এ কথা ইতিহাস স্বীকৃত যে, ১৬০৮ (মতান্তরে ১৬১০) সালে বাংলার সুবেদার ইসলাম খাঁ চিশতীর ঢাকা আগমন এবং ১৬১০ সালে সুবা বাংলার রাজধানী হিসেবে দিল্লির সম্রাট জাহাঙ্গীর কর্তৃক সনদ প্রাপ্তির পূর্বেই ঢাকা একটি বাণিজ্যিক নগরী হিসেবে বিদ্যমান ছিল। বাহান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি খ্যাত সমৃদ্ধ নগরীকে ইতিহাস বিশারদরা ঢাকা বলেই শনাক্ত করেছেন।
বৃহৎ বাংলার জনপদে গৌড়, পুন্ড্র, মহাস্থান, ময়নামতি, সম্ভার, সোনারগাঁও প্রভৃতি নগরী প্রাচীন ইতিহাসের ধাপে ধাপে সমৃদ্ধ নগরী হিসেবে বিরাজমান থাকলেও এসব নগরী সীমিতকাল পর্যন্ত তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছিল। কারণ এসব নগরী গড়ে ওঠার পটভূমিতে কোনো কোনো পরাক্রমশালী রাজা, গোষ্ঠী ও ধর্মমত কাজ করছিল। কিন্তু ব্যতিক্রম নগরী ঢাকা, শিল্প ও বাণিজ্য নগরী হিসেবে এর অভিযাত্রা শুরু করাতে শত ঘাত-প্রতিঘাত, চড়াই-উতরাইয়ের মধ্যেও প্রায় হাজার বছর ধরে তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরী, তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা সিঞ্চিত ভৌগলিক সুবিধাই ঢাকার গৌরবকে সমৃদ্ধ ও স্থায়ী করেছে।
আনিস আহামেদ, ঢাকাইয়া আসলি, বাংলা একাডেমি, ২০১৮
ঢাকা সম্পর্কে বিশিষ্ট ইতিহাস গবেষক আনিস আহামেদের এই মূল্যায়ন নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক মর্যাদার দিক দিয়ে ঢাকার নানা উত্থান-পতন ঘটলেও, বাণিজ্যিক কারণে ঢাকা বরাবর একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। ঢাকা বাংলাদেশের প্রাচীন শিল্প নগরী। ফলে এখানে নানা সময়ে নানান ধরণের শিল্প, কল-কারখানা স্থাপিত হয়েছে। সেসব কল-কারখানার অনেক কিছু এখনও বিদ্যমান থাকলেও, সময়ের তাগিদে বা বাজার বিবেচনায় অনেক ব্যবসায়-বাণিজ্য ও শিল্প-কারখানা বিলুপ্তও হয়েছে। তেমনই একটি শিল্পের নাম ‘কাঙ্গিসাজ’।
ভৌগলিক দিক বিবেচনায় মুঘল আমলে ঢাকার বাণিজ্যকে বেশ গুরুত্ব সহকারে করে দেখা হয়। এসময় দ্রুত বাণিজ্যিক প্রসার ও কল-কারখানায় শ্রমিক নিয়োগের লক্ষ্যে ঢাকার বাহির থেকে প্রণোদনা দিয়ে কর্মী সরবরাহ করা হয়। বিশেষত, অভিজ্ঞ লোকদের ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এ সময়ে পেশাজীবীরা ঢাকায় এসে আবাস গড়ে তোলেন।
‘লাখেরাজ’ তথা তাদের জন্য খাজনাবিহীন জমি বরাদ্দ করা হয়। তারা সেখানে ঘর-বাড়ি নির্মাণ করে বসবাস শুরু করেন। এদের একটি অংশ পরবর্তীতে হাতির দাঁত ও অন্যান্য পশুর হাড় দিয়ে বিভিন্ন ব্যবহার্য পণ্য তৈরি করতে শুরু করেন। এই হাতির দাঁতের শিল্পকেই বলা হত ‘কাঙ্গিসাজ’। এ বিষয়ে আনিস আহামেদ তার ঢাকাইয়া আসলি গ্রন্থে বলেন:
একসময়ের শিল্পসমৃদ্ধ নগরী ধার পশ্চিমাংশে লালবাগ কেল্লা সংলগ্ন আমলিগোলা, নবাববাগিচা, হাজারীবাগ, মসজিদগঞ্জ, চৌধুরী বাজার, ভাট মসজিদ, পোস্তা, গোড়ে শহীদ, খাজে দেওয়ান, রহমতগঞ্জ এলাকায় বিচ্ছিন্নভাবে বসবাসকারী মুসলমান শিল্পী পরিবাররা হস্তিদন্ত নির্মিত পাখা, চুড়ি, পাশার ছক, ঘুঁটি ও বোতাম তৈরি করতো। এছাড়া তারা মহিষের শিং নির্মিত পাখা, চিরুনি, বোতাম, হরিণের শিংয়ের পাশার ছক ও ঘুঁটি তৈরিতে নিয়োজিত ছিল।
বিভিন্ন প্রাণী তথা হাতি, হরিণ, মহিষ, গরু, গণ্ডার ইত্যাদির দাঁত, হাড় ও শিং দিয়ে পণ্য তৈরিকে কেন্দ্র করে এই শিল্প গড়ে ওঠে। পণ্যসমূহের মধ্যে রয়েছে চিরুনি, বোতাম, পানপাত্র, পেয়ালা, বাদ্যযন্ত্র, কৌটা, তীর-ধনুক, আতরদানি, তলোয়ার, ছড়ি, ছড়ির বাট, ছড়ি লুকানোর ছোরা ও নানা ধরনের শৌখিন শোপিস। এই কাঙ্গিসাজ শিল্পীরা পশুর হাড় দিয়ে চিরুনি তৈরি করতো বলে এর নামকরণ ‘কাঙ্গাই’, ‘কাহই’ ইত্যাদি হয়েছিল।
মূলত মোঘল আমলে এই শিল্পের ব্যপক প্রসার ঘটে। প্রথমিক দিকে এই শিল্পের কাঁচামাল তথা হাড়, শিং ও দাঁত তৎকালীন বাংলাদেশেরই বিভিন্ন স্থান থেকে সংগ্রহ করা হতো। বিশেষ করে ঢাকার পিলখানা, গাজীপুর, সিলেট ও আসামের জঙ্গল থেকে হাতির দাঁত ও হাড় সরবরাহ করা হতো। এছাড়া গাজীপুর, সুন্দরবন, চট্টগ্রাম, আসাম, আরাকান ও রেঙ্গুন থেকে হরিণ, গণ্ডার, গরু ও মহিষের শিং সরবরাহ করা হতো।
পুরান ঢাকার বিভিন্ন স্থানে এই বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে বড় বড় প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। এসব প্রতিষ্ঠানে উৎপাদিত পণ্য ভারতবর্ষ, ইরান, ইরাক, তুরস্কসহ মধ্য প্রাচ্যের নানা অভিজাত এলাকায় রপ্তানি করা হতো। ভারতবর্ষে মহিষের হাড় দিয়ে তৈরি চিরুনি তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। ইতিহাসবিদ যতীন্দ্রমোহন রায় (১৮৬৪-১৯২৪) তার ঢাকার ইতিহাস গ্রন্থে লিখেছেন
বহুকাল হইতেই ঢাকাতে হস্তীদন্ত নির্মিত শাঁখা ও চুড়ি প্রস্তুত হইয়া আসিতেছে। এখানে খেদা অফিস থাকায় হস্তীদন্ত সংগ্রহ করা অনায়াসসাধ্য ছিল; সুতরাং শিল্পীগণ উহা সংগ্রহপূর্বক শাঁখা, চুড়ি, পাশার ছক ও ঘুঁটি বোতাম প্রভৃতি নির্মাণ করিয়া বেশ দু’পয়সা উপার্জন করিতে সমর্থ হইতো। এই শিল্পটি এক্ষণেও লুপ্ত হয় নাই।
ইংরেজ আমলে তাদের শাসন-শোষণের মুখে এই শিল্প ক্রমাগত সংকুচিত হতে থাকে। বিদেশে পণ্য রপ্তানি জটিল হয়ে পড়ে। ফলে কাঙ্গিসাজ শিল্প প্রতিষ্ঠান ক্রমান্বয়ে বন্ধ হয়ে যেতে থাকে। অনেক শ্রমিক পর্যাপ্ত অর্থ আয় না হওয়ায় অন্য পেশায় জড়িয়ে পড়ে। কাঙ্গিসাজ শিল্পের সাথে জড়িত অনেক পরিবার রেঙ্গুন, চট্টগ্রাম, বরিশাল ও কলকাতায় চলে যায়।
কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এই শিল্পের জন্য সাপে বর হিসেবে দেখা দেয়। যুদ্ধকে কেন্দ্র করে ইংরেজ সেনাবাহিনীতে ব্যাপক সৈন্য নিযুক্ত করা হয়। এসব সৈন্যদের জন্য তৈরিকৃত নতুন পোশাকের জন্য প্রচুর বোতামের প্রয়োজন হয়, যা সরবরাহ করে কাঙ্গিসাজ শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো। ফলে এই শিল্প আবার তার যৌবন ফিরে পায়। এ বিষয়ে আনিস আহামেদ তার ঢাকাইয়া আসলি গ্রন্থে লিখেছেন-
ভারতবর্ষের আনাচে-কানাচে ব্রিটিশ রাজশক্তি ও মিত্রশক্তি দেশগুলোর ব্যাপক সৈন্য সমাবেশ ঘটে। কয়েক লাখ ভারতীয়দের নিয়োগ দেয়া হয় সেনাবাহিনী ও তার সহযোগী বাহিনীতে। লাখ-লাখ সেনার উর্দির জন্য শিংয়ের বোতামের চাহিদা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পায়।
ফলে বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরিবর্তে উল্টো নতুন নতুন কাঙ্গিসাজ শিল্প-কারখানা গড়ে উঠতে থাকে। বৃহৎ কারখানার পাশাপাশি লালবাগের ঘরে ঘরে কুটির শিল্প আকারে মহিষের শিং দিয়ে বোতাম তৈরি হতে থাকে। অনেক পরিবারের সকল সদস্যই এই কাজে নিযুক্ত হয়ে যায়। স্বল্প সময়ের মধ্যে পুরাতন ঢাকা কাঙ্গিসাজ ব্যবসায়ীরা বিত্তশালী হয়ে ওঠে। সেই বর্ণনা দিতে গিয়ে আনিস আহামেদ লিখেছেন-
এর ব্যবসালব্ধ উপার্জনে লালবাগে অনেক নব্য হিন্দু-মুসলমান ব্যবসায়ীদের ধন-সম্পদ ফুলে-ফেঁপে ওঠে। ফলে এসব এলাকায় অনেকগুলো বিত্তশালী পরিবারের জন্ম হয়। মহাদুর্ভিক্ষের সময়ও শিং শিল্প সংশ্লিষ্ট মানুষরা উৎসবের আমেজে খানা-পিনা, ফুর্তি চালিয়ে গেছে।
এক পর্যায়ে বোতামের চাহিদা এত বৃদ্ধি পায় যে, এর জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামালের অভাব দেখা দেয়। ফলে ব্যবসায়ীরা শিং সংগ্রহের জন্য দেশ থেকে দেশান্তরে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। তারা শিংয়ের বিকল্প উৎস সন্ধানে দক্ষিণ ভারতের অন্ধ্র প্রদেশ, তামিলনাড়ু, কেরালা প্রভৃতি অঞ্চলে অঞ্চলে চলে যায়। অনেকে শুধু শিং সরবরাহকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়ে ভারতের ওইসব অঞ্চলে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। তাদের অনেকে পরে আর দেশে ফিরে আসেনি।
বোতাম ও চিরুনি তৈরি প্রক্রিয়ার বর্ণনা জানতে ইতিহাস গবেষক আনিস আহামেদ পুরাতন ঢাকার সাকিয়া বানু নামের এক বৃদ্ধা নারীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। সাকিয়া বানুর পিতা আহমাদউল্লা সরদার কাঙ্গিসাজ শিল্পের স্বর্ণযুগে অন্যতম সফল ব্যবসায়ী ছিলেন। তার সেই সাক্ষাৎকার থেকে বোতাম ও চিরুনি তৈরির প্রক্রিয়াটি এখানে তুলে দেয়া হলো-
হাত করাত দিয়ে প্রথমে মহিষের শিংয়ের অগ্রভাগের পুরু অংশ কাটা হতো। শিংয়ের পুরো অংশ দিয়ে তৈরি হতো বোতাম। আর শিংয়ের গোড়ায় ফাঁপানো অংশ দিয়ে তৈরি হতো কাঙ্গাই (চিরুনি)। বোতামের জন্য নির্দিষ্ট ‘পুরু শিং’ সারারাত গামলা ভর্তি পানিতে ডুবিয়ে রাখা হতো। পরদিন সকালে বারশোলা (বাটালি) দিয়ে শিংয়ের বহিরাবরণ চেছে সমান করা হতো। এভাবে তৈরি হতো বোতাম তৈরির লুড়ি। এরপর লুড়িকে কাঠের সাইজ করা খণ্ডের সাথে আঠা দিয়ে লম্বাভাবে লাগানো হতো, যাতে পুরো শিং দিয়েই বোতাম তৈরি করা যায়। এ পর্যায়ের নাম ছিল ‘চাপড়া’। চপড়ার শিংয়ের অংশকে ছেনি দিয়ে ছেঁচে বহিরাবরণের নরম অংশ (ভূষি) বাদ দেওয়া হতো।
এরপর বোতাম শিল্পীরা বোতাম তৈরি শুরু করতো। তারা কামারশালায় নির্মিত কয়েক রকমের লোহার যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতো। একহাতে লুড়ি ধরে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে অন্যহাতে চলতো হস্তযন্ত্র ব্যবহারের খেলা। প্রথমে বোতামের নকশা নির্দিষ্ট করা হতো। এরপর লোহার কলম দিয়ে দাগ কাটা হতো। ঘূর্ণায়মান অবস্থায় এভাবেই একপিস করে বোতাম কাটা হতো। কাটা বোতামগুলো কয়লার গুড়া ও কম্বলের টুকরা দিয়ে পালিশ করা হতো।
মহিষের শিংয়ের ফাঁপানো অংশটুকু হাতকরাত দিয়ে লম্বালম্বিভাবে কেটে চারখণ্ড করা হতো। প্রতিদিন প্রথম সকালে লোহার চিমটি দিয়ে ধরে সোজা করা হতো। এরপর এই খিং খণ্ডগুলো পুড়িয়ে লোহার চিমটি দিয়ে ধরে সোজা করা হতো। এরপর এই খণ্ডগুলোকে গরম অবস্থায় কাঠের দুটি তক্তার মধ্যে ঢুকিয়ে তক্তার উপরে বসে শরীরের চাপে সোজা করা হতো। এরপর মসৃণ শিং খণ্ডগুলো দু’পায়ের বুড়ো আঙ্গুলে আটকিয়ে মিহি হাত করাত দিয়ে চিরুনির দাঁত কাটা হতো। সমান চিরুনি, মাছের ডিজাইন, নকশী, হাতির মাথা, ময়ূরপঙ্খী প্রভৃতি ডিজাইনে চিরুনি প্রস্তুত করা হতো।
কিন্তু যুদ্ধের তো এক সময়ে সমাপ্তি ঘটে গেল। সেই সাথে এই শিল্পের রমরমা ব্যবসাও বন্ধ হয়ে যেতে থাকলো। তাছাড়া এসব পণ্যের বিকল্প আসতে শুরু করলো। প্লাস্টিক এবং লাইলনের বোতাম ও চিরুনি বাজারে আসল। এসব আধুনিক পণ্য বাজার দখল করে নিল। পাকিস্তান আমলেও এ শিল্প প্রায় মৃত অবস্থায় বেঁচে ছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই শিল্প ঢাকা থেকে পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে যায়।
পুরাতন ঢাকার ব্যবসায়ীদের সফলতার গল্প অনেক পুরাতন। কাঙ্গিসাজ শিল্পেও তারা সফল ছিলেন। এর মাধ্যমে তারা অঢেল অর্থ উপার্জন করেছেন। কিন্তু যারা বাহির থেকে এসে তাদের শিল্প-কারখানায় কাজ করেছিলেন তাদের ভাগ্যের তেমন কোনো পরিবর্তন ঘটেনি তখন। এই সময়টাতে দেশে দুর্ভিক্ষ শুরু হলে সেই সুবিধাও কাজে লাগায় কাঙ্গিসাজ ব্যবসায়ীরা। দুর্ভিক্ষের কারণে কাজের সন্ধানে গ্রাম থেকে যারা ঢাকায় এসেছিলেন তাদেরকে নামমাত্র পারিশ্রমিকের বিনিময়ে প্রচুর কাজ করিয়ে নিতেন তারা। পুঁজিবাদের সময়ে ব্যবসার নীতিটাই যেন এমন। সবমিলিয়ে কাঙ্গিসাজ ছিল পুরাতন ঢাকার আরেকটি সফল শিল্পের গল্প।
ফিচার ইমেজ- phys.org
সূত্র:
১. আনিস আহামেদ, ঢাকাইয়া আসলি, বাংলা একাডেমি, ২০১৪
২. যতীন্দ্রমোহন রায়, ঢাকার ইতিহাস, বইপত্র, ২০১২