‘ব্লু’ বা নীল রঙকে অনেক সময় আমরা স্যাডনেস বা দুঃখসূচক দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে থাকি। এই ব্লু রঙের বিষয়টা আসলে কিছুই না, বলতে গেলে অনেকটাই আপেক্ষিক। দুঃখ বা মন খারাপের কারণ অনীহা বা উদ্যমহীনতা যেকোনো কিছু থেকেই হতে পারে। ঠিক একইভাবে কাজে অনীহা বিষয়টি থেকেই যে শব্দগুচ্ছ উঠে এসে পুরো বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়ে গড়ে দিয়েছে নিজস্ব আঙ্গিক তাকেই বলা হয় ‘মানডে ব্লুজ’।
বিষয়টিকে আরো বিস্তারিতভাবে বলার চেষ্টা করা যাক।কর্মব্যস্ত দিনগুলোর সপ্তাহান্তে এক বা দু’দিন ছুটি উপভোগ করে ছুটি পরবর্তী সোমবার কাজে ফেরার কথা ভাবলেই যেন গায়ে জ্বর এসে যায় অনেকেরই। তারই পোশাকি নাম হচ্ছে ‘মানডে ব্লুজ’।
এটি মূলত বাইরের দেশগুলোতে, যাদের ছুটি গণনা হয় শনি ও রবিবার এবং কর্মদিবস শুরু হয় সোমবার, তাদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। কিন্তু অনুরূপভাবে আমাদের দেশে কারো কারো কর্মদিবস রবিবার থেক্ কারো বা শনিবারেই শুরু হয়ে যায় অফিসের দৌড়-ঝাঁপ। কর্মদিবস শনি, রবি বা সোমবার যা-ই হোক না কেন, জিনিস কিন্তু একটাই, কাজে যাওয়ার অনীহা বা বিরক্তি। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে আমরা মানডে ব্লুজকে স্যাটারডে বা সানডে ব্লুজ নামেই অভিহিত করতেই পারি।
সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবসে ঘুম থেকে উঠে অফিসে যেতে হবে ভাবলেই মেজাজটা যেন সা রে গা মা পা এর সপ্তকে চড়ে বসে। অফিসে গিয়েও কাজে মন বসতে চায় না। সারাদিনই কেমন যেন ঘুম ঘুম পায়। শুধু আপনার নয়, অনেকেরই ক্ষেত্রেই এমনটা হয়ে থাকে।
উইকেন্ড শেষে প্রথম কর্মদিবসে অফিস যেতে অনীহা যাদের, তাদের এ ধরণের সমস্যা এড়িয়ে চলার জন্য স্পেশাল কিছু টিপস দেওয়ার আগে চলুন আগে মনোযোগ দেওয়া যাক কিছু বিষয়ের উপর, যা আপনার ভাবার সময় হয়তবা এসে গিয়েছে কিন্তু আপনি বুঝে উঠতে পারছেন না।
১) আপনার কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ কি আপনার কাজের অনুপযোগী হয়ে উঠেছে কিনা!
বিগত কয়েক দশক ধরে দেখা যাচ্ছে যে সরকারি বা বেসরকারি যেকোনো চাকুরির চাহিদা যেন আকাশচুম্বী! আবার অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, আপনার কাজের অফিস খুবই নামিদামী, কিন্তু কর্তৃপক্ষ ‘ম্যান পাওয়ার কস্ট’ অর্থাৎ আপনার মতো যারা কাজ করছেন কোম্পানির জন্য, তাদের যে মোটা অংকের বেতন দিতে হচ্ছে তা কমাতে একদিকে লোক ছাটাই করছে, অন্যদিকে দক্ষদের উপর কাজের চাপ বাড়িয়ে দিয়েছে।
যদি এমন অবস্থার সম্মুখীন হন, তবে আপনার সুপারভাইজারের সাথে কথা বলুন আপনার কাজের চাপ নেওয়ার ক্ষমতা এবং কোম্পানির কাজের চাহিদার মাঝে সমন্বয়ের বিষয়টি নিয়ে। আপনি যদি কোনো আশানুরূপ সাহায্য না পেয়ে থাকেন, তবে ধরে নিবেন যে আপনার সে চাকুরি ছাড়ার সময় এসে গিয়েছে। সুতরাং পাশাপাশি নতুন মন মতো চাকুরির সন্ধানে নেমে পড়ুন। কারণ মন মতো কর্মস্থল না হলেও আপনার মাঝে এসে যেতে পারে মানডে ব্লুজ এর প্রভাব।
২) আপনার চাকুরিতে আপনি সন্তুষ্ট তো?
বর্তমান যুগে এসে খুব কম ভাগ্যবান লোক আছেন যারা নিজের কর্মক্ষেত্র নিয়ে সন্তুষ্ট থাকেন। এমন খুব কম চাকুরিক্ষেত্রে সচরাচর দেখা যায় যে কর্মক্ষেত্র পরিবেশ খুব পরিতৃপ্তিদায়ক, উপভোগ্য এবং প্রতিটি মিনিটই মন মতো সমৃদ্ধ গোছের হয়ে থাকে।
সুতরাং যদি প্রতিকূল পরিবেশ মানিয়ে নিতে না পারেন, তবে চাকুরি সুইচ করার চেষ্টা করুন, নতুবা ধীরে ধীরে আপনার মাঝেই অজান্তে গড়ে উঠবে চাকুরিক্ষেত্রে যাওয়ার অনীহা।
৩) আপনার জীবনযাপনের ধরণ কি ভারসাম্যপূর্ণ নাকি নয়?
এই প্রশ্নটা নিজেই নিজেকে করুন না কেন? যদি আপনার জীবনে কেবল কাজ, কাজ আর কাজ হয়ে থাকে, তবে আপনি অবশ্যই ভারসাম্যহীন জীবনযাপন করছেন। তাতে অবশ্যই অল্প কয়েক দিনেই আপনি হাঁপিয়ে উঠতে বাধ্য।
৪) আপনার চাকরি বনাম পারিবারিক সম্পর্ক, সম্পর্কগুলো শিথিল হওয়ার পথে নয়তো?
নিজেই এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করুন। আমরা প্রায়শ অনেককেই দেখে থাকি অফিস শেষে বাসায় এসে এমনকি উইকেন্ডেও ল্যাপটপ অথবা অফিসের ফাইল পত্র নিয়ে ব্যস্ত থাকতে। এমনও দেখা যায় অফিসের কাজের চাপে কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে সময় দেওয়ার মতো সময় পর্যন্ত পান না। সেক্ষেত্রে খুব শিগগির কাজে অনীহা তৈরি হতে দেখা যেতে পারে।
৫) আপনার চাকুরিক্ষেত্র কি শুধুমাত্র মানিয়ে নেওয়া অ্যাডজাস্টমেন্ট?
ধরুণ, আপনার খুব কাছের বন্ধু রাতের ডিনারে আপনাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। ডিনারে অখাদ্য দেওয়ার পরেও জোরপূর্বক সৌজন্যতার খাতিরে তা গিলতে হচ্ছে। এমন কোনো পরিস্থিতিতে পড়েছেন কখনও? তাহলে বুঝুন, চাকুরীক্ষেত্র যদি কেবলমাত্র অখাদ্য হজম করার মতন অ্যাডজাস্টমেন্টের উপর টিকে থাকে, তবে নিশ্চিত আপনি মানডে ব্লুজের কবলে পড়তে যাচ্ছেন।
৬) চাকুরির প্রতিকূল পরিবেশ কি আপনাকে ডিপ্রেশানের পথে টেনে নিয়ে যাচ্ছে?
আপনার কি খাবারে অনীহা? রাতে ঠিক মতো ঘুম হয় না? সব সময় কীসের যেন একটা আতংক মনের মাঝে ঘুরপাক খায়? কিন্তু বুঝতে পারছেন না সেটা কি? প্রায় সময় অফিস নিয়ে দুঃস্বপ্নে আপনার ঘুম ভেঙ্গে যায়? কারো সাথে কথা বলতে ভালো লাগে না? প্রিয় মানুষগুলোকেও যেনো বিরক্ত লাগে? যদি এসব বিষয় আপনার ক্ষেত্রেও ঘটে থাকে, তবে আপনি ডিপ্রেশানে ভুগছেন বুঝতে হবে।
জানা তো হলো মন মতো কর্ম পরিবেশ না হওয়া থেকে কীভাবে মানডে ব্লুজের শিকার হতে পারেন আপনিও। এবার আসুন জেনে নিই কী করে এর প্রতিকার করা যায় বা পরিত্রাণ পাওয়া যায় সহজেই।
১) জীবন যাত্রায় বৈচিত্র্য আনুন
এটা কোনো বিষয়ই নয় যে, আপনার কর্মক্ষেত্রের কাজগুলো কতটা গুরুত্বপূর্ণ, আপনার পাশাপাশি অবশ্যই নিজেকে রি-ফুয়েল করে নেয়ার মতো ব্যবস্থা রাখা অবশ্যই জরুরী। সে জন্য বাগান করা বা নিজের কিছু শখের চর্চা করা, টেলিভিশন বা মুভি দেখা, ছুটি কাটানো বা কোথাও ঘুরতে যাওয়া, হঠাৎ পরিবারের সবাইকে চমকে দিয়ে কিছু টুকটাক নিজেই রান্না করা, ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করা, সঠিক নিয়ম মেনে ঘুমানো, অল্প কিছু সময়ের জন্যে হলেও কিছু ব্যায়াম বা যোগাসন চর্চায় নিজেকে সময় দেওয়া ইত্যাদি ছোট ছোট কাজগুলোই আপনার কর্মব্যস্ত দিবসগুলোতে আপনাকে একঘেয়েমি মনোভাব থেকে মুক্তি দিতে পারে। স্যাটারডে বা সানডে ব্লুজের ভয়- ছুঁতেই পারবে না আপনাকে, নিশ্চিত থাকুন।
২) কাউন্ট ডাউন পদ্ধতি
আমরা অনেকেই স্বাভাবিকভাবে যখন ছাত্র জীবন পার করি, তখন একটা বিষয় খেয়াল করবেন যে, কোনো কঠিন পড়া শেষ করার আগেই পাতা উল্টিয়ে দেখে নিই যে আর কতো পৃষ্ঠা পড়া বাকি আছে। এতে আমাদের পড়ার গতি একটু হলেও বেড়ে যায়। অনুরূপভাবে কাউন্টডাউন হলো সেইরকম মানসিক একটি ব্যাপার।
প্রথম কর্মদিবসেই কাউন্ট করা শুরু করুন। আজ প্রথম দিন, মানে আর বাকি চারটে দিন। তারপরই আপনি আবার উপভোগ করতে পারবেন সাপ্তাহিক ছুটি। ব্যস এভাবেই হয়ে গেলো আপনার রিল্যাক্স মুডে কাজ করার উদ্যম।
৩) চোখকে রাখুন সবুজ, থাকুন সতেজ
হ্যাঁ, সবুজ রঙ একটু হলেও আমাদের মস্তিষ্কে প্রশান্তি এনে দেয়- একথা বলেছেন ক্যালিফোর্নিয়া ভিত্তিক লাইসেন্সড সাইকোথেরাপিস্ট স্ট্যাকি কায়সার। আপনার কাজের ডেস্ক যতই ছোট হোক না কেন, ছোট ছোট কিছু সবুজ ফুলের টব সাজিয়ে রাখুন। তাতে ছুটি শেষে কর্মস্থলে এসেই এই ছোট্ট সবুজই আপনার মনকে কিছুটা হলেও প্রশান্তি এনে দিবে।
ওয়াশিংটন স্টেট ইউনিভার্সিটির এক গবেষণায় এটি প্রমাণিত হয়েছে যে, যারা দীর্ঘক্ষণ কম্পিউটার বা ল্যাপটপের সামনে কাজে ব্যস্ত থাকেন, তাদের সামনে যদি সামান্য হলেও সবুজ গাছ বা টব রাখা হয়, তবে তারা কিছুটা হলেও কাজের চাপ কম অনুভব করে থাকেন। গবেষণায় এটিও বলা হয়েছে যে, যারা এরকম সবুজের মাঝে থাকেন তাদের ব্লাড প্রেশারের ঝুঁকি তুলনামূলকভাবে কম থাকে।
৪) মেডিটেশান
গ্যাংনন নামের এক গবেষক প্রমাণ করে দেখিয়েছেন যে, মেডিটেশানই পারে একমাত্র কর্ম উদ্যম পুরোপুরিভাবে ফিরিয়ে দিতে। কাজের মাঝে সুযোগ পেলে কোনো শুনশান নীরব জায়গা খুঁজে বের করুন। দু’চোখ বন্ধ করুন। খুব ধীরে নাক দিয়ে দীর্ঘ শ্বাস টানুন, আরও ধীরে ধীরে মুখ দিয়ে নিশ্বাস ছেড়ে দিন। কান দিয়ে শুনে অনুভব করতে চেষ্টা করুন আপনার শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ। এভাবে পাঁচ মিনিট সময় নিন মেডিটেশানে।
পাঁচ মিনিট পর ফিরে যান আপনার কাজের ডেস্কে আর দেখুন এর ম্যাজিক। কয়েকগুণ বেড়ে যেতে বাধ্য আপনার কাজের গতি। এই মেডিটেশান প্রসেস আমার দেওয়া নয়, দিয়েছেন গবেষক গ্যাংনন।
৫) পজিটিভ বা বাস্তববাদী হন
বাস্তবতা কোনো টিভি সিনেমার সিরিয়াল বা সিনেমা নয়, বড্ড কঠিন যেকোনো বাস্তবতা। নিজের কাজ নিয়ে বাস্তববাদী হোন।
কাজের ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব আনুন। দেখবেন প্রথম কর্ম দিবসে অত খারাপ লাগছে না, কর্তব্যজ্ঞানেই সব কাজ ঠিক মতোই এগুচ্ছে।
৬) নিজেকে ভাগ্যবান ভাবতে শিখুন
একবার ভাবুন সেসব পেশার লোকগুলোর কথা যাদের জীবনে সাপ্তাহিক ছুটি বলে কোনো শব্দ নেই। আমাদের দেশে বলতে গেলে যারা প্রশাসনিক গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে আসীন রয়েছেন তারা, বড় বড় গবেষক, সাংবাদিক, মিডিয়া কর্মী, চিকিত্সক, কলসেন্টার কর্মী এমনকি খেটে খাওয়া দিন মজুর পর্যন্ত অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় জীবিকা অর্জনের তাগিদে বলুন বা দায়িত্ব বলুন- তা যা ই হোক না কেন, তাদের সাপ্তাহিক ছুটি কাটানোর জন্য হয়তো তেমন বিশেষ কোনো দিন থাকে না। আপনি তো সপ্তাহান্তে ছুটি পান। সুতরাং নিজে কতটা ভাগ্যবান সেটা অনুভব করতে ক্ষতি কি বলুন?
৭) হাসতে শিখুন
অনেক বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা বলে থাকেন যে, হাসি হলো সর্ব রোগের ওষুধ। সম্প্রতি সাইকোলজিক্যাল সায়েন্সের এক গবেষণায় যে বিষয়টি উঠে এসেছে তা হলো, হাসি-তামাশার কাজটি মানুষের মেজাজকে উন্নত করে এবং তাত্ত্বিক ঘটনার (যেমন শনি বা রবিবার সকালে কাজ শুরু করার মতো) দ্রুত সামঞ্জস্য থেকে তাদের প্রত্যাবর্তন করতে সহায়তা করে, যদি তারা মন থেকে হাসতে পারে।
৮) গান শুনুন
২০১৫ সালে রেন্সেলিয়ার পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটের এক গবেষণায় এটি প্রকাশিত হয় যে, গান মস্তিষ্কের কোষগুলোকে প্রশান্তি দান করে। এতে আপনার মুড পরিবর্তন থেকে শুরু করে আপনার মুখে হাসির ঝলক এনে দিতে পারে। এমনকি ভালো গানের তাল বা রিদম উচ্চ রক্ত চাপের ঝুঁকি কমিয়ে সুন্দর একটি দিনের সূচনায় আপনাকে অনুপ্রাণিত করতে পারে।
৯) ক্যাট ভিডিও
২০১৫ সালে ইন্ডিয়ানা ইউনিভার্সিটি মিডিয়া স্কুল কর্তৃক এক গবেষণা চালানো হয় ৭০০০ লোকের উপর। এতে দেখা যায় ইউটিউবে যেসব হাস্যকর ‘ক্যাট’ বা বিড়ালের ভিডিও রয়েছে, রোজ তা দেখার অভ্যাস মানুষের মুড এবং এনার্জি লেভেল দুটোই খুব উন্নত হয়। কাজে গতি পাওয়া যায়। আপনিও ট্রাই করে দেখুন না একবার?
“সানডে ব্লুজ” বা “মানডে ব্লুজ’ যে নামেই তাকে অভিহিত করি না কেন, ব্যাপারটা পুরোটাই মানসিক। দু’দিন ছুটি কাটানোর পর কর্মব্যস্ত দিবসের সপ্তাহের প্রথম দিন কাজে ফিরে মনকে প্রস্তুত করতে কিছুটা সময় লাগে। নিজেকে বলুন অন্যান্য কাজের দিনের মতো এটাও একটা দিন, আলাদা কিছুই নয়। তাছাড়া নিয়ম মেনে ভারসাম্যপূর্ণ জীবন যাপনে অভ্যস্ত থাকার অভ্যাস গড়ে তুলতে পারলেই এই মন খারাপের রোগ বা কাজে অনীহার অসুখ কাটিয়ে তোলা সম্ভব।