সময়কে কেউ বাঁধতে পারেনি, পারেনি থামিয়ে দিতেও। তবে যুগে যুগে এমন কিছুর নির্মাণ করেছে মানুষ, যা মুঠোবন্দী করেছে বিভিন্ন সময়ের স্মৃতিকে – সময়ের আদি প্রকৃতির কিছু নির্যাসকে। ইতিহাসের পরতে পরতে লুকোনো নানা কাহিনী অপ্রকাশিত রয়ে গেলেও এক চিলতে ঘটনা কিংবা এক তিল পরিমাণ নিদর্শনই হয়তো নিজগুণে অমর হয়ে গেছে পৃথিবীতে। এই সকল নিদর্শন দেখেছে সময়ের বয়ে চলা আর দিনরাত্রির পালাবদলকে, দেখেছে ক্ষমতার যুদ্ধ, ষড়যন্ত্র আর রাজনৈতিক ঘূর্ণিজলকেও। কখনো লুণ্ঠন কখনোবা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে হাতবদল হওয়া আরো কিছু ঐতিহাসিক নিদর্শনের গল্প শোনাবো আজ ‘লুণ্ঠিত ঐতিহাসিক নিদর্শনের গল্প’- এই শীর্ষক লেখাটির তৃতীয় পর্বে।
প্রিয়ামের গুপ্তধন, তুরস্ক
সোনা ও অন্যান্য পুরাকীর্তির সমন্বয়ে গঠিত প্রিয়ামের গুপ্তধন। উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে জার্মান প্রত্নতত্ত্ববিদ হেইনরিচ স্ক্লিয়েম্যান আনাতোলিয়ায় (বর্তমানে তুরস্কের অংশ) এটি আবিস্কার করেন। তিনি এগুলোকে হোমারীয় রাজা প্রিয়ামের সম্পদ বলে দাবী করেন এবং সেগুলোকে বার্লিনে চালান করে দেন। জার্মানরা ভেবেছিল তিনি হোমারের ইলিয়াড মহাকাব্যের বিখ্যাত সেই ট্রয় নগরীর খোঁজ পেয়েছেন। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন জার্মানি আক্রমণের সময় রাশিয়া জিনিসগুলি হাতিয়ে নেয়। ১৯৯৬ সালে রাশিয়ার পুশকিন জাদুঘর এই সম্পদগুলোর প্রদর্শনীর আয়োজন করে এবং তাতে জার্মান সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিবাদ জানানো হয়। প্রতিবাদের পাশাপাশি এসব কিছু ফিরে পাবার দাবীও করা হয়। বলা বাহুল্য, এসব প্রতিবাদের কিছুই কোনো কাজে আসেনি।
সুলতানগঞ্জের বুদ্ধমূর্তি, ভারত
১৮৬১ সালে রেলওয়ে নির্মানের কাজ করার সময় বিহারের ভাগলপুর জেলার সুলতানগঞ্জ শহরে সম্পূর্ণ ধাতব এই মূর্তিটি পাওয়া যায়। মূর্তিটির ওজন প্রায় ৫০০ কেজি। রেইলওয়ে ইঞ্জিনিয়ার ই.বি. হ্যারিস তৎক্ষণাৎ এটিকে বার্মিংহামে পাঠিয়ে দেন। প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে মূর্তিটি ৫০০-৭০০ খ্রিষ্টাব্দের। বর্তমানে এটি ইংল্যান্ডের বার্মিংহামের বার্মিংহাম মিউজিয়াম এন্ড আর্ট গ্যালারীর শোভাবর্ধন করছে।
টিপু সুলতানের তরবারি ও আংটি, ভারত
মহীশুরের বাঘ টিপু সুলতানের বীরোচিত মৃত্যুর পর ব্রিটিশ সৈন্যদল তার সম্পদ লুঠ করে এবং তার তরবারি ও আংটিটি সাথে করে নিয়ে যায়। ২০০৪ সাল পর্যন্ত এগুলো ব্রিটিশ মিউজিয়ামেই প্রদর্শিত হচ্ছিল। বিজয় মাল্য নামক ভারতীয় ব্যক্তি ১১ লাখ ৭৫ হাজার ইউরো দিয়ে নিলামে টিপু সুলতানের তরবারিটি কিনে এটিকে পুনরায় ভারতবর্ষে ফিরিয়ে আনেন। এছাড়াও আরো অর্থ খরচ করে তিনি সুলতানের ৩০টি যুদ্ধ সামগ্রী ফিরিয়ে আনেন যার মধ্যে বাঁকানো তূণ, ফ্লিন্টক পিস্তল, কামান এবং অন্যান্য ব্যক্তিগত ব্যবহার্য জিনিস বিদ্যমান।
স্ফিংসের দাড়ি, মিশর
স্ফিংসের ধাঁধা সংক্রান্ত গল্পটি কমবেশি আমরা অনেকেই জানি। স্থাপত্যকর্ম হিসেবেও স্ফিংসের কদরের কমতি নেই। মিশরের চতুর্থ রাজবংশের শাসনামলে তৈরি করা হয় স্ফিংস। সিংহের শরীর এবং রাজার মাথা বসানো এই স্থাপত্যটি আদতে ফারাও খাফ্রের আদলে তৈরি বলে বলা হয়। বহুল আলোচিত এই স্ফিংস স্থাপনাটির দাড়ি যে অংশটি দিয়ে তৈরি ছিল তা একসময় দুর্ঘটনাবশত ভেঙ্গে পড়ে। অতঃপর সেটিকে বহন করে দূরে নিয়ে যাওয়া হয় এবং ১৮১৮ সালে তা ব্রিটিশ মিউজিয়ামের কাছে বিক্রি করে দেয়া হয়। এরপর থেকে ৪,৬০০ বছরের পুরনো এই পুরাকীর্তিটি ১৬০ বছর ধরে ব্রিটিশ মিউজিয়ামের বেজমেন্টে সংরক্ষিত আছে। এটিকে মিশরে ফেরত দেবার ব্যাপারে কোনো আগ্রহ দেখা যায়নি।
মহারাজা রঞ্জিত সিং-এর সিংহাসন, ভারত
রেজিনের মূল ভিত্তি, সোনা, কাঠ ও কাঠের উল্টোপিঠে হাতুড়ি চালিয়ে সামনে কারুকার্য করা কাঠের পাত দিয়ে এই সিংহাসনটি তৈরি হয় ১৮২০ থেকে ১৮৩০ সালের ভেতর। এটি প্রস্তুত করেন স্বর্ণকারিগর হাফেজ মুহাম্মাদ মুলতানি। ১৮৪৯ সালে দ্বিতীয় অ্যাংলো-শিখ যুদ্ধে পাঞ্জাব বিজয়ের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এটি হস্তগত করে ইংল্যান্ডে পাঠায়। ১৮৫১ সালে ভারতীয় সাম্রাজ্যের অন্যান্য সম্পদের সাথে এটিকেও বৃহৎ প্রদর্শনীতে রাখা হয়। বর্তমানে এটি ভিক্টোরিয়া এন্ড আলবার্টস মিউজিয়ামে আছে। এর ইনভেন্টরি নম্বর ২৬১৮ (আইএস)।
অ্যাম্বার রুম, রাশিয়া
১৭১৬ সালে প্রুসিয়ান রাজা ফ্রেডরিখ উইলিয়াম রুশ জার পিটার দ্য গ্রেটকে অ্যাম্বার নির্মিত একটি কক্ষ উপহারস্বরূপ দেন। এর দেয়ালগুলো ছিল খুবই সুন্দর ও মনোলোভা এবং একে পৃথিবীর অষ্টমাশ্চর্য হিসেবেও অভিহিত করতেন অনেকে। ১৯৪১ সালে জার্মান সৈন্যরা এটিকে চুরি করে কালিনিনগ্রাদ নামক শহরের দূর্গে নিয়ে আসে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে প্যানেলটি নিখোঁজ হয়ে যায়। ধারণা করা হয় সোভিয়েতদের করা অবরোধের সময় এটি ধ্বংস হয়ে যায় কিংবা শহরটি ধ্বংস হবার পূর্বেই এটিকে অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হয়। রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গের ক্যাথরিন প্যালেসে দেয়ালটির একটি পুননির্মিত স্থাপনা রয়েছে।
পাতিয়ালা নেকলেস, ভারত
অনিন্দ্য সৌন্দর্য্যের অধিকারী পাতিয়ালা নেকলেসটির নকশা করা হয় ১৯২৮ সালে। হাউজ অফ কার্টিয়ারের নকশা করা এই মনোলোভা হারটি মহারাজা স্যার ভূপিন্দর সিংকে উপহার হিসেবে দেয়া হয়েছিল। হারটিতে ছিল মোট পাঁচ সারি প্লাটিনামের তৈরি চেইন ও ২,৯৩০টি হীরে। এছাড়াও এতে অন্যান্য রত্নপাথরের পাশাপাশি বার্মিজ রুবি বসানো ছিল। মূলকেন্দ্রে বসানো ছিল প্রায় গলফ বলের আকৃতির হলদে হীরে ‘ডি বিয়ার্স ডায়মন্ড’। ২৩৪.৬ ক্যারেটের এই হীরেটি বিশ্বের সপ্তম বৃহৎ হীরে হিসেবে পরিচিত। ১৯৪৮ সালে এটি হারিয়ে যায়। হারিয়ে যাবার আগে শেষবারের মতো এটি ব্যবহার করেছিলেন ভূপিন্দর সিং এর পুত্র মহারাজা যাদবেন্দ্র সিং।
৫০ বছর পর কার্টিয়ারেরই একজন প্রতিনিধি নেকলেসটি খুঁজে পান। কিন্তু ততদিনে এটি তার সবচেয়ে আকর্ষণীয় রত্নগুলি হারিয়েছে যার মধ্যে বার্মিজ রুবি ও ডি বিয়ার্স ডায়মন্ড অন্যতম। কার্টিয়ার এটিকে পুনরায় সজ্জিত করার সম্পূর্ণ চেষ্টা করে এবং কম মূল্যবান রত্ন, যেমন কিউবিক জিরকোনিয়াম ও অন্যান্য কমদামের রত্ন দিয়ে নেকলেসটিকে পুনর্গঠন করে। আসল নেকলেসটি থাকলে সেটির বর্তমান বাজারমূল্য হতো ২০-৩০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ধারণা করা হয়, মহারাজার পরিবারের সদস্যরাই হারটির রত্নগুলিকে আলাদা করে বিক্রি করে দিয়েছেন।
বৃদ্ধ জেলের অসম্পূর্ণ মূর্তি, তুরস্ক
প্রায় ২,০০০ বছরের পুরনো হাত পা বিহীন জেলের এই অসম্পূর্ণ মূর্তিটি তুরস্কের এফ্রোডিসিয়াস নামক অঞ্চলে পাওয়া যায়। থিওডোর উইগান্ড নামক এক জার্মান ১৯০৫ সালে এটিকে নিলামে কিনে নেন। এটি বর্তমানে জার্মানির বার্লিনে পারগামন মিউজিয়ামে আছে। ২০১২ সালে তুরস্কের পক্ষ থেকে এর মালিকানা চেয়ে জোর দাবী জানানো হলে ফাউন্ডেশন অফ প্রুসিয়ান কালচার হেরিটেজের প্রেসিডেন্ট হারমান পারজিঞ্জার সেটি উড়িয়ে দিয়ে বলেন, “এটি পুরনো জিনিসপত্রের সংগ্রহের সাথে ১৯০৪ সালে এখানে আসে। এটিকে একটি আর্ট মার্কেট থেকে কেনা হয়। এটি আইনসিদ্ধ এবং আমরা তা প্রমাণ করতে পারি। তাই এটা ফেরত দেবার পক্ষে কোনো যুক্তিই নেই।”
ইশতার ফটক, ইরাক
ইরাকে খোঁড়াখুঁড়ি করতে গিয়ে জার্মান দল এটি খুঁজে পায়। ব্যাবিলনের ভেতরের শহরের অষ্টম ফটক ছিল এই ইশতার ফটকটি। ৫৭৫ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে রাজা দ্বিতীয় নেবুচাদনেজার শহরের উত্তরপার্শ্বে এটি নির্মাণ করেন। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে জার্মান একটি দল এটি খোঁড়াখুঁড়ি করার সময় খুঁজে পায়। এটির নিজস্ব ইটগুলো দিয়েই এর পুনঃনির্মাণ করা হয় এবং বর্তমানে এটি বার্লিনের পারগামন মিউজিয়ামে প্রদর্শিত হচ্ছে।
ব্যবিলনীয় দেবী ইশতারকে উৎসর্গ করে ফটকটি বানানো হয়। এতে ড্রাগন ও ষাঁড় বসানো ছিল যা যথাক্রমে দুই দেবতা মারদুক ও আদাদকে নির্দেশ করে। ফটকটির ছাদ এবং দরজা সিডার কাঠের তৈরি এবং ইটগুলি ল্যাপিস ল্যাজুলির প্রলেপযুক্ত যা এতে চমক এনে দিয়েছে। এর দেয়ালগুলোর এনামেল করা হলুদ ও কালো রঙা ইটগুলোর ওপরে ১২০টি সিংহ, ড্রাগন, ষাঁড় ও ফুল রয়েছে যা দেবী ইশতারকে নির্দেশ করে। ইরাক থেকে এটি ফেরত দেবার জোরালো দাবী জানানো হলেও তা আমলে নেয়া হয়নি।
ইতিহাসের বহু লুণ্ঠিত নিদর্শন এভাবেই তুলে ধরে অতীতকে। সময়ের প্রবাহ ও পরিস্থিতির নীরব সাক্ষী এসকল নিদর্শন। বর্তমানে একইসাথে বিতর্ক, বিবাদ ও আগ্রহের জন্ম দেয়া এই সকল নিদর্শন তাই জ্ঞানের খোরাকও বটে!