উপঢৌকন প্রেরণ করেন। সেখানে, হেরার জন্য বরাদ্দ ছিল চকচকে একটি স্বর্ণনির্মিত সিংহাসন। এই সিংহাসনে বসা মাত্রই তিনি এর সাথে আঠার মতো লেগে গেলেন, বহু চেষ্টা করেও সিংহাসন থেকে উঠে দাঁড়াতে পারলেন না। হেরা কোনোভাবেই নিজেকে এই অদৃশ্য বেড়াজাল থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারছিলেন না। তৎক্ষণাৎ তিনি অন্যান্য দেবতাদের ডেকে পাঠান। সবাই বহু চেষ্টার পরেও বিফল হলেন। তখন তারা বুঝতে পারলেন, যে এই সিংহাসনের নির্মাতা, শুধুমাত্র তিনিই হেরাকে এর বন্ধন থেকে মুক্ত করতে পারবেন। তাই সকল দেবতারা মিলে লেমনস দ্বীপে গিয়ে হেফাস্টাসকে অনুনয়-বিনয় করতে লাগল। তখন হেফাস্টাস সরাসরি বলে দিলেন, “আমার কোনো মা নেই।”
প্রথমে যুদ্ধ ও কলহের দেবতা এরিস গিয়েছিলেন রাগ ভাঙাতে। কিন্তু মন গলে না হেফাস্টাসের। একে একে সবাই ব্যর্থ হলে, সফল হয়েছিলেন মদের দেবতা ডায়োনিসাস। তিনি হেফাস্টাসকে সুকৌশলে মদ পান করিয়ে মাতাল অবস্থায় অলিম্পাসে নিয়ে আসেন। বাহক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল নাদুসনুদুস এক খচ্চরকে। স্বর্গে এসে হেফাস্টাস হেরাকে এই শাপ থেকে মুক্তি দিয়ে অলিম্পাসে বসবাস শুরু করেন। মুক্তকরণের পূর্বে দেবরাজ জিউস হেফাস্টাসের নিকট প্রতিজ্ঞা করেন, হেরাকে মুক্ত করার বিনিময়ে তার যেকোনো শর্ত পূরণে রাজি থাকবে দেবসভা। তখন তিনি জ্ঞানের দেবী অ্যাথেনাকে বিবাহের ইচ্ছা-পোষণ করেন। আবার আরেক সংস্করণে পাওয়া যায়, তিনি আফ্রোদিতি বিয়ে করতে চেয়েছিলেন, এবং হেরা সে শর্ত পূরণ করে দিয়েছিলেন। আফ্রোদিতির সাথে সংসার জীবন সুখের হয়নি হেফাস্টাসের। কারণ দেবী আফ্রোদাইতি দেবতা অ্যারিসের সাথে পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়েছিলেন।
হেফাস্টাসের লোলুপ কামাতুর দৃষ্টির শিকার হয়েছিলেন জ্ঞানের দেবী অ্যাথেনা। একদিন অস্ত্র বানানোর উদ্দেশ্যে অ্যাথেনা হেফাস্টাসের দ্বারস্থ হলে, হেফাস্টাস জোর করে অ্যাথেনার সাথে সঙ্গমে লিপ্ত হতে চাইলেন। কিন্তু অ্যাথেনা তাতে বাধা প্রদান করলে সেটা আর সম্ভব হয়ে উঠেনি। হেফাস্টাস তখন তার বীর্য ছুড়ে মারলেন অ্যাথেনার দিকে, যা গিয়ে পড়ল অ্যাথেনার উরুতে। সেই বীর্য অ্যাথেনা দূরে ছুড়ে মারলে তা থেকে গায়া এবং এরিকথোনিয়াসের জন্ম হয়।
হেফাস্টাসের আদর্শ জীবনসঙ্গী হিসেবে বার বার উঠে এসেছে জ্ঞানের দেবী অ্যাথেনার নাম। অ্যাথেনার মন্দিরে হেফাস্টাসের অনেক চিত্র পাওয়া গেছে। উপকথা অনুসারে, তারা দুজনে মিলে মানবজাতিকে শিল্পকর্ম শিখিয়েছিলেন। দুজনেরই ছিল মানুষকে আরোগ্য করার অলৌকিক ক্ষমতা। হেফাস্টাসের পুরোহিতেরা জানতেন, বিষধর সাপ দংশন করলে কীভাবে মানুষকে বাঁচাতে হয়।
গ্রিস-ট্রয়ের যুদ্ধে হেফাস্টাস ছিলেন গ্রিকদের পক্ষে। তবে ট্রয়বাসীরাও তাকে পূজা করত বলে, তিনি ডায়োমেডেসের হাত থেকে বহু ট্রয়বাসীকে প্রাণে বাঁচিয়েছিলেন। তবে, ওই যুদ্ধে তিনি নদী দেবতা স্ক্যামান্ডারের মুখোমুখি হয়েছিলেন। স্ক্যামান্ডার পুত্র টিউকার ছিলেন ট্রয় অঞ্চলের প্রথম শাসনকর্তা। অর্থাৎ, ট্রয় রাজবংশের পূর্বপুরুষ ছিল টিউকার, স্ক্যামান্ডারেরা। আবার স্ক্যামান্ডার নদী ট্রয়ের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় ওই যুদ্ধে দেবতা স্ক্যামান্ডার ট্রয়ের পক্ষই বেছে নিয়েছিলেন।
যুদ্ধের একপর্যায়ে অ্যাকিলিসের সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু প্যাট্রোক্লাস ট্রয়ের বীরযোদ্ধা হেক্টরের হাতে নিহত হলে, অ্যাকিলিস ক্ষ্যাপা ষাঁড়ের মতো ক্ষিপ্ত হয়ে যান। অ্যাকিলিসকে পথভ্রষ্ট করতে স্ক্যামান্ডার তখন ট্রয়ের সমতল ভূমি প্লাবিত করে দেন। ওদিকে দেবী হেরা ছিলেন গ্রিকদের পক্ষে। তাই তিনি পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য হেফাস্টাসকে পাঠান রণক্ষেত্রে। হেফাস্টাস তার অগ্নিশিখা দিয়ে প্লাবনের গতি থামিয়ে দেন। ফলে, সমতল ভূমির পানি ধীরে ধীরে শুকিয়ে যায়। দেবতা স্ক্যামান্ডার তখন বুঝতে পারলেন কামার দেবতাকে টেক্কা দেওয়ার সাধ্য তার নেই। তাই তিনি ট্রয়ের সমভূমিকে প্লাবিত করা থেকে বিরত থাকেন। এভাবে হেফাস্টাস যুদ্ধের গতি-প্রকৃতি অনেকটাই পাল্টে দেন।
মর্ত্যলোকে হেফাস্টাসের প্রিয় জায়গা ছিল লেমনস দ্বীপ, যেখানে তিনি সিন্টিয়ান্সদের সাথে সময় কাটাতে পছন্দ করতেন। তবে লেমনস দ্বীপ ছাড়াও তিনি আগ্নেয়গিরির দ্বীপ লিপারি, হিয়েরা, ইমব্রোস, সিসিলিতে মাঝেমধ্যে যেতেন। দানবদের বিরুদ্ধে লড়ে তিনি গলিত লোহা নিক্ষেপের মাধ্যমে মিমাস নামে এক দৈত্যকে বধ করেছিলেন। আরেক দৈত্য তখন অ্যারিস্টাস রণে ভঙ্গ দিয়ে প্রাণ নিয়ে পালায়।
দেবতা হেফাস্টাস একাধারে কামারশালা, শিল্প-কুশলতা, উদ্ভাবন, আগুন এবং আগ্নেয়গিরির দেবতা ছিলেন। তার প্রতীক ছিল আগুন, নেহাই, কুঠার, গাধা, হাতুড়ি এবং সাঁড়াশি। রোমান সভ্যতায় তিনি ভালকান নামে জনপ্রিয় ছিলেন।