উত্তরের বরফপড়া তীব্র ঠান্ডায় আপনি কি আপনার নবজাতক শিশুকে বাইরে রেখে দিয়ে কোথাও চলে যেতে পারবেন? কিংবা অকল্যাণের ভয়ে শিশুকে কোল থেকে নামালেন না মাসের পর মাস, কেমন হবে তখন? আর যদি এমন হয়, মায়ের নাড়িছেঁড়া শিশু যাতে মাকে ভালোবাসে, তাই মা সেই নাড়িটি যত্নে তুলে রাখলো সারাজীবন? কতো অবাক করা সব ব্যাপার!
একটি জন্ম মানেই একটি নতুন আরম্ভ, জীবনের উঁচুনিচু পথে একটি নতুন যাত্রার শুরু। একটি নতুন জীবন মানেই নতুন আশা আর অপার সম্ভাবনার হাতছানি। আর সে নবজাতক যদি হয় আপনার নিজের সন্তান, তবে পৃথিবীতে কোনোকিছুই যেন তার চেয়ে বিশেষ হবে না আপনার কাছে, তাই না? হ্যাঁ, আর তাই মানুষ চিরকাল এই পৃথিবীতে নতুন জীবনকে উদযাপন করে এসেছে বিভিন্নভাবে। সে তার নবজাতকের জন্য যা কল্যাণকর মনে করেছে তা-ই করে এসেছে। নতুন শিশুদের নিয়ে তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা, ভয়-আশংকা সবটাই ফুটে ওঠে এসব নিয়মরীতির মাধ্যমে। পৃথিবীর প্রতিটি কোনে এক নতুন প্রাণের আগমন যেমন মানুষের মনে একইরকম আনন্দ আর তৃপ্তির সৃষ্টি করে, তেমনি প্রতিটা কোনায় এই নতুনের আগমনকে উদযাপন করা হয়। কল্যাণের জন্য পালন করা হয় বিচিত্র সব আচার-অনুষ্ঠান। দেশে দেশে, ভিন্ন ভিন্ন সমাজে নবজাতক শিশুকে নিয়ে মানুষের বিচিত্র ধারণা আর পালন করা বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতার কথা আজ শোনানো যাক।
শীতপ্রধান দেশের বরফপড়া তীব্র শীতের মধ্যে আপনার নবজাতক শিশুকে বারান্দায় কনকনে ঠান্ডা হাওয়ায় রেখে দিয়ে কফি খেতে চলে যাওয়ায় কথা চিন্তা করতে পারেন? আপনি হয়তো না-ও পারতে পারেন, কিন্তু ডেনমার্ক, সুইডেনসহ অনেক দেশে এটা রীতিমত একটা নিয়মই বটে! এই নিয়ম আরো প্রচলিত আছে ফিনল্যান্ড, আইসল্যন্ড আর নরওয়ের মতো দেশেও। এই অদ্ভুত নিয়মের বর্ণনা দিয়েই আমাদের আজকের লেখা শুরু করবো। এসব দেশের শিশুদের বাবা-মায়েদের জন্য গরমকাল তো বটেই, এমনকি শীতকালের প্রচন্ড ঠান্ডার মধ্যেও শিশুদের দুপুরের ঘুমসহ দিনের বেশিরভাগ সময় বাইরে রেখে দেওয়া একটা নিত্যদিনের ব্যাপার। সেসব দেশে মনে করা হয় যে, মুক্ত ঠান্ডা বাতাস শিশুদের ভালো ঘুম আর ক্ষুধা বাড়তে সাহায্য করে। তাছাড়া এসব শিশুরা নাকি সহজে ঠান্ডা-জ্বরেও আক্রান্ত হয় না। এ ধারণা সুইডেনে এত দূর প্রতিষ্ঠিত যে, সেখানে অধিকাংশ শিশুযত্ন কেন্দ্রগুলোতে শিশুদের দিনের বেলায় শূন্যের নিচে পাঁচ ডিগ্রী সেলসিয়াস বা ২৩ ডিগ্রী ফারেনহাইটে রাখা হয়। অনেক কোম্পানি সেখানে বিশেষ অ্যালার্ম-ব্যবস্থা পর্যন্ত তৈরী করে যাতে বাবা-মা একটা সময় পরে শিশুদের ঘরে নিয়ে আসতে ভুলে না যায়। এমনকি ডেনমার্কের জাতীয় স্বাস্থ্য বোর্ড তাদের এই পদ্ধতিকে সমর্থন করে।
আর জাপানী মায়েরা মনে করেন, জন্মের পর নবজাতকের কাটা নাড়ি যতো যত্নে রাখা হবে, পরবর্তীতে মা ও সন্তানের সম্পর্ক ততো ভালো হবে, মায়ের সাথে সন্তানের বন্ধন তত মজবুত হবে। এই বিশ্বাস থেকেই তারা সন্তানের জন্মের পর তার কাটা নাড়ি অত্যন্ত যত্নের সাথে একটি কাঠের বাক্সে সংরক্ষণ করে এবং সারাজীবন তা খুবই যত্নের সাথে রেখে দেয়। এখন অবশ্য জাপানের হাসপাতালগুলো শিশুর এই কাটা নাড়ি সুন্দর একটা বাক্সে সাজিয়ে বিদায়ের সময় শিশুর মাকে উপহার হিসেবে দেয়। বাক্সে অনেক সময় শিশুর প্রতীক হিসেবে ‘কিমোনো’ নামের এক বিশেষ পোষাক পরিয়ে একটা ছোট্ট পুতুল রাখা হয়। এই জামার ভেতরেই লুকানো থাকে কাটা নাড়ি, যা মেডিকেল সায়েন্সের ভাষায় Umbilical Cord নামে পরিচিত। এছাড়া জাপানে শিশুর প্রথম জুতো, এমনকি শিশুর প্রথম চুল কাটার পর এক গোছা চুলও সারাজীবন সংরক্ষণের প্রথা আছে। জন্মের সাতদিন পর গৃহের বুদ্ধদেবতার সামনে শিশুর নাম রাখার এক পারিবারিক অনুষ্ঠানও জাপানে পালন করা হয়।
শিশুদের মাটি স্পর্শ তাদের আত্মার ঐশ্বরিকতাকে নষ্ট করে দেয়- এমনটাই বিশ্বাস করা হয় বালিতে। তাই জন্মের প্রথম তিন মাস শিশুকে সব সময় কোলে রাখতে হবে এবং কোনোভাবেই তাদের মাটি স্পর্শ করতে দেয়া যাবে না। এভাবেই সেখানে ঐশ্বরিক দুনিয়ার সাথে শিশুদের বন্ধন অটুট রাখা হয়। সেখানে জন্মের তিন মাস পরে শিশুর পা প্রথম মাটি স্পর্শ করা উপলক্ষ্যে ‘নিয়ামবুটিন’ নামের সামাজিক উৎসবের অয়োজন করা হয়।
পশ্চিম আফ্রিকার ঘানা আর নাইজেরিয়ায় একটি মজার ধারণা প্রচলিত আছে অমরা (শিশুকে ঘিরে থাকা পাতলা আবরণ, যা শিশুর জন্মের সময় বেরিয়ে আসে) নিয়ে। সেখানে মনে করা হয় যে, অমরার আলাদা প্রাণ থাকে এবং শিশুর জন্মের সময় তা মারা যায়। তাই শিশুর জন্মের পর শেষকৃত্যের সম্পূর্ণ রীতি মেনে সেটিকে একটা গাছের নিচে কবর দেওয়া হয়। আফ্রিকা ছাড়াও অমরা নিয়ে এরকমই কিছু ঐতিহ্য প্রচলিত আছে কেনিয়াতেও। তবে সেখানে অমরাটিকে কোনো অনাবাদী জমিতে পোতা হয় এবং সেটা ঘাস আর শস্য দ্বারা ঢেকে দেওয়া হয়।
বিচিত্র মানুষের মন কত বিচিত্র ধারণাই না পোষণ করতে পারে! কেমন হবে যদি শিশুর কল্যণের কথা বলে সন্ধ্যা ৬টা বাজতেই আপনাকে আর শিশুকে দেখতে যেতে না দেয় শিশুর বাবা-মা? আশ্চর্য হলেও কিছুটা এরকমই নিয়ম মেনে চলে ত্রিনিদাদ আর টোবাগোর লোকেরা। সেখানে মনে করা হয় সন্ধ্যার শিশির শিশুকে অসুস্থ্ করে দেয়। তাই সেখানে শিশুর বাবা-মা তাদের বাসায় সন্ধ্যা ৬টার পরে আর কোনো অতিথি চায় না। আরো একটি ধারণা প্রচলিত আছে সেখানে শিশুদের নিয়ে। মনে করা হয় যে, নতুন শিশুর হাতে অর্থ দিলে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি আসে। তাই নতুন কেউ যখন সেখানে শিশুদের দেখতে আসে তারা শিশুর হাতে অর্থ অথবা দামী কিছু দেয় শিশুর সৌভাগ্য ও ভবিষ্যত সমৃদ্ধির আশায়। এ ধারণাটি বিশ্বের আরো অনেক দেশেই প্রচলিত আছে।
নতুন একটি শিশুর জন্ম মানেই তার ভবিষ্যত নিয়ে পরিবারের লোকজনের হাজার জল্পনা-কল্পনা। আর সে জল্পনা-কল্পনা থেকেই একটি মজার রীতি গড়ে উঠেছে আর্মেনিয়ায়। যখন শিশুটির প্রথম দাঁত ওঠে, তার পিতা-মাতা সেটি উদযাপন করে ‘আগ্রা হাদিজ’ নামের এক সামাজিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। অনুষ্ঠানটিতে শিশুটিকে বিভিন্ন প্রতীকী জিনিসপত্র দিয়ে ঘিরে রাখা হয় আর তার বাবা-মা তাকে উৎসাহিত করে যেকোনো একটি তুলে নিতে। মনে করা হয়, শিশু যেটা তুলে নেবে, সেটাই তার ভবিষ্যত নির্দেশ করবে। যেমন বলা যায়, কোনো শিশু যদি স্টেথোস্কোপ তুলে নেয়, তাহলে সে ভবিষ্যতে ডাক্তার হতে যাচ্ছে!
চীনে নবজাতক আর তার মাকে নিয়ে প্রচলিত আছে আরেক প্রথা। বাচ্চা জন্মের এক মাস পর্যন্ত মা ঘর থেকে বের হতে পারে না, আরও পারে না কোনো কাঁচা ফল খেতে ও গোসল করতে। এভাবে এক মাস কিছুই না করে বসে থাকাকে চীনা সংস্কৃতিতে বলা হয় ‘জুও ইয়োজি’। এ প্রথাটি প্রায় ২,০০০ বছর ধরে চলে আসা একটি চীনা ঐতিহ্য, যদিও বর্তমানের চীনা নারীরা ধীরে ধীরে এই প্রথা থেকে নিজেদের বের করে আনছে।
চীনের পর এবার বলি আমাদের সবচেয়ে কাছের প্রতিবেশী দেশ ভারতে শিশুর জন্মদান নিয়ে প্রচলিত এক প্রথা সম্পর্কে। বিশাল এই দেশে অঞ্চল ভেদে না জানি কতো না প্রথা প্রচলিত আছে! সবচেয়ে প্রচলিত প্রথাটা অনেকটা চীনের মতোই। ভারতেও নারীরা চীনের মতো সন্তান জন্ম দেওয়ার পরপরই গোসল দেয় না। সন্তান জন্মদানের পঞ্চম দিনে তারা গো-মূত্র ও গরুর দুধ দিয়ে গোসল দেয়। তারপর তারা বাকি দিনগুলো গোবর-লেপা ঘরে বিশ্রাম নেয়। পবিত্রতার ধারণা জনে জনে কতোই না আলাদা!
শেষ করতে করতে বলে যাই সবচেয়ে মজার কিছু রীতি। ফিনল্যন্ডে সন্তান জন্মদানের পর প্রত্যেক নারী পায় সরকারের কাছে থেকে শিশুর জন্য খেলনা, পোষাক আর কাপড়ের টুকরা সম্বলিত উপহারের বাক্স। এর পরিবর্তে তারা ১৯০ ডলারের অর্থমূল্যও গ্রহণ করতে পারে। তবে ৯৫% মায়েরা উপহার বাক্সই নেয়, কারণ তা তাদের আবেগের সাথে জড়িত। আর ভিয়েতনামে নতুন মায়েরা শাশুড়ির হাতের মজার মজার খাবার আর স্যুপ খেয়ে থাকে। সেই সাথে শিশুর দেখাশোনা করার জন্যও শাশুড়িকে এক মাসের জন্য আঁতুড়ঘরে চলে আসতে হয়।
আর মালয়েশিয়ায় তো শিশুর জন্মদান পরবর্তী মায়ের যত্নে চালু আছে সবচেয়ে দারুণ প্রথা। সেখানে শিশুর জন্মের পর মাকে দেওয়া হয় গরম পাথরের ম্যাসাজ, সারা শরীরের প্রচলিত পদ্ধতিতে যত্ন, সাথে পর্যাপ্ত বিশ্রাম। ধারণা করা হয়, এ যত্নটুকু নতুন মায়েদের সৌন্দর্য, স্বাস্থ্য আর উর্বরতা রক্ষায় দারুণ কার্যকরী।