“সবচেয়ে শক্তিশালী মানুষের চেয়েও শক্তিশালী মানুষ কীভাবে তৈরি করা যায়? ব্যাপারটা হাস্যকর এবং অবান্তর, কিন্তু আমার মাথায় তখন অন্য খেয়াল। আমি সীমার বাইরে চিন্তা করা শুরু করলাম। আচ্ছা, তার মানুষ হওয়া কি খুবই জরুরি? এবার একজন ‘গড’ বানানো যাক। বই আর গল্পপোকারা ইতোমধ্যে হাজার হাজার রোমান আর গ্রিক গডের উপাখ্যানের সাথে পরিচিত। আমি তাদের একটু আলাদা স্বাদ দিতে চাইলাম। এবার একজন নর্স গডকে দৃশ্যপটে আনার পালা। তাছাড়া আমি থরকে কল্পনা করছিলাম একটু ভিন্নরূপে। দুর্ধর্ষ ভাইকিংদের মতো দাড়ি, শৃঙ্গযুক্ত মুকুট আর যুদ্ধক্লাবের মিশ্রণে এক অনন্য নর্স দেবতার পুনর্জন্ম। ঠিক এমন একজনকেই ‘জার্নি ইনটু মিস্ট্রি’র প্রয়োজন ছিল, তাই আমি থরকেই বেছে নিয়েছিলাম বইটির নতুন ফিচারের শিরোনামের জন্য। মনে উদয় হওয়া চরিত্রগুলো নিয়ে একটি রূপলেখা রচনার পর আমি আমার ভাই ল্যারিকে বললাম লেখাটি সম্পূর্ণ করতে। কারণ আমার হাতে পর্যাপ্ত সময় ছিলো না এবং স্বাভাবিকভাবেই চিত্রায়নের দায়িত্ব দিয়েছিলাম জ্যাক কার্বির উপর।”
২০০২ সালে প্রকাশিত মারভেল প্যানথিয়নে থরকে উপমা দিতে কথাগুলো বলেছিলেন কমিকবই কিংবদন্তী স্ট্যান লি। নর্স পুরাণের এই বজ্রদেবতাকে তিনি মারভেল কমিকস পাঠকদের কাছে প্রথমবারের মতো উপস্থাপন করেছিলেন ১৯৬২ সালের আগস্ট মাসে প্রকাশিত ‘জার্নি ইনটু মিস্ট্রি’ সিরিজের ৮৩তম সংখ্যায়। সেই সময় এর সম্পাদনায় ছিলেন স্ট্যান লি ও তার ভাই ল্যারি লাইবার এবং অংকনের দায়িত্বে ছিলেন চিত্রশিল্পী জ্যাক কার্বি। মজার কথা হলো, জ্যাক কার্বি ডিসি কমিকসের হয়েও তাদের থর সংস্করণের চিত্রাঙ্কন করেছেন।
গ্রিক পুরাণে যেমন বজ্র দেবতা হিসেবে আছে জিউস, ঠিক তেমনি নর্স পুরাণের বজ্রদেবতা থর। আসগার্ডিয়ান দেবরাজ অডিন ও জ্যেষ্ঠ দেবী গাইয়ার একমাত্র পুত্র। জন্ম পরিচয় ঠিক রাখলেও, মারভেলের কমিক জগতের সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্যে থরের উৎপত্তির গল্পে আনা হয়েছে বেশ কিছু পরিবর্তন। সেই অনুযায়ী থরের জন্ম হয়েছিল শত শত বছর পূর্বে নরওয়ের এক গুহায়। কৈশোরে উত্তীর্ণ হওয়ার পর অডিন তাকে আসগার্ডে নিয়ে আসেন যাতে পূর্ণবয়স্ক হওয়ার পর তাকে আসগার্ডের সিংহাসনে বসাতে পারেন। লকি লাউফিসান নামে থরের এক পালক ভাই রয়েছে। তাকে বলা হয় দুষ্কর্মের দেবতা এবং মারভেল ইউনিভার্সের অন্যতম প্রধান সুপারভিলেনদের একজন। ইয়োথানহাইমের সংঘটিত যুদ্ধ জয়ের পর সেখান থেকে ফেরার পথে অডিন, শিশু লকিকে নিয়ে আসগার্ডে আসেন এবং নিজের সন্তানের মতো করে তাকে লালন পালন করেছেন।
দেবতা বলেই কিনা থরের গায়ে ছিল অসুরের সমান শক্তি। ছোটবেলা থেকে সে শিখতে শুরু করে যুদ্ধের নানা কৌশল। ধীরে ধীরে সে হয়ে ওঠে আসগার্ডের সবচেয়ে বলবান বীর। অস্ত্র বলতে তার আছে অবিনাশী পাথর উরু দিয়ে তৈরি ম্যিয়লনির নামের প্রকাণ্ড হাতুড়ি। সেটা দিয়ে সে মেঘ, বজ্রপাত এবং বাতাসকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। অডিনের বক্তব্য অনুযায়ী যোগ্য কেউ ব্যতীত ম্যিয়লনিরকে তোলার সামর্থ্য কারো নেই। সন্তানকে আরও দক্ষ এবং পরাক্রমশালী রূপে গড়ে তোলার লক্ষ্যে, সর্বপিতা অডিন আসগার্ডিয়ান সামরিক বাহিনীর দায়িত্ব তার হাতে তুলে দিলেন।
তার নেতৃত্ব বেশ কিছু যুদ্ধ জয় করে আসগার্ডিয়ানরা। এছাড়া বছরের পর বছর আসগার্ডকে শত্রুর কবল থেকে রক্ষা করতে করতে থরের ভিতর এক ধরনের অহমিকা আর একগুঁয়েমিতার তৈরি হয়। সেটা অডিনের নজরে আসে। অডিন সবসময় চাইতেন তার ছেলে হবে তার থেকেও মহৎ, উদার এবং ক্ষমতাবান। ছেলের ভেতরের এই অহমিকা দূর করার জন্যে তিনি থরকে মিডগার্ডে (পৃথিবী) নির্বাসিত করে একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে, যাতে করে সে সাধারণ মানুষের সাথে থেকে নম্রতা আর উদারতা শিখতে পারে। কমিকবই থেকে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, থরকে পৃথিবীতে পাঠান হয়েছিল ড. ডোনাল্ড ব্লেইক নামের এক পঙ্গু মেডিকেল ছাত্র হিসেবে। তখন তার মধ্যে কোনো স্বর্গীয় শক্তি বা তার আগের জীবনের কোনো স্মৃতি ছিল না। অডিনের বশীকরণের ফলে সে তার অতীতের সবকিছু ভুলে নিজেকে একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে বিশ্বাস করা শুরু করে। ধীরে ধীরে থর শিখতে পারে ক্ষুদ্রতা কী, দুর্বলতা কী- এগুলোর সাথে কোনোই পরিচয় তার ছিল না পূর্বে। সে আরও শিখে মরণশীল হয়েও কীভাবে সত্যিকারের বিনয়ী আর মহৎ হতে হয়।
একদিন ক্রোনান নামের এলিয়েন জাতি তাদের স্কাউটদলকে পৃথিবীতে পাঠায় আক্রমণ করার জন্যে। সেই স্কাউটদল অবতরণ করে নরওয়ের এক জায়গায়। ডাক্তারি পাশ করার পর ডোনাল্ড ব্লেইকরুপী থর অবসর কাটানোর জন্যে অবস্থান করছিল সেই শহরেই। আকাশ থেকে আলোর ঝলকানি মাটিতে পড়তে দেখে ব্লেইক কৌতূহলের বসে সেটাকে ফলো করে। তখনই ঘটে আশ্চর্যজনক এক ঘটনা। হঠাৎ করেই ব্লেইক উড়তে শুরু করে এবং এক গুহায় অবতরণ করে। এই একই গুহায় তার জন্ম হয়েছিল। সেখানে সে নিজের ছড়িটি দিয়ে পাথরে আঘাত করে এবং ফিরে পায় হয় তার পূর্বের রূপ, বজ্রদেব থর। থরে রূপান্তরিত হবার পর সে ক্রোনানদের সাথে ভয়াবহ যুদ্ধে লিপ্ত হয়। তার বীরত্বে ক্রোনানদের অভিযানে ভাঁটা পড়ে। এরপর হাতের হাতুড়ি ম্যিয়লনির দিয়ে মাটিতে আঘাত করে সে নিজেকে আবার ডোনাল্ড ব্লেইকে রূপান্তরিত করে। পরাক্রমশীল থর বনে যায় সাধারণ মানুষে আর থরের হাতুড়ি বদলে যায় সামান্য কাঠের লাঠিতে। ক্রোনানদের অবৈধ অনুপ্রবেশ প্রতিহত করার কিছুদিন পর থর জানতে পারে তার গর্ভধারিণী মা গাইয়ার কথা, জানতে পারে তার জন্ম হয়েছিল এই পৃথিবীতেই। তাই পৃথিবীকে শত্রুর কবল থেকে বাঁচানোর জন্যে সে সেখানেই থেকে যায় এর রক্ষক এবং একজন মূর্তমান অধিপতি হিসেবে।
থরের নেপথ্যে ছিলেন যারা
দীর্ঘদিন যাবত থরের কাহিনী লেখার দায়িত্ব স্ট্যান লির উপর অর্পিত থাকলেও পরবর্তীকালে ল্যেইবারের পাশাপাশি তার সাথে লেখালেখির দায়িত্বে যুক্ত হন রবার্ট বার্নস্টেইন (ছদ্মনাম: রবার্ট বার্ন)। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন চিত্রশিল্পী ফিচারটির চিত্রায়নের দায়িত্বে নিয়েছিলেন জ্যাক কার্বি সহ জো সিনট, ডন হেক এবং অ্যাল হার্টলে। ১৯৬৩ সালের অক্টোবর মাসে ‘জার্নি ইনটু মিস্ট্রি’র ৯৭তম সংখ্যা প্রকাশের সময় এর সাথে ‘টেইলস অফ আসগার্ড’ নামে থরের আলাদা একটি ফিচার প্রকাশ করা হয়। সেই ফিচার ধীরে ধীরে সিরিজের আকার পায়। দীর্ঘদিন থরকে ‘জার্নি ইনটু মিস্ট্রি’র আলোচিত চরিত্র হিসেবে প্রকাশ করার পর ১৯৭০ সালের আগস্ট মাসে সেই সিরিজটি নাম বদলে সেটাকে থরের নিজস্ব সিরিজ আকারে প্রকাশ পায় থরের ১৭৯তম সংখ্যা হিসেবে।
১৯৬৩ সালের অগাস্ট মাসের মারভেল তাদের তারকা সুপারহিরোদের একত্রিত করে নতুন এক সিরিজ শুরু করার পরিকল্পনা করে, নাম দেয় দ্য অ্যাভেঞ্জারস। সেই সিরিজের প্রথম সংখ্যা রচনার সময় স্ট্যান লি আর কার্বি থরকে এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে নিয়ে যুক্ত করেন। এরপর থেকে ‘দ্য অ্যাভেঞ্জার্স’ সিরিজের পরবর্তী প্রত্যেকটি সংখ্যায় থরের উপস্থিতি ছিল। ১৯৭০ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে জ্যাক কার্বি মারভেল ছেড়ে চলে যাওয়ার পর কিছুদিনের জন্যে চিত্রায়নের দায়িত্ব নিয়েছিলেন নীল এডামস। পরে জন বুসেমাকে নিযুক্ত করা হয় নিয়মিত আর্টিস্ট হিসবে। কোনরকম বিরতি ছাড়াই ১৯৭৮ সালের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত চিত্রকরের চেয়ারটি বুসেমাই দখল করে ছিলেন। কার্বি চলে যাওয়ার পর স্ট্যান কাহিনী লেখা বন্ধ করে দেন, তখন বুসেমার সাথে মূল গল্প লেখার দায়িত্বে ছিলেন গ্যারি কনওয়ে, লেন ওয়েইন আর রয় থমাস।
সিনেমায় থর
অন্যান্য সুপারহিরোর তুলনায় থরকে নিয়ে অ্যানিমেশন অথবা চলচ্চিত্র কোনোটাই তেমন একটা নির্মাণ হয়নি। ২০০৬ সালে মারভেল স্টুডিও এবং লায়ন্স গেইট এন্টারটেইনমেন্টের যৌথ পরিচালনায় নির্মিত অ্যানিমেশন সিনেমা ‘আল্টিমেট অ্যাভেঞ্জার্সে’ তাকে প্রথম দেখা যায়। পরবর্তীতে ১৯৬৩ সালে প্রকাশিত ‘টেইলস অফ আসগার্ড’ নামের একটি ফিচারের উপর ভিত্তি করে ২০১১ সালের মে মাসে একই নামে নামে থরের প্রথম একক অ্যানিমেশন মুভি বের হয়। ২০০৮ সালে শুরু হাওয়া মারভেল সিনেমাটিক ইউনিভার্সের অংশ হিসেবে সে বছরই নির্মিত হয় থরের প্রথম মোশন ছবি ‘থর’, সেখানে থর চরিত্রে অভিনয় করেন অস্ট্রেলিয়ান অভিনেতা ক্রিস হেমসওয়ার্থ। এখন পর্যন্ত মোট পাঁচটি সিনেমায় থরকে দেখা গেছে; সেগুলো হল- থর, দ্য অ্যাভেঞ্জার্স, থর: ডার্ক ওয়ার্ল্ড এবং অ্যাভেঞ্জার্স: এজ অফ আল্ট্রন। আর ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে মুক্তি পেতে পেলো থরের তৃতীয় একক চলচ্চিত্র থর: রাগনারক।