Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

চিলিংহাম ক্যাসেল: এক ভয়াবহ অত্যাচারের অন্ধকূপ

প্রাসাদ বা দুর্গের কথা উঠলেই আমরা কল্পনার জগতে ফিরে যাই, কল্পনা করতে থাকি রূপকথার কোনো এক সুসজ্জিত দালানের কথা। মনে প্রশান্তির অনুভূতিও জন্ম নেয়। কিন্তু যদি এর উল্টোটা হয়, দুর্গের কথা মনে আসা মাত্রই যদি আপনার শিরদাঁড়া বেয়ে একটা হিমশীতল অনুভূতির সৃষ্টি হয়? আজকে এমনই এক দুর্গের কথা আলোচনা করা হবে, যা আপনাদের ফিরিয়ে নিয়ে যাবে বার শতকের এক অমানবিক অন্ধকারের যুগে। সেখানে রয়েছে শুধু চরম নিষ্ঠুরতা আর অত্যাচারের চিহ্ন।

চিলিংহাম ক্যাসেল; Source: thevintagenews.com

ইংল্যান্ডে অবস্থিত চিলিংহাম দুর্গ ইউরোপের মধ্যযুগীয় বর্বরতা ও বিকৃত মস্তিষ্ক হতে উদ্ভুত অত্যাচার পদ্ধতির প্রত্যক্ষ সাক্ষী। এর ভৌগোলিক অবস্থান ইংল্যান্ডের নর্থামবারল্যান্ডের উত্তর দিকের চিলিংহাম গ্রামে। লোমহর্ষক সব উপায়ে অত্যাচার করা হতো এখানে, অত্যাচারের হাত থেকে সৈন্য, গুপ্তচর, অপরাধী, ছেলে-বুড়ো, নারী, এমনকি শিশুরাও বাদ পড়ে নি। দুর্গের তলদেশে ‘অন্ধকার মৃত্যুকূপ’ নামে একটি কুঠুরী তৈরি করা হয়ছিল, যেখানে নানারকম অমানবিক উপায়ে অত্যাচার করা হতো। বলা হয়ে থাকে, মধ্যযুগীয় ইউরোপীয় সভ্যতার সর্বনিকৃষ্ট বর্বরতা সংঘটিত হয়েছিল এখানে।

হাজার হাজার মানুষের আর্ত-চিৎকারে কম্পিত হওয়া দূর্গের দেয়ালে আজও খুঁজে পাওয়া যায় অসংখ্য নখের আঁচড়। ধারণা করা হয়ে থাকে, এখানে প্রায় ৭,৫০০ মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করে হয়েছিল।

প্রায় আট শতক যাবত দাঁড়িয়ে রয়েছে এই দুর্গটি। এই দীর্ঘসময়ে দুর্গটি বিভিন্ন রাজার হাতবদল হয়েছে এবং তারা তাদের মতো করে আধিপত্য কায়েম করেছেন। ১২৫৫ সালে রাজা তৃতীয় হেনরী, ১২৯৮ সালে রাজা প্রথম এডওয়ার্ড, ১৮৭২ সালে যুবরাজ ওয়ালেস এবং বর্তমান ব্রিটেনের রাজ পরিবারের অনেকেই এই দুর্গটির দখল নিয়েছিলেন।

চিলিংহাম দুর্গটি  ইংরেজ-স্কটিশ সীমান্তে অবস্থিত হওয়ার কারণে দুই দেশের মধ্যেই যুদ্ধ সংক্রান্ত একটা উত্তেজনা লেগেই থাকত।রাজা প্রথম এডওয়ার্ড এই দুর্গটিকে তার সকল যুদ্ধ পরিচালনার প্রাণকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করতেন, যাতে করে তিনি খুব সহজেই স্কটিশদের পরাস্ত করতে পারেন। শুধু তা-ই নয়, এখানে যুদ্ধবন্দীদের কয়েদ করে রাখা হতো এবং গভীর অন্ধকার এক কূপে তাদেরকে প্রবেশ করিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হতো। বিশেষত পুরুষদেরকে প্রায় ২০ ফুট মৃত্যুকূপে ফেলে দেয়া হত এবং ফেলার আগে তাদের হাত-পা ভেঙে দেয়া হত। দুর্গের ভেতরে সবচেয়ে লোহমর্ষক এবং ভয়াবহ জায়গাটি ছিল টর্চার চেম্বার, যেখানে নানা বিকৃত উপায়ে লোকজনের উপর অত্যাচার করা হতো।

অত্যাচারের নমুনা

পেরেকযুক্ত চেয়ার; Source: thevintagenews.com

বন্দীদেরকে প্রথমে একটি অন্ধকার ঘরে পাঠানো হতো, যেখানে এতো গাঢ় অন্ধকার যে কিছুই দেখা যেত না। এমনকি নিজেকে দেখাও অসম্ভব ছিল। এখানে কিছুদিন রাখার পরে হঠাৎ করেই কোনো পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই বন্দীকে নিয়ে গিয়ে জোর করে বসানো হতো একটি পেরেকযুক্ত চেয়ারে। চেয়ারের পুরোটা জুড়েই থাকত অসংখ্য পেরেক, আর তাতে বসা মাত্রই বন্দী নিজেকে মুক্ত করার জন্য প্রাণপন চেষ্টা করত। কিন্তু কিছু বর্বর প্রহরী তাকে আরো জোর করে চেপে ধরত চেয়ারে। বন্দী যত চেষ্টা করত নিজেকে ছাড়াতে, চেপে ধরার জোরটাও ঠিক ততটাই বাড়তে থাকত। এভাবে যুদ্ধ করতে করতে এক সময় ক্ষতবিক্ষত হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ত তারা।

র‍্যাক; Source: thevintagenews.com

কাঠের তৈরি র‍্যাকে মানুষের হাত ও পা বেঁধে শাস্তি দেয়া হতো। প্রথমে তাদের হাত ও পায়ের গোড়ালি র‍্যাকের সাথে এত শক্তভাবে বাঁধা হতো যে মানুষটির পক্ষে বিন্দুমাত্রও নড়াচড়া করা সম্ভব হত না। পায়ের গোড়ালি আবার একটি চাকতির সাথে সংযুক্ত থাকত। এভাবেই চলত জিজ্ঞাসাবাদ পর্ব এবং এক পর্যায়ে গিয়ে চাকতিটি ঘোরানো হতো। ধীরে ধীরে চাকতির গতি বাড়তে থাকতো এবং একসময় মোচড় খেতে খেতে পায়ের গোড়ালি আলাদা হয়ে যেত। আটকে থাকা মানুষটি তীব্র যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে একসময় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতো।

ম্যাঙ্গল; Source: thevintagenews.com

‘ম্যাঙ্গল’ নামক একটি যন্ত্রের সাহায্যে দুই হাত পিষ্ট করে ফেলা হতো বন্দীদের। দুটি রোলারের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে দেয়া হতো এবং রোলারের চাপে হাত থেঁতলে যেত। এখানেই শেষ নয়, এরপর কাটার দিয়ে কেটে ফেলা হতো সেই থেঁতলানো হাত। সেই মধ্যযুগীয় যুগের কিছু মানুষের অস্বাভাবিক চিন্তা-চেতনার ফসল এই নির্যাতনের কথাগুলো শুনলে নিজের অজান্তেই গায়ের লোম খাড়া হয়ে যায়।

ইমপেলমেন্ট ডিভাইস; Source: thevintagenews.com

এক নিকৃষ্ট অমানবিক যন্ত্রের নাম ‘ইমপেলমেন্ট ডিভাইস‘। যন্ত্রটি অনেকটা এরকম- কাঠের পাটাতনের মাঝে সূঁচালো অগ্রভাগবিশিষ্ট একটি দন্ড। অসহায় মানুষগুলোকে বিবস্ত্র করে, গায়ে তেল মাখিয়ে এই সূঁচালো দন্ডের মাথায় বসানো হয় এবং তা পশ্চাৎদেশ দিয়ে ঢুকে ক্রমশ মাথা অবধি পৌঁছে যায়। তিলে তিলে মৃত্যুযন্ত্রণা ভোগ করে ঢলে পড়ে মৃত্যুর কোলে।

পেরেকযুক্ত ব্যারেল; Source: thevintagenews.com

চারিদিকে পেরেকযুক্ত একটি ব্যারেলের মধ্যে দোষী ব্যক্তিটিকে জোর করে ঢুকানো হতো। অতঃপর ব্যারেলের মুখ বন্ধ করে ফেলে দেয়া হতো পাহাড়ের ঢালে। ভেতরে আবদ্ধ হতভাগা মানুষটির কপালে কী নারকীয় যন্ত্রণা জুটতো তা বলাই বাহুল্য!

কাঁটাযুক্ত কাঠের বিশাল রোলার; Source: thevintagenews.com

কাঁটাযুক্ত কাঠের একটি বিশাল রোলারের সাথে বন্দীদের শরীরটাকে বেঁধে দেয়া হতো। এই রোলারটি মাটি থেকে কিছুটা উপরে থাকত এবং নিচে থাকত আগুনের লেলিহান শিখা। ধীরে ধীরে রোলারটি ঘুরতে থাকত আর সারা শরীরে পেরেক বিঁধে যাওয়ার যন্ত্রণা নিয়ে বন্দী মানুষটি আগুনে দগ্ধ হত।

ঝুলন্ত খাঁচা;Source: thevintagenews.com

ঝুলন্ত খাঁচায় মানুষকে উল্টো করে পুরে দিনের পর দিন ঝুলিয়ে রাখত। এভাবে থাকতে থাকতে শারীরিক প্রক্রিয়ার অসামঞ্জস্যতা ঘটতে শুরু করতো আর দিনে দিনে এক পা-দু’পা করে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যেত তারা।

গ্যাস মাস্ক; Source: thevintagenews.com

শিশুদেরকে পরিয়ে দেয়া হতো গ্যাস মাস্ক। ছোট্ট শরীরটাতে এত ধকল সহ্য করাটা অসম্ভব ব্যাপার। কিছুক্ষণের মধ্যেই শিশুটির নিথর দেহ লুটিয়ে পড়ত মাটিতে।

পৃথিবীর বুকে চিলিংহাম দুর্গ ছিল এক জীবন্ত নরক, যেখানে হাজার হাজার মানুষ নির্মম মৃত্যু যন্ত্রণা ভোগ করে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে। বর্তমান যুগে বাস করে আমরা হয়ত কল্পনাও করতে পারি না এমন নিষ্ঠুরতার কথা। এই দুর্গের শক্তিশালী কাঠামোগত কারণে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এটি আর্মিদের ব্যারাক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল। কথিত আছে, সেই সময় আর্মিরা কাঠের তৈরি অনেক কিছুই পুড়িয়ে দিয়েছিল। যার ফলে সেই সময়ের নিষ্ঠুরতার অনেক কিছু সম্পর্কে জানার সুযোগ হয়ে ওঠেনি।

বর্তমানে দুর্গটি সংস্কার করা হয়েছে এবং জনসাধারণের জন্য তা উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে। সাধারণ মানুষের কাছে সেই দিনগুলো তুলে ধরার জন্য, অত্যাচারের কাজে ব্যবহৃত যন্ত্রগুলির রেপ্লিকা তৈরি করা হয়েছে। ছুটির দিনে সময় কাটানোর জন্য অ্যাপার্টমেন্ট তৈরি করা হয়েছে, বিয়ে-শাদী অথবা ব্যক্তিগত কোনো অনুষ্ঠানের আয়োজনের ব্যবস্থা রয়েছে এখানে।

ফিচার ইমেজ: thevintagenews.com

Related Articles