Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ডাস্ট বোল: আমেরিকার ইতিহাসে ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ

ত্রিশের দশকে লাগাতার আট বছর, তথা প্রায় এক যুগ ধরে মূলত উত্তর আমেরিকার মিডওয়েস্ট এবং এর আশেপাশের আরো কিছু বৃক্ষহীন তৃণভূমি অঞ্চলের আমজনতাকে মুখোমুখি হতে হয় খরা ও ধূলোঝড়ের। চারপাশে শুধু ধূলো আর ধূলো, যেন কোনো ধূলোর বেড়াজালে আটকে গেছে সাধারণ জীবনযাত্রা। এমন একটা সময় শুরু হয়, যখন জীবনের ছোট ছোট প্রয়োজনীয় কাজগুলো করতেও বেগ পেতে হয় সাধারণ মানুষকে। শ্বাস নেওয়া, খাওয়া-দাওয়া করা কিংবা একটু হেঁটে আসাও যেন একটি যুদ্ধ হয়ে দাঁড়ায় তাদের কাছে। রাস্তায় বের হলেই ধূলো থেকে বাঁচতে মাস্ক ছিল অত্যন্ত দরকারি একটি বস্তু। বাসাবাড়ির জানালায় ভেজা কাপড় ব্যবহার করে অন্তত নিজের আবাসস্থলের ভেতরে এই ধূলোঝড় থেকে বাঁচার চেষ্টা করলেও তা কাজে লাগেনি। মাস্ক, ভেজা কাপড়ের মতো ছোট ছোট পদক্ষেপ কোনো স্বস্তি আনতে পারেনি ঐ অশান্ত পরিবেশে। দিন দিন ঐ অস্বস্তিকর অবস্থা থাকে অপরিবর্তিত।

মাস্ক, ভেজা কাপড়ের মতো সব পদক্ষেপই বৃথা যায়; Image source: thoughtco.com

কারো যেন কিছুই করার নেই। এর মধ্যে খরা তো আছেই। সবচাইতে কষ্টে সময় পার করেন কৃষকেরা। কষ্ট করে উৎপাদিত সকল শস্য উড়ে যাচ্ছিল, তবে এর প্রতিরোধের কোনো উপায় না জানায় অসহায়ের মতো দেখা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না। ইতিহাসের পাতায় এই খরা এবং ঝড়ের ভয়াবহ দুর্যোগটি ‘ডাস্ট বোল’ নামে পরিচিত। বিগত ১০০০ বছরে এই ডাস্ট বোল আমেরিকার সবচাইতে ভয়াবহ এবং দীর্ঘস্থায়ী পরিবেশগত একটি দুর্যোগ হিসেবে পরিচিত।

সবচাইতে কষ্টে সময় পার করে কৃষকেরা; Image source: specialcollections.wichita.edu

কারণ

১৯৩০ সালে আটলান্টিক এবং প্রশান্ত মহাসাগরের আবহাওয়ার ধরন বদলাতে শুরু করে। যার দরুন দুই মহাসাগরীয় অঞ্চলে দু’ধরনের বায়ুর পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। আটলান্টিকের দিকে আবহাওয়া স্বাভাবিকের চেয়ে অধিক গরম বা উষ্ণ এবং প্রশান্ত মহাসাগরের দিকে অধিক শীতল আবহাওয়া পরিলক্ষিত হয়। এই দুই বিপরীতধর্মী বায়ু মিলিত হলে জেট স্ট্রীম দুর্বল হয়ে যায় এবং এর দিক পরিবর্তিত হয়। উল্লেখ্য যে, জেট স্ট্রীম হলো বিশ্বের সকল গ্রহের বায়ুমণ্ডলে দ্রুত প্রবাহিত, সংকীর্ণ এবং মৃদু বায়ুর স্রোত। সাধারণত এই বায়ু প্রবাহ মেক্সিকো উপসাগর থেকে গ্রেট প্লেইনসের দিকে আর্দ্রতা বহন করে আনে। আর এই বায়ুপ্রবাহ উত্তর আমেরিকার রকিজের কাছে যাওয়ার পর তা বৃষ্টিপাত ঘটায়। অনেক সময় এ কারণে টর্নেডোও সৃষ্টি হতে পারে। তবে বিপরীতধর্মী বায়ুপ্রবাহের কারণে জেট স্ট্রিমের দিক পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিল সেই সময়ে। যার কারণে ঐ জেট স্ট্রিম গ্রেট প্লেইনসের দিকেও যায়নি এবং কোনো প্রকার বৃষ্টিপাতও সৃষ্টি করেনি। যেসব অঞ্চলে বৃষ্টি হয় না, সেসব এলাকায় খরা পড়াটাই স্বাভাবিক। এই খরার কারণে আর্দ্রতা কমে গিয়ে এক শুষ্ক পরিবেশের সৃষ্টি হয়, যা ধূলোঝড়কে ত্বরান্বিত করে; মূল কথা হলো, ডাস্ট বোল সৃষ্টিতে সহায়তা করে।

দিন দিন খরা এবং ধুলো ঝড় দু’টোর পরিমাণই বেড়ে যায়; Image source: mansharamani.com

উত্তর আমেরিকার ওহিও থেকে রকি পর্বতমালা পর্যন্ত রয়েছে মিডওয়েস্ট। এই মিডওয়েস্টের কর্ষণযোগ্য জমি প্রাকৃতিকভাবেই সংরক্ষিত হতো ঘাসের কারণে। তবে এসব অঞ্চলে বসতি স্থাপিত হলে বাসিন্দারা অতিরিক্ত চাষাবাদ শুরু করে দেয়। কৃষিকাজের জন্য ৫.২ মিলিয়ন একর জমির ঘাস কেটে ফেলে যার মূল মাটির গভীর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। বছরের পর বছর অতিরিক্ত কৃষিকাজ এসব জমির উর্বরতা নষ্ট করে দেয়। যখন খরার ফলে ফসল নষ্ট হয়ে যায়, তখন অতিরিক্ত শুষ্ক বায়ুপ্রবাহ বা ঝড় কর্ষণীয় জমির মাটিকে খুব সহজেই নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয় এবং ডাস্ট বোল নামক একপ্রকার প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি করে। এসব কারণে দিন দিন খরা এবং ধূলোঝড় দু’টোর পরিমাণই বেড়ে যায়। স্বাভাবিকভাবেই বাষ্পীভবনের প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। এতে করে না মেঘ সৃষ্টি হতে পারে, না বৃষ্টি। সেই সময়ের দুর্যোগটি এতটাই ভয়াবহ ছিল যে আজ পর্যন্ত মিডওয়েস্ট পুরোপুরি আগের অবস্থায় তথা উর্বর এলাকায় পরিণত হতে পারেনি। 

ধূলোঝড়; Image source: mymodernmet.com

বিভিন্ন সময়ে ডাস্ট বোল

ডাস্ট বোলের মূল আঘাত বা প্রভাব লক্ষ করা যায় চারবার। ১৯৩০-৩১, ১৯৩৪, ১৯৩৬ এবং ১৯৩৯-৪০ সালে। তবে এই ডাস্ট বোল বিরামহীন একটি দুর্যোগ বলেই মনে হয়। কারণ একটির আঘাত সামলাতে না সামলাতেই আরেক দফা আঘাত হানে এই প্রাকৃতিক দুর্যোগ। আমজনতাকে আগের আঘাত থেকে পুরোপুরি সেরে ওঠার আগেই মুখোমুখি হতে হয় অপর আঘাতের। 
১৯৩০-৩১ সালে সংঘটিত ডাস্ট বোল ছারখার করে দেয় ২৩টি প্রদেশ। পরবর্তীতে এই খরা ও ধুলো ঝড় মধ্য-আটলান্টিক অঞ্চলে পৌঁছায় এবং দক্ষিণে আটটি প্রদেশে আঘাত হানে। এরই মাঝে গ্রেট ডিপ্রেশনের তথা মহামন্দার প্রভাব আরো বাড়তে থাকে। ১৯২৯ সালে তুলার মূল্য প্রতি পাউন্ড ১৬.৭৯ সেন্ট ছিল, যা ১৯৩১ সালে কমে প্রতি পাউন্ড ৫.৬৬ সেন্ট হয়ে যায়। খরার কারণে অবস্থাটা এমন দাঁড়ায় যে, তুলার চাষাবাদ করতে যা খরচ হয় তা প্রাপ্ত আয় থেকেও বেশি। অর্থাৎ মোটা অংকের লোকসান গুণতে  হয় কৃৃষকদের। অন্যদিকে, খাদ্যের অভাব দেখা যায়।

কিন্তু তাও তৎকালীন প্রসিডেন্ট হার্বার্ট হুভার সাহায্য করতে অস্বীকৃতি জানান। কারণ তার মতে, এরকম সহায়তা মানুষদের দুর্বল করবে। যদিও রেড ক্রস বীজ সরবরাহ করে আর্থিক সহায়তা করে, তবে সেই বীজ শুধু শালগম উৎপাদনেই সক্ষম ছিল। অবশ্য খরা লাগাতার চলতে থাকলে কংগ্রেস ৪৫ মিলিয়ন ডলারের চারা এবং ২০ মিলিয়ন ডলারের খাদ্য যোগান দেওয়ার জন্য খরচ করেন। ১৯৩২ সালে ১৪টি ধূলোঝড় হয় এবং ১৯৩৩ সালে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৪৮-এ। 
১৯৩৪ সালে সংঘটিত খরা ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ। ২০১৪ সাল অবধি এটি উষ্ণতম বছর হিসেবেও বিবেচিত হয়। এমনও পরিস্থিতি ছিল যে লাগাতার ২৯দিন তাপমাত্রা ১০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা এর বেশি ছিল। খরার কবলে পড়া অঞ্চলের ৮০% একেবারে শুকিয়ে যায়। পরের বছর তথা ১৯৩৫ সালের ১৪ এপ্রিল সবচাইতে খারাপ ধূলোঝড় সংঘটিত হয়। এর ভয়াবহতার কারণে এই দিনটিকে পরবর্তী সময়ে ‘ব্ল্যাক সানডে’ নাম দেওয়া হয়।

ব্ল্যাক সানডে; Image source: history.com

এর কয়েক সপ্তাহ পরেই তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি.রুজভেল্ট মাটি সংরক্ষণ আইন পাস করেন। যার উদ্দেশ্য ছিল, কৃষকদের টেকসই উপায়ে চাষাবাদ শেখানো। প্রাকৃতিক দুর্যোগকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলেও এর ভয়াবহতা এবং খাদ্যাভাব যেন নিয়ন্ত্রণ করা যায়, সেজন্যই এই পদক্ষেপ। 
১৯৩৬ সালের জুনে আটটি প্রদেশে তাপমাত্রা ১১০ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা এর বেশি দেখা যায়। এই প্রদেশগুলো ছিল, যেমন- আরকানসাস, ইন্ডিয়ানা, কেনটাকি, লুইসিয়ানা, মিসিসিপি, মিসুরি, নেবরাস্কা এবং টেনেসি। জুলাইয়ে ডাস্ট বোল আঘাত হানে আরো ১২টি প্রদেশে। এদের মধ্যে কানসাস, মেরিল্যান্ড, মিশিগান, মিনিসোটা, নিউ জার্সি, উত্তর ডাকোটায় তাপমাত্রা ১২১ ডিগ্রি ফারেনহাইট এবং ওকলাহোমা, পেনসিলভেনিয়া, দক্ষিণ ডাকোটা, পশ্চিম ভার্জিনিয়া এবং উইসকোনসিনে তাপমাত্রা ১২০ ডিগ্রি ফারেনহাইট দেখা যায়। এসব প্রদেশে এত বেশি তাপমাত্রা এর আগে কখনও দেখা যায়নি। ১৯৩৬ সালের আগস্ট মাসে টেক্সাসে ১২০ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রার কারণে প্রায় ১,৭০০ জন মানুষ মারা যায়। তাছাড়া প্রায় ৩,৫০০ জন গরম থেকে বাঁচার চেষ্টা করতে নিয়ে পানিতে ডুবে মারা যায়। 

১৯৩৯-৪০: ১৯৩৬ সালের পর আবার ফিরে আসে খরা এবং ধুলো ঝড়। আগের আঘাত থেকে তখনও সেরে উঠতে পারেনি অঞ্চলগুলো। লুইসিয়ানা প্রদেশে ১৯৩৯ সালের ৯ জুন থেকে ২৯ সেপ্টেম্বর তথা লাগাতার ১১৫ দিন ৯০ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রা থাকে। দক্ষিণ-পূর্ব দিকের অঞ্চলের জন্য এটি তাপমাত্রার একটি রেকর্ড ছিল। ১৯৩৯ সালে শুরু হওয়া ডাস্ট বোলের প্রভাব ১৯৪০ পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। 

১৯৪১ সালের দিকে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে শুরু করে বিধ্বস্ত অঞ্চলগুলো। স্বাভাবিক মাত্রায় বৃষ্টি পড়াও শুরু করে। এই বৃষ্টিই ডাস্ট বোল এবং গ্রেট ডিপ্রেশনের নেতিবাচক প্রভাব কমাতে সহায়তা করে।    

ডাস্ট বোল; Image source: youtube.com

অর্থনীতির ক্ষতি

ডাস্ট বোল চলাকালীন সাধারণ মানুষ নিজেদের খাদ্য এবং বাসস্থানের চাহিদা পূরণ করতেও ব্যর্থ হয়। অনেকে নিজেদের প্রাণও হারায়। এই অবস্থার কারণে কৃষকদের যে খুব ভালোমতোই ক্ষতির স্বীকার হতে হয়, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আয় থেকে খরচের পরিমাণই বেশি ছিল। ১৯৩৩ সালে সরকার ‘সারপ্লাস রিলিফ করপোরেশন’ গঠন করে, যা বিভিন্ন খামারের উদ্বৃত্ত গরীবদের খাদ্যের যোগান দিতে ব্যবহার করে। তবে এতে করে বেশি কোনো লাভ হয় নাই। ১৯৩৪ সালে কৃষকেরা তাদের খামারের ১০% বিক্রি করতে বাধ্য হয়। বেশিরভাগ বিক্রির পেছনে দায়ী ছিল খরা এবং মহামন্দা। এর তিন বছর পরে অবস্থার আরো অবনতি হলে প্রতি পাঁচজন কৃষকের মধ্যে একজন সরকারের সহায়তার উপর অত্যধিক নির্ভরশীল হয়ে উঠে। এই ডাস্ট বোলের জন্যই গ্রেট ডিপ্রেশনের প্রভাব আরো বেশি ক্ষতিকর ছিল।

This article is in Bangla language. It's about 'Dust Bowl'.

Sources have been hyperlinked in this article. 

Featured image: youtube.com

Related Articles