Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

জেনে নিন বর্ণচোরা প্রাণীদের কথা

প্রকৃতি একদিকে যেমন নানা প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণীর সমাহার তৈরি করে রেখেছে, আমাদের চারপাশে তেমনই এসব উদ্ভিদ ও প্রাণীকে দান করেছে কিছু অতিরিক্ত ক্ষমতা। অবশ্য জীববিজ্ঞানীগণ এই ক্ষমতাকে কখনো কখনো অভিব্যক্তি বা অভিযোজনের দিকে নিয়ে যান। এই লেখার উদ্দেশ্য অবশ্য এসব প্রাণীর অভিযোজন নিয়ে আলোচনা করা নয়। যে প্রাণীগুলো প্রয়োজনে নিজেদের বর্ণ পরিবর্তনে সক্ষম, তাদের নিয়েই সাজানো আজকের লেখাটি। কখনো কখনো এরা বিপরীত লিঙ্গকে আকৃষ্ট করতে রঙ পরিবর্তন করে, কখনো শিকার ধরতে, আবার কখনো নিজে শিকারীর হাত থেকে বাঁচতেও তারা এমনটি করে থাকে। তো চলুন জানা যাক এসব প্রাণী সম্পর্কে।

ক্যামেলিওন

বর্ণ পরিবর্তনকারী প্রাণীদের কথা বললে সর্বপ্রথম যে প্রাণীটি আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে, সেটা হচ্ছে গিরগিটির মতো একধরনের সরীসৃপ। যারা অ্যানিমেশন দেখতে পছন্দ করেন, তারা হয়তো ‘ট্যাঙ্গলড’ এনিমেশন মুভিটি দেখেছেন। এই এনিমেশনে রাপানজেলের সাথেই দেখতে পাওয়া যায় ক্যামেলিওনকে, যে ক্ষণে ক্ষণে বর্ণ পরিবর্তন করতে পারে।

ক্যামেলিওন; source: img.theepochtimes.com

যা-ই হোক, বর্ণ পরিবর্তনের এই অদ্ভুত ক্ষমতার কারণেই এরা অনন্য হয়ে আছে এদের গোত্রে। এরা এদের চারপাশের পরিবেশের সাথে রঙ বদলে সহজেই গায়েব হয়ে যেতে পারে। ক্যামেলিওনের এই রঙ পরিবর্তন এদের মেজাজ, পরিবেশের তাপমাত্রা কিংবা আলোর উজ্জ্বলতার উপর নির্ভর করে। এদের অনেক প্রজাতি প্রায় সবধরনের রঙই ধারণ করতে সক্ষম।

এখন জানা যাক যে কীভাবে ক্যামেলিওন তাদের রঙ বদলাতে পারে। এদের শরীরে চামড়ার নিচে বিশেষ ধরণের পিগমেন্ট ধারণকারী কোষ থাকে। যখন এদের মেজাজ বা তাপমাত্রা কিংবা আলোর উজ্জ্বলতার পরিবর্তন ঘটে, তখন এদের মস্তিষ্ক থেকে এই সকল পিগমেন্ট কোষে বিশেষ সিগন্যাল প্রেরিত হয়। ফলে পূর্বে বর্ণিত অবস্থাসমূহের প্রকৃতি অনুসারে বিভিন্ন রঙ প্রকাশ পায়। এই প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হতে প্রায় ষোল থেকে বিশ সেকেন্ড সময় লাগে। রঙ বদলানোর মাধ্যমে সাধারণত এরা অন্য ক্যামেলিওনের সাথে যোগাযোগ করতে পারে এবং পরিবেশের সাথে মিশে গিয়ে শত্রুকে সহজেই বোকা বানাতে পারে।

রঙ বদলে ফেলা একটি ক্যামেলিওন; source: s2.thingpic.com

বর্তমানে পৃথিবীতে মোট প্রায় ১৬০ প্রজাতির ক্যামেলিওন পাওয়া যায়, যার অর্ধেকের বেশিই বাস করে মাদাগাস্কার দ্বীপে। এদের আরেকটি বিশেষ ক্ষমতা হলো এরা এদের প্রতিটি চোখকে আলাদাভাবে ঘোরাতে সক্ষম। ফলে সহজেই এরা ত্রিমাত্রিকভাবে অর্থাৎ ৩৬০ ডিগ্রী কোনে দেখতে সক্ষম। দৈর্ঘ্যে সর্বোচ্চ সাতাশ ইঞ্চি থেকে সর্বনিম্ন আধা ইঞ্চি পর্যন্ত হতে পারে এবং এদের জিহ্বার দৈর্ঘ্য হয় এদের দেহের দৈর্ঘ্যের দেড় থেকে দুই গুণ। এরা দৃশ্যমান আলো ও অতিবেগুনি রশ্মি- উভয়ই দেখতে সক্ষম।

ফ্লাউন্ডার ফিশ

অভিযোজিত ক্যামোফ্লাজিং বা ছদ্মবেশ ধারণকারী প্রাণীর সবথেকে ভালো উদাহরণ হতে পারে ফ্লাউন্ডার ফিশ। কারণ এরা সহজেই এদের বাসস্থান বা চলাচলের পথের উপর নির্ভর করে এদের বর্ণ পরিবর্তন করতে সক্ষম। সাধারণত ধূসর বা বাদামী বর্ণের হলেও এ মাছ যেকোনো অবস্থানে এর রঙ পাল্টাতে পারে এবং সেটাও পাঁচ থেক আট সেকেন্ডের মধ্যে।

ফ্লাউন্ডার ফিশ; source: ak3.picdn.ne

এ ধরনের মাছ যখন চলাচল করে বা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যায়, তখন সেই পরিবেশের আলোর প্রতিফলনের মাধ্যমে ওই নতুন পরিবেশের বর্ণের তথ্য রেটিনা হয়ে মস্তিষ্কে চলে যায়। এরপর মস্তিষ্ক হতে সিগন্যাল চলে যায় পিগমেন্ট কোষে। চ্যাপ্টা আকৃতির এই দুর্ধর্ষ শিকারী মাছের শরীরে এক বিশেষ ধরনের হরমোন বিন্যাস পাওয়া যায়। মূলত এই হরমোন বিন্যাসই পিগমেন্ট কোষে রঙ পরিবর্তনের বিশেষ সিগন্যাল বয়ে নিয়ে যায়।

এখানেই লুকিয়ে আছে একটি ফ্লাউন্ডার ফিশ; সূত্রঃ media.novinky.cz

ফ্লাউন্ডার সাধারণত পাঁচ থেকে পঁচিশ ইঞ্চি লম্বা হয়ে থাকে এবং এদের আকৃতি চ্যাপ্টা। এরা সহজেই সমুদ্রের তলার সাথে মিশে যেতে পারে এবং শিকারকে খুব সহজে আক্রমণ করতে পারে।

ক্যাটল ফিশ

সেফালোপোডা শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত এই বিশেষ ও অদ্ভুত প্রাণীটিও নিজের বর্ণ পরিবর্তনের ক্ষমতা রাখে। সামুদ্রিক এই প্রাণীটির প্রায় একশটি প্রজাতির সন্ধান পাওয়া যায় সারা পৃথিবীতে। তবে এরা ফ্লাউন্ডার মাছের মতো শিকারী নয়। বরং এরা শিকারী মাছের আক্রমণ থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য এই রঙ পরিবর্তনের পদ্ধতি প্রয়োগ করে।

ক্যাটল ফিশ; source: images7.alphacoders.com

আট বাহু বিশিষ্ট এই সামুদ্রিক অমেরুদণ্ডী প্রাণীটি অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণী থেকে কিছুটা বুদ্ধিমান হয়। শত-সহস্র পিগমেন্ট কোষের সহায়তায় এরা সহজেই সাগরতলের সাথে নিজেদের মিশিয়ে ফেলতে পারে এবং সহজেই শিকারীর হাত থেকে রক্ষা পেতে পারে। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে, এরা নিজেরাই রঙের প্রতি অনুভূতিশূন্য। অর্থাৎ বলা যায় এরা কালার ব্লাইন্ড। এদের দেখার কৌশল হচ্ছে সমবর্তিত (পোলারাইজড) আলোর মাধ্যমে, যা সাধারণ মানুষের দৃষ্টিসীমার বাইরে।

মিমিক অক্টোপাস

একদিকে বিস্ময়কর এবং বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারী সামুদ্রিক এই প্রাণীটি শুধুমাত্র এদের বর্ণ পরিবর্তন করেই এদের কাজ শেষ করে না। এদের আছে নিজের দেহকে অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণীর মতো অনুকরণ করিয়ে নেবার ক্ষমতা। এরা নিজেদের রঙের বিন্যাস যেমন পরিবর্তন করে, তেমনি দেহের আকার সামুদ্রিক সাপ, লায়ন ফিশ, জেলীফিশ কিংবা ভাসমান প্রবালের মতো করতে পারে। বিভিন্ন সামুদ্রিক প্রাণীকে অনুকরণ করার এই বিশেষ ক্ষমতার জন্যই এদের নাম দেয়া হয়েছে ‘মিমিক অক্টোপাস’। ইংরেজি ‘Mimic’ শব্দের অর্থ অনুকরণ করা। এরা এদের পরিবেশের সাথেও সহজে মিশে যেতে পারে।

মিমিক অক্টোপাস; source: allteresting.com

এদের বিশেষ এই ক্ষমতা একদিকে যেমন এদের শিকারীর হাত থেকে রক্ষা করে, অন্যদিকে তেমনি শিকার ধরতেও সাহায্য করে। মিমিক অক্টোপাসের অধিকাংশই খুব বিষাক্ত হয়ে থাকে। সমুদ্রতলে এরা গর্ত করে বাস করে। এ ধরণের অক্টোপাসের বুদ্ধিমত্তা এতোটাই উন্নত যে এরা জানে কোন ধরনের শিকারী প্রাণীর আক্রমণে কোন ধরণের ছদ্মবেশ ধারণ করতে হবে। সবথেকে অদ্ভুত ব্যাপার হলো, যখন এদের খাদ্যসংকট দেখা দেয়, তখন এরা একে অপরকে খেয়ে উদরপূর্তি করে।

গোল্ডেন টরটয়েজ বীটল

সোনার মতো শরীরের রঙ হওয়ায় এদের অনেক সময় স্বর্ণপোকা বলা হয়। আবার দেহ কিছুটা কচ্ছপের মতো দেখতে বলে সাথে ‘টরটয়েজ’ শব্দটা জুড়ে দেয়া হয়েছে। গোল্ডেন টরটয়েজ বীটল মূলত পূর্ব-উত্তর আমেরিকার অধিবাসী। শরীরের বর্ণ পরিবর্তনের অদ্ভুত ক্ষমতা থাকায় পোকামাকড়ের জগতে এক বিশেষ স্থান করে নিয়েছে এই ‘সোনালী’ পোকাটি।

গোল্ডেন টরটয়েস বীটল; source: planetstillalive.com

তবে ধারণা করা হয়, এরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিকারীর আক্রমণ থেকে বাঁচতেই নিজেদের রঙ পরিবর্তন করে থাকে। এদের বর্ণ তখন অনেকটা উজ্জ্বল সোনালী কমলা রঙের হয়। এই রঙ পরিবর্তনের জন্য পোকাটির সময় লাগে প্রায় দুই থেকে তিন মিনিট। এরা যখন ভীত হয়ে শরীরের রঙ পাল্টে ফেলে, তখন স্বাভাবিকভাবে দেখলে মনে হবে এরা খুব বিষাক্ত কোনো পোকা। ফলে সহজেই শিকারী পোকার হাত থেকে নিস্তার পেতে পারে।

কিন্তু আধুনিককালে অনেক পতঙ্গবিদের মতে এই গোল্ডেন টরটয়েজ বীটল কেবল আত্মরক্ষার জন্যই এদের বর্ণ পরিবর্তন করে না। কখনো কখনো রোমান্সও এদের রঙ বদলে দিতে পারে। বিপরীত লিঙ্গকে আকর্ষণের সময় এদের রঙ হতে পারে স্কারলেট (টকটকে লাল রঙ)।

আকারের দিক থেকে কাছিমের মতো দেখতে এই পোকা পরিমাপে প্রায় পাঁচ থেকে সাত মিলিমিটার হয়ে থাকে। এরা এদের বর্ণ পরিবর্তনের জন্য শরীরের চামড়ার নিচে সূক্ষ্ম প্রণালী দিয়ে প্রবাহিত তরল পদার্থের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। সাধারণত মিষ্টি আলু বা মর্নিং গ্লোরি টাইপের উদ্ভিদে এরা হোস্ট হিসেবে থাকে।

প্রশান্ত মহাসাগরীয় গেছো ব্যাঙ

প্যাসিফিক ট্রি ফ্রগস বা প্রশান্ত মহাসাগরীয় গেছো ব্যাঙ বর্ণ পরিবর্তনকারী প্রাণীদের দলের আরেক সদস্য। সাধারণত উত্তর আমেরিকার পশ্চিম উপকূলে এদের আবাসস্থল। বিশেষ ধরনের আঠালো পদার্থ বিশিষ্ট পা থাকায় এরা সহজে যেকোনো ধরনের গাছের ডাল বেয়ে উঠতে বা কোনো কিছু আঁকড়ে ধরতে পারে। শরীরের রঙ পরিবর্তন করাও এদের আরেকটি বিশেষ ক্ষমতার মধ্যে পড়ে যায়।

প্যাসিফিচ ট্রি ফ্রগ। source: themysteriousworld.com

যদিও প্রকৃতিতে এদের এই বিশেষ প্রজাতিটি সবুজ, তবু এরা তামাটে, লাল বা বাদামীও হতে পারে। এরা এদের চারপাশের পরিবেশের উপর নির্ভর করে নিজেদের রঙ পরিবর্তন করতে পারে। এই রঙ পরিবর্তনের জন্য এদের সময় লাগে দু-এক মিনিট। একবার রঙ বদলে ফেললে সহজে এদের চিহ্নিত করা খুবই দুষ্কর। ফলে শিকারী প্রাণী যেমন সাপ বা পাখির হাত থেকে এরা রক্ষা পেতে পারে সহজেই। দৈর্ঘ্যের দিক থেকে এরা প্রায় আড়াই থেকে চার সেন্টিমিটার পর্যন্ত হতে পারে।

প্রয়োজনে দ্রুত নিজের রঙ পরিবর্তন করার বিশেষ ক্ষমতা এসব প্রাণীদের করেছে প্রাণীজগতের অন্যতম সদস্য। আরো অনেক জানা-অজানা প্রাণী আছে, যারা অনেকেই বিশেষ বিশেষ বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন। যে প্রক্রিয়ায় এরা এতো সহজে প্রকৃতি ও পরিবেশের সাথে মিশে যেতে পারে, তা প্রকৃতির সৃষ্ট এক বিস্ময়ই বটে।

ফিচার ইমেজ- cdn.theconversation.com

Related Articles