মনে কি পড়ে প্যারিসের টানেলে ভয়াবহ সেই মোটর দুর্ঘটনার কথা? তার ঘন্টা কয়েকের মধ্যেই শোকবার্তা প্রকাশ। মারা গেলেন রাজকুমারী ডায়ানা। ঠিক সেই সময়েই তিনি মারা গেলেন, যখন ধীরে ধীরে হয়ে উঠছিলেন আর্তমানবের বন্ধু। রক্ষণশীল রাজপরিবারে ডায়ানা ছিলেন এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তিনি জন্মেছিলেন সোনার চামচ মুখে দিয়েই। নরফোকের বিখ্যাত স্পেনসার পরিবারে ১৯৬১ সালের ১ জুলাই ঘর আলো করে জন্ম হয় প্রিন্সেস ডায়ানার। পৃথিবীর সুন্দরীতমাদের একজন হয়েও সৌন্দর্যের সাথে সাথে ঐশ্বর্য, বুদ্ধি আর বাকপটুতায় ছিলেন অনন্য, আর তাই ক্রমেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন জনতার যুবরানী। ঐশ্বর্য, প্রাচুর্য, রূপ, লাবণ্য, প্রেম ও রাজকীয়তায় কিংবদন্তী যেন এক রূপকথার রানী।
জীবন থেকে বিদায় নেওয়ার আগেই রেখে গেলেন এক অন্তিম আভিজাত্য। কোটি কোটি পুরুষের মনে একরাশ তুফানের ঢেউ খেলানো লাস্যময়ী এই নারী আলোকচিত্রীদের চোখ এড়াতে প্যারিসের টানেলে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। বাঁচতে গিয়েও মরণের ঝাঁপ। আর সেই সাথে দুমড়ে মুচড়ে স্তব্ধ হয়ে গেলো আরেকটি অধ্যায়। এ যেন সুন্দরবনের হিংস্র রয়েল বেঙ্গলের দল ছুটছে বনের সোনার হরিণটিকে শিকারের উদ্দেশ্যে। শেষ পর্যন্ত কাজল নয়না হরিণীর প্রেম-রহস্য উদ্দামতার যবনিকা পতন ঘটল মুহূর্তের মধ্যে। এক বাঁধভাঙা ঢেউ সবকিছু শেষ করে দিয়ে গেল চোখের পলকে।
৩৬ বছরের এই জীবনে বহু পুরুষের সাহচর্যে এসেছিলেন ডায়ানা। প্রিন্স চার্লস যেমন ছিলেন, তেমনি গায়ক ব্রায়ান অ্যাডামস, আর্ট ডিলার অলিভার হোর, বিলিনিয়র ব্যবসায়ী থিওডোর ফোরস্টম্যান থেকে শুরু করে দোদি আল ফায়েদ- সকলেই ডায়ার রূপ লাবণ্য ও ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হয়েছিলেন। কখনো সেই ভালোবাসা ডায়ানার কাছ থেকে প্রকাশ পেয়েছিল, কখনোবা তার পুরুষ সঙ্গীর কাছ থেকে। আবার এদের মধ্যে কেউ ছিল তার খুব ভালো বন্ধু, আবার কেউ ছিল তার সত্যিকারের ভালোবাসা। ডায়ানার জীবনে আসা সেসব পুরুষের কথা জানতে চেষ্টা করবো আজকে।
ইংল্যান্ডের যুবরাজ চার্লস
প্রিন্স চার্লসের সাথে ডায়ানার প্রণয় কাহিনী সেসময় ছিল সারা বিশ্বে বহুল আলোচিত এক খবর। হবে নাই বা কেন! রাজপুত্রের প্রেম এমন একজনের সাথে, যার রূপ-লাবণ্যে মুগ্ধ হয়ে আছে পুরো বিশ্ব। ১৯৭৫-এ স্যানড্রিংহ্যামে থাকাকালীন দুই পরিবারের মধ্যে ঘনিষ্ঠতাও ছিল।
এরপর অনেকবারই চার্লস ও ডায়ানার সাক্ষাত হয়েছে। তখন প্রিন্স চার্লসের বয়স ছিল ৩২ আর প্রিন্সেস ডায়ানার বয়স ২০। দু’জনের মধ্যে মন দেওয়া-নেওয়া পর্বও চলেছে বেশ জমিয়ে। সেই প্রেমের খবর চাপা থাকেনি। বিশ্ব মিডিয়ায় তাদের দুজনের প্রেমের খবর বেশ ফলাও করেই প্রচার হতে থাকে।
প্রিন্স চার্লস ও ডায়ানার এই ভালোবাসা বিয়েতে রূপ নেবে, তা ধরেই নিয়েছিল সবাই। কিন্তু এই বিয়েতে বাধ সাধেন রানী এলিজাবেথ। তিনি কিছুতেই এই বিয়েতে সায় দিচ্ছিলেন না। রাজ পরিবারের মধ্যে চলছে তখন নানা চাপা কথা। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে শেষ পর্যন্ত রানী এই বিয়েতে অনুমতি দেন। শুরু হয় বিয়ের তোড়জোড়। চার্লস ও ডায়ানার বিয়ের কথা বেশ ফলাও করে প্রচার করে বিশ্বের প্রভাবশালী সব গণমাধ্যম। ১৯৮১ সালের ২৯ জুলাই সেই বাকিংহাম প্যালেসের বারান্দায় দাঁড়িয়ে কুড়ি বছরের নববধূ ডায়ানার শান্ত, স্নিগ্ধ চুম্বন আজো ছবিতে অমলিন।
দেহরক্ষী ব্যারি মান্নাকি
ডায়ানা তার মৃত্যুর কয়েক মাস আগে এক সাক্ষাৎকারে জানান যে, তার একান্ত দেহরক্ষী ব্যারি মান্নাকি নাকি ছিলেন তার জীবনের সেরা প্রেমিক। ১৯৮৫ সালে মান্নাকিকে যুবরানী ডায়ানার দেহরক্ষী হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। কিন্তু এক বছর পরই তাকে তাকে সেখান থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
ধারণা করা হয়, ডায়ানার সাথে তার সম্পর্কের কথা রাজপ্রাসাদে জানাজানি হওয়ার পরেই তাকে সেই পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। তবে মান্নাকির জীবনও দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। হঠাৎই ১৯৮৭ সালের এক গাড়ি দুর্ঘটনায় মান্নাকির মৃত্যু হয়। তবে ডায়ানা এই হত্যাকাণ্ডের জন্য পরোক্ষেভাবে রাজপরিবারকেই দায়ী করে গেছেন।
প্রপার্টি কনসাল্ট্যান্ট জেমস গিলবি
জেমস গিলবি ছিলেন একজন প্রপার্টি কনসাল্ট্যান্ট। তিনি ছিলেন ডায়ানার বিয়ে-পূর্ব জীবনের প্রেমিকও। প্রেমিকদের চোখ ধাঁধানো তালিকায় গিলবির স্থান ততটা ‘গুরুত্বপূর্ণ’ সারিতে নেই। তবু ডায়ানার প্রথমদিকের প্রেম হিসেবে গিলবির নামটি সর্বাগ্রে উচ্চারিত হয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত গিলবি এই প্রেম নিয়ে মিডিয়ায় কোনো বক্তব্য রাখেননি। একসময় ডায়ানা-গিলবি প্রেম নিয়ে বেশ হৈচৈ পড়ে যায় সারা ব্রিটেনে।
১৯৮৯ সালের দিকের ঘটনা। ‘নিউ ইয়ার্স ইভ’ উৎসব চলাকালীন ডায়ানা ও গিলবির মধ্যকার এক ফোনালাপ শুনে ফেলে ব্রিটেনের ‘গভর্নমেন্ট কমিউনিকেশনস হেড কোয়ার্টার্স’। কান্নাভেজা গলায় সেই ফোনালাপে শোনা যায় ডায়ানা চার্লসের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছেন,
‘‘আমার জীবনটাকে সত্যি সত্যি সে অত্যাচারে ভরিয়ে দিয়েছে।’’
এই ফোনালাপ প্রকাশের পর সারা বিশ্বে আলোড়নের ঝড় ওঠে। কথিত রয়েছে, গভর্নমেন্ট কমিউনিকেশনস হেড কোয়ার্টার্স থেকেই নাকি ডায়ানাকে অপদস্থ করার জন্য এই ফোনালাপ ফাঁস করে দেয়া হয় ব্রিটিশ গোয়েন্দা দপ্তরের কাছে। যদিও আজ পর্যন্ত গিলবি এই ব্যাপারে কখনো কোনো কথা বলেননি। ২০১৪ সালে লাভিনিয়া হাডসলে চ্যাপলিনকে বিয়ে করেন গিলবি। আজও ‘স্কুইজি টেপস্’ (Squidgy tapes) নামে পরিচিত ডায়ানা-গিলবির সেই ফোনালাপ রেকর্ডটি।
পদাতিক বাহিনীর আধিকারিক মেজর জেমস হিউইট
মেজর জেমস হিউইট ছিলেন ব্রিটেনের পদাতিক বাহিনীর আধিকারিক। টানা পাঁচ বছর এই মেজরের সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয় পড়েছিলেন ডায়ানা। ১৯৯৫ সালের বিবিসির এক প্রোগ্রামে ডায়ানা জানান যে, জেমস হিউইটের সাথে তার প্রেমের সম্পর্ক ছিল।ডায়ানার সাথে হিউইটের সাক্ষাত হয় ১৯৮৬ সালে। ডায়ানাকে ঘোড়ায় চড়া শেখানোর জন্য মেজর হিউইটকে ডেকে আনা হয়। সুদর্শন এই মেজরের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে যুবরানীর। ধীরে ধীরে তাদের মধ্যকার এই সম্পর্ক গাঢ় হতে থাকে।
এই সম্পর্ক ‘৯২ সাল পর্যন্ত টিকে ছিল বলে জানা যায়। পরবর্তীতে জানা যায়, মেজর এই সম্পর্কের সুবাদে একধরনের সুবিধা নেয়ার চেষ্টায় ছিল। ডায়ানার সাথে তার এই সম্পর্কের ফায়দা লুটতে মেজরই নাকি পাপারাজ্জিদের তাদের এই সম্পর্কের নানা খবর দিতে থাকেন। ডায়ানার পাঠানো চিঠিপত্র, কার্ড, এমনকি পাঁচ বছর বয়েসে প্রিন্স উইলিয়ামের হাতের লেখা সম্বলিত দুটো নোটও বিক্রি করে দেওয়ার চেষ্টায় ছিলেন মেজর। ডায়ানার লেখা হিউইটের অধিকাংশ চিঠিই সাদামাটা ধরনের। তবে একটি চিঠিই বেশ তাৎপর্যের।
১৯৮৮ সালের ৪ মার্চে মেজরকে ডায়ানার এরকমই এক চিঠিতে লেখা,
‘‘প্রিয়তম জেমস, তুমি চলে যাওয়ার পর থেকেই এখানের সবকিছুই ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। তার মধ্যে একটা শ্যাম্পেনের বোতলও আছে! তোমার সাথে দেখা পাওয়া সত্যিই আনন্দের!’’
অনেকে বলে থাকেন ডায়ানার দ্বিতীয় পুত্র হ্যারি নাকি এই মেজরের সন্তান। হিউইটের চেহারাগত বেশ সাদৃশ্যও পাওয়া যায় হ্যারির সাথে। তবে জেমস হিউইট বা ডায়ানা কখনোই বিষয়টি স্বীকার করেননি। বর্তমানে ষাটের কাছাকাছি বয়স হিউইটের। চুলেও পাক ধরেছে। শোনা যায়, তিনি নাকি এখন দেউলিয়া। নিঃসঙ্গ হিউইট থাকেন মায়ের সাথে।
পাকিস্তানি ডাক্তার হাসনাত খান
হাসনাত খান ছিলেন লন্ডনে বসবাসকারী পাকিস্তানী বংশোদ্ভূত এক শল্য চিকিৎসক। ১৯৯৫ সালের এক সেপ্টেম্বরে ডায়ানার সাথে তার প্রথম সাক্ষাত হয়। হাসনাত তখন সুদর্শন যুবক। সেসময় তিনি রয়েল ব্রমপ্টন হাসপাতালে কর্মরত হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ। সেদিন ডায়ানা তার এক বন্ধুর চিকিৎসারত স্বামীকে দেখতে ওই হাসপাতালে গিয়েছিলেন। বন্ধুর সেই স্বামীর চিকিৎসক ছিলেন ডা. হাসনাত। এরপর তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। বছর দুয়েক টিকে ছিল এই বন্ধুত্ব। ১৯৯৫ থেকে ১৯৯৭। বন্ধুত্ব থেকে প্রেম। পত্রপত্রিকায় তাদের নিয়ে অসংখ্য ছবিও বেরিয়েছিল সেই সময়।
হাসনাতকে ডায়ানা ‘মিস্টার ওয়ান্ডারফুল’ নামে ডাকতেন। ডায়ানার সম্পর্কে হাসনাতের এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন,
“আমি ডাক্তার,আর ডায়ানা ইংল্যান্ডের যুবরানী, আমাদের দুজনের সম্পর্কে তা কখনো বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। দুটো মানুষের মধ্যে যেমন বন্ধুত্ব থাকে, ঠিক তেমনি আমরা দুজন নিছকই বন্ধু ছিলাম। ”
হাসনাত স্বীকার না করলেও তাদের দুজনের মধ্যকার সম্পর্ক বন্ধুত্বের চেয়েও বেশি ছিল তা জানা যায় যখন ডায়ানা পাকিস্তানে গিয়ে হাসনাতের মা-বাবার সাথে দেখা করেন। এমনকি একবার হাসনাতকে ডায়ানা নিজের গাড়িতে লুকিয়ে নিয়ে যান কেনসিংটন প্রাসাদে। হাসনাতকে বিয়ে করার জন্য ডায়ানা নাকি বন্ধু জেমিমার সাহায্য চেয়েছিলেন। জেমিমা তখন প্রাক্তন ক্রিকেটার ইমরান খানের স্ত্রী। একসময় ডায়ানা-হাসনাতের এই সম্পর্কও ভেঙে যায়। হাসনাতই নাকি এই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসেন। তাদের এই সম্পর্ক নিয়ে লেখক কেট স্নেল ‘ডায়ানা, হার লাস্ট লাভ’ নামে একটি বই লেখেন যা পরবর্তীতে চলচ্চিত্রে রূপ পায়।
বর্তমানে হাসনাত এসেক্সের বেসিলডন ইউনিভার্সিটিতে কর্মরত। ইথিওপিয়ায় তৈরি করেছেন একটি দাতব্য হাসপাতাল। শোনা যায়, ডায়ানার অনুপ্রেরণাতেই নাকি হাসনাত এই হাসপাতালটি নির্মাণ করেন। ২০০৬ সালে বিয়ে করেন। কিন্তু সেই বিয়ে টেকেনি। বছর দেড়েক পর সেই বিয়ে ভেঙে যায়। এখন তিনি তার হাসপাতাল ও সেবামূলক কাজ নিয়ে ব্যস্ত রয়েছেন।
মিশরের যুবরাজ দোদি আল ফায়েদ
যুবরানী ডায়ানার শেষ প্রেম ছিল দোদি আল ফায়েদ। হাসনাত খানের সাথে সম্পর্ক থাকা অবস্থায় যুবরানী মিশরীয় ধনকুবের দোদির প্রেমে পড়ে যান। শুরু থেকেই দোদির সঙ্গে ডায়ানার এই সম্পর্ক নিয়ে রাজপরিবার থেকে শুরু করে ব্রিটেনের জনগণের মধ্যে মিশ্র এক প্রতিক্রিয়া ছিল। এরপর দুজনেই পড়লেন পাপারাজ্জিদের খপ্পরে। একবার এই দুইজন ছুটি কাটাতে গিয়ে তাদের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি ক্যামরাবন্দী হয়ে ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বের বিভিন্ন মিডিয়াতে।
কিন্তু রাজকুমারীকে ঘরনী করার স্বপ্ন বাস্তবিকই অসম্পূর্ণ থেকে গেল দোদির। একই সঙ্গে মৃত্যুর দেশে নতুন ঘর সাজানোর আশায় যেন পাড়ি দিলেন দুজনেই। মৃত্যুর শেষ সময়েও দুজন ছিলেন একসাথে। সালটা ১৯৯৭ এর ৩১ আগস্ট। পাপারাজ্জিদের চোখ এড়িয়ে ফায়েদের বাবর ‘রিটজ হোটেলের পিছন দিক দিয়ে ডায়ানা ও দোদি গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে পড়েন। উদ্দেশ্য দোদির ফ্ল্যাট। গাড়িতে তাদের সঙ্গে ছিল দোদির দুজন স্টাফও।
প্যারিসের পন্ট-ডি-আলমা রোড টানেল পাড়ি দেওয়ার সময় তাদের গাড়ি দুর্ঘটনায় পড়ে। দুর্ঘটনাগ্রস্ত হওয়ার পর দোদি এবং গাড়ির ড্রাইভার হেনরি সাথে সাথেই মারা যান। আহত হওয়া সত্ত্বেও বেঁচে যান দোদির দুই স্টাফ। আর ডায়ানা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন পরবর্তী তিন ঘন্টার মধ্যে। আর এভাবে ডায়ানা ও দোদির পথচলা চিরজীবনের জন্য থেমে যায়।
ফিচার ইমেজ- IBTimes UK