
দেবাধিদেব জিউস থাকেন মহান পর্বত অলিম্পাসে। সেখানে অসংখ্য পত্নী উপপত্নী থাকা সত্বেও জিউসের মন পড়ে থাকে অন্য নারীদের উপর। সে হোক অমর বা নশ্বর, দেবী বা উপদেবী। নানান রূপে জিউস তাদের সান্নিধ্যে পৌঁছে নিজের প্রেম জানান। এদের বেশিরভাগকেই বিয়ে করতে পারেন না তিনি। তার ভক্তদের দাবি, এতজনকে বিয়ে করে এনে অলিম্পাসে রাখতে গেলে তো তিল ধারণের জায়গা হবে না, তাই দেবরাজ আর অলিম্পাসের পরিবেশ নষ্ট করতে চান না। কিন্তু কারণটা আসলে ভিন্ন। জিউস প্রচণ্ড ভয় পান তার তৃতীয় স্ত্রী হেরাকে। হেরা যদি এসব জানতে পারে, জিউসকে সে কিছুই বলবে না, দেবাধিদেবকে ভয় দেখিয়ে কতটুকুই বা করতে পারবে সে? ক্ষতি করবে জিউসের প্রেমিকাদের। বিভিন্নভাবে কষ্ট দিয়ে মনের রাগ মেটাবে। জিউস তার সব প্রেমিকাকে মনে রাখতে পারেন না। তবে কিছু ব্যতিক্রমকে ভোলাও যায়না। সেই অজস্র নারীদের মাঝে বিখ্যাত একজন ছিল ইউরোপা।

ইউরোপার জন্ম হয়েছিল ফিনিসিয়ায়। বাবা ছিলেন ফিনিসিয়ার রাজা এজিনর। মা টেলেফাসা। জন্মসূত্রে ইউরোপা সমুদ্রদেব পসেইডনের বংশধর। ইউরোপা ছিল সবার চোখের মণি। তিন ভাই ক্যাডমাস, সিলিক্স আর ফিনিক্স বোনকে চোখের আড়াল হতে দিতে চাইতো না। সে ছিল অপার্থিব সুন্দরী। নশ্বর কোনো মানুষ এত সুন্দর হতে পারে বিশ্বাস হতো না ফিনিসিয়ার অধিবাসীদের। যেন আকাশে উড়তে গিয়ে কখনো হয়তো কোনো দেবী মাটিতে খসে পড়েছিলেন। তারপর স্বর্গের স্মৃতি ভুলে হয়ে গেছেন ইউরোপা। এমন সব কল্পনাতেই ফিনিসিয়াবাসীরা ইউরোপাকে আরো বেশি করে আগলে রাখত। সব মেয়ের মায়েরা চাইতো তাদের মেয়ে ইউরোপার সাথে খেলাধুলা করুক। ছেলের মায়েরা বৃথাই তাদের ছেলের বউ হিসেবে ইউরোপাকে কামনা করত। সবার প্রশ্রয়ে হেসেখেলে, ফুল তুলে, সাগর তীরে ঘুরেফিরে ভালই কাটছিল ইউরোপার দিনকাল। কিন্তু একটা সময়ে ইউরোপা রাতে অদ্ভুত কিছু স্বপ্ন দেখতে শুরু করল। ইউরোপা স্বপ্ন দেখল তাকে নিয়ে যুদ্ধ করছে দুই নারী। তারা নিজেদের দুইটি মহাদেশ বলে দাবী করছে। একজনের গায়ে এশিয়ার নারী যোদ্ধাদের পোশাক। আরেকজনেরটা তাদের (ফিনিসিয়ার) মতোই।
এশিয় নারী বলল,
“আমি তোমার চাইতে অধিক শক্তিশালী, সম্পদেরও কিছু কমতি নেই আমার। সমৃদ্ধিতে আমি বিশ্বব্যাপী। ইউরোপা আমার। তোমার মতো নামহীনের অধিকার নেই তার উপর”।
যুদ্ধ করতে করতেই অন্য নারী বলল, “আমি নামহীন, আমার সম্পদও নেই তোমার মতো, তাই আমার ইউরোপাকে দরকার। ইউরোপা আমার অলঙ্কার হবে। জিউস আমাকেই দান করবেন তাকে।” স্বপ্নের এই যুদ্ধে দ্বিতীয় নারী জিতে যায়। প্রথম যেদিন স্বপ্নটা দেখল ইউরোপা, আর পাঁচটা স্বপ্নের মতো অর্থহীন ভেবে উড়িয়ে দিল। কিন্তু তারপর প্রতিরাতেই এমন স্বপ্ন আসতে শুরু করল। ভেবে কূলকিনারা না পেয়ে বসে থাকতেন ইউরোপা। কিন্তু এসব স্বপ্নের কথা বাড়িতে ঘুণাক্ষরেও জানতে দেননি। এমনিতে তাকে সাগরতীরে একটু ফুল তুলতে দিতেই যেন বাড়ির সবার প্রাণ ওষ্ঠাগত, এসব স্বপ্নের কথা শুনলে হয়তো ঘর থেকেই বেরোতে দেবেনা।
ওদিকে অলিম্পাস পর্বতে বসে জিউসের চোখ পড়েছে ফিনিসিয়ার এই অপূর্ব সুন্দরীর উপর। এরোস বা কিউপিড জিউসের চোখের দিকে তাকিয়ে একবার তীর ছুঁড়ে গেছে জিউসের বুকে। জিউস পাগল হয়ে উঠেছেন ইউরোপার জন্য। কিন্তু হেরাকে এড়িয়ে কীভাবে যাবেন, ইউরোপার কাছে তা ভেবে পান না। আর সবদিনের মতো সেদিনও ইউরোপা তার সখীদের সাথে নিয়ে সাগর তীরের ছোট বনটার ধারে ফুল তুলতে এসেছিল। তাদের হাসির দমকের সাথে তাল মেলাচ্ছিল ঘাসফুলেরা। জিউস দেখলেন হেরা বাড়িতে নেই। এই তো সুযোগ। সাদা ষাঁড়ের রূপ ধরে মর্ত্যের দিকে চললেন। সাগর পেরিয়ে সোজা ঢুকলেন বনে।

ষাঁড়ের কাঁধে ইউরোপা; image source: Living Moon Astrology
এত বড় ষাঁড় দেখে ভয় পাওয়ার কথা। কিন্তু এই ষাঁড়ের হাবভাব ছিল পোষা বিড়ালের মতো আদুরে। ইউরোপা আর তার সখীদের তো ভীষণ ভাল লেগে গেল তাকে। সবাই একে একে তার পিঠে চড়ে ঘুরে বেড়াতে লাগল। যখন ইউরোপার পালা এল, আর সবার মত সেও নিশ্চিন্তে চেপে বসল ষাঁড়ের কাঁধে। যেই না চড়ে বসা, ষাঁড় তাকে নিয়ে দৌড় দিল সাগরের দিকে। সখীরা ভাবছিল, এ বুঝি কোনো মজার খেলা। তারাও পিছু পিছু আসছিল দৌড়ে। তাদের ধারণা ছিল, ষাঁড় নিশ্চয়ই পানির আগে গিয়ে থেমে যাবে। কিন্তু সে থামল না, তীরের ছোট ছোট ঢেউ কেটে সে এগিয়ে চলল আরো বড় ঢেউয়ের দিকে। সখীদের সম্বিৎ ফিরল। ষাঁড়টিকে ধাওয়া করে ফেরাবার চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু কতই বা পাল্লা দেবে দেবতার সাথে? এদিকে ইউরোপার কিন্তু তখনও ভয় লাগেনি, বরং ষাঁড়টা এত সুন্দর সাঁতার কাটতে পারে দেখে তার আনন্দই হল। ততক্ষণে বেশ খানিকটা পথ চলে এসেছে তারা। তীর থেকে হাপুস চোখে কাঁদা সখীদের মুখগুলো অস্পষ্ট লাগছে এখান থেকে। সে ভাবল, কি বোকা তার সখীরা! এমন বাধ্য ষাঁড়কে তো বললেই ফিরিয়ে নিয়ে যাবে তীরে। কিন্তু না, যতই চেষ্টা চরিত্র করুক, কিছুতেই কাজ হল না। ইউরোপার ভুল ভাঙল, ষাঁড় তাকে নিয়ে আরো বেশি গভীর সমুদ্রের দিকে এগিয়ে গেল। ইউরোপার একবার মনে হল লাফ দেয় পানিতে। কিন্তু এই গভীর সমুদ্রে লাফ দিয়ে সাঁতার কেটে তীরে পৌছানোর শক্তি নেই তার। সে ষাঁড়কে অবিরাম অনুনয় করে গেল, যেন ষাঁড় তাকে ফিরিয়ে দেয়। ষাঁড় তখন মানুষের ভাষায় কথা বলে উঠল, “হে ইউরোপা, তুমি ভয় পেয়ো না, আমি তোমার নামকে দেব অমরত্ব!” ইউরোপা দেখল তাদেরকে ঘিরে ঘুরছে ডলফিনে চড়া দেবতারা। আরো অনেক দেবতাকেই সে দেখল। তাদের মধ্যে চিনতে পারল দাদা পসেইডনকে। ইউরোপাকে যেন আশীর্বাদ করছেন পসেইডন। সে বুঝল এই ষাঁড়ও কোনো দেবতাই হবে।
জিউস থামল ক্রিট দ্বীপে গিয়ে। এখানেই গোপনে তার মা তাকে জন্ম দিয়েছিল। জিউসের বেড়ে ওঠাও এখানে। তারপর তিনি দেবতার রূপে ফিরে এলেন। কিছুদিন ইউরোপার সাথে থেকে জিউস ফিরে গেলেন অলিম্পাসে। জিউস আর ইউরোপার তিন ছেলে হয়। মিনোস, র্যাডাম্যান্থস আর সারপেডন। তারপর তার বিয়ে হয় ক্রিটের রাজা এস্টেরিওনের সাথে। ইউরোপা হন ক্রিটের প্রথম রানি।

ওদিকে ফিনিয়াসে রাজা এজিনর মেয়েকে হারিয়ে শোকে পাগল হয়েছেন। তিন ছেলেকে ডেকে বললেন, “যেখান থেকে পারো বোনকে খুঁজে আনো, যদি না পারো, মুখ দেখিয়ো না কখনো।” বাবার আদেশের পর তিন ছেলে পথে বেরিয়ে পড়ল তাদের কাছে কোনো সূত্র ছিল না। তাই তিনজন তিনদিকে চলে গিয়ে বোনকে খুঁজতে লাগল। ক্যাডমাস বোনকে না পেয়ে গ্রিসে গিয়ে থিবসের প্রতিষ্ঠা করল। উপকথায় প্রচলিত আছে, সে সেখানে অক্ষরজ্ঞান এনেছিল। সিলিক্স গেল এশিয়া মাইনরের দিকে, প্রতিষ্ঠা করল সিসিলিয়ার, ফিনিক্স চলে গেল আফ্রিকাতে।
জিউস ইউরোপাকে চারটি উপহার দিয়েছিলেন। প্রথমটা সুন্দরভাবে অলংকৃত এক কণ্ঠহার। কন্ঠহারটা বানিয়েছিলেন হিফিস্টাস স্বয়ং। দ্বিতীয়টা ছিল ট্যালোস। ব্রোঞ্জনির্মিত বিশালাকায় এক প্রহরী। ক্রিট দ্বীপে ইউরোপাকে নিরাপদ রাখার জন্য জিউস এটা ইউরোপাকে উপহার দেন। প্রতিদিন ট্যালোস তিনবার করে পুরো ক্রিট দ্বীপের চারপাশে ঘুরে আসত। তৃতীয় উপহার ছিল ল্যেল্যাপ্স নামের এক কুকুর। যার নিয়তি ছিল, সে যাকে তাড়া করবে, তাকে ধরবেই। একদিন এক তিউনিশীয় শেয়ালকে ল্যেল্যাপ্স তাড়া করে। শিয়ালটার নিয়তি ছিল কেউ তাকে ধরতে পারবে না। এমন উভয়সংকটে পড়ে জিউস দুজনকেই পাথর বানিয়ে দেন। চতুর্থ উপহার ছিল একটা বর্শা, যা কখনো লক্ষ্যচ্যুত হবে না।

জিউস যে ষাঁড়ের রূপ ধরেছিলেন, তাকে স্মরণীয় করে রাখতে আকাশের তারকামন্ডলী বানিয়ে দেন, আমাদের দেখা বৃষ (taurus) তারকামণ্ডলীর পেছনের উপকথা এটি।
ইউরোপা আর তার ছেলেরা যেহেতু অমর ছিল, সাধারণ মানুষের মতোই তাদের মৃত্যু হয়। মৃত্যুর পর ইউরোপার তিন ছেলে পাতালের তিন বিচারক নিযুক্ত হয়। আর ইউরোপাকে দেওয়া কথা অনুযায়ী ক্রিটের নাম ইউরোপার সাথে মিলিয়ে ‘ইউরোপ’ রাখেন জিউস। গ্রিক পুরাণে এভাবেই জন্ম হয় ইউরোপ মহাদেশের।
ফিচার ইমেজ- Ovid’s Metamorphoses