শার্লক হোমসকে আমরা দুঁদে গোয়েন্দা হিসেবেই জানি। এই দুঁদে গোয়েন্দার খুব মজার একটা তত্ত্ব আছে। শার্লক হোমসের জবানীতে স্যার আর্থার কোনান ডয়েলের এই তত্ত্বকে বলা যেতে পারে, ‘মগজ-কুঠুরি তত্ত্ব’। ‘অ্যা স্টাডি ইন স্কারলেট’ উপন্যাসে ডা. ওয়াটসনের মাধ্যমে শার্লক হোমসকে পাঠকের সাথে পরিচয় করান স্যার আর্থার কোনান ডয়েল। শার্লকের জ্ঞানের বিষয়ে ওয়াটসনের পর্যবেক্ষণ ছিল অনেকটা এরকম যে, সে কিছু বিষয়ে অগাধ জ্ঞান রাখে, কিন্তু কিছু বিষয়ে অবিশ্বাস্য রকমের অজ্ঞ। যেমন- কোনো মাটির নমুনা দেখে সে মুহূর্তে বলে দিতে পারে কোথাকার মাটি, কিন্তু পৃথিবী যে সূর্যের চারদিকে ঘোরে সেটা সে জানেই না! কিংবা অ্যানাটমিতে তার অনেক জ্ঞান, কিন্তু রাজনৈতিক জ্ঞান তার শূন্যের কোথায়। এ ব্যাপারে শার্লকের মত,
মানবমস্তিস্ক এক শূন্য ঘরের মতো, সেই ঘরে কী জিনিস রাখবে সেই সিদ্ধান্ত তোমার। তুমি চাইলে ঘরকে অপ্রয়োজনীয় জিনিস দিয়ে বোঝাই করতে পারো, আবার প্রয়োজনীয় জিনিসও রাখতে পারো। অপ্রয়োজনীয় জিনিস দিয়ে ঘর বোঝাই করলে প্রয়োজনীয় জিনিসটা সহজে খুঁজে পাওয়া যায় না, ঠিক তেমনি অদরকারি জ্ঞান দিয়ে মাথা বোঝাই করলে, কাজের জিনিস আর সহজে মনে পড়ে না। তাই যে জিনিস জানার প্রয়োজন নেই, তা জেনে মাথা বোঝাই করে কী লাভ?
শার্লক হোমসের এই তত্ত্বের মাধ্যমে আমরা জ্ঞানার্জনের একটা মূলনীতি লক্ষ্য করি, আর তা হলো- সব বিষয়ে অল্প অল্প না জেনে, কিছু নির্দিষ্ট বিষয়ে অনেক বেশি জ্ঞানার্জন, যাকে বলা যায় স্পেশালিস্ট বা বিশেষজ্ঞ হওয়া।
তাহলে সব বিষয়ে কিছু কিছু জ্ঞান থাকার কি কোনো প্রয়োজন নেই? আসলে এই ‘Generalist Vs Specialist’ বিষয়ক বিতর্ক বেশ পুরনো। এর কোনটা ভালো এর কোনো সর্বজনগ্রাহ্য উত্তর নেই। তবে এটা সত্যি যে সমাজ তথা বিশ্ব চালাতে এই দুই দলেরই প্রয়োজন আছে। কারণ দুই দল দুভাবে সমাজে কাজে লাগে।
জ্যাক অফ অল ট্রেডস বা সকল কাজের কাজী
কাউকে ‘সকল কাজের কাজী’ বলা হলে ব্যাপারটা একটু নেতিবাচক হিসেবেই দেখা হয়। কিন্তু এই প্রবাদের পুরোটার দিকে যদি তাকাই, তা হলো-
‘Jack of all Trades, Master of None; Oftentimes Better than Master of One.”
এর মানে দাঁড়াচ্ছে, কখনো কখনো বিশেষজ্ঞ লোকের চেয়ে একজন সব বিষয়ে কিছু জ্ঞানসম্পন্ন লোক বেশি উপকারে আসে।
সব বিষয়ে কিছু কিছু জ্ঞানার্জন- বিষয়টি আসলে ততটা সহজও নয়। উদাহরণস্বরুপ- একজন ইঞ্জিনিয়ারের ইতিহাস বিষয়ে বিষদ পড়াশোনা থাকতে পারে, একজন ডাক্তারের আধুনিক প্রযুক্তি বিষয়ে ভালো জ্ঞান থাকতে পারে, কিংবা কোনো বড় আইনবিদ সাহিত্য বিষয়েও অনেক জ্ঞান রাখতে পারেন। এই বাড়তি জ্ঞানের জন্য কিন্তু ব্যক্তিকে একটু বেশি সময় ও শ্রম দিতে হয়, নিজের ফিল্ডের বাইরে পড়াশোনা করতে হয়, খোঁজখবরও রাখতে হয়। সেক্ষেত্রে দেখা যায় যে, তার জ্ঞানের পরিধি বেশ বিস্তৃত হয়।
বিশেষজ্ঞদের গল্প
এবার বিশেষজ্ঞ অর্থাৎ নির্দিষ্ট বিষয়ে দক্ষ দলের দিকে তাকানো যাক। বিশেষজ্ঞ কাদের বলা হয়? যাদের কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে সাধারণের চেয়ে অনেক বেশি জ্ঞান ও দক্ষতা রয়েছে। বিশেষজ্ঞ বা এক্সপার্ট কেউ একদিনে হয় না। এজন্য প্রয়োজন দীর্ঘদিনের সাধনা, অধ্যবসায় আর পরিশ্রম- যার কোনোই বিকল্প নেই। কোনো বিষয়ে বিশেষজ্ঞের তকমা লাগাতে গেলে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। কখনো জীবনের স্বাভাবিক ছন্দও হারাতে হয়। নির্দিষ্ট বিষয়ে পারদর্শী হতে গিয়ে অন্য বিষয়গুলোর দিকে আর তাকানোরই সুযোগ হয় না। সেজন্য অন্যান্য বিষয়ে জ্ঞানার্জনের সুযোগও হয়তো তাদের হয় না।
ভারসাম্য রাখা জরুরি
এ দু’দলের মাঝে নির্দিষ্ট এক দল ভালো, অন্য দল খারাপ- এমনটা বলার অবকাশ নেই। দুটো দলেরই প্রয়োজন আছে, এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো এ দুইয়ের মাঝে ভারসাম্য করা। আমরা যদি আমাদের শিক্ষাজীবন আর কর্মজীবনের দিকে তাকাই তাহলে বিষয়টা আরও ভালভাবে বোঝা সম্ভব।
স্কুলজীবনে আমরা সবকিছুই শিখি- গণিত, বিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, সাহিত্য ইত্যাদি। উচ্চ মাধ্যমিকে গিয়ে সায়েন্স, আর্টস, কমার্স এ তিনভাগে ভাগ হয়, অর্থাৎ স্পেশালাইজেশনের দিকে একধাপ এগিয়ে যাই। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্দিষ্ট বিষয়ে পড়াশোনা করে গ্র্যাজুয়েট হই, তারপর আরও স্পেশালাইজেশনের জন্য পোস্ট গ্র্যাজুয়েট, ডক্টরেট, পোস্ট ডক্টরেট করে চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে যাই।
কিন্তু কর্মক্ষেত্রে আবার ব্যাপারটা উল্টোদিকে ঘুরতে থাকে। চাকরির একদম শুরুতে নির্দিষ্ট কোনো পোস্টে প্রবেশ করি, সেখানে বিশেষ জ্ঞান আর পারদর্শীতার প্রয়োজন হয়। এরপর আস্তে আস্তে যখন উচ্চপদে যেতে শুরু করি, তখন নিজক্ষেত্রের পাশাপাশি সার্বিক আরো অনেক বিষয়ে জানার প্রয়োজন হয়। একজন কর্মীকে তার নিজের কাজের বাইরে না জানলেও হয়তো চলে, কিন্ত কর্মক্ষেত্রে যারা নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে কাজ করেন তাদেরকে তাদের নির্দিষ্ট ক্ষেত্রের বাইরেও একাউন্টিং, ম্যানেজমেন্ট, হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট, দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা, মানুষের চাহিদা ইত্যাদি আরও অনেক বিষয়ে ধারণা রাখতে হয়। যার জ্ঞানের বিস্তৃতি যত বেশি, তার পারফরম্যান্সও তত ভালো হয়।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, বিশেষজ্ঞ মানুষের যেমন প্রয়োজন আছে, তেমনি ‘সকল কাজের কাজী’ হওয়াও কখনো কখনো বেশ গুরুত্বপূর্ণ। আর এ দুয়ের মধ্যে চমৎকার ভারসাম্য বজায় রেখে যদি চলা যায়, তবে তো সোনায় সোহাগা।
এখন পাঠক, Generalist হবেন নাকি Specialist হবেন নাকি General Specialist হবেন- তা আপনারই সিদ্ধান্ত!