Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

‘হোয়াইট ডেথ’ নামের এক মৃত্যুদূতের গল্প

১৯০৫ সালের ১৭ ডিসেম্বর, দক্ষিণ ফিনল্যান্ডের সাউথ কারেলিয়া অঞ্চলের রাউতজার্ভি পৌরসভায় জন্ম নেয় এক ছেলে, নাম তার সিমো হায়েহা। সময়ের সাথে সাথে একসময় হায়েহাও বড় হতে থাকেন। আট-দশটা সাধারণ ছেলের মতোই কেটে যাচ্ছিলো তার শৈশব-কৈশোরের দিনগুলো। কৃষিকাজ ও শিকার করেই জীবিকা নির্বাহ করতেন তরুণ হায়েহা।

অবশেষে ১৯২৫ সালে বিশ বছর বয়সে ফিনল্যান্ডের রক্ষীবাহিনী হোয়াইট গার্ডে যোগ দেন তিনি। সেখানে নানা শুটিং স্পোর্টসে স্নাইপার হিসেবে নিজের দক্ষতার পরিচয় দিয়ে তিনি তাক লাগিয়ে দেন সবাইকে। আর স্নাইপার হায়েহার এ দক্ষতাই ঘুম হারাম করে দিয়েছিলো হাজার হাজার সোভিয়েত সেনার। ‘হোয়াইট ডেথ’ নামে সোভিয়েত বাহিনীতে ত্রাস সৃষ্টি করা সিমো হায়েহার অসাধারণ বীরত্ব আর চমৎকার রণকৌশলের গল্প শোনাতেই আজকের এ লেখা।

white-death-2

সিমো হায়েহা; Image Courtesy: 4ChanArchives

১৯৩৯ সালের কথা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবার পর প্রায় মাস তিনেক সময় চলে গেছে। এমন সময় লেনিনগ্রাদের নিরাপত্তার অজুহাত তুলে সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষ থেকে ফিনল্যান্ডকে জানানো হয় যে, তারা যেন দেশ দুটির সীমান্তবর্তী কিছু এলাকা সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে বিনিময় করে নেয়। কারণ লেনিনগ্রাদ থেকে ফিনল্যান্ডের সীমান্তের দূরত্ব ছিলো মাত্র ৩২ কিলোমিটার। ফিনল্যান্ড সরকারের পক্ষ থেকে এমন প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা হলে ৩০ নভেম্বর দেশটিতে হামলা চালায় সোভিয়েত ইউনিয়ন।

উভয় পক্ষের শক্তির মাঝে ছিলো আকাশ-পাতাল ব্যবধান। সোভিয়েত ইউনিয়নের ছিলো প্রায় ৯,৯৮,১০০ জন সৈন্য; ১,৫০০ এর অধিক সাঁজোয়া যান, ২,৫১৪-৬,৫৪১টি ট্যাঙ্ক এবং ৩,৮৮০টি যুদ্ধবিমান। অপরদিকে ফিনল্যান্ডের ছিলো মাত্র ২,৫০,০০০-৩,৪০,০০০ সৈন্য, ৩২টি ট্যাঙ্ক ও ১১৪টি যুদ্ধ বিমান। তবে প্রায় ৩০,০০০ এর মতো উচ্চ পদের অফিসারের মৃত্যুদন্ড ও বন্দীত্বের ফলে ১৯৩৯ সালে রেড আর্মি যখন ফিনল্যান্ডে আক্রমণ চালায়, তখন তাদের বাহিনীতে অনভিজ্ঞ সিনিয়র ও মিড-লেভেল অফিসারের সংখ্যাই ছিলো বেশি। তাই সংখ্যায় কম হলেও ‘উইন্টার ওয়্যার’ নামে পরিচিতি পাওয়া এ যুদ্ধে স্বদেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ ফিনল্যান্ডের সেনারা যে অসামান্য বীরত্ব প্রদর্শন করেছিলো তা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার।

শেষ পর্যন্ত অবশ্য সোভিয়েত শক্তি-সামর্থ্যের কাছে মাথা নত করতে বাধ্য হয়েছিলো ফিনল্যান্ড। তবে এ যুদ্ধে ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয়েছিলো সোভিয়েতদেরই। আর এটি আন্তর্জাতিক মহলে তাদের সুনাম ক্ষুণ্ণ করেছিলো অনেকখানি। একটি পরিসংখ্যান দিলেই বোঝা যাবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ। এ যুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের ১,২৬,৮৭৫-১,৬৭,৯৭৬ জন সেনা নিহত বা নিখোঁজ হয়, ১,৮৮,৬৭১ জন আহত হয়, ৫,৫৭২ জন সেনা বন্দী হয়, ৩,৫৪৩টি ট্যাঙ্ক ধ্বংস হয় এবং ২৬১-৫১৫টি যুদ্ধবিমান ধ্বংস হয়। অন্যদিকে ফিনল্যান্ডের ২৫,৯০৪ জন সেনা নিহত বা নিখোঁজ হয়, ৪৩,৫৫৭ জন সেনা আহত হয়, ৮০০-১,১০০ জন বন্দী হয়, ৯৫৭ জন সাধারণ মানুষ বিমান হামলায় মারা যায়, ২০-৩০টি ট্যাঙ্ক ধ্বংস হয় এবং ৬২টি যুদ্ধবিমান ধ্বংস হয়। অর্থাৎ শেষ পর্যন্ত ফিনল্যান্ডকে মাথা নোয়াতে বাধ্য করলেও ক্ষতির পাল্লাটা সোভিয়েত ইউনিয়নের দিকেই বেশি ঝুঁকে ছিলো। ১৯৪০ সালের ১৩ মার্চ মস্কো শান্তি চুক্তির মাধ্যমে এ যুদ্ধের অবসান ঘটে।

ব্যাটেল অব কল্লার মানচিত্র

ব্যাটেল অব কল্লার মানচিত্র; Image Courtesy: ranker.com

উইন্টার ওয়্যারেরই একটি অংশ ছিলো ‘ব্যাটেল অব কল্লা (Battle of Kollaa)’ যা ১৯৩৯ সালের ৭ ডিসেম্বর থেকে শুরু হয়ে শেষ দিন পর্যন্ত চলেছিলো। এখানেই ফিনিশ আর্মির ষষ্ঠ কোম্পানির স্নাইপার হিসেবে লড়েছিলেন সিমো হায়েহা। যুদ্ধকালে সেখানকার পরিবেশ ছিলো একেবারেই প্রতিকূলে, -৪০ ডিগ্রি থেকে -২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মাঝে ঘোরাঘুরি করছিলো তাপমাত্রা। এমন বৈরি পরিবেশেও সাদা ক্যামোফ্লেজের আশ্রয় নিয়ে শত্রুদের কাছে সাক্ষাৎ যমদূত হয়ে ওঠায় ‘হোয়াইট ডেথ’ নামটি নিজের করে নিয়েছিলেন সিমো হায়েহা। আর বলবেই না কেন? হায়েহা এ যুদ্ধে স্নাইপার হিসেবে ছিলেন ১০০ দিনেরও কম সময় ধরে। এ সময়েই তার নির্ভুল নিশানায় ৫০৫ জন সোভিয়েত সেনা প্রাণ হারায়! অর্থাৎ প্রতিদিন প্রায় ৫ জন সেনা হায়েহার হাতে প্রাণ হারাচ্ছিলো। চারদিকের তুষার ঢাকা পরিবেশেও সোভিয়েত বাহিনী সাদা ক্যামোফ্লেজের আশ্রয় না নেয়ায় ব্যাপারটি আরো সহজ হয়ে গিয়েছিলো হায়েহার মতো স্নাইপারদের জন্য। ১৯৯৮ সালে একবার হায়েহাকে তার এমন নিখুঁত নিশানার পেছনের কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি উত্তর দিয়েছিলেন- “চর্চা”। আবার যখন জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো এতজন সৈন্যকে মারার জন্য তিনি অনুতপ্ত কিনা, তখন তিনি বলেছিলেন, “আমি কেবল আমার দায়িত্ব পালন করেছিলাম এবং যতটা সম্ভব ভালো করে আমি সেটাই করছিলাম যা আমাকে করতে বলা হয়েছিলো।”

যুদ্ধকালে হায়েহা ইম্পেরিয়াল রাশিয়ান আর্মির তৈরি মোসিন-নাগান্ট রাইফেলের ফিনিশ হোয়াট গার্ড মিলিশিয়া সংস্করণটি ব্যবহার করেছিলেন। এর সিরিয়াল নাম্বার ছিলো ৬০৯৭৪। শত্রুর কাছে নিজের অস্তিত্বকে যথাসম্ভব কম জানান দিতে টেলিস্কোপিক সাইটের তুলনায় আয়রন সাইটকেই বেশি প্রাধান্য দিতেন হায়েহা। কারণ টেলিস্কোপিক সাইট ব্যবহার করলে একজন স্নাইপারকে মাথা তুলনামূলক উঁচুতে তুলতে হয়। টেলিস্কোপিক সাইটের গ্লাস ঠান্ডা আবহাওয়ায় সহজেই কুয়াশার কারণে ঝাপসা হয়ে যায়। আবার এর গ্লাসে সূর্যের আলোর ঝলকানি সহজেই দিনের বেলায় একজন স্নাইপারের লুকোবার স্থান শত্রুপক্ষের কাছে প্রকাশ করে দিতে পারে। এসব কারণে আয়রন সাইটই ছিলো হায়েহার পছন্দনীয়। সাদা ক্যামোফ্লেজ গায়ে জড়িয়ে, অসীম সাহস বুকে নিয়ে তাই মাত্র এক দিনের খাদ্য ও গোলাবারুদ নিয়ে চলে যেতেন তিনি। নিজের সামনে একগাদা তুষারের স্তুপ জড়ো করে শত্রুর দৃষ্টিসীমা থেকে নিজেকে আড়ালে রাখতেন হায়েহা। এমনকি সোভিয়েত সেনারা যাতে এমন ঠান্ডা আবহাওয়ায় তার শ্বাস-প্রশ্বাসের ফলে মুখ থেকে বের হওয়া ধোঁয়াও দেখতে না পায়, সেজন্য মাঝে মাঝে মুখে বরফও পুরে রাখতেন তিনি!

আয়রন সাইট ও টেলিস্কোপিক সাইট

আয়রন সাইট ও টেলিস্কোপিক সাইট; Image Courtesy: Purbashabd24.com

হায়েহার কাছ থেকে এমন প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়ে তাকে ঘিরেই নতুন করে পরিকল্পনা সাজাতে বাধ্য হয়েছিলো সোভিয়েত বাহিনী। শুধুমাত্র তাকে শেষ করতে আলাদা স্নাইপারদের কাজে লাগিয়েছিলো তারা, আয়োজন করেছিলো আর্টিলারি স্ট্রাইকের। কিন্তু লাভের লাভ কিছুই হয় নি। বরং একবার এক সোভিয়েত সেনা হায়েহার খোঁজে কয়েকজন ফিনিশ সেনা ও তিনজন অফিসারকে মেরে ফেললে ঠান্ডা মাথায় তার টেলিস্কোপিক সাইটে সূর্যের আলোর ঝলকানি দেখে ৪৫০ মিটার দূরে থেকে তাকে শেষ করে দেন হায়েহা।

অবশেষে এলো হায়েহার জীবনের সেই অন্ধকারতম অধ্যায়, ১৯৪০ সালের ৬ মার্চ। অন্যান্য দিনগুলোর মতো সেদিনও নিজের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছিলেন তিনি। হঠাৎ করে এক সোভিয়েত সেনার এক্সপ্লোসিভ বুলেট আঘাত হানে তার বাম চোয়ালের নিম্নাংশে। এ আঘাতের পরেও মারা যান নি তিনি, শুধু বাম গালের নিচের দিকের কিছুটা অংশ হারাতে হয় তাকে। সহযোদ্ধারা হায়েহাকে উদ্ধার করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। এক সপ্তাহ পর, যেদিন মস্কো শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হলো, সেদিনই জ্ঞান ফিরে পান তিনি। যুদ্ধক্ষেত্রে অসামান্য বীরত্বের স্বীকৃতিস্বরুপ যুদ্ধের পরপরই তাকে কর্পোরাল থেকে সেকেন্ড লেফটেনেন্টে পদোন্নতি দেয়া হয়।

white-death
Image Courtesy: Purbashabd24.com

জীবনের শেষ দিনগুলোতে সিমো হায়েহা রাশিয়ার সীমান্তবর্তী দক্ষিণ ফিনল্যান্ডের ছোট্ট শহর রুওকোলাহ্‌তিতে থাকতেন। ২০০২ সালে যুদ্ধপ্রবীণদের এক নার্সিং হোমে ৯৬ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন কিংবদন্তীতুল্য এ স্নাইপার।

white-death-6

সিমো হায়েহার সমাধিস্তম্ভ; Image Courtesy: Daily mail

This article is in Bangla. It is a story about a finnish sniper Simo Hayha.

References:

  1. www.simohayha.com
  2. www.damninteresting.com/white-death/

Featured Image: homesecurity.press

Related Articles