[দ্রোণ পর্ব মহাভারতের ১৮টি পর্ব/অধ্যায়ের মধ্যে ৭ম পর্ব। পর্বটিতে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের একাদশ থেকে পঞ্চদশ দিনের ঘটনাবলির বিবরণ দেয়া হয়েছে। কিশোরীমোহন গঙ্গোপাধ্যায় কর্তৃক সম্পাদিত মহাভারতের ইংরেজি সংস্করণ এবং ভারতের মহারাষ্ট্র প্রদেশের পুনে শহরে অবস্থিত ‘ভাণ্ডারকর ওরিয়েন্টাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট’ কর্তৃক প্রকাশিত মহাভারতের ‘সমালোচনামূলক সংস্করণ’ (critical edition) অনুযায়ী, দ্রোণ পর্ব ৫টি উপ–পর্বে বিভক্ত — দ্রোণাভিষেক পর্ব, অভিমন্যু–বধ পর্ব, জয়দ্রথ–বধ পর্ব, ঘটোৎকচ–বধ পর্ব এবং দ্রোণ–বধ পর্ব।
দ্রোণাভিষেক পর্বে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের একাদশ ও দ্বাদশ দিনের যুদ্ধের বিবরণ দেয়া হয়েছে। অভিমন্যু–বধ পর্বে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের ত্রয়োদশ দিনের যুদ্ধের বিবরণ দেয়া হয়েছে। জয়দ্রথ–বধ পর্বে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের চতুর্দশ দিনের যুদ্ধের বিবরণ দেয়া হয়েছে। ঘটোৎকচ–বধ পর্বে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের চতুর্দশ রাতের যুদ্ধের বিবরণ দেয়া হয়েছে। দ্রোণ–বধ পর্বে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পঞ্চদশ দিনের যুদ্ধের বিবরণ দেয়া হয়েছে।
ইতিপূর্বে রোর বাংলায় ‘কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ: দ্রোণ পর্বের সারসংক্ষেপ‘ শিরোনামে প্রকাশিত ৪ পর্ববিশিষ্ট নিবন্ধে দ্রোণাভিষেক ও অভিমন্যু–বধ পর্ব দুটির সংক্ষিপ্ত বিবরণ প্রদান করা হয়েছে। এই নিবন্ধে জয়দ্রথ–বধ পর্বের (অর্থাৎ কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের চতুর্দশ দিনের যুদ্ধের) একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ প্রদান করা হবে]
যুদ্ধের চতুর্দশ দিন: সময়ের বিরুদ্ধে অর্জুনের লড়াই
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের চতুর্দশ দিনে দ্রোণাচার্য কৌরব সৈন্যদের নিয়ে ‘শকটব্যূহ’, ‘চক্রব্যূহ’ ও ‘সূচিমুখব্যূহে’র সমন্বয়ে একটি অত্যন্ত জটিল ব্যূহ গঠন করেন। ব্যূহের একেবারে শেষ প্রান্তে ছিলেন জয়দ্রথ। কর্ণ, অশ্বত্থামা, ভুরিশ্রবা, বৃষসেন, শল্য ও কৃপাচার্যের নেতৃত্বে ৬০,০০০ রথী, ১৪,০০০ হাতি, ১ লক্ষ অশ্বারোহী এবং ১,২০,০০০ পদাতিক সৈন্য জয়দ্রথের সুরক্ষার জন্য নিয়োজিত ছিল। কৌরব ব্যূহকে প্রতিহত করার জন্য ধৃষ্টদ্যুম্ন ও শতানীক পাণ্ডব সৈন্যদের নিয়ে একটি ব্যূহ গঠন করেন এবং এরপর উভয় পক্ষের মধ্যে ঘোরতর যুদ্ধ আরম্ভ হয়ে যায়। চতুর্দশ দিনের যুদ্ধে কৌরবদের মূল লক্ষ্য ছিল জয়দ্রথকে অর্জুনের হাত থেকে রক্ষা করা, আর পাণ্ডবদের মূল লক্ষ্য ছিল অর্জুন যেন জয়দ্রথকে হত্যা করতে পারেন সেটি নিশ্চিত করা। অর্জুনের জন্য এটি ছিল মরণপণ সংগ্রাম, কারণ তিনি ঐদিন সূর্যাস্তের মধ্যে জয়দ্রথকে হত্যা করতে ব্যর্থ হলে তার নিজের করা প্রতিজ্ঞা অনুযায়ী তাকে আগুনে আত্মাহুতি দিতে হতো।
যুদ্ধের শুরুতেই দুর্যোধনের ভাই দুর্মর্ষণ ১,০০০ রথ, ১০০ হাতি, ৩০০ অশ্বারোহী এবং ১০,০০০ পদাতিক সৈন্যের সমন্বয়ে গঠিত একটি সৈন্যদল নিয়ে কৌরব ব্যূহ থেকে বেরিয়ে এসে অর্জুনের দিকে অগ্রসর হন। অর্জুন তাদের দিকে অগ্রসর হয়ে তাদেরকে আক্রমণ করেন এবং একাকী তাদের সকলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে থাকেন। ক্রুদ্ধ অর্জুনের তীরে কৌরব বাহিনীর বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয় এবং তাদের বহুসংখ্যক রথী, হাতি, অশ্বারোহী ও পদাতিক সৈন্য নিহত হয়। কার্যত অর্জুন এত তীব্রতার সঙ্গে যুদ্ধ করছিলেন যে, কৌরব সৈন্যদের মনে হচ্ছিল, একজন নয়, অসংখ্য অর্জুন তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছেন। শীঘ্রই দুর্মর্ষণ ও তার সৈন্যদলকে পরাজিত করে অর্জুন কৌরব বাহিনীর অন্যান্য অংশের ওপর আক্রমণ চালান এবং কৌরব সৈন্যরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়তে শুরু করে।
অর্জুনের নিকট দুর্মর্ষণ ও তার সৈন্যদলের পরাজয়ের পর দুঃশাসন একটি বৃহৎ হস্তীবাহিনী নিয়ে কৌরব ব্যূহ থেকে বেরিয়ে আসেন এবং অর্জুনের দিকে অগ্রসর হন। অর্জুন একই রকম তীব্রতার সঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন এবং কৌরব হস্তীবাহিনীর ওপর বিপুল সংখ্যক তীর নিক্ষেপ করেন। তার তীরে কৌরব হস্তীবাহিনীর বিপুল সংখ্যক হাতি ও তাদের আরোহীরা নিহত হয়। বিপুল ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে কৌরব সৈন্যরা সেখান থেকে পশ্চাৎপসরণ করতে শুরু করে। দুঃশাসন নিজেও অর্জুনের তীরের আঘাতে গুরুতরভাবে আহত হন এবং আতঙ্কিত হয়ে তার অবশিষ্ট সৈন্যদের নিয়ে সেখান থেকে পশ্চাৎপসরণ করেন। অর্জুনের নিকট পরাজিত হওয়ার পর দুঃশাসন তার সৈন্যদল নিয়ে পুনরায় কৌরব ব্যূহের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন।
দ্রোণাচার্য–অর্জুন যুদ্ধ: কৃষ্ণের চাতুর্য এবং কৌরব ব্যূহে অর্জুনের অনুপ্রবেশ
এরপর অর্জুন ক্ষিপ্রগতিতে কৌরব ব্যূহের প্রবেশমুখে এসে পৌঁছান এবং সেখানে অবস্থানরত দ্রোণাচার্যের সম্মুখীন হন। কৃষ্ণের পরামর্শে অর্জুন বিনীতভাবে দ্রোণাচার্যের কাছে কৌরব ব্যূহে প্রবেশ করার জন্য অনুমতি প্রার্থনা করেন। কিন্তু দ্রোণাচার্য প্রত্যুত্তরে বলেন যে, তাকে পরাজিত না করে অর্জুন জয়দ্রথকে হত্যা করতে পারবেন না। এটি বলে দ্রোণাচার্য অর্জুনের বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন এবং অর্জুনের দিকে তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন। অর্জুন তীরের সাহায্যে দ্রোণাচার্য কর্তৃক নিক্ষিপ্ত তীরবৃষ্টিকে প্রতিহত করেন এবং দ্রোণাচার্যের দিকে পাল্টা তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন। দ্রোণাচার্য তীরের সাহায্যে অর্জুন কর্তৃক নিক্ষিপ্ত তীরবৃষ্টিকে প্রতিহত করেন এবং অর্জুন ও কৃষ্ণকে তীরবিদ্ধ করেন। এরপর দ্রোণাচার্যের তীরের আঘাতে অর্জুনের দৈব ধনুক গাণ্ডীবের জ্যা কাটা পড়ে এবং দ্রোণাচার্য অর্জুন, কৃষ্ণ ও অর্জুনের রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলোকে তীরবিদ্ধ করেন।
কিন্তু অর্জুন ক্ষিপ্রগতিতে তার ধনুকে জ্যা পরিয়ে নেন এবং তার তীরে দ্রোণাচার্যের অধীনস্থ বহুসংখ্যক রথী, হাতি, অশ্বারোহী ও পদাতিক সৈন্য নিহত হয়। এরপর দ্রোণাচার্য অর্জুনের দিকে তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন এবং দ্রোণাচার্যের তীরের আঘাতে অর্জুন কয়েক মুহূর্তের জন্য সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন। অবশ্য তিনি শীঘ্রই সংজ্ঞা ফিরে পান এবং দ্রোণাচার্যকে তীরবিদ্ধ করেন। প্রত্যুত্তরে দ্রোণাচার্য অর্জুন ও কৃষ্ণকে তীরবিদ্ধ করেন এবং তাদের দিকে এত তীর নিক্ষেপ করেন যে, অর্জুনের রথের চারদিক অন্ধকার হয়ে যায়। এমতাবস্থায় কৃষ্ণ অর্জুনকে এই মর্মে পরামর্শ দেন যে, তাদের উচিত দ্রোণাচার্যকে এড়িয়ে কৌরব ব্যূহের অভ্যন্তরে অগ্রসর হওয়া, কারণ তাদের হাতে খুব কম সময় রয়েছে।
কৃষ্ণের পরামর্শে অর্জুন দ্রোণাচার্যের সঙ্গে চলমান দ্বৈরথ যুদ্ধ পরিত্যাগ করেন এবং কৃষ্ণ অর্জুনের রথ ঘুরিয়ে দ্রোণাচার্যকে অতিক্রম করে কৌরব ব্যূহের ভিতরের দিকে পরিচালিত করেন। এমতাবস্থায় দ্রোণাচার্য পিছন থেকে অর্জুনকে ডেকে বলেন যে, “অর্জুন, তুমি কোথায় যাচ্ছো? এটি কি সত্যি নয় যে, তুমি ততোক্ষণ রণে ভঙ্গ দাও না, যতক্ষণ না তোমার শত্রু পরাজিত হয়?” অর্জুন এর জবাবে বলেন, “আপনি আমার গুরু, আমার শত্রু নন। আমি আপনার শিষ্য এবং আপনার ছেলের মতো। আর পুরো বিশ্বে এমন কোনো ব্যক্তি নেই যে আপনাকে যুদ্ধে পরাজিত করতে পারে।” এই বলে অর্জুন কৌরব ব্যূহের ভেতরের দিকে অগ্রসর হন। পাঞ্চাল রাজ্যের রাজপুত্র যুধমন্যু ও উত্তমৌজ অর্জুনের রথের রক্ষী হিসেবে তার পিছে পিছে কৌরব ব্যূহে প্রবেশ করেছিলেন এবং তারাও অগ্রসরমান অর্জুনকে অনুসরণ করেন।
এ সময় কৃতবর্মা, সুদক্ষিণ ও শ্রুতায়ুর নেতৃত্বে কৌরব সৈন্যরা অর্জুনকে আক্রমণ করে তার গতিরোধ করে এবং দ্রোণাচার্য অর্জুনের পশ্চাদ্ধাবন করে অর্জুনের কাছাকাছি এসে পৌঁছান। অর্জুনের তীরে তাকে বাধা প্রদানকারী কৌরব সৈন্যদলটির বহুসংখ্যক সৈন্য নিহত হয় এবং এরপর অর্জুন আবার দ্রোণাচার্যের বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন। দ্রোণাচার্য অর্জুনকে তীরবিদ্ধ করেন এবং অর্জুনের দিকে তীব্র তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন। অর্জুন মন্ত্র উচ্চারণ করে ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করেন এবং দ্রোণাচার্য কর্তৃক নিক্ষিপ্ত তীরবৃষ্টিকে প্রতিহত করেন। দ্রোণাচার্য আবার অর্জুনের দিকে বিপুল সংখ্যক তীর নিক্ষেপ করেন, কিন্তু অর্জুন মন্ত্র উচ্চারণ করে ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগের মাধ্যমে দ্রোণাচার্য কর্তৃক নিক্ষিপ্ত তীরবৃষ্টিকে প্রতিহত করেন। এরপর দ্রোণাচার্য অর্জুন ও কৃষ্ণ উভয়কে তীরবিদ্ধ করেন। এমতাবস্থায় অর্জুন আবারো দ্রোণাচার্যকে এড়িয়ে সেখান থেকে সরে পড়েন এবং কৃতবর্মা ও সুদক্ষিণের রথের মাঝামাঝি স্থানে অবস্থান গ্রহণ করেন।
কৃতবর্মা–অর্জুন যুদ্ধ: অর্জুনের রক্ষীদের গতিরোধ
এরপর কৃতবর্মা অর্জুনের বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন এবং কৃতবর্মা ও অর্জুন একে অপরকে তীরবিদ্ধ করতে থাকেন। অর্জুনের তীরের আঘাতে কৃতবর্মার ধনুক কাটা পড়ে, কিন্তু কৃতবর্মা আরেকটি ধনুক উঠিয়ে অর্জুনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ অব্যাহত রাখেন এবং তারা আবার একে অপরকে তীরবিদ্ধ করতে থাকেন। এমতাবস্থায় কৃষ্ণ অধৈর্য্য হয়ে অর্জুনকে বলেন, “কৃতবর্মার প্রতি কোনোরকম দয়া দেখিয়ো না! তার সঙ্গে তোমার সম্পর্ককে উপেক্ষা করে তাকে পরাজিত ও হত্যা করো!” এরপর অর্জুনের তীরের আঘাতে কৃতবর্মা মুহূর্তের জন্য সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন এবং সেই সুযোগে অর্জুন সেখান থেকে সরে সামনের দিকে অগ্রসর হয়ে কম্বোজ রাজ্যের সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন।
এদিকে মুহূর্তের মধ্যেই কৃতবর্মা সংজ্ঞা ফিরে পান এবং অর্জুনকে কম্বোজের সৈন্যদের সঙ্গে যুদ্ধরত অবস্থায় দেখে তিনি অর্জুনের সঙ্গে থাকা যুধমন্যু ও উত্তমৌজের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন। একটি সংক্ষিপ্ত যুদ্ধের পর যুধমন্যু ও উত্তমৌজের তীরের আঘাতে কৃতবর্মার ধনুক ও রথের ঝাণ্ডা কাটা পড়ে। কৃতবর্মা আরেকটি ধনুক উঠিয়ে যুধমন্যু ও উত্তমৌজের দিকে তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন এবং তার তীরের আঘাতে যুধমন্যু ও উত্তমৌজের ধনুকদ্বয় কাটা পড়ে। যুধমন্যু ও উত্তমৌজ নতুন ধনুক উঠিয়ে কৃতবর্মার বিরুদ্ধে যুদ্ধ অব্যাহত রাখেন। এভাবে অর্জুন কৌরব ব্যূহের গভীরে প্রবেশের সুযোগ লাভ করেন, কিন্তু যুধমন্যু ও উত্তমৌজ কৌরব ব্যূহের প্রথমভাগে আটকা পড়ে যান।
শ্রুতায়ুধ–অর্জুন যুদ্ধ: মহাভারতের ‘বুমেরাং’
অর্জুনকে অগ্রসর হতে দেখে রাজা শ্রুতায়ুধ সসৈন্যে অর্জুনের দিকে ছুটে যান এবং তার বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন। তিনি অর্জুন ও কৃষ্ণকে তীরবিদ্ধ করেন এবং প্রত্যুত্তরে অর্জুন তাকে তীরবিদ্ধ করেন। এরপর শ্রুতায়ুধ আবার অর্জুনকে তীরবিদ্ধ করেন, কিন্তু অর্জুনের তীরের আঘাতে শ্রুতায়ুধের ধনুক ও তূণীর কাটা পড়ে এবং এরপর অর্জুন শ্রুতায়ুধকে তীরবিদ্ধ করেন। ক্রুদ্ধ শ্রুতায়ুধ আরেকটি ধনুক উঠিয়ে অর্জুনকে তীরবিদ্ধ করেন, কিন্তু প্রত্যুত্তরে অর্জুন শ্রুতায়ুধকে তীরবিদ্ধ করেন এবং অর্জুনের তীরের আঘাতে শ্রুতায়ুধের রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো ও রথটির সারথি নিহত হয়। এরপর অর্জুন আবার শ্রুতায়ুধকে তীরবিদ্ধ করেন। শ্রুতায়ুধ ক্ষিপ্ত হয়ে তার ধনুক নামিয়ে রেখে একটা গদা হাতে নিয়ে তার বিকল রথ থেকে লাফিয়ে নেমে পড়েন এবং অর্জুনের রথের দিকে ছুটে যান।
শ্রুতায়ুধ ছিলেন বরুণদেবের সন্তান এবং উক্ত গদাটি ছিল তারই দেয়া। এই গদার সাহায্যে শ্রুতায়ুধ যে কাউকে হত্যা করতে সক্ষম ছিলেন, কিন্তু এই গদা ব্যবহারের একটি বিশেষ নিয়ম ছিল। এই গদা দিয়ে কোনো নিরস্ত্র ব্যক্তিকে আঘাত করলে সেটি ফিরে এসে গদা নিক্ষেপকারীকেই হত্যা করতো। শ্রুতায়ুধ ক্রোধের বশে এই নিয়মের কথা ভুলে যান এবং গদাটিকে কৃষ্ণের দিকে নিক্ষেপ করেন। গদাটি কৃষ্ণের শরীরে আঘাত করে, কিন্তু তাতে কৃষ্ণের কিছুই হয়নি। কৃষ্ণের শরীরে আঘাত করেই গদাটি উল্টোদিকে ঘুরে শ্রুতায়ুধের দিকে ছুটে গিয়ে তাকে আঘাত করে এবং এর ফলে শ্রুতায়ুধ নিহত হন। শ্রুতায়ুধ নিহত হওয়ার পর তার সৈন্যরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পশ্চাৎপসরণ করে।
কৌরব ব্যূহের অভ্যন্তরে অর্জুনের ধ্বংসযজ্ঞ
শ্রুতায়ুধ নিহত হওয়ার পর কম্বোজের রাজা সুদক্ষিণ সসৈন্যে অর্জুনের দিকে ছুটে যান এবং তার বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন। অর্জুনের তীর সুদক্ষিণের শরীর ভেদ করে মাটিতে গেঁথে যায় এবং সুদক্ষিণ অর্জুন ও কৃষ্ণকে তীরবিদ্ধ করেন। অর্জুনের তীরের আঘাতে সুদক্ষিণের ধনুক ও রথের ঝাণ্ডা কাটা পড়ে এবং এরপর অর্জুন সুদক্ষিণকে তীরবিদ্ধ করেন। সুদক্ষিণ আরেকটি ধনুক উঠিয়ে অর্জুনকে তীরবিদ্ধ করেন এবং এরপর অর্জুনের দিকে একটি বিশেষ ধরনের তীর নিক্ষেপ করেন। উক্ত তীরটির আঘাতে অর্জুন সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন, কিন্তু তিনি শীঘ্রই সংজ্ঞা ফিরে পান এবং তীরের সাহায্যে সুদক্ষিণের রথটিকে টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলেন। এরপর অর্জুনের তীরের আঘাতে সুদক্ষিণ নিহত হন। সুদক্ষিণ নিহত হওয়ার পর তার সৈন্যরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পশ্চাৎপসরণ করে।
অর্জুনের হাতে সুদক্ষিণ নিহত হওয়ার পর কৌরব সৈন্যরা অর্জুনকে চতুর্দিক থেকে আক্রমণ করে, কিন্তু অর্জুনের তীরে ৬০০ কৌরব সৈন্য নিহত হয় এবং বাকিরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পশ্চাৎপসরণ করে। শীঘ্রই তারা আবার সংগঠিত হয়ে অর্জুনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়, কিন্তু অর্জুনের তীরে বিপুল সংখ্যক কৌরব সৈন্য নিহত হয়। এটি দেখে শ্রুতায়ু ও অচ্ছুতায়ু একযোগে অর্জুনের দিকে অগ্রসর হয়ে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন। তারা উভয়েই অর্জুনের দিকে তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন এবং এরপর শ্রুতায়ু ও অচ্ছুতায়ু যথাক্রমে অর্জুনের দিকে একটি বর্শা ও একটি বল্লম নিক্ষেপ করেন। সেগুলোর আঘাতে অর্জুন সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন এবং এটি দেখে কৌরব সৈন্যরা এই মনে করে উল্লসিত হয়ে ওঠে যে, শ্রুতায়ু ও অচ্ছুতায়ুর হাতে অর্জুন নিহত হয়েছেন।
অর্জুন সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ার পর শ্রুতায়ু ও অচ্ছুতায়ু অর্জুনের রথের দিকে তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন এবং তাদের নিক্ষিপ্ত তীরে কার্যত অর্জুনের রথ ঢাকা পড়ে যায়। কিছুক্ষণ পর অর্জুন সংজ্ঞা ফিরে পান এবং মন্ত্র উচ্চারণ করে শ্রুতায়ু ও অচ্ছুতায়ুর বিরুদ্ধে ঐন্দ্রাস্ত্র প্রয়োগ করেন। এর ফলে শ্রুতায়ু ও অচ্ছুতায়ু কর্তৃক অর্জুনের রথের দিকে নিক্ষিপ্ত তীরবৃষ্টি প্রতিহত হয় এবং শ্রুতায়ু ও অচ্ছুতায়ু উভয়েই নিহত হন। এরপর অর্জুনের হাতে ৫০ জন কৌরব রথী নিহত হয় এবং অর্জুন সামনের দিকে অগ্রসর হয়ে আরো বহুসংখ্যক কৌরব সৈন্যকে হত্যা করেন। এদিকে শ্রুতায়ু ও অচ্ছুতায়ু নিহত হওয়ার পর শ্রুতায়ুর ছেলে নিয়তায়ু ও অচ্ছুতায়ুর ছেলে দীর্ঘায়ু ক্রুদ্ধ হয়ে অর্জুনের দিকে অগ্রসর হন। কিন্তু অর্জুনের তীরের আঘাতে তারা উভয়েই নিহত হন। এরপর অর্জুনের হাতে বিপুল সংখ্যক কৌরব সৈন্য নিহত হয় এবং কৌরবদের প্রতিরোধ ভেঙে অর্জুন ব্যূহের শেষভাগের দিকে (যেখানে জয়দ্রথ ছিলেন) অগ্রসর হতে থাকেন।
এসময় অম্বস্তের রাজা শ্রুতায়ু (ইতিপূর্বে উল্লিখিত শ্রুতায়ু থেকে পৃথক ব্যক্তি) অর্জুনের দিকে অগ্রসর হন এবং তার বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন। অর্জুনের তীরের আঘাতে শ্রুতায়ুর রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো নিহত হয় এবং তার ধনুক কাটা পড়ে। ক্ষিপ্ত শ্রুতায়ু একটি গদা হাতে নিয়ে তার অচল রথ থেকে লাফিয়ে নেমে অর্জুনের রথের দিকে ছুটে যান এবং গদার সাহায্যে কৃষ্ণকে আঘাত করেন, কিন্তু অর্জুনের তীরের আঘাতে শ্রুতায়ুর গদাটি টুকরো টুকরো হয়ে যায়। এরপর শ্রুতায়ু আরেকটি গদা হাতে নিয়ে অর্জুন ও কৃষ্ণকে বারবার আঘাত করেন, কিন্তু শীঘ্রই অর্জুনের তীরের আঘাতে তিনি নিহত হন। অর্জুনের হাতে শ্রুতায়ু নিহত হওয়ার পর কৌরব সৈন্যরা চতুর্দিক থেকে অর্জুনকে ঘিরে ফেলে।
দ্রোণাচার্য–দুর্যোধন আলাপচারিতা: দুর্যোধনকে দ্রোণাচার্যের দৈব বর্ম প্রদান
অর্জুনকে কৌরব ব্যূহের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে দেখে দুর্যোধন ক্ষিপ্ত হয়ে দ্রোণাচার্যের কাছে এসে অর্জুনকে হত্যা ও জয়দ্রথকে রক্ষা করার জন্য তাকে আহ্বান জানান। তিনি উল্লেখ করেন যে, দ্রোণাচার্য যদি জয়দ্রথকে রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি না দিতেন, সেক্ষেত্রে তিনি কখনোই জয়দ্রথকে সিন্ধুতে ফিরে যেতে বাধা দিতেন না। দ্রোণাচার্য প্রত্যুত্তরে মন্তব্য করেন যে, অর্জুনের রথ ক্ষিপ্রগতিতে কৌরব ব্যূহের অভ্যন্তরে এগিয়ে চলেছে এবং তিনি বৃদ্ধ বিধায় এত ক্ষিপ্রগতিতে অর্জুনের পশ্চাদ্ধাবন করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। তিনি উল্লেখ করেন যে, ইতিপূর্বে তিনি সর্বসমক্ষে যুধিষ্ঠিরকে বন্দি করার প্রতিজ্ঞা করেছেন এবং এজন্য তিনি অর্জুনের অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে যুধিষ্ঠিরকে বন্দি করার প্রচেষ্টা চালাতে চান। তিনি আরো মন্তব্য করেন যে, এমতাবস্থায় দুর্যোধনের উচিত অর্জুনের পশ্চাদ্ধাবন করে তাকে বাধা প্রদান করা।
দুর্যোধন প্রত্যুত্তরে দ্রোণাচার্যকে প্রশ্ন করেন যে, দ্রোণাচার্য স্বয়ং যখন অর্জুনকে বাধা প্রদান করতে পারেননি, সেক্ষেত্রে তিনি কীভাবে অর্জুনকে বাধা প্রদান করবেন? দুর্যোধনের বক্তব্য শুনে দ্রোণাচার্য তাকে একটি মন্ত্রপূত দৈব বর্ম প্রদান করেন। দেবরাজ ইন্দ্র ও অসুর বৃত্রের মধ্যেকার চূড়ান্ত যুদ্ধের আগে মহাদেব/শিব ইন্দ্রকে এই বর্ম দিয়েছিলেন, এবং নানা হাত ঘুরে অগ্নিবেশ্যর মাধ্যমে এটি দ্রোণাচার্যের হস্তগত হয়েছিল। এই বর্মটিকে কোনো অস্ত্রের সাহায্যেই বিনষ্ট করা সম্ভব ছিল না। দ্রোণাচার্য কর্তৃক প্রদত্ত এই বর্ম পরিধান করে দুর্যোধন অর্জুনকে বাধা প্রদানের উদ্দেশ্যে তার পশ্চাদ্ধাবন করেন। এরপর কৌরব ব্যূহের প্রবেশমুখের কাছে দ্রোণাচার্যের নেতৃত্বাধীন কৌরব সৈন্যদল ও ধৃষ্টদ্যুম্নের নেতৃত্বাধীন পাণ্ডব সৈন্যদলের মধ্যে তীব্র যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।
কৌরব ব্যূহের প্রবেশমুখে কৌরব–পাণ্ডব লড়াই
দ্রোণাচার্যের তীরে বহুসংখ্যক পাণ্ডব সৈন্য নিহত হয়, কিন্তু ধৃষ্টদ্যুম্নের নেতৃত্বে পাণ্ডব সৈন্যরা কৌরবদের ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালায় এবং উক্ত আক্রমণের তোড়ে কৌরব ব্যূহের প্রবেশমুখে মোতায়েনকৃত কৌরব সৈন্যদল তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে যথাক্রমে কৃতবর্মা, জলাসন্ধ ও দ্রোণাচার্যের দিকে পশ্চাৎপসরণ করে। দ্রোণাচার্য বারবার কৌরব সৈন্যদেরকে সংগঠিত করেন, কিন্তু পাণ্ডবদের তীব্র আক্রমণের মুখে তারা বারবার ছত্রভঙ্গ হয়ে যেতে থাকে। ক্রুদ্ধ দ্রোণাচার্যের তীরে বিপুল সংখ্যক পাণ্ডব সৈন্য নিহত হয়, কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা কৌরব ব্যূহের ওপর আক্রমণ অব্যাহত রাখে। এমতাবস্থায় উভয় পক্ষের শীর্ষ যোদ্ধারা পরস্পরের বিরুদ্ধে অগ্রসর হয়ে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়েন, কিন্তু সেগুলোর সিংহভাগই ছিল এলোমেলো ও বিভ্রান্তিকর ধাঁচের।
অবন্তী রাজ্যের রাজপুত্র বিন্দ ও অনুবিন্দ মৎস্য রাজ্যের রাজা বিরাটের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন। বাহ্লিক রাজ্যের রাজা বাহ্লিক পাঞ্চালের রাজপুত্র শিখণ্ডীর বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন, কিন্তু শীঘ্রই দেখা যায় যে, তিনি উপপাণ্ডবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত। দুঃশাসন সাত্যকির বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন এবং উভয়ে তীরের আঘাতে একে অপরকে ক্ষতবিক্ষত করেন। রাক্ষস অলম্বুশ কুন্তী রাজ্যের রাজা কুন্তীভোজের বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন, কিন্তু শীঘ্রই দেখা যায় যে, তিনি রাক্ষস ঘটোৎকচের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত। শকুনি নকুল ও সহদেবের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন, কিন্তু শীঘ্রই তিনি নকুল ও সহদেবের নিকট পরাজিত হন এবং সেখান থেকে পশ্চাৎপসরণ করতে বাধ্য হন। শল্য যুধিষ্ঠিরের বিরুদ্ধে এবং দুর্যোধনের ভাই বিকর্ণ, চিত্রসেন ও বিবিংশতি ভীমের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন।
দ্রোণাচার্য–ধৃষ্টদ্যুম্ন যুদ্ধ এবং দ্রোণাচার্য–সাত্যকি যুদ্ধ: ধৃষ্টদ্যুম্নের পরাজয় এবং সাত্যকির প্রতিরোধ
ইতোমধ্যে দ্রোণাচার্য ও ধৃষ্টদ্যুম্ন তীরের সাহায্যে প্রতিপক্ষের সৈন্যদের হত্যা করতে করতে একে অপরের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন এবং এক পর্যায়ে তাদের রথ দুইটি এত কাছাকাছি চলে আসে যে, তাদের রথদ্বয়ের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো একে অপরের সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে যায়। এমতাবস্থায় ধৃষ্টদ্যুম্ন ধনুক নামিয়ে রেখে একটি ঢাল ও একটি তলোয়ার উঠিয়ে নেন এবং দ্রোণাচার্যকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে লাফিয়ে দ্রোণাচার্যের রথে আরোহণ করেন। দ্রোণাচার্য তার ধনুক ধৃষ্টদ্যুম্নের দিকে তাক করার চেষ্টা করেন, কিন্তু ধৃষ্টদ্যুম্ন দ্রোণাচার্যের রথের ওপরে এত ক্ষিপ্রগতিতে স্থান পরিবর্তন করছিলেন যে দ্রোণাচার্যের পক্ষে তাকে তীরবিদ্ধ করা সম্ভব হচ্ছিল না। বেশ কিছুক্ষণ এভাবে চলার পর দ্রোণাচার্য ধৃষ্টদ্যুম্নের দিকে ধনুক তাক করতে সক্ষম হন এবং তার তীরের আঘাতে ধৃষ্টদ্যুম্নের ঢাল ও তলোয়ার কাটা পড়ে। এরপর দ্রোণাচার্যের তীরের আঘাতে ধৃষ্টদ্যুম্নের রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো নিহত হয়, রথটির ঝাণ্ডা কাটা পড়ে এবং রথটির দুই পার্শ্বনী সারথি নিহত হয়।
কার্যত ধৃষ্টদ্যুম্ন তখন দ্রোণাচার্যের হাতে বন্দি হয়ে পড়েছিলেন বলা চলে। দ্রোণাচার্য ধৃষ্টদ্যুম্নকে হত্যা করার জন্য তার দিকে একটি বিশেষ তীর নিক্ষেপ করেন, কিন্তু সাত্যকির তীরের আঘাতে দ্রোণাচার্য কর্তৃক নিক্ষিপ্ত তীরটি কাটা পড়ে। এরপর দ্রোণাচার্য ও সাত্যকি একে অপরের ওপর তীরবর্ষণ করতে শুরু করেন এবং এই সুযোগে পাঞ্চালের রথীরা এসে ধৃষ্টদ্যুম্নকে উদ্ধার করে নিয়ে যান। এদিকে সাত্যকি দ্রোণাচার্যের কাছাকাছি অগ্রসর হন এবং তার বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধ চালিয়ে যান।
দ্রোণাচার্য সাত্যকির দিকে তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন, কিন্তু সাত্যকি তীরের সাহায্যে সেটিকে প্রতিহত করেন এবং তার তীরের আঘাতে দ্রোণাচার্যের ধনুক কাটা পড়ে। দ্রোণাচার্য তৎক্ষণাৎ আরেকটি ধনুক উঠিয়ে নেন, কিন্তু সাত্যকির তীরের আঘাতে সেটিও কাটা পড়ে। এভাবে সাত্যকির তীরের আঘাতে পরপর দ্রোণাচার্যের ১৬টি ধনুক কাটা পড়ে। তীরচালনার ক্ষেত্রে সাত্যকির ক্ষিপ্রতা দেখে দ্রোণাচার্য মুগ্ধ হন, কিন্তু তিনি আরেকটি ধনুক উঠিয়ে সাত্যকির দিকে তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ অব্যাহত রাখেন এবং সাত্যকি তীরের সাহায্যে দ্রোণাচার্য কর্তৃক নিক্ষিপ্ত তীরবৃষ্টিকে প্রতিহত করতে থাকেন। এরপর দ্রোণাচার্য মন্ত্র উচ্চারণ করে সাত্যকির বিরুদ্ধে আগ্নেয়াস্ত্র প্রয়োগ করেন, কিন্তু সাত্যকি দ্রোণাচার্য কর্তৃক প্রয়োগকৃত আগ্নেয়াস্ত্রকে নিষ্ক্রিয় করার জন্য মন্ত্র উচ্চারণ করে বরুণাস্ত্র প্রয়োগ করেন এবং দিব্যাস্ত্র দুইটি একে অপরের প্রভাবে নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়।
এমতাবস্থায় যুধিষ্ঠির, ভীম, নকুল ও সহদেবের নেতৃত্বে পাণ্ডব সৈন্যরা সাত্যকিকে সহায়তা করার জন্য দ্রোণাচার্যের বিরুদ্ধে অগ্রসর হয় এবং দুঃশাসনের নেতৃত্বে কৌরব সৈন্যরা দ্রোণাচার্যকে সহায়তা করার জন্য সাত্যকির বিরুদ্ধে অগ্রসর হয়। উভয় সৈন্যদল একে অপরের নিকটবর্তী হওয়ার পর উভয় পক্ষের মধ্যে বিক্ষিপ্ত কিন্তু তীব্র যুদ্ধ আরম্ভ হয়ে যায় এবং এর ফলে দ্রোণাচার্য ও সাত্যকির মধ্যে চলমান দ্বৈরথ যুদ্ধ অপূর্ণ থেকে যায়।
কৌরব ব্যূহের অভ্যন্তরে অর্জুনের বীরত্ব
এদিকে কৌরব ব্যূহের অভ্যন্তরে অর্জুন ক্ষিপ্রগতিতে জয়দ্রথের অবস্থানকে লক্ষ্য করে অগ্রসর হচ্ছিলেন। একের পর এক কৌরব সৈন্যদল এসে অর্জুনের গতি রোধ করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছিল, কিন্তু অর্জুনের তীরবৃষ্টির তোড়ে এবং দিব্যাস্ত্রের প্রকোপে তাদের কেউই অর্জুনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বেশিক্ষণ টিকতে পারছিল না। এমতাবস্থায় অবন্তীর রাজপুত্র বিন্দ ও অনুবিন্দ অর্জুনকে বাধা প্রদানের জন্য তার বিরুদ্ধে অগ্রসর হন এবং অর্জুনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন।
বিন্দ ও অনুবিন্দ অর্জুন ও কৃষ্ণকে তীরবিদ্ধ করেন এবং প্রত্যুত্তরে অর্জুন বিন্দ ও অনুবিন্দকে তীরবিদ্ধ করেন। বিন্দ ও অনুবিন্দ অর্জুনের দিকে তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন, কিন্তু অর্জুনের তীরের আঘাতে তাদের ধনুকদ্বয় ও রথেদ্বয়ের ঝাণ্ডা কাটা পড়ে। তারা উভয়েই নতুন ধনুক উঠিয়ে নেন এবং অর্জুনকে তীরবিদ্ধ করেন। ক্রুদ্ধ অর্জুনের তীরের আঘাতে তাদের ধনুকদ্বয় কাটা পড়ে, তাদের রথদ্বয়ের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো ও রথদ্বয়ের সারথিরা নিহত হয় এবং তাদেরকে রক্ষাকারী সৈন্যরাও প্রাণ হারায়। এরপর অর্জুনের তীরের আঘাতে বিন্দ নিহত হন। বিন্দ নিহত হওয়ার পর অনুবিন্দ একটি গদা হাতে নিয়ে তার বিকল রথ থেকে লাফিয়ে নেমে পড়েন এবং অর্জুনের রথের দিকে ছুটে যান। তিনি উক্ত গদা দিয়ে কৃষ্ণের কপালে আঘাত করেন, কিন্তু কৃষ্ণ অটল থাকেন এবং এর পরপরই অর্জুনের তীরের আঘাতে অনুবিন্দ নিহত হন।
অর্জুনের হাতে বিন্দ ও অনুবিন্দ নিহত হওয়ার পর অবন্তীর সৈন্যরা চতুর্দিক থেকে অর্জুনকে ঘিরে ফেলে এবং অর্জুন ও তার রথের ওপর বিভিন্ন ধরনের অস্ত্রশস্ত্র নিক্ষেপ করে, কিন্তু অর্জুন তীরের সাহায্যে সেগুলোকে প্রতিহত করেন। এদিকে ক্ষিপ্রগতিতে ছুটে চলার কারণে ও কৌরব সৈন্যদের অস্ত্রাঘাতে অর্জুনের রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো ক্লান্ত ও আহত হয়ে পড়েছিল। অর্জুনের রথ ছিল দেবতাদের দেয়া এবং কৃষ্ণ স্বয়ং অর্জুনের রথের সারথি হওয়ায় এই রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলোকে হত্যা করা সম্ভব ছিল না। এই কারণে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অর্জুনের রথটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়নি এবং রথটির সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো নিহত হয়নি। কিন্তু অন্যান্য ঘোড়ার মতোই সেগুলো ক্লান্ত ও আহত হতে পারতো।
এমতাবস্থায় ঘোড়াগুলোকে বিশ্রাম প্রদানের জন্য অর্জুন তার রথ থেকে নিচে নামেন এবং কৃষ্ণ উক্ত ঘোড়াগুলোকে অর্জুনের রথ থেকে বিচ্ছিন্ন করেন। এই সুযোগে কৌরব সৈন্যরা চতুর্দিক থেকে অর্জুনকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে তার ওপর বিভিন্ন ধরনের অজস্র অস্ত্রশস্ত্র নিক্ষেপ করে। কিন্তু অর্জুন তীরের সাহায্যে কৌরবদের আক্রমণ প্রতিহত করতে থাকেন। এসময় কৃষ্ণ অর্জুনকে বলেন যে, তাদের ঘোড়াগুলোকে পানি পান করানো প্রয়োজন, কিন্তু আশেপাশে কোনো জলাধার নেই। কৃষ্ণের কথা শুনে অর্জুন মন্ত্র উচ্চারণ করে মাটির দিকে একটি দিব্যাস্ত্র প্রয়োগ করেন এবং সেখানে তৎক্ষণাৎ একটি হ্রদের সৃষ্টি হয়। কৃষ্ণ অর্জুনের রথের ঘোড়াগুলোকে পানি পান করিয়ে সেগুলোকে আবার রথটির সঙ্গে জুড়ে দেন এবং এরপর অর্জুন আবার তার রথে আরোহণ করেন।
এই ঘটনাটি দেখে কৌরব সৈন্যদের মনোবলে চিড় ধরে যায়। অর্জুন যে রথবিহীন অবস্থায় কৌরব সৈন্যদের তীব্র আক্রমণ প্রতিহত করেছেন এবং সেই অবস্থাতেই তার ঘোড়াগুলোকে পানি পান করানোর জন্য যুদ্ধক্ষেত্রের মধ্যে দিব্যাস্ত্রের সাহায্যে একটি হ্রদের সৃষ্টি করেছেন, এই দৃশ্য দেখে কৌরব সৈন্যরা নিশ্চিত হয়ে যায় যে, অর্জুনকে কোনোক্রমেই প্রতিহত করা সম্ভব নয় এবং তার হাতে জয়দ্রথের মৃত্যু সুনিশ্চিত। এমতাবস্থায় অর্জুন কৌরব সৈন্যদের ওপর তীব্র আক্রমণ চালাতে থাকেন এবং তাদের সৃষ্ট সমস্ত প্রতিবন্ধকতা ধ্বংস করে দিয়ে জয়দ্রথের অবস্থানের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন।