ফয়’স লেক চট্টগ্রামের সৌন্দর্যের একটি অন্যতম পরিচয়। এর নাম শোনেন নি এমন মানুষ পাওয়া দায়। কিন্তু কতটুকু জানি আমরা এই হ্রদ সম্পর্কে? আসুন এক নজরে জেনে নেয়া যাক এই লেকের ইতিহাস এবং বৈশিষ্ট্য।
ফয়’স লেক কোনো প্রাকৃতিক হ্রদ নয়। কৃত্রিম এই হ্রদটি ১৯২৪ সালে আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে খনন করা হয়। ঐ সময়ে এই হ্রদটি ‘পাহাড়তলি লেক’ নামেই পরিচিত ছিল। পরবর্তীতে প্রকৌশলী মি. ফয়-এর নামে হ্রদটির নাম ‘ফয়’স লেক’ রাখা হয়। তখন এই হ্রদটি রেল কলোনীতে বসবাসকারীদের কাছে পানি পৌঁছে দেবার উদ্দেশ্যে খনন করা হয়েছিল।
ফয়’স লেক চট্টগ্রামের পাহাড়তলি রেলস্টেশনের অদূরে (চট্টগ্রাম শহর কেন্দ্র হতে ৮ কি.মি. দূরে) খুলশি এলাকায় অবস্থিত। ৩৩৬ একর জমির উপর নির্মিত এই হ্রদটি পাহাড়ের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তের মধ্যবর্তী একটি সরু উপত্যকায় আড়াআড়িভাবে বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে সৃষ্ট। চট্টগ্রাম শহরের উত্তর দিকের পাহাড় শ্রেণী থেকে নেমে আসা পানি প্রবাহের দিক পরিবর্তনের মাধ্যমে এই হ্রদটি তৈরি হয়েছে।
ফয়’স লেক চট্টগ্রামের সবচেয়ে উঁচু পাহাড় বাটালি হিলের পাশেই অবস্থিত। দীর্ঘ সময় ধরে অযত্নে পড়ে থাকা এই হ্রদটি একসময় তার জাঁকজমক হারিয়ে ফেলে প্রায়। তাই এর প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে সঙ্গতি রেখে ২০০৫ সালে সেখানে গড়ে তোলা হয় আধুনিক অ্যামিউজমেন্ট পার্ক ও রিসোর্ট। এর মালিকানা রয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ের অধীনে।
এই লেক ভ্রমণপিয়াসী মানুষদের অন্যতম পছন্দের নাম। এখানে যেমন শিশুদের জন্য রাইডের ব্যবস্থা আছে, তেমনি বড়দের জন্য রয়েছে পাহাড় ও হ্রদ মিলে মনোমুগ্ধকর এক পরিবেশ। এখানে রয়েছে অরুণাময়ী, গোধূলি, আকাশমণি, মন্দাকিনী, দক্ষিনী এবং অলকানন্দা নামের হ্রদ। নামের মতোই সুন্দর এর পরিবেশ। হ্রদের পাড়েই মেলে সারি সারি নৌকার দেখা। ভ্রমণপিপাসুদের থাকার জন্য রয়েছে নানা রিসোর্ট।
অ্যামিউজমেন্ট ওয়ার্ল্ডের উত্তরে টিলার উপরে মূল ফয়’স লেক। লেক ঘিরে রয়েছে সুউচ্চ সবুজ পাহাড়। পাহাড়গুলোর মধ্যে দু একটির নাম হলো আসমানী, গগনদ্বীপ, জলটুঙ্গি ইত্যাদি। এসব পাহাড়ের কাছেই রয়েছে ঘন বনজঙ্গল, যে বনে খেলা করে খরগোশ এবং চিত্রা হরিণের মতো সুন্দর কিছু বন্যপ্রাণী। টিলার উপরে আছে পিকনিক করার মতো জায়গা। সেখান থেকে আরেকটি টিলার উপরে গেলে পাবেন পর্যবেক্ষণ টাওয়ার। চট্টগ্রাম শহরের ‘বার্ডস আই ভিউ’ দেখা যায় এ টাওয়ার থেকে।
কীভাবে যাবেন
চট্রগ্রাম শহরের জিইসি মোড় থেকে সিএনজিতে ৬০-৭০ টাকা নেবে, রিক্সায় ৪০ টাকা। শহর থেকে রিক্সা পেতে খুব বেশি বেগ পেতে হয় না।
টিকিটের মূল্য এবং সময়
প্রবেশ ফি
প্রাপ্তবয়স্ক – ২০০ টাকা
শিশু – ১৮০ টাকা (৩ ফুটের কম উচ্চতার শিশুদের জন্য ফ্রি)
খোলার সময়
সকাল ১০টা ৩০ মিনিট
বন্ধের সময়
শনিবার থেকে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত।
শুক্রবার ও শনিবার সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত।
কোথায় থাকবেন
চট্রগ্রাম পৌছানোর পর যারা ঘোরাঘুরির জন্য কিছুদিন থাকতে চান, তারা হোটেল আগ্রাবাদে থাকতে পারেন। চট্রগ্রামে আগ্রাবাদ হোটেলটি বেশ অভিজাত একটি হোটেল। এছাড়াও অনেক হোটেল ও রিসোর্ট রয়েছে। ফয়’স লেক গেটেও রিসোর্টের ব্যবস্থা আছে। হোটেল এবং রিসোর্ট ভেদে আপনার প্রতি রাতে খরচ হতে পারে ১২০০-৬০০০ টাকা পর্যন্ত।
কখন নৌকায় চড়বেন
শীতের দিনে আপনি দুপুর ৩টার দিকে নৌকায় চড়ার কথা চিন্তা করতে পারেন। বোটে ফয়’স লেক ঘুরে আপনি ওয়াটার ওয়ার্ল্ড পর্যন্ত যেতে পারেন। ছবিতে দেখানো সারি সারি নৌকা পাবেন। ছোট বোট নিলে বেশি ভালো হবে।
বাড়তি আনন্দ
ওয়াটার ওয়ার্ল্ডে পৌছে পরে ফেলুন আপনার বহন করা থ্রি কোয়ার্টার, জিন্স বা ট্রাউজারস, টি-শার্ট এই জাতীয় কাপড়। বিভিন্ন রাইডে চড়তে পারেন সারাদিন। তবে সত্যিকার ভিউ পেতে হলে পাহাড়ে উঠে যান সন্ধ্যার আগেই। সেখানে রাখা আছে বেশ বড়সড় বাইনোকুলার। চাইলে বাইনোকুলারেই দেখে দিন সাগরিকা সমুদ্র সৈকত। ইচ্ছে হলে দেখতে পারেন ক্রিকেট স্টেডিয়াম সহ অনেক কিছু। এখানে ফি নেবে মাত্র ৩০ টাকা। প্রতিটি স্থানেরই ছবি তুলে রাখুন। যখন বাড়িতে ফিরে যাবেন, তখনও রেশ থেকে যাবে সুন্দর এ ভ্রমণের।
ভৌতিক ফয়’স লেক
ফয়’স লেককে বলা যায় বাংলাদেশের ভয়ংকর সৌন্দর্য। ‘ভয়ংকর’ কথাটি শাব্দিক অর্থে সঠিক। ফয়’স লেকের সৃষ্টির সময় হতেই এই ইতিহাসের উৎপত্তি। মুখে মুখে শোনা গল্পগুলো কিন্তু মোটেও মিথ্যে নয়। এ কারণেই অনেকেই ফয়’স লেককে বাংলাদেশের ১ নাম্বার ভৌতিক স্থান হিসেবে মানেন।
হ্রদটি এখনো একশ বছরের বেশি পুরনো ইতিহাসকে বয়ে বেড়াচ্ছে। এমনকি স্থানীয় লোকজনও সঠিকভাবে বলতে পারেন নি কবে থেকে এবং কীভাবে এই ভৌতিক ঘটনাগুলো এখানে ঘটেছে। কিন্তু সেই কাহিনীগুলো এখনো অবিকৃতভাবে প্রজন্মান্তরে লোকমুখে চলে এসেছে। ফয়’স লেক দুটি ভৌতিক ঘটনার জন্য বিখ্যাত/কুখ্যাত। লোকমুখে শোনা ঘটনাগুলো সেভাবেই উল্লেখ করা হলো।
ভৌতিক কালো ছায়া
এই ইতিহাস প্রায় ১৩০ বছরের পুরনো। কেউ কেউ বলে পুরনো ফয়’স লেকের ব্রিজটি অতিক্রম করার সময় একটি অশরীরী কালো ছায়া লোকদের আক্রমণ করে। আবার অনেকে বলে সেখানে আসলে দুটি অশরীরী আত্মা আছে, যাদের মাঝে একটি ভালো যাকে একজন কমবয়স্ক মহিলার বেশে দেখা যায় এবং অন্যটি খারাপ যাকে কালো ছায়া বা বেশি বয়স্ক মহিলা হিসেবে দেখা যায়। কালো ছায়াটি যাকে আক্রমণ করতে উদ্যত হতো, কম বয়স্ক মহিলাটি গাছের উপর থেকে তাকে আগে থেকেই সাবধান করে। অনেকে বলে এই দুই সত্ত্বার মধ্যকার দ্বন্দ্ব শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলে আসছে এবং এরা প্রত্যেকেই অতিপ্রাকৃতিক ক্ষমতার অধিকারী। এই দুই সত্ত্বাকে নিজের চোখে দেখেছে এমন মানুষেরও দেখা পাওয়া যাবে। কেউ কেউ বলে এদেরকে এমন দুইটি পাশাপাশি পাহাড়ের ঢালে বসে থাকতে দেখা যায় যেখানে পৌঁছানো মানুষের সাধ্যের বাইরে।
উড়ন্ত আগুনের গোলা
ফয়’স লেকে প্রচলিত আরেকটি ঘটনা বেশ রোমাঞ্চকর। এই ঘটনাটি যে শুধু লোকমুখে প্রচলিত তা-ই নয়, বরং ঐ এলাকার অনেকে এর প্রত্যক্ষদর্শী বলেও জানা যায়। স্থানীয় লোকেরা দাবি করেন যে, মাঝে মাঝে রাতে তারা বিভিন্ন আকারের আগুনের গোলা হ্রদের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে উড়ে যেতে দেখেন। যদিও অনেকেই এই ঘটনা দেখে বলে জানিয়েছেন, কিন্তু তাদের মাঝে কেউই স্পষ্ট করে বলতে পারেন নি এগুলো আসলে কী! কেউ কেউ দাবি করেন এগুলো আসলে জ্বিনের অস্তিত্ব প্রকাশ করে। অনেকে আবার এই ঘটনাকে বৈজ্ঞানিকভাবে ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন- এটি আসলে ভৌতিক কিছু নয়, বরং গ্রীষ্মের রাতে মিথেন গ্যাসের দহনের কারণে এই আগুনের উৎপত্তি হয়। তবুও স্থানীয় লোকেরা একে যথেষ্ট ভয় পায়।
বর্তমানে ট্যুরিস্ট স্পট এবং চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে ফয়’স লেকের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব কনকর্ড ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট কোম্পানির। কনকর্ড ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি ১০০ বছরের জন্য ফয়’স লেকের ৩৩৬ একরের জমির লীজ নিয়েছে। তাদের উদ্দেশ্য এটিকে দেশের সর্ববৃহৎ থিম পার্ক এবং অ্যামিউজমেন্ট সেন্টার হিসেবে গড়ে তোলা।
তাহলে আর দেরি কেন, সময় করে ঘুরে আসুন এই সুন্দর এবং মনোরম হ্রদটি। বলা তো যায় না, ভৌতিক কোনো অভিজ্ঞতাও হয়ে যেতে পারে সেসময়ে!