রোমান পোলানস্কি পরিচালিত অ্যাকাডেমী অ্যাওয়ার্ড জয়ী চলচিত্র ‘দ্য পিয়ানিস্ট’ দেখে চোখ ছলছল করে ওঠেনি, এমন লোক খুব কমই পাওয়া যাবে নিয়মিত সিনেমা দর্শকদের মধ্যে। যুদ্ধকবলিত ওয়ারশ্ শহরে পিয়ানো বাদক ভ্লাদিস্ল স্পিলমানের মানবেতর জীবন-যাপন এবং পালিয়ে থাকার ঘটনার চেয়ে দর্শকের মনে যেটা করুণ হয়ে ধরা পড়ে সেটি হচ্ছে- যুদ্ধের ধ্বংসস্তুপে ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত এবং নিরন্ন অবস্থাতেও পিয়ানোতে তোলা তার সুর। আর এই কারণেই পিয়ানিস্ট শব্দটিই এখন একটা বিশেষণে রুপ নিয়েছে, যা যুদ্ধ, বিধি-নিষধ, অত্যাচার কিংবা ধ্বংসলীলার মাঝেও ললিতকলার চর্চার এক প্রতিকী প্রকাশকে মূর্ত করে। যিনি এই ধরনের সাহসী এবং মানবিক চর্চা ধরে রেখে মানবতার এই শিল্পিত দিকটি তুলে ধরেন তিনিই হয়ে ওঠেন এক একজন “পিয়ানিস্ট”। ইরাকে সদ্য আইএস জঙ্গিদের কবল থেকে মুক্ত হওয়া মসুলে দেখা মিলেছে এরকম একজন পিয়ানিস্টের। তিনি মোস্তফা তায়েই। তবে তিনি পিয়ানো বাজান না, ছবি আঁকেন।
পেশায় ইঞ্জিনিয়ার মোস্তফা তায়েই’র শখ ছবি আঁকা। শুধু শখ বললে ভুল বলা হবে, ছবি আঁকা বিষয়টা এখন তার বেঁচে থাকার জন্য আবশ্যক এবং অনেকটা অক্সিজেনের মতো ভূমিকা রাখে। তার ভাষায়, এটা তার রক্তে মিশে আছে। আর যার রক্তে মিশে আছে ছবি আঁকার নেশা, তাকে কি কোনো নিষেধের বেড়িতে বেধে রাখা যায়? না, পারেনি ভয়ঙ্কর জঙ্গিগোষ্ঠী আইএসের কঠোর নিষেধের বেড়ি কিংবা মৃত্যুভয়ও। তিনি এঁকে গেছেন নিজের মতো করে।
২০১৪ সালে হঠাৎ করেই উল্কার গতিতে উত্থান ঘটে জঙ্গিগোষ্ঠী আইএসের। ইরাকের মরুভূমিতে মরুঝড়ের মতোই হাজির হয় কালো পতাকাধারী এই কট্টর জঙ্গিগোষ্ঠীটি। কল্পনার চেয়েও দ্রুতগতিতে তারা দখল করে নেয় ইরাকের নিনেভেহ প্রদেশের পুরোটা। প্রাদেশিক রাজধানী মসুলে তারা গড়ে তোলে শক্ত ঘাঁটি। আশপাশের সব শহরও দখল করে নিয়ে সেখানে গড়ে তোলে তাদের জঙ্গিরাজ্য।
মসুল থেকে ২০ কিলোমিটার দূরের ছোট্ট শহর হাম্মান আল-আলিলও চলে যায় তাদের দখলে। এই শহরেই জন্ম এবং বেড়ে ওঠা মোস্তফা তায়েই’র। ইঞ্জিনিয়ারিং এ স্নাতক এই শিল্পী প্রথমে প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করলেও পরে হয়ে ওঠেন সর্ব কাজের কাজী, যাকে ইংরজিতে বলা হয় জ্যাক অব অল ট্রেড। তার কাছে বিভিন্ন লোক তাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র মেরামত করে নিতে আসতে থাকে। তিনিও হাসিমুখে তাদের কাজ করে দেন। তবে তার মূল পরিচয় চিত্রশিল্পী। কিন্তু আইএস জঙ্গিরা শহরে তাদের ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করার সঙ্গে সঙ্গে আরোপ করে নানা রকম বিধি-নিষেধ। শিল্প-সংস্কৃতির সুকুমার চর্চার ওপর তারা চাপিয়ে দেয় নিষেধের কালো পর্দা। মোবাইল ফোন ব্যবহার, সিনেমা দেখা, গান শোনা থেকে শুরু করে ধূমপান পর্যন্ত সবই নিষিদ্ধ হয় আইএসের জঙ্গিরাজ্যে। সেই সাথে নিষিদ্ধ হয় ছবি আঁকাও। আইএসের কঠোর নিষেধ না মানলে জঙ্গিরা কঠোর শাস্তি দিতে শুরু করে লোকজনকে। বেত্রাঘাত থেকে শুরু করে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে কিংবা গুলি করে হত্যা সবই তারা করতে থাকে প্রকাশ্য দিবালোকে। আর স্থানীয় জনতাকে এসব দেখতে বাধ্য করে। ফলে এক আতঙ্কের পরিবেশ কায়েম হয় আইএসের শাসনাধীন হাম্মান আল-আলিল এ।
কিন্তু মোস্তফা তায়েই’র রক্তেই যে মিশে আছে আঁকাআঁকির নেশা। আর তাই গোপনে তিনি এঁকে চললেন। তবে তার ছবির বিষয়বস্তু গেল বদলে। আগে যে শিল্পী সুকুমার অনুসঙ্গ আর প্রকৃতির সৌন্দর্য্য এঁকেছেন তিনিই এবার শুরু করলেন আইএসের নিষ্ঠুরতার ছবি আঁকা। নানা প্রতীকী ব্যঞ্জনায় ফুটিয়ে তুলতে শুরু করলেন জঙ্গিদের অত্যাচারের চিহ্ন। তিনি আঁকলেন আইএসের অধীনে মানুষের কঠিন জীবনযাত্রার ছবি। তার ছবি সাক্ষী হয়ে আছে, আইএসের অত্যাচারে কিভাবে তার শহরের মানুষের জীবনযাত্রা দুর্বিসহ হয়ে উঠেছিল। তার ছবি আঁকার বিষয়টি প্রকাশ হয়ে পড়েছিল আইএস জঙ্গিদের কাছে। তারা তাকে ধরে নিয়ে শহরের কেন্দ্রস্থলে প্রকাশ্যে বেত্রাঘাত করে। বেত্রাঘাতের পর তাকে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য কারাগারে বন্দি রাখে আইএস জঙ্গিরা। সেই ঘোর কারাগারে তার প্রতিটি মুহুর্ত কেটেছে মৃত্যুভয়কে সঙ্গে নিয়ে। নিজের চোখের সামনেই অনেককে মরতে দেখেছেন নিষ্ঠুর জঙ্গিদের হাতে। কিন্তু একদিন মৃত্যুর অন্ধকার গহ্বর থেকে তিনি মুক্তি পেলেন। ইরাকি সেনারা আইএসের কবল থেকে শহরটি মুক্ত করে ২০১৬ সালের নভেম্বরে। নতুন করে জীবন ফিরে পান তিনি। এবার আবার তার মিলেছে আঁকার স্বাধীনতা।
আইএসের হাতে নিহত অনেকের ছবিই তিনি এঁকেছেন। তার আঁকা ছবিতে অমরত্ব পেয়েছেন অনেক শহীদ। এমনই একজনের কথা তিনি বলেন আল-জাজিরার এক সাংবাদিকের সঙ্গে। হানি নামের এক শহীদের মৃতদেহের ছবি দেখিয়ে তিনি জানান, ইরাকি সেনারা শহর পুনঃদখল করার ঠিক আগে এই ব্যক্তি নিহত হয়। নিহত হওয়ার সময় নিষ্ঠুর জঙ্গিরা তার সব কাপড়-চোপড়ও খুলে ফেলেছিল। কিন্তু ছবি আঁকার সময় তায়েই তার গায়ে ইউনিফর্ম এঁকে দেন। তার ভাষায় এভাবেই তিনি এই শহীদকে সম্মান জানালেন।
শহীদদের তিনি সম্মান জানালেও ইরাকি এই শিল্পীর অনুযোগ- স্থানীয় লোকজন তার আঁকা ছবিকে বেশি কদর করছে না এবং তিনিও পাচ্ছেন না তার প্রাপ্য সম্মান। আইএস জঙ্গিরা চলে যাবার পর তিনি স্থানীয় স্কুলে একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করেন। অবরুদ্ধ সময়ের মধ্যে বসে আঁকা সেই ছবিগুলো তেমন সাড়া ফেলেনি লোকের মাঝে। হয়তো এর একটা কারণ, লোকজন এখনো সেই আতঙ্কের ঘোরটা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। কিন্তু শিল্পী মানুষ, একটু অভিমান তো হয় বৈকি।
তবে অভিমান করে কিন্তু তিনি বসে নেই। ছবি আঁকা যে তার রক্তে। তিনি নিজেই বলেন, “লোকে ধুমপান করে, আর আমি ছবি আঁকি। এটা আমার রক্তে।” আর তাই আইএসের সঙ্গে রক্তাক্ত লড়াইয়ে নিহত শহীদদের ছবি আঁকায় এখন মনোনিবেশ করেছেন তিনি। বর্তমানে ৫৩ বছর বয়সী এই চিত্রশিল্পী আইএসের সঙ্গে লড়াইয়ে নিহত যোদ্ধাদের মুখচ্ছবিসহ পোস্টার আঁকেন। এই কাজে তার বেশ ব্যস্ত সময় কাটছে। মসুলের কাছে এখনো আইএসের সঙ্গে লড়াইয়ে নিয়োজিত রয়েছে ইরাকি বাহিনী। সেখানে প্রতিনিয়তই কেউ না কেউ মারা যাচ্ছেন। আর সহযোদ্ধা কিংবা স্বজনদের আত্মত্যাগকে মহিমান্বিত করতে এবং স্মৃতিতে স্মরণীয় করে রাখতে অনেকেই তাদের ছবি নিয়ে আসছেন তার কাছে পোস্টার আঁকিয়ে নিতে। তিনিও নিরলসভাবে এঁকে চলেছেন। ২০১৭ সালের মে মাস পর্যন্ত তিনি একশোরও বেশি শহীদের পোস্টার একেছেন। শহরে জনপ্রিয়তা না পেলেও মসুলের লড়াইরত যোদ্ধাদের কাছে তিনি খুবই জনপ্রিয়। প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো যোদ্ধা নিহত সহযোদ্ধার ছবি নিয়ে এসে হাজির হন তার কাছে। এসব ছবি তারা নিয়ে টানিয়ে রাখেন তাদের ব্যারাকের দেয়ালে।
নিহত যোদ্ধাদের ছবি আঁকার পাশাপাশি তিনি আঁকছেন ইরাকের প্রাচীন গৌরব আর বহুত্ববাদী চরিত্রের ছবিও। তিনি একটি ছবিতে এঁকেছেন ইরাকের পতাকার দুই পাশে মসজিদ এবং গির্জা। প্রাচীন ব্যবিলনীয় এবং সুমেরিয় সভ্যতার নানা নির্দশনও তিনি তুলে আনছেন তার ছবিতে। যে প্রাচীন সভ্যতার চিহ্নগুলো আইএস জঙ্গিরা মুছে দিতে চেয়েছিল, যে বহুত্ববাদী চরিত্রের ইরাকে তারা কায়েম করতে চেয়েছিল জঙ্গিরাজ্য, সেই আইএসের বিদায়ের পর তিনি আবারো তার ছবিতে ওড়াচ্ছেন ঐতিহ্য ও ঐক্যের লাল-কালো-সাদা ইরাকি পতাকা। আইএসের অন্ধকার কুঠুরিতে থেকেও শিল্পের চর্চায় নিয়োজিত থাকা এই “পিয়ানিস্ট” মোস্তফা তায়েই স্বপ্ন দেখেন- একদিন কেটে যাবে বিভীষিকা, আসবে আলো। যেই আলোতে ইরাকি শিয়া-সুন্নী মুসলমান, খৃষ্টান, ইয়াজিদিসহ সব মানুষ দেখতে পাবে মুক্ত স্বদেশভুমি।