
পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের নিকট সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ স্বাধীনতার নায়ক নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু। তবে তার মৃত্যু কেবল পশ্চিমবঙ্গই নয়, গোটা ভারতের ইতিহাসেরই অন্যতম উল্লেখযোগ্য অমীমাংসিত রহস্য। নেতাজির মৃত্যুকে কেন্দ্র করে যুগে যুগে অসংখ্য কন্সপিরেসি থিওরি আবির্ভূত হয়েছে। সেগুলোর অধিকাংশই পরবর্তী সময়ে যথাযথ প্রমাণ সাপেক্ষে বাতিল বলে গণ্য হয়েছে। কিন্তু একটি থিওরি এই ২০১৯ সালে এসেও বহাল রয়েছে। সেটি হলো: ভারতে ফিরে এসেছিলেন নেতাজি। ১৯৮৫ সালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের আগ পর্যন্ত তিনি বাস করতেন উত্তর প্রদেশের ফাইজাবাদে, এক নিঃসঙ্গ সাধু হিসেবে, যাকে সবাই চিনত গুমনামি বাবা নামে।
সুরজিৎ দাশগুপ্তের কাহিনী
১৯৮২ সালে একবার এক সেকেন্ডের ভগ্নাংশ সময়ের জন্য ভগবানজির (গুমনামি বাবার আরেক নাম) মুখের দিকে তাকিয়েছিলেন সুরজিৎ দাশগুপ্ত। সেই মুহূর্তটা আজও তার স্মৃতিতে চির অম্লান হয়ে আছে। নিজের জীবনের সেই মহা-গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তটার কথা তিনি স্মরণ করেন এভাবে,
“অন্য আর সবদিনের মতো সেদিনও তিনি আমার সামনে বসে ছিলেন। হঠাৎ করেই আমার মনে তীব্র ইচ্ছা জাগল তাকে দেখার। আমি চুরি করে এক পলক তার দিকে চাইলাম। কিন্তু তার ভেতর থেকে উৎসারিত আভায় আমি এতটাই বিমোহিত হয়ে পড়লাম যে, সঙ্গে সঙ্গে চোখ নামিয়ে ফেলতে বাধ্য হলাম। ওই এক মুহূর্তের দর্শন আমি কোনোদিন ভুলতে পারব না।”
এখানে সুরজিৎ বাবু এমন এক ভগবানজির কথা বলছিলেন, খুব কম মানুষই ‘জানত’ যে তিনিই আসলে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু! সেই মানুষটি, যাকে আরো ৩৭ বছর আগে মেরে ফেলেছে খবরের কাগজের মানুষেরা। অবশ্য সেই খবর বিশ্বাস করেনি পশ্চিমবঙ্গসহ ভারতের কোটি কোটি মানুষ। তারা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে এসেছে, নেতাজি মরেননি, একদিন তিনি ঠিকই ফিরে আসবেন, উদ্ধার করবেন ভারতমাতাকে। সেই নেতাজিই ১৯৮২ সালের সেই বিশেষ দিনটিতে দেখা দিয়েছিলেন সুরজিৎ বাবুর সামনে।

কথিত নেতাজির সাথে সুরজিৎ বাবুর সাক্ষাতের প্রেক্ষাপটটা কিন্তু বেশ চমকপ্রদ। নেতাজির সহচর ও সুরজিৎ বাবুদের গুরু, সুনীল গুপ্ত, দীর্ঘ দুই দশক ধরে নিয়মিত সাক্ষাৎ করে আসছিলেন ভগবানজির। প্রথম প্রথম বিষয়টি ছিল খুবই গোপনীয়। কাউকেই তিনি জানান দিতেন না, আসলে ঠিক কোথায় যাচ্ছেন। সবাই শুধু জানত, খুবই ‘জরুরি মিশনে’ যাচ্ছেন তিনি। এরপর একদিন তিনি খুব রহস্য করে বললেন, “সংযোগ স্থাপিত হয়েছে!” সাথে সাথেই সুরজিৎ বাবুর সামনে সবকিছু দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে গেল। তিনি বেশ ভালো করেই বুঝতে পারলেন, সুনীল বাবু আসলে নেতাজির কথা বলছেন।
উত্তেজনায় সুরজিৎ বাবুর রক্ত যেন টগবগ করতে লাগল। পরের কয়েকটা বছর, তিনি নিজেও সুনীল বাবুর সাথে স্টেশন অবধি যেতে লাগলেন। বছরে দুইবার করে প্রথমে নিমসার ও তারপর ফাইজাবাদে যেতেন সুনীল বাবু। একবার দূর্গাপূজার সময়, অন্যবার ২৩ জানুয়ারি, নেতাজির জন্মদিনে। এর অনেক বছর পর, ১৯৮২ সালে সুনীল বাবু সিদ্ধান্ত নিলেন, অবশেষে সময় এসেছে ভগবানজিরূপী নেতাজির সাথে সাক্ষাৎকারীর চক্রটি আরেকটু বড় করা যেতে পারে। তখন সুরজিৎ বাবুসহ তাদের আড্ডার আরো কয়েকজন ফাইজাবাদের ট্রেনে চেপে বসলেন ভগবানজি-দর্শনের উদ্দেশে।
এখানে একটি ব্যাপার জানিয়ে রাখা ভালো, সুনীল বাবুকে দায়িত্বটি দিয়েছিলেন নেতাজির বড়দা সুরেশ চন্দ্র বসু। তার কথামতোই, যখনই নেতাজির দেশে ফিরে আসা নিয়ে কোনো গুজব রটছিল, সেদিকে ধেয়ে যাচ্ছিলেন সুনীল বাবু। এভাবেই শৌলমারিসহ আরো অনেক জায়গায় তিনি ছুটে গিয়েছিলেন নেতাজির সন্ধানলাভের আশায়। প্রতিবারই হতাশ হতে হতো তাকে। অবশেষে ১৯৬২ সালে ভাগ্যদেবী মুখ তুলে চাইল তার উপর। নিমসারে তিনি পেয়ে গেলেন নেতাজিকে। তবে তিনি আর নেতাজি নন, বনে গেছেন ভগবানজি!
তো যা-ই হোক, ভগবানজির সাথে সাক্ষাতের পূর্বে সুরজিৎ বাবুদেরকে বেশ কিছু নিয়মকানুন শিখিয়ে পড়িয়ে দিলেন সুনীল বাবু। প্রথম নিয়মটিই হলো, ভগবানজির দিকে কখনো মুখ তুলে তাকানো যাবে না। সাধারণত ভগবানজি যখন কারো সাথে কথা বলতেন, সাক্ষাৎপ্রার্থী আর তার মাঝে একটি পর্দা ফেলা থাকত, যে কারণে সাক্ষাৎপ্রার্থীর পক্ষে তার মুখ-দর্শন করা সম্ভব হতো না। প্রথমদিকে সুরজিৎ বাবুদেরও এভাবেই ভগবানজির সাথে কথা বলতে হতো।

যতদিন সুরজিৎ বাবুরা ফাইজাবাদে ছিলেন, এটি যেন একটি অলিখিত নিয়মেই পরিণত হয়েছিল যে প্রতিদিন সকালে তারা ভগবানজির বাড়িতে হানা দেবেন, প্রাতরাশও সেখানেই সারবেন। এরপর বেরিয়ে পড়বেন বাজার করতে। বাজার করে ফেরা হলে সরস্বতী দেবী রান্না চাপাবেন, আর সেই ফাঁকে সবাই মিলে রাজনৈতিক আড্ডা জমাবেন। দুপুরের খাবারটা শেষ হয়ে গেলে আড্ডার বিষয়বস্তু আরো বৈচিত্র্যময় হয়ে উঠত। তখন কথা হতো ধর্মতত্ত্ব, সঙ্গীত, এমনকি দর্শনশাস্ত্র নিয়েও। কখনো কখনো আলোচনা এতটাই জমাটি হয়ে উঠত যে, কখন মধ্যরাত পেরিয়ে গেছে কারো হুঁশই থাকত না। আলোচনার মধ্যমণি থাকতেন অবশ্যই ভগবানজি। তিনি কথা বলতেন, আর বাকিরা মুগ্ধ হয়ে তা শুনত। কয়েকজন অতি উৎসাহী তো তার কথা রীতিমতো নোটও করত!
সেই আলোচনার বৈঠকেই ভগবানজি এমন একটা সময়ে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাবে, যখন তা কল্পনাও করা যেত না। তিনি কথা বলতেন ভিয়েতনাম যুদ্ধের ভয়াবহতা নিয়েও। সমাজতন্ত্র তার জন্মস্থানেই মৃত্যুবরণ করবে, এমন মন্তব্যও তিনি করেছিলেন। এছাড়াও বাংলাদেশে যখন মুক্তিযুদ্ধ চলছিল, নিয়মিত সে ব্যাপারে খোঁজ-খবর রাখতেন তিনি। সুরজিৎ বাবুর তো দৃঢ় বিশ্বাস, ভগবানজি মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশে নাকি বিভিন্ন কৌশলগত দিক-নির্দেশনাও পাঠিয়েছিলেন, যা তাদের যুদ্ধ জয়ে বিশেষ সহায়ক হয়েছিল!
প্রথম দুই-তিনদিন পর্দার আড়াল থেকে কথা বলার পর, ভগবানজি বিশ্বাস করেছিলেন যে সবাই তার বানানো নিয়ম মেনে চলবে। তাই তিনি নিজের সামনে পর্দা ফেলা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এমনই একদিন লোভ সংবরণ করতে পারেননি সুরজিৎ বাবু। নিজের মনের সাথে লড়াই করে না পেরে, এক মুহূর্তের জন্য তাকিয়ে ফেলেছিলেন ভগবানজির দিকে। আর সে কী এক অভাবনীয় দৃশ্যই না ছিল! সুরজিৎ বাবু বলেন,
“কোনো সন্দেহ নেই ওটা নেতাজিই ছিলেন। মাথার চুল পাতলা হয়ে গিয়েছিল। আমরা ছবিতে যা দেখে অভ্যস্ত, তার তুলনায় অনেক কম চুল ছিল। তার মুখভর্তি দাঁড়ি ছিল। কিন্তু মুখাবয়ব যেন অবিকল এক। শুধুমাত্র, তিনি কিছুটা বুড়িয়ে গিয়েছিলেন। তার চোখ দুটি এতটাই শক্তিশালী ছিল যে, আমি সাথে সাথেই নিজের চোখ নামিয়ে ফেলতে বাধ্য হই। আমি অনুধাবন করি, যেই মহান দেশপ্রেমিককে আমাদের বাবা-মা, এবং আমরাও, এতদিন পূজা করে এসেছি, তিনি এখন অস্তিত্বের আরো উচ্চতর স্তরে উপনীত হয়েছেন। তিনি হয়ে উঠেছেন মহাত্মা।”
জাস্টিস সাহাই কমিশনের প্রতিবেদন
কেউ যেন মনে না করেন, এক সুরজিৎ বাবুই ভগবানজি তথা গুমনামি বাবাকে নেতাজি বলে মনে করেছিলেন। ২০১৬ সালের জুন মাসে এলাহাবাদ উচ্চ আদালতের নির্দেশে বিচারপতি (অবসরপ্রাপ্ত) বিষ্ণু সাহাইয়ের নেতৃত্বে জাস্টিস সাহাই কমিশন গঠন করে উত্তরপ্রদেশের তৎকালীন সমাজবাদী পার্টি সরকার। নির্দেশনাটি এসেছিল একটি পিআইএলের পর, যেখানে পিটিশনার দাবি করেছিলেন যে গুমনামি বাবাই ছিলেন নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে বিষ্ণু সাহাই উত্তর প্রদেশের গভর্নর রাম নায়েকের কাছে তার প্রতিবেদন জমা দেন, যেখানে তিনি বলেন, “অধিকাংশ মানুষই, যারা কমিশনের কাছে সাক্ষ্যপ্রদান করেছে, বলেছে যে গুমনামি বাবাই ছিলেন নেতাজি।“

৩৪৭ পাতার প্রতিবেদন গঠনের সময় বিষ্ণু সাহাই তথ্যপ্রমাণের প্রাথমিক উৎস হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন সেসব সাক্ষীর দেয়া বয়ানকে, যারা সশরীরে এসে তার সাথে কথা বলেছিল, কিংবা যাদের বিবৃতির হলফনামা তার কাছে জমা পড়েছিল। বেশিরভাগ সাক্ষীই বলে যে গুমনামি বাবাই নেতাজি, কিংবা ‘হয়তো’ নেতাজি। অল্প কয়েকজন ব্যক্তি আবার এটিও বলেছিল যে, না, গুমনামি বাবা নেতাজি নন।
তবে বিষ্ণু সাহাই নিজেই স্বীকার করেছিলেন যে, প্রতিবেদনটিকে শতভাগ সত্য বলে ধরে নেয়ার কোনো সুযোগ নেই। কেননা গুমনামি বাবা মারা যান ১৯৮৫ সালে, আর সাক্ষীরা তাদের বয়ান দেয় ২০১৬ অথবা ২০১৭ সালে। অর্থাৎ মাঝখানে লম্বা সময় কেটে গেছে। এ সময়ের মাঝে মানুষের পক্ষে কিছুটা হলেও স্মৃতিভ্রষ্ট হওয়া খুবই স্বাভাবিক। তাছাড়া কারো কারো মাঝে অতীতের কল্পনাকে সময়ের ব্যবধানে বাস্তব সত্য বলে ধরে নেয়ার প্রবণতাও থাকতে পারে। এ প্রসঙ্গে বিষ্ণু সাহাই বলেন,
“কমিশনের উদ্দেশ্যই ছিল গুমনামি বাবার পরিচয় উদ্ঘাটন করা। কিন্তু বেশিরভাগ সাক্ষী তাদের বয়ান শুরুই করে এমনটা ধরে নিয়ে যে গুমনামি বাবাই নেতাজি। তাদের কথা বলার ধরন ছিল এমন যে, যদি কমিশন তাদের পূর্বনির্ধারিত ধারণার সাথে একমত পোষণ না করে, তাহলেই তারা চেষ্টা করবে গুমনামি বাবার অন্য কোনো পরিচয় আছে কি না তা ভেবে দেখার। সহজ ভাষায় বলতে গেলে, তারা সবাই হালের চেয়ে আগে হাঁটছিল।”
গুমনামি বাবার সম্পদ তালিকা থেকে নেতাজির সাথে যোগসূত্র স্থাপন
গুমনামি বাবা বা ভগবানজিকেই নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু হিসেবে মনে করার সুযোগ কিন্তু এরপরও থাকে। ফাইজাবাদের জেলা রাজস্ব বিভাগ গুমনামি বাবার জিনিসপত্র নিয়ে বিশদে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছিল, যার ফলাফল ২০১৭ সালে প্রকাশিত হয়। সেই ফলাফলেও এমন কিছু বিস্ময়কর তথ্য উঠে এসেছিল যা থেকে গুমনামি বাবা ও নেতাজির মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করা সম্ভব।

অন্তত ৮টি তথ্য থেকে মনে হতে পারে যে গুমনামি বাবা ও নেতাজির মধ্যে কোনো না কোনো সম্পর্ক রয়েছে।
- নেতাজির দুটি পোস্ট স্ট্যাম্পের ছবি: নেতাজির ৬৭তম জন্মবার্ষিকীতে প্রকাশিত দুটি পোস্ট স্ট্যাম্পের ছবি পাওয়া যায় গুমনামি বাবার সম্পদের তালিকায়।
- অন্তর্দেশীয় চিঠি ও টেলিগ্রাম: এমন কিছু অন্তর্দেশীয় চিঠি ও টেলিগ্রাম পাওয়া যায়, যেগুলোর প্রেরক অথবা প্রাপক ছিলেন নেতাজির ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির গোয়েন্দা বিভাগের সিনিয়র অফিসার, ড. পবিত্র মোহন রয়। অবশ্য সেসব চিঠি বা টেলিগ্রামের বক্তব্য এখনো অনিশ্চিত।
- আজাদ হিন্দ ফৌজের ব্যবহৃত বাইনোকুলার: জার্মানিতে নির্মিত এক জোড়া বাইনোকুলার পাওয়া যায়, যা নেতাজি ও আজাদ হিন্দ ফৌজের অন্যান্য সদস্যরা ব্যবহার করতেন।
- পত্রিকার কাটিং: আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রাপ্তি ছিল ১৯৭৮ সালের ১৩ মার্চ সংবাদপত্রে সমর গুহ রচিত একটি লেখা, যেখানে দাবি করা হয়েছিল যে নেতাজি তখনো বেঁচে আছেন, এবং তিনি রাশিয়ায় চলে গেছেন।
- হাতে তৈরী বাংলাদেশের মানচিত্র: একটি হাতে তৈরি বাংলাদেশের মানচিত্রও পাওয়া যায়, যেটিতে পদ্মাসহ আরো কয়েকটি নদী চিহ্নিত করা ছিল।
- কলকাতা থেকে আসা টেলিগ্রাম: ১৯৮৫ সালের ৩১ মার্চ কলকাতা থেকে আসা ড. পি এম রয়ের একটি টেলিগ্রাম পাওয়া যায়, যেখানে লেখা ছিল, “বাসন্তী দূর্গাপূজার দিনে আমাদের প্রণাম গ্রহণ করুন।”
- বিভিন্ন নোটসহ একটি বই: ‘হিমালয় ব্লান্ডার’ নামক একটি বইয়ের কপি পাওয়া যায়, যার বিভিন্ন লাইনের নিচে দাগ দেয়া ছিল, এবং কয়েক পাতা পরপরই বিভিন্ন নোট লেখা ছিল। কোথাও কোথাও লেখা ছিল ‘Imp’ (important), আবার কোথাও বা লেখা ছিল ‘M Imp’ (most important).
- এম এস গোলওয়ালকারের চিঠি: ১৯৭২ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর লেখা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের প্রধান এম এস গোলওয়ালকারের একটি চিঠি পাওয়া গিয়েছিল, যেখানে লেখা ছিল, “আমি গত ৬ সেপ্টেম্বর তোমার ২৫ আগস্ট থেকে ২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত লেখা চিঠিগুলো পেলাম। তুমি যদি চিঠিতে উল্লিখিত তিনটি স্থানের মধ্য থেকে যেকোনো একটি স্থানকে আলাদা করে চিহ্নিত করতে, তাহলে আমার কাজটি নিঃসন্দেহে অনেক সহজ হয়ে যেত।” চিঠিতে গুমনামি বাবাকে সম্বোধন করা হয়েছিল ‘পূজ্যপদ শ্রীমান স্বামী বিজয়নন্দজি মহারাজ’ হিসেবে। চিঠির শেষাংশে আরো লেখা ছিল, “আমি আগামী ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে ১২ অক্টোবর প্রবাসে থাকব। এই সময়ের মাঝে তিনদিনের জন্য আমি নাগপুরে অবস্থান করব।”
এছাড়াও গুমনামি বাবার সম্পদের তালিকায় একটি ওভারকোটেরও উল্লেখ ছিল, যদিও সেটি আজাদ হিন্দ ফৌজের ইউনিফর্ম কি না, তা নিশ্চিত করা যায়নি। এছাড়া একটি রোলেক্স ঘড়িও পাওয়া গিয়েছিল, যে সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করতে চায়নি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
সুতরাং গুমনামি বাবার সম্পদের ভিতরও এমন অনেক কিছুই পাওয়া গিয়েছে, যেগুলো তার নেতাজি হওয়ার সম্ভাবনাকেই নির্দেশ করে। তবে এ থেকেও কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব নয়। কেননা এমনও হতে পারে যে তিনি জীবিত থাকাকালীনই অনেকে তাকে নেতাজি হিসেবে মনে করেছিলেন বিধায় তার কাছে ঐসব জিনিস প্রেরণ করেছিলেন।
গুমনামি বাবাকে নিয়ে বই ও চলচ্চিত্র
২০১৮ সালে ইস্টার্ন বুক কোম্পানি থেকে প্রকাশিত হয়েছে অধীর সোম রচিত Gumnami Baba: A Case History বইটি। এছাড়া ২০১৮ সালের ১৮ আগস্ট পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান সময়ের খ্যাতিমান পরিচালক সৃজিত মুখার্জী ঘোষণা দেন যে তিনি প্রসেনজিৎ চ্যাটার্জীকে মুখ্য ভূমিকায় রেখে, অনুজ ধর ও চন্দ্রচুর ঘোষ রচিত বই CONUNDRUM, Subhas Bose’s Life After Death থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে নির্মাণ করবেন ‘গুমনামি – দ্য গ্রেটেস্ট স্টোরি নেভার টোল্ড’ ছবিটি। গত ২৩ জানুয়ারি নেতাজির জন্মদিনে ছবিটির টিজার পোস্টার উন্মুক্ত করা হয়। তবে সর্বশেষ খবর হলো, ছবিটির ভবিষ্যৎ এখন অনিশ্চিত। নেতাজির পরিবারের সদস্য চন্দ্র কুমার বসু ছবিটি নির্মাণের ক্ষেত্রে বিরোধিতা জানিয়ে বলেছেন, যেহেতু গুমনামি বাবার প্রকৃত পরিচয় এখন পর্যন্ত প্রমাণিত হয়নি, তাই তাকে ছবিতে নেতাজি হিসেবে উপস্থাপন করা যাবে না। জানিয়ে রাখা ভালো, চন্দ্র কুমার বসু পশ্চিমবঙ্গ ভারতীয় জনতা পার্টির ভাইস প্রেসিডেন্ট। সুতরাং বেশ ভালোই প্রভাবশালী তিনি। তিনি তার প্রভাব খাটিয়ে ছবিটির কাজ বন্ধ করে দিলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। ইতিমধ্যেই রোজভ্যালি কেলেঙ্কারিতে প্রযোজক শ্রীকান্ত মোহতার গ্রেফতারের পর এসভিএফের বেশ কিছু ছবি নির্মাণ স্থগিত হয়ে গিয়েছে। সেই তালিকায় যোগ হতে পারে ‘গুমনামি’-ও।
চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/