টিমটিম করে জ্বলছে আলো।
তাঁবুর ভেতরে একা দাঁড়িয়ে আছে অপরূপা এক নারী, জুডিথ। তার থেকে একটু দূরে, বিছানায় প্রায় বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছে শিবিরের কমান্ডার। জুডিথের চোখ তারই দিকে।
তাঁবুর চারপাশ একদম শুনশান। রক্ষীরা পর্যন্ত ভোজ শেষে একদম কাত হয়ে গেছে। বিশাল সেনাঘাটি প্রায় নিস্তব্ধ। এমনই সুযোগই দরকার ছিল জুডিথের। ঈশ্বরের ইচ্ছায় পুরষ্কার এখন তার হাতের মুঠোয়।
নিজের মনকে শক্ত করল জুডিথ। পা টিপে টিপে এগিয়ে গেল কমান্ডারের বিছানার দিকে। তার পাশেই পড়ে আছে তরবারির খাপ। আস্তে করে তরবারি কোষমুক্ত করল সে, চকচকে ফলাতে একমুহূর্তের জন্য দেখে নিল নিজের প্রতিচ্ছবি। এরপর শরীরে সঞ্চিত সব শক্তি দিয়ে দু’হাতে উঁচিয়ে ধরল ধারাল অস্ত্র।
বুক অফ জুডিথ
বুক অফ জুডিথ হিব্রুতে লিখিত একটি গ্রন্থ। ষোল অধ্যায়ের এই বইয়ে বিবৃত হয়েছে জুডিথ নামে এক নারীর সাহসিকতার কথা। নিজ শহর আসিরিয়ানদের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে যখন পতনের দোরগোড়ায়, তখন জুডিথ একাই শত্রু জেনারেলকে হত্যা করে শত্রুদের বিশৃঙ্খল করে দেয়।
জুডিথের গল্প খ্রিস্টীয় এবং ইহুদি ধর্মীয় ইতিহাসের বিতর্কিত এক বিষয়। এই বিতর্ক মূলত এর ঐতিহাসিক সত্যতা নিয়ে। সেপ্টুয়াজিন্ট (Septuagint) বা গ্রীক ভাষার ওল্ড টেস্টামেন্টে জুডিথের ঘটনা লিখিত থাকলেও দশম শতকের আগপর্যন্ত হিব্রু বাইবেলে এই কাহিনী অন্তর্ভুক্ত ছিল না, যদিও ওল্ড টেস্টামেন্টের মূল ভিত্তি কিন্তু এই হিব্রু বাইবেলই। এই সময়ে মিদ্রাশে (ইহুদি পবিত্র গ্রন্থের ব্যাখ্যা সম্বলিত বই) জুডিথের উল্লেখ পাওয়া যায়।
রোমান আমলে প্রথম জুডিথের বর্ণনা টেনে আনেন রোমের তৃতীয় বিশপ ক্লেমেন্ট। জুডিথের গল্পকে নীতিনৈতিকতার শিক্ষা হিসেবে ব্যবহার করেন তিনি। চতুর্থ শতাব্দী থেকে খ্রিস্টান মানসে জুডিথ একজন ধর্মভিরু বিধবা হিসেবে স্বীকৃত হন। পঞ্চম শতকে জেরোম ল্যাটিনে বাইবেল অনুবাদ করেন, যার নামকরণ করা হয় ভালগেট (Vulgate)। এখানেও জুডিথের কথা উল্লেখ ছিল।
বর্তমানে রোমান ক্যাথলিক, গ্রীক এবং রাশিয়ান অর্থোডক্স চার্চের মতবাদে জুডিথের কাহিনী ধর্মীয় ইতিহাস হিসেবে স্বীকৃত। তবে প্রোটেস্ট্যান্ট এবং ইহুদি ধর্মীয় পণ্ডিতদের কাছে এটি শিক্ষামূলক একটি গল্প ছাড়া কিছু নয়।
ইতিহাস কী বলে?
লেখিকা সারাহ জনস্টনের মতে, বুক অফ জুডিথ আসলে ইতিহাসমিশ্রিত একটি কল্পকাহিনী, যাকে হিস্টোরিক্যাল ফিকশন নামে অভিহিত করা যায়। জুডিথের গল্পের অনেক কিছুই প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে প্রমাণিত ইতিহাসের সাথে মেলে না। যেমন- এখানে নেবুশ্যাডনেজার নামে আসিরিয় এক রাজার কথা বলা আছে, অথচ আমরা এখন পর্যন্ত ব্যাবিলনের রাজা হিসেবেই নেবুশ্যাডনেজারের নাম জানি। এরকম আরো অনেক ঐতিহাসিক অসঙ্গতি থাকায় জুডিথের ঘটনা উপকথা হিসেবেই স্বীকৃত।
অধিকাংশ বিশেষজ্ঞই মনে করেন, জুডিথের পুস্তক লিখিত হয় হেলেনিস্টিক সময়ে, যার সময় ধরা যায় ৩২৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৩০ খ্রিস্টাব্দ অবধি। বর্তমান ফিলিস্তিন বা আলেক্সান্দ্রিয়াতে এই কাহিনী রচনা বলে তারা ধারণা করেন। অনেকেই দাবি করেন, তৎকালীন ফিলিস্তিনে কোনো ইহুদি এই কাহিনী লিখেছিল। কেউ কেউ আরো নির্দিষ্ট করে রচনার সময় দ্বিতীয় খ্রিস্টাব্দ দাবি করেন। এ সময় জুডিয়াতে সংঘটিত হয় ইহুদিদের একটি বিদ্রোহ, যা ম্যাকাবিয়ান বিদ্রোহ নামে পরিচিত। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞের মতে, বিদ্রোহীদের উদ্দীপ্ত করতেই জুডিথের গল্পের অবতারণা।
বহু শতাব্দীর পরিক্রমায় জুডিথের কাহিনীর বেশ কিছু সংস্করণ তৈরি হয়েছে। তবে সব গল্পেই মূলভাব অপরিবর্তিত। জুডিথের শহর শত্রুদের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে যখন পতনোন্মুখ, তখনই সে আবির্ভূত হয় রক্ষাকর্তা হিসেবে।
নেবুশ্যাডনেজার
দোর্দণ্ড প্রতাপশালী আসিরিয়ান সাম্রাজ্যের শীর্ষে তখন নেবুশ্যাডনেজার। রাজধানী নিনেভেহ থেকে বিস্তৃত তার রাজকীয় প্রভাব। নিজের সীমানা সম্প্রসারণ নেবুশ্যাডনেজারের ধ্যানজ্ঞান। সেই লক্ষ্যে নিজের শাসনের দ্বাদশ বছরে তার দৃষ্টি পড়ল একবাটানা নগরীর দিকে। মেডেস গোষ্ঠীর শক্তিশালী ঘাঁটি এই একবাটানা, যেখানে রাজত্ব করছেন আরফাক্সাড (Arphaxad)।
আরফাক্সাডের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রার প্রস্তুতি নিলেন আসিরিয়ান সম্রাট। নিজের দলে যোগ দিতে আহ্বান পাঠানো হলো দূরদূরান্তে। নেবুশ্যাডনেজারের বার্তা নিয়ে দূত ছুটে গেল পশ্চিমের সমস্ত নগরীতে। সিলিসিয়া, দামেস্ক, লিবেনাস পাড়ি দিয়ে সম্রাটের দূতেরা সমুদ্র উপকূল ধরে সামারিয়া, জর্ডান, মিশর, ইথিওপিয়া আর জেরুজালেম অবধি চলে গেল।
উপকূলবর্তী সিডোন, টাইর, সুর, জেম্নান অঞ্চল থেকে শুরু করে সিলিসিয়া, জেরুজালেম আর অন্যান্য দেশ নেবুশ্যাডনেজারের অনুরোধ ফিরিয়ে দিল। আসিরিয়ান দূতকেও অপমান করতে ছাড়ল না। সম্রাট এতে অত্যন্ত ক্রোধান্বিত হয়ে পড়লেন। তার আহ্বান মানে কিন্তু আদেশ, সেই আদেশ অমান্য করে রাজ্যগুলো তাদের উপর আসিরিয়ানদের ক্রোধই শুধু ডেকে আনল।
নেবুশ্যাডনেজার প্রতিজ্ঞা করলেন, আরফাক্সাডের একটা বিহিত করেই তিনি এদের ধরবেন। ক্ষমতা নেয়ার সতেরতম বছরে সুরক্ষিত একবাটানা আক্রমণ করল আসিরিয়ান সেনারা। মেডেসদের রাজা পালিয়ে বাঁচলেন।
পরের বছর প্রথম মাসের একুশতম দিনে বিজয় উদযাপনে রাজপ্রাসাদের জমকালো অনুষ্ঠানের আয়োজন করলেন নেবুশ্যাডনেজার। তার উপদেষ্টারা প্রতিজ্ঞার কথা স্মরণ করিয়ে দিল। সম্রাট সিদ্ধান্ত নিলেন নতুন অভিযানের। ডেকে পাঠানো হলো তার সেরা জেনারেল, হলোফার্নেসকে (Holofernes)।
হলোফার্নেস
সম্রাটের আদেশ পেয়ে হলোফার্নেস প্রস্তুতি নিতে আরম্ভ করলেন। প্রায় ১,২০,০০০ সৈন্য সমাবেশ করলেন তিনি। এদের ১২,০০০ ছিল অশ্বারোহী তীরন্দাজ। মালপত্র বয়ে নিতে উট, গাধা আর খচ্চরের বিরাট পাল জড়ো করা হলো। শস্য আর গবাদি পশু নেয়া হলো সবার খাবারের সংস্থান করতে। প্রচুর সোনা-রূপাও হলোফার্নেস সঙ্গে নেন।
জোগাড়যন্ত্র শেষ করে পুরোহিতদের আশীর্বাদ নিয়ে শুভদিন দেখে বেরিয়ে পড়লেন হলোফার্নেস। তিন দিন যাত্রা করে সিসিলিয়া নিকটবর্তী বেক্টিলেথ শহরের সামনে এসে পড়লেন তিনি। শুরু হলো জ্বালাও-পোড়াও। মেসোপটেমিয়ার যেসব নগরী নেবুশ্যাডনেজারের বিরোধিতা করেছিলে তাদের ছারখার করে দেয়া হলো। সিলিসিয়ার সীমান্ত এলাকা কব্জা করে উপকূল ধরে অভিযান চালালেন হলোফার্নেস। লণ্ডভণ্ড করে দিলেন বহু অঞ্চল।
দামেস্কের কৃষকেরা যখন ফসল ঘরে তুলতে ব্যস্ত তখন পাহাড়ি এলাকা থেকে নেমে এলো আসিরিয়ানরা। সব ক্ষেতে আগুন লাগিয়ে ধ্বংস করে দিল পশুপাল। এরপর সৈন্যরা হলোফার্নেসের নির্দেশে হত্যা করল অস্ত্র ধরতে সক্ষম সব লোককে। লুণ্ঠন চালালো রক্তে ভেসে যাওয়া শহরে।
নেবুশ্যাডনেজারের আহ্বান ফিরিয়ে দেয়া সবাই তখন প্রচণ্ড ভীত। সম্রাটের প্রতি আনুগত্য জাহির করার হুড়োহুড়ি শুরু হয়ে গেল। সিডোন, টাইর, সুর, জেম্নানসহ সকল নগরী হলোফার্নেসের কাছে নতজানু হয়ে বার্তা পাঠাল। আসিরিয়ান জেনারেল সব শহরে নিজের ঘাঁটি বসালেন, নিয়ে গেলেন তাদের অনেক পবিত্র সম্পদ। পদানত রাজ্যগুলো থেকে অনেককে অন্তর্ভুক্ত করে নিলেন নিজ বাহিনীতে। এরপর রওনা দিলেন জুডিয়ার দিকে। জুডিয়ার প্রবেশমুখে প্রাচীন গেবা আর স্কাইথোপোলিস নগরীর মাঝখানে শিবির করে বসে রইলেন একমাস।
জুডিয়ার অধিবাসীরা হলোফার্নেসের সব খবরই পাচ্ছিল। কী উদ্দেশ্যে তিনি ঘাঁটি করেছেন তা বুঝতে তাদের সময় লাগল না। তারা সবাই একত্রিত হলো পরামর্শ করতে। জেরুজালেম থেকে তাদের প্রধান পুরোহিত জোয়াকিম শত্রুদের প্রতিরোধ করতে সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোকে দুর্গে পরিণত করবার নির্দেশ দিলেন।