বিশ শতকের প্রথমভাগের সবচেয়ে প্রভাবশালী দুজন কবির একজন হচ্ছেন ডব্লিউ বি ইয়েটস্ (১৮৬৫-১৯৩৯); যিনি আধুনিক কবিতায় ছড়ি ঘোরান। অপরজন হচ্ছেন টি এস এলিয়ট (১৮৮৮-১৯৬৫)। মজার ব্যাপার হচ্ছে দুজনই বহিরাগত! ইয়েটস্ ছিলেন জন্মসূত্রে আইরিশ আর এলিয়ট যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণ করেন; কিন্তু লেখাপড়া এবং সেটলড হন ইংল্যান্ডে। ১৯২৭ সালে ইংল্যান্ডের নাগরিকতা গ্রহণ করে ইংল্যান্ডেই স্থিতধী হয়ে যান। ইয়েটস অসংখ্য কবিতা লেখেন এবং তার বিখ্যাত কবিতার সংখ্যাও প্রচুর। অন্যদিকে এলিয়টের খ্যাতির পেছনে কাজ করে দুটি কাব্য : দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড (১৯২২) এবং ফোর কোয়ারটেটস্ (১৯৪৩)। তার আরেকটি বিখ্যাত কবিতা হচ্ছে ‘দ্য লাভ সং অব জে আলফ্রেড প্রুফ্রক’।
বিশ শতকের প্রথম ভাগটাতে ইংরেজি উপন্যাস ও কথাসাহিত্যে নেতৃত্বের আসনে ছিলেন জোসেফ কনরাড, হেনরি জেমস ও জেমস জয়েস। তাদের বেলায়ও একই কথা প্রযোজ্য। কেউই মূল ভূখ- ইংল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করেননি। জোসেফ কনরাড (১৮৫৭-১৯২৪) ছিলেন পোলিশ। তার বাবা-মা দেশ থেকে পালিয়ে ইংল্যান্ডে আশ্রয় নেয়। বিশ বছর পার করে ইংরেজি ভাষার সাথে পরিচিত হন, শেখেন এবং সে ভাষায় সাহিত্য রচনা করেন। হার্ট অব ডার্কনেস, লর্ড জিম ও নস্ট্রোমোর লেখক বিশ শতকের সবচেয়ে প্রভাবশালী লেখকদের একজন। তার লেখা পরবর্তীকালে অনেক উত্তর-ঔপনিবেশিক লেখক-চিন্তকদের বেশ উসকে দিয়েছে। আমাদের সময়ের শক্তিশালী চিন্তক এডওয়ার্ড সাঈদ থেকে শুরু করে বাংলাদেশের অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর মতো লেখক কনরাডের ওপর পিএইচডি করেছেন; যা তার গুরুত্বকে বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। রুডইয়ার্ড কিপলিং, ই এম ফ্রস্টার থেকে শুরু করে জোসেফ কনরাডরা পোস্ট কলোনিয়াল স্টাডিতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে হেনরি জেমস (১৮৪৩-১৯১৬) জন্মসূত্রে আমেরিকান আর জেমস জয়েস (১৮৮২-১৯৪১) ছিলেন আইরিশ।
বিশ শতকের প্রথমভাগে উল্লেখযোগ্য লেখকরা হচ্ছেন জর্জ বার্নার্ড শ (১৮৫৬-১৯৫০), এইচ জি ওয়েলস্ (১৮৬৬-১৯৪৬), ই এম ফ্রস্টার (১৮৭৯-১৯৭০), ডি এইচ লরেন্স (১৮৮৫-১৯৩০), জর্জ ওরওয়েল (১৯০৩-১৯৫০), ভার্জিনিয়া ওল্ফ (১৮৮২-১৯৪১) প্রমুখ। জেমস জয়েস, ডি এইচ লরেন্স ও ভার্জিনিয়া ওল্ফ তাদের সাহিত্যে মানবচরিত্র ও মননের সেই অংশটা নিয়ে আসে যা আগের সাহিত্যিকরা করে নাই। সেই সময়ে সিগমুন্ড ফ্রয়েডদের হাত ধরে সমৃদ্ধ হতে থাকা সাইকোলজি ও সাইকোএনালিসিসের সার্থক সাহিত্যিক রূপ দেন তারা।
ভিক্টোরীয় যুগ কাব্য আর উপন্যাসে ছিল সমৃদ্ধ; কিন্তু নাটকে বন্ধ্যা। বিশ শতকের শুরু থেকে নাটকের দৃশ্যপট পাল্টাতে শুরু করে। অনেক জনপ্রিয় ও শ্রেষ্ঠ নাটক মঞ্চায়িত হতে থাকে। ইংরেজি নাটকে তখনকার গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র ছিলেন জর্জ বার্নার্ড শ (১৮৫৬-১৯৫০)। শেক্সপিয়রের পরে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ ইংরেজ নাট্যকার হচ্ছেন জর্জ বার্নার্ড শ। তার বিখ্যাত নাটকগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ‘ম্যান অ্যান্ড সুপারম্যান’ (১৯০৩), পিগমেলিয়ন (১৯১২) এবং সেইন্ট জোয়ান (১৯২৩)।
আধুনিক উপন্যাসকলায় জেমস জয়েস (১৮৮২-১৯৪১), ভার্জিনিয়া ওল্ফ (১৮৮২-১৯৪১), ডি এইচ লরেন্স (১৮৮৫-১৯৩০) সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নাম। তারা প্রায় একই সময়ে দাঁড়িয়ে উপন্যাসকে ভিক্টোরীয় যুগ থেকে আধুনিক যুগে নিয়ে আসে। জেমস জয়েসের তিনটি উপন্যাসই শ্রেষ্ঠ উপন্যাসের সারিতে পড়ে। ১৯২২ সালে প্রকাশিত ‘ইউলিসিস’ উপন্যাসের মাধ্যমে তিনি এমন এক সৃষ্টিকর্ম নিয়ে আসেন, যা ‘কয়েক শ বছরে পণ্ডিতদের মাথা কুটে মরার জন্য’ যথেষ্ট। এর আগে প্রকাশিত ‘অ্যা পোর্ট্রেট অব দ্য আর্টিস্ট এজ এন ইয়াং ম্যান’ (১৯১৬) এবং সর্বশেষ প্রকাশিত ‘ফিনেগানস ওয়েক’ও (১৯৩৯) গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যকর্ম। ‘ফিনেগানস ওয়েক’ সাহিত্যের সবচেয়ে দুর্বোধ্য সৃষ্টিকর্মের একটি।
ভার্জিনিয়া ওল্ফ ছিলেন সময়ের সবচেয়ে সাহসী ও প্রত্যয়ী নারী। নারীদের বিভিন্ন সংকট ও সাহিত্যক্ষেত্রে তাদের সম্ভাবনা ও প্রতিবন্ধকতা নিয়ে লিখেছেন বিস্তর। আধুনিক উপন্যাসে নারীদের ভূমিকা, লেখালেখির জগতে থাকার জন্য যে নিজের একটি রুম থাকা লাগে, সেটা নিয়ে লিখেছেন ‘অ্যা রুম অব ওয়ানস ওন’এবং নারীদের কেমন পেশা হতে পারে তা নিয়ে ‘প্রফেশনস ফর উইমেন’। ভার্জিনিয়া ওলফের সবচেয়ে বিখ্যাত দুটি উপন্যাস হচ্ছে মিসেস ডালওয়ে (১৯২৫) এবং ‘টু দ্য লাইটহাউস’(১৯২৭)।
আধুনিক সাহিত্যে ইকারাসের মিথ
গ্রিক মিথের ইকারাসের মতো ওড়ার দুরন্ত বাসনা যেমন তার মহাপতন নিয়ে এসেছে, তেমনি তার মহাপতনও যে মহাসফল তার উদাহরণ হচ্ছে তার কয়েক হাজার বছর পরে সেই মানবপ্রজাতি চাঁদ জয় করে ও সৌরজগৎ ভ্রমণ শেষে মহাবিশ্বে উড়ে বেড়াচ্ছে। মানুষ এখন ইকারাসের পাখা নিয়ে শুধু একাই ঘুরে বেড়াচ্ছে না, কয়েক শ লোককে একসাথে নিয়ে বিশাল ফড়িংয়ের পেটে আরামসে ভ্রমণ করছে হাজার হাজার মাইল।
ইকারাসের এই মিথটি ইংরেজি সাহিত্যে সফল প্রয়োগ করেছেন সাহিত্যের জন্য শহীদ (!) জেমস জয়েস। তার ‘দ্য পোর্ট্রেট অব দ্য আর্টিস্ট এজ অ্যান ইয়াং ম্যান’-এর স্টিফেন দেদালাস চরিত্রটি নির্মাণের মাধ্যমে।স্টিফেন দেদালাসকে আমরা তার ‘ইউলিসিস’ ও ‘ফিনেগেনস ওয়েক’ উপন্যাসেও পাই। স্টিফেন দেদালাস নামটির দুটি অংশ ‘স্টিফেন’ ও ‘দেদালাস’।
দেদালাস ছিলেন শিল্পী মানুষ, ইকারাসের বাবা। রাজার দ্বীপান্তর নির্বাসনের শাস্তি থেকে বাঁচার জন্য আকাশপথই বাছাই করেছিলেন। কারণ জলপথ ও স্থলপথে রাজার সৈন্য সামন্ত প্রহরায় ছিল। মোমের তৈরি সেই পাখা মেলে ওড়ার আগে বাবা দেদালাস ছেলে ইকারাসকে সতর্ক করেছিলেন যেন সে এত ওপরে না ওঠে, যার কারণে সূর্যের কাছে চলে যায় আবার সাগরের কাছেও যেন চলে না যায়; যার কারণে পাখায় পানি জমে পাখা ভারী হয়ে যায়। তাকে অনুসরণ করার আদেশ দিয়ে আকাশে উড়ছিলেন বাবা-ছেলে।
কিন্তু নতুন পাওয়া পাখা এবং ওড়ার ক্ষমতা দিয়ে সে যেন ওপরের দিকেই উড়তে ছিল। এটা এক অপূর্ব স্বাধীনতা! মানুষ দেখল সে দেবতার মতো, ঈশ্বরের মতো, স্বর্গদূতের মতো আকাশে উড়ছে। ইকারাস যেন মানুষের দুর্দমনীয় জানার আকাঙ্খা, অর্জন, দেখা ও জয় করার আকাঙ্খার সার্থক প্রতিমূর্তি। সেই ইকারাস ঠিকই সেই আকাঙ্খার বলে একসময় সূর্যের কাছাকাছি চলে যায়। কিন্তু মোমের পাখা গলে যেতে থাকে ইকারাসের। একসময় দেখে সে শুধু হাত দিয়েই ঝাপটাচ্ছে কিন্তু আর উড়তে পারছে না। শেষে আকাশ থেকে একটি সাগরে পরে সলিলসমাধি ঘটে।
ইকারাসের এই মহাপতন কয়েক হাজার বছর ধরে মানুষের কল্পনাশক্তিকে মসলা সরবরাহ করেছে। ইকারাস এবং তার বাবা দেদালাসের আকাশে ওড়ার অদম্য আকাঙ্খা, এর একদিকে সফল ও অন্যদিকে ব্যর্থ প্রয়াস বিভিন্নভাবে শিল্প, সাহিত্য ও নাটকে উঠে এসেছে। ক্রিস্টোফার মার্লোর ডক্টর ফস্টাস একটি সার্থক উদাহরণ। বিশ শতকে জেমস জয়েস এই মিথটাকে সবচেয়ে সফলভাবে ব্যবহার করেছেন।
শিল্প হচ্ছে শিল্পীর কাছে সেই ইকারাসের ডানা, যার মাধ্যমে দূর আকাশে, দূর অতীতে বা দূর ভবিষ্যতে উড়ে বেড়ানো যায়। জেমস জয়েস ইংরেজি সাহিত্যের দেদালাস। ইকারাসের বাবার মতো শিল্পী তিনি, শিল্পের জন্য ত্যাগ করেছেন অনেক; দেশ, পরিবার এমনকি ধর্ম। সাহিত্য হয়ে উঠে তার কাছে আরাধ্য বিষয় এবং সেই মন্দিরেই সারা জীবনের সব পূজা জমা করেছেন। দেদালাস যেমন উড়ে গিয়ে মুক্ত হতে পেরেছেন, কিন্তু সেই মুক্তির ফলও যে কম তেঁতো নয়! একজন বাবার সব সাফল্যই ম্লান হয়ে যায় ছেলের এমন করুণ মৃত্যুর কাছে।
জয়েস তার ‘ইউলিসিস’নিয়ে বলেছিলেন, তিনি সেখানে এমন সব রসদ দিয়েছেন, যা আগামী কয়েক শতকের সাহিত্য সমালোচকদের মাথা কুটে মরার জন্য যথেষ্ট। বিশ্বকে তিনটি কালজয়ী উপন্যাস, একগুচ্ছ ছোটগল্প, অনেকগুলো কবিতা উপহার দিয়ে গেলেও তার মৃত্যুর পর শেষকৃত্য পরিচালনার মতো যথেষ্ট টাকা ছিল না তার পরিবারে। তার বইয়ের প্রকাশকের সহায়তায় সেটা সমাধা হয়েছিল। জয়েসের কথা বলার কারণ হলো শিল্পীদের দেদালাসের মতো এমন অর্জন বিসর্জনের সহবাসের মধ্য দিয়েই যেতে হয়। কোনো অর্জনই যেন সম্পূর্ণ অর্জন নয়, পেছনে অনেক বিসর্জনের কাহিনিও থাকে।
ফরাসি কবি শার্ল বোদলেয়ার বলেছিলেন, ‘কবিরা এত বড় ডানাওয়ালা পাখা নিয়ে উড়ে বেড়ায় যে তারা মাটিতে পা রাখতে পারে না।’ কবিদের কল্পবিলাস, কল্পনার জগতে বসবাসের বিষয়টি, সীমানার বাইরে চিন্তা করার বিষয়টি অত্যন্ত সুন্দরভাবে এ উক্তিটির মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। জেমস জয়েস ছিলেন খুব খুঁতখুঁতে ও নাক উঁচা শিল্পী। সেটা খুব অল্প বয়সেই তার মধ্যে ধরা পড়ে। বিশ-একুশ বছর বয়সের দিকে তখনকার ইংরেজি কবিতা ও সাহিত্যজগতের সরদার ডব্লিউ বি ইয়েটসের সাথে সাক্ষাৎ হয়। ইয়েটস ভেবেছিলেন সেই তরুণ ছোকরা হয়তো তার কাছ থেকে আশীর্বাদ ও কোনো টিপস নিতে এসেছেন। কিন্তু জেমস জয়েস উল্টোটাই করেছিলেন! ‘আমার বয়স বিশ, তোমারটা কত? তুমি আসলে এতই বুড়ো যে তোমাকে পাল্টানো যাবে না!’
ইয়েটসের সাথে মোলাকাতের সময়টা ছিল ১৯০৩। ‘ডাবলিনারস’ নামক একটি ছোটগল্প সংকলন এবং কয়েকটি কবিতা ছাড়া তেমন কোনো বিশিষ্ট সাহিত্যকর্ম প্রকাশ পায়নি জয়েসের। ১৮৮২ সালে জন্মসাল হওয়ায় তার বয়স তখন কত ছিল সেটা আমরা হিসাব করে দেখতেই পারি। সাহিত্যাঙ্গনের বেয়াদবির ইতিহাসে এটি সবচেয়ে শক্তিশালী বলা যায়। জয়েস যে শুধু কথার কথা বা পাগলামি বা বেয়াদবিবশতই কিছু বলেননি তার পরবর্তী সৃষ্টিকর্ম। জয়েস নিজেকে এমন এক জায়গায় নিয়ে যান, যার কারণে তাকে সাহিত্যিকদের সাহিত্যিক মনে করা হয়।