‘অর্থই অনর্থের মূল’ কিংবা ‘Money Can’t Buy Happiness’ ধরনের বুলি যতই আওড়ানো হোক না কেন, অর্থ ছাড়া একেবারেই চলা সম্ভব নয়। আর এ টাকা-পয়সা উপার্জনের জন্য মানুষের চেষ্টারও তাই কোনো শেষ নেই। এ প্রচেষ্টায় কেউ করে চাকরি, কেউবা করে ব্যবসা। যে ব্যবসা করে, তার অধীনে আবার অন্যরা করে চাকরি। এভাবেই চলতে থাকে জীবিকার্জনের কঠিন সংগ্রাম। তারপরও এ পৃথিবীতে আমাদের চেনা-জানা গন্ডির বাইরে এমন অনেক জীবিকার্জনের উপায় আছে, যা শুনলে আশ্চর্য না হয়ে পারা যায় না। এগুলোর কিছু কিছু যেমন মারাত্মক হাসির খোরাক জোগান দেয়, তেমনি কিছু কিছু উপায় আমাদের চোখগুলোকে বিস্ময়ে বড় বড় করে ছাড়ে। টাকা-পয়সা রোজগারের জন্য বর্তমান পৃথিবীতে প্রচলিত বিচিত্র কিছু উপায় নিয়েই সাজানো হয়েছে আজকের পুরো লেখা।
সাপের বিষ সংগ্রহকারী
‘সাপ’ শব্দটা শুনলেই তো অধিকাংশ মানুষের গা ভয়ে শিউরে ওঠে। এর বিষ সংগ্রহ করা তো পরের কথা। কিন্তু পৃথিবীতে বেশ কিছু মানুষের পেশাই হলো র্যাট্লস্নেক, কোবরা এবং এমনই আরো বিষধর সাপদের বিষ সংগ্রহ করা। এ বিষগুলোই পরবর্তীতে সাপের বিষের প্রতিষেধক তৈরির উদ্দেশ্যে চলে যায় বিভিন্ন গবেষণাগারে। এর প্রতি গ্রামের দাম পড়ে ১,০০০ ইউএস ডলারের কাছাকাছি!
হিমশৈল অপসারণকারী
১৯১২ সালে আরএমএস টাইটানিকের মর্মান্তিক দুর্ঘটনার পরই হিমশৈল সরানো একটি পেশার রুপ নেয়। ১৯১৩ সালে ইন্টারন্যাশনাল আইস পেট্রল প্রতিষ্ঠিত হয় যা যুক্তরাষ্ট্রের কোস্ট গার্ডের অধীনে পরিচালিত। বিভিন্ন হিমশৈলের অবস্থান শনাক্ত করে এর পাশে দিয়ে নিরাপদে জাহাজ যাওয়ার রাস্তা বাতলে দেয়াই তাদের কাজ। দরকার হলে হিমশৈলটিকে ঐ জায়গা থেকে সরানোর ব্যবস্থাও করা হয়।
পেশাদার শোক প্রকাশকারী
পশ্চিমা বিশ্বে বোধহয় মৃতদের জন্য শোক প্রকাশের লোকেরও কখনো কখনো অভাব হয়। তাই এমন মানবিক ও দুঃখজনক এক পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করেও সেখানে গড়ে উঠেছে এক অদ্ভুত ব্যবসা।
ভাড়ায় পেশাদার শোক প্রকাশকারী পাওয়া যায় সেখানে। সেই লোকটির কাজ হবে কোনো শেষকৃত্যানুষ্ঠানে গিয়ে মৃত ব্যক্তির জন্য শোক প্রকাশ করা। এমনকি ইংল্যান্ডে এ নিয়ে ভালোই ব্যবসা করে এক কোম্পানি, নাম ‘Rent A Mourner’। দুই ঘন্টায় ৭০ ইউএস ডলার হারে তারা একেকজন শোক প্রকাশকারীকে ভাড়া দিয়ে থাকে!
ডগ সার্ফিং ইনস্ট্রাক্টর
বিদেশের বিভিন্ন ওশান রিসোর্টে এ পেশাজীবীদের দেখা মেলে। আপনার পাশাপাশি আপনার পোষা কুকুরটিকেও সার্ফিং শেখার ব্যবস্থা করে দেয় তারা।
অপরিচিত কাউকে জড়িয়ে ধরে থাকা
কাউকে জড়িয়ে ধরাটা সাধারণত আবেগের উষ্ণতম বহিঃপ্রকাশ। তবে কারো কারো কাছে অপরিচিতদের সাথে এভাবে উষ্ণ আলিঙ্গনে থাকাটাই পেশা।
‘কাড্লার’ নামে এক অদ্ভুত পেশা আছে। ইংরেজি ‘কাড্ল (Cuddle)’ শব্দটির আভিধানিক অর্থ ‘পরস্পর জড়াজড়ি করে আরামে শোয়া’। সুতরাং প্রফেশনাল কাড্লাররা যে এ জিনিসটিকেই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছে তা আর আলাদা করে না বললেও চলে। অবশ্য বর্তমান দুর্মূল্যের বাজারে কোনো কিছুই ফ্রি না! শুধুমাত্র এমন উষ্ণ আলিঙ্গন মাখা সেবা দিয়ে ঘন্টায় ৮০ ইউএস ডলার হারে অর্থও কামিয়ে নিচ্ছে পেশাদাররা!
ফেস ফীলার
এ পেশার মানুষেরা ‘সেন্সরি সায়েন্টিস্ট (Sensory Scientist)’ বা ‘ইন্দ্রীয় সম্বন্ধীয় বিজ্ঞানী’ নামেও পরিচিত। বিভিন্ন লোশন, মুখমণ্ডল পরিষ্কারক কিংবা রেজর কতটা কার্যকরভাবে কাজ করছে সেটির বিচার-বিশ্লেষণ করাই তাদের কাজ। আর বিচিত্র এ কাজটি করে ঘন্টায় ২৫ ইউএস ডলারের মতো ঠিকই পকেটে পুরে নেন তারা।
ছাইয়ের কারিগর
এখন যে পেশাটির কথা বলতে যাচ্ছি সেটি অবশ্য বেশ অদ্ভুত। কারণ এখানে একজন শিল্পীর শিল্প ফুটে ওঠে মৃত ব্যক্তির দেহের সংস্পর্শে!
মৃতদেহ সৎকারের যেসব প্রথা প্রচলিত আছে মানবসমাজে, শবদাহ করা এর মাঝে একটি। এ পেশায় নিয়োজিত একজন শিল্পী মৃত ব্যক্তির সেই পোড়ানো দেহের ছাইকেই তার শিল্পের জন্য ব্যবহার করেন। কেউ কেউ সেই ছাইয়ের সাথে বিভিন্ন রাসায়নিক মিশিয়ে কোনো ছবি এঁকে দেন। কেউ আবার নেকলেস কিংবা কাঁচের উপর শিল্পকর্ম ফুটিয়ে তোলেন।
পোষা প্রাণীদের খাদ্য চেখে দেখা
যেকোনো খাবারের খেতে গেলেই প্রথম যে প্রশ্নটি মনে আসে তা হলো, “খেতে মজা হবে তো?” মানুষ নাহয় খাওয়ার পর মন্তব্য করতে পারবে। কিন্তু ঘরে থাকা কুকুর-বেড়ালের জন্য বাজার থেকে কোনো খাবার কিনে আনলে তারা কি বলতে পারবে- “ভাই/আপু, খাবারটা চরম হইছে!”? এসব পশুখাদ্যের স্বাদ পরীক্ষা করার কাজটিও তাই মানুষেরাই করে থাকে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা খাবারটি গিলে ফেলেন না, শুধু স্বাদ পরীক্ষা করেই ফেলে দেন মুখ থেকে। simplyhired.com এর তথ্যমতে- চাকরির ভৌগলিক অবস্থান, প্রতিষ্ঠান ও অভিজ্ঞতা ভেদে একজন ডগ ফুড টেস্টারের বার্ষিক আয় ৪০,০০০ ইউএস ডলার পর্যন্ত হতে পারে।
চিকেন সেক্সার
পেশার নাম দেখেই অনেকের চোখ-মুখ কুঁচকে যাওয়ার কথা। কেউ কেউ আগ বাড়িয়ে ভাবতে পারে যে, এ পেশার লোকদের হয়তো…। থাক, এত ভাববার দরকার নেই। খোলাসা করে দিচ্ছি বিষয়টি।
মুরগির বাচ্চার লিঙ্গ নির্ধারণের কাজই করে থাকেন এ পেশাজীবীরা। মূলত যুক্তরাজ্য ও জাপানেই খুঁজে পাওয়া যাবে তাদের। একেকজনের বার্ষিক আয়ও কিন্তু কম না, প্রায় ৬০,০০০ ইউএস ডলার!
লাইনে দাঁড়ানোর চাকরি
কোনোকিছু কিনতে, বিদ্যুত-টেলিফোন ইত্যাদির বিল দিতে বা দৈনন্দিন জীবনের আরো নানা কাজে লাইনে দাঁড়াবার অভিজ্ঞতা আমাদের সবারই আছে। তবে অপেক্ষার প্রহর যত দীর্ঘায়িত হয়, বিরক্তির মাত্রাও হয়ে যায় ততই আকাশ ছোঁয়া। আর এ বিরক্তি থেকে মানুষকে মুক্তি দিতে কেউ কেউ লাইনে দাঁড়ানোকেই নিজেদের পেশা বানিয়ে নিয়েছে।
আপনার পক্ষ থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে আপনার পছন্দের জিনিসটি কিনে এনে দেয়াই তাদের কাজ। এমন অদ্ভুত কাজ করে কেউ কেউ আবার সপ্তাহে ১,০০০ ইউএস ডলার করেও আয় করে থাকেন!
ফরচুন কুকি লিখিয়ে
নিজের ভবিষ্যত কেমন যাবে তা নিয়ে মানুষের আগ্রহের শেষ নেই। বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকার ‘রাশিচক্র’ পাতাটি দেখলেই এ কথার সত্যতা উপলব্ধি করা যায়।
ফরচুন কুকি হলো ময়দা, চিনি, ভ্যানিলা ইত্যাদির সংমিশ্রণে বানানো ছোট্ট এক ধরনের কেক। এর ভেতরে একটি কাগজে আপনার ভবিষ্যত কেমন যাবে সেই সম্পর্কে কিছু লেখা থাকে। আর এসব লিখে দেয়ার জন্যও আছে বিভিন্ন ফ্রিল্যান্সার। ehow.com এর তথ্যানুযায়ী- শুধুমাত্র এসব লিখেই কেউ কেউ বছরে ৪০,০০০ ইউএস ডলার পর্যন্ত কামিয়ে থাকেন!
হাঙ্গরের ট্যাঙ্ক পরিষ্কারক
হাঙ্গর মাছের নাম শুনলেই ধারালো দাঁতওয়ালা হিংস্র এক মাছের প্রতিচ্ছবি ভেসে ওঠে আমাদের মনে। তবে মজার কথা হলো, এখন পর্যন্ত সন্ধান পাওয়া প্রায় ৪৮০টি হাঙ্গরের প্রজাতির মাঝে মাত্র ৩-৪টি মানুষের মৃত্যুর কারণ!
বিভিন্ন চিড়িয়াখানায় জীবন্ত হাঙ্গরদের যেসব ট্যাঙ্কে রাখা হয় সেগুলো পরিষ্কার রাখা, পানির গুণগত মান ঠিক রাখা, হাঙ্গরকে সময়মতো খাবার দেয়া কিংবা মাঝে মাঝে ফটোগ্রাফারদের অনুরোধে হাঙ্গরদের সাথে বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গিমায় ছবি তোলাই তাদের কাজ।
বমি সংগ্রাহক
পেশাটির নাম পড়েই যে কারো গা ঘিনঘিন করবে। তবে এমন পেশার অস্তিত্বও আছে দুনিয়ায়। বিভিন্ন অ্যামিউজমেন্ট পার্কে দেখা মেলে এ পেশাজীবীদের। রোলার কোস্টারের মতো বিভিন্ন রাইডে চড়ার পর অনেকেই কিছুটা শারীরিক অসুস্থায় ভোগেন, কেউ কেউ বমিও করে থাকেন। আর এসব জায়গায় বমি পরিষ্কার করাই তাদের কাজ।
ডাইস ইন্সপেক্টর
লুডু কিংবা মনোপলি খেলায় একটু পরপরই ছুঁড়ে দেয়া ডাইসের সাথে পরিচয় আছে আমাদের সবারই। বড় বড় ক্যাসিনোগুলোতে বিভিন্ন খেলায় ব্যবহার করা হয় এগুলো। সেখানে একেকটি চালেই নির্ধারিত হয়ে যায় মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের ভাগ্য। তাই সেখানের ডাইসগুলোও হতে হয় নিখুঁত। সামান্য আঁচড়, কোনো পাশের সামান্য অসামঞ্জস্যতাও হয়ে যেতে পারে বিরাট বড় প্রতারণার কারণ। এজন্য সেখানকার ডাইসগুলো ব্যবহারের পূর্বে সেগুলো পরীক্ষা করার জন্য একজন ডাইস ইন্সপেক্টরও থাকেন।
ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে অর্থ আয়
ঘুমাতে ভালোবাসে না এমন মানুষ বোধহয় খুঁজে পাওয়া যাবে না। আর পছন্দের এ ঘুমের বদৌলতে যদি কিছু অর্থের সমাগম ঘটে, তাহলে তো সোনায় সোহাগা!
বছরখানেক আগে হেলসিঙ্কির এক হোটেলের কথা খবরে এসেছিলো যারা ঘুমের জন্য মানুষকে অর্থ দিতে রাজি। তবে শর্ত হলো- সেই মানুষটিকে ৩৫ দিন হোটেলটির ৩৫টি বিছানায় রাত কাটাতে হবে। আর প্রতিটি বিছানায় রাত কাটানোর অভিজ্ঞতা নিয়ে ব্লগে লিখতে হবে! অনেক সময় আবার গবেষকরা ঘুম নিয়ে গবেষণার জন্যও মানুষজনকে অর্থ দিয়ে থাকেন। তখন অবশ্য ঘুমানোর সময় তাদের গায়ে বিভিন্ন ইলেকট্রোড ও ইলেকট্রনিক ডিভাইস লাগানো থাকে যাতে করে প্রয়োজনীয় বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করা যায়।