Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

যার জীবনের ঘটনা অবলম্বনে তৈরি হয়েছে রূপকথার আলাদিন

আলাদিন নামটির সাথে আমরা সবাই কমবেশি পরিচিত। ‘আলদিনের জাদুর চেরাগ’ গল্পটি আরব্য রজনীর সবচেয়ে জনপ্রিয় গল্পগুলোর একটি। ১৯৯২ সালের ডিজনির ক্লাসিক চলচ্চিত্রটি ছাড়াও আলাদিনের কাহিনী নিয়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দেশে একাধিক কার্টুন এবং চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। এ বছরও হলিউড নতুন করে আলাদিনকে নিয়ে নির্মাণ করেছে একটি লাইভ অ্যাকশন চলচ্চিত্র

আলাদিনের গল্পটি সবার পড়া না থাকলেও কিংবা ১৯৯২ সালের ডিজনির ক্লাসিক চলচ্চিত্রটি দেখা না থাকলেও অন্তত এটুকু নিশ্চয়ই সবার জানা আছে, আলাদিনের একটি চেরাগ ছিল এবং সেই চেরাগে ঘষা দিলে দৈত্য বেরিয়ে এসে তার ইচ্ছা পূরণ করত। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আলাদিনের এ গল্পের প্রধান উৎস কী? এটি কি নেহাতই রূপকথার গল্প? নাকি এই চরিত্রের পেছনে আসলেই কোনো সত্যিকার বালক ছিল?

২০১৯ সালের আলাদিন চলচ্চিত্র; Image Source: Disney

আলাদিনের গল্পটি আরব্য রজনীর গল্প হিসেবে পরিচিত হলেও বাস্তবে এটি হচ্ছে আরব্য রজনীর বিচ্ছিন্ন গল্পগুলোর মধ্যে একটি। আরব্য রজনীর বিচ্ছিন্ন গল্প বলতে সাধারণত সেই গল্পগুলোকে বোঝানো হয়, যেগুলো মূল আরবি পাণ্ডুলিপি তথা ‘আলফ লাইলা ওয়া লাইলা’য় ছিল না। এই গল্পগুলো পরবর্তীতে আরব্য রজনীর ফরাসি বা ইংরেজি সংস্করণে যুক্ত হয়, কিন্তু এগুলোর মূল উৎস সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায় না। আলাদিন ছাড়াও আলিবাবা এবং সিন্দবাদের গল্প দুটিও এরকমই বিচ্ছিন্ন গল্প।

আলাদিনের জাদুর চেরাগের গল্পটির প্রথম সন্ধান পাওয়া যায় ১৭১২ সালে ফরাসি পণ্ডিত অঁতোয়া গ্যাঁলো (Antoine Galland) কর্তৃক প্রকাশিত আরব্য রজনীর অনুবাদে। অঁতোয়া গ্যাঁলো ছিলেন ইস্তাম্বুলে নিযুক্ত ফরাসি রাষ্ট্রদূতের সেক্রেটারি। ইস্তাম্বুল থেকে তিনি একাধিকবার সিরিয়ায় ভ্রমণ করেন। সে সময়ই তিনি চতুর্দশ শতকে লিপিবদ্ধ ‘আলফ লাইলা ওয়া লাইলা’র একটি পাণ্ডুলিপির সন্ধান পান।

দেশে ফিরে এসে তিনি ধারাবাহিকভাবে আরব্য রজনীর গল্পগুলো অনুবাদ করতে শুরু করেন। তার অনুবাদের শিরোনাম ছিল Les mille et une nuits: Contes Arabes তথা 1001 Nights: Arabian tales, যা পরবর্তীতে ইংরেজিতে সংক্ষিপ্ত আকারে শুধুমাত্র Arabian Nights তথা আরব্য রজনী হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। অঁতোয়া গ্যাঁলোই ছিলেন আলফ লাইলার প্রথম ইউরোপীয় অনুবাদক।

অঁতোয়া গ্যাঁলো; Image Source: J. Cazon, Kean Collection/Getty Images

তার অ্যারাবিয়ান নাইটস সিরিজের গল্পগুলো প্রকাশিত হয় ১৭০৪ থেকে ১৭১৭ সাল পর্যন্ত। এরমধ্যে আলাদিনের গল্পটি প্রকাশিত হয় ১৭১২ সালে। কিন্তু তার প্রকাশিত অধিকাংশ গল্পই মূল আরবি পাণ্ডুলিপি থেকে অনুবাদকৃত হলেও আলাদিনের গল্পসহ আরব্য রজনীর শেষ কয়েকটি খণ্ডের গল্পগুলোর কোনো সন্ধান মূল আরবি পাণ্ডুলিপিতে পাওয়া যায় না। বরং গ্যাঁলোর ডায়েরি থেকে জানা যায়, আলাদিনের গল্পটি তিনি কোনো পাণ্ডুলিপি থেকে পাননি। গল্পটি তিনি শুনেছিলেন হানা দিয়াব নামে এক সিরিয়ান বালকের মুখে

গ্যাঁলোর কাছে আরব্য রজনীর যে মূল পাণ্ডুলিপিটি ছিল, সেটি ছিল অসম্পূর্ণ। ১৭০৪ সাল থেকে ১৭০৯ সালের মধ্যে তিনি আটটি খণ্ডে সেখানকার সবগুলো গল্প অনুবাদ করে ফেলেন। কিন্তু সিরিজটির জনপ্রিয়তা এবং বিপুল চাহিদা লক্ষ্য করে তার প্রকাশক অষ্টম খণ্ড পূর্ণ করার জন্য সেখানে কিছু তুর্কি গল্পের অনুবাদ সংযোজন করে দেন। প্রকাশকের এই অসততায় গ্যাঁলো বেশ অসন্তুষ্ট হন এবং নিজেই আরো আরব্য রজনীর সন্ধান করতে শুরু করেন।

সে সময় প্যারিসে পল লুকাস নামে এক গুপ্তধন শিকারী এবং অভিযাত্রী বসবাস করতেন। তিনি সম্রাট চতুর্দশ লুইয়ের পক্ষ হয়ে প্রাচীন সমাধির ভেতরে থাকা গুপ্তধন সংগ্রহ করার জন্য নিয়মিত মধ্যপ্রাচ্যে যাতায়াত করতেন। সিরিয়ার আলেপ্পোতে ভ্রমণকালে তার সাথে হানা দিয়াব নামে এক বালকের পরিচয় হয়। তিনি তাকে তার অনুবাদক এবং সহকারী হিসেবে নিযুক্ত করেন এবং পরবর্তীতে সাথে করে ফ্রান্সে নিয়ে আসেন। এই পল লুকাসের বাসায়ই ১৭০৯ সালে গ্যাঁলো প্রথম দিয়াবের সাক্ষাৎ পান।

ডিজনির ১৯৯২ সালের আলাদিন; Image Source: Disney

ডায়েরির বর্ণনা অনুযায়ী, গ্যাঁলো দিয়াবের কাছ থেকে আরব্য রজনীর গল্প শুনতে চাইলে দিয়াব তাকে অনেকগুলো গল্প বলে। পরবর্তী দিনগুলোতে গ্যাঁলো দিয়াবের সাথে অনেকগুলো বৈঠক করেন এবং তার কাছ থেকে অনেকগুলো গল্প শুনে সেগুলো লিপিবদ্ধ করেন। এই গল্পগুলোর একটি ছিল আলাদিনের গল্প, অন্য একটি ছিল আলিবাবার গল্প। এই গল্পগুলোকেই গ্যাঁলো পরবর্তীতে তার অনুদিত আরব্য রজনীর নবম থেকে দ্বাদশ খণ্ডে স্থান দেন।

গ্যাঁলো তার আরব্য রজনীর অনুবাদে দিয়াবের নাম উল্লেখ না করলেও তার ডায়েরির কল্যাণে গবেষকরা দীর্ঘদিন ধরেই জানতেন যে, আলাদিনের মূল কাহিনী তিনি দিয়াবের কাছ থেকেই শুনেছিলেন। কিন্তু তারা এটা জানতেন না, দিয়াব গল্পটা কোথা থেকে শুনেছে। সে কি গল্পটা আরব্য রজনীর ভিন্ন কোনো পাণ্ডুলিপিতে পড়েছে, নাকি আলেপ্পোর কোনো গল্প বলিয়ের কাছ থেকে শুনেছে, নাকি এটা নিছকই তার নিজের বানানো গল্প- এটা নিয়ে গবেষকরা দীর্ঘদিন ধরেই ধোঁয়াশার মধ্যে ছিলেন।

রহস্যের আংশিক সমাধান হয় ১৯৯৩ সালে, যখন ভ্যাটিক্যান লাইব্রেরি থেকে দিয়াবের নিজের লেখা একটা ভ্রমণ কাহিনীর পাণ্ডুলিপি উদ্ধার করা হয়। এই ভ্রমণ কাহিনীতে দিয়াব নিজেও গ্যাঁলোর সাথে সাক্ষাতের কথা এবং তাকে আলাদিনের গল্প শোনানোর কথা উল্লেখ করেছে। এখান থেকেও অবশ্য আলাদিনের গল্পটির মূল উৎস জানা যায় না। কিন্তু এই ভ্রমণকাহিনীতে এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উল্লেখ আছে, যা গবেষকদেরকে আলাদিনের উৎস সম্পর্কে নতুন চিন্তার খোরাক যুগিয়েছে।

আলাদিন ও তার চেরাগের দৈত্য; Image Source: Disney

হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ও মধ্যপ্রাচ্যের সংস্কৃতি বিষয়ের বাঙ্গালি গবেষক আরাফাত আব্দুর রাজ্জাক মনে করেন, আলাদিন চরিত্রটির মাধ্যমে হানা দিয়াব আসলে তার জীবনের গল্পই বর্ণনা করেছে। এটা মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে। গল্পে বর্ণিত আলাদিনের মতোই দিয়াবের ছোটকালে একটি দোকানের মালিক হওয়ার শখ ছিল। আলাদিনের মতোই দরিদ্র পরিবারে বড় হওয়া দিয়াবের সমাজে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ইচ্ছা ছিল। এবং শেষপর্যন্ত নানান প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে আলাদিনের মতো সেও জীবনে সফল হয়েছিল।

আলাদিনের গল্পে মাগরেব থেকে আসা এক জাদুকর আলাদিনকে ব্যবহার করে গুহার ভেতরে লুকানো জাদুর চেরাগ উদ্ধার করার জন্য। বাস্তব জীবনেও ফ্রান্স থেকে যাওয়া এক গুপ্তধন শিকারী পল লুকাস দিয়াবকে নিয়োগ করে গুপ্তধনের সন্ধানের সময় তাকে সাহায্য করার জন্য। গল্পের জাদুকর আলাদিনকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। বাস্তবেও পল লুকাস দিয়াবকে ফরাসি রাজদরবারে চাকরি দেয়ার ভ্রান্ত প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। সবচেয়ে নাটকীয় মিল হলো, লুকাসের সাথে প্রথম সমাধিক্ষেত্রের অভিযানে দিয়াব একটি আংটি এবং চেরাগ খুঁজে পেয়েছিল, ঠিক গল্পের মতোই।

এখানেই শেষ না। গল্পে অচেনা চীন দেশে আলাদিন বিশাল বিশাল প্রাসাদ দেখে মুগ্ধ হয়। আর বাস্তব জীবনে দিয়াব ফ্রান্সের ভার্সেই শহরের বিশাল বিশাল অট্টালিকা এবং রাজপ্রাসাদ দেখে মুগ্ধ হয়। গবেষকরা লক্ষ্য করেন, দিয়াবের ভ্রমণ কাহিনীর বর্ণনাভঙ্গির সাথে গ্যাঁলোর অনুদিত মূল আলাদিনের গল্পের বর্ণনাভঙ্গির প্রচুর মিল পাওয়া যায়। কাজেই এটা খুবই যৌক্তিক যে, আলাদিন গল্পটি আসলে হানা দিয়াবেরই আংশিক আত্মজীবনী।

১৯২৮ সালে মার্কিন চিত্রশিল্পীর অঙ্কনে চীনা আলাদিন; Image Source:  Virginia Frances Sterrett/ ajammc.com

ডিজনির কল্যাণে যদিও এখন অনেকেই মনে করে আলাদিনের ঘটনাগুলো মধ্যপ্রাচ্যে বা পারস্যে ঘটেছিল, কিন্তু বাস্তবে গ্যাঁলোর মূল অনুবাদে আলাদিনের ঘটনাগুলো ঘটেছিল চীনে। সে সময়ের অনেক ইউরোপীয় অনুবাদের সাথে সংযুক্ত চিত্রকর্মে আলাদিনকে চীনাদের মতো পোশাকেও উপস্থাপন করা হয়েছিল। পরবর্তীতে অনেকে আলাদিনের ঘটনাকে পারস্যে চিত্রায়িত করেন এই কারণে যে, আরব্য রজনীর যে প্রধান চরিত্র রাজা শাহরিয়ার, তিনি ছিলেন পারস্যের রাজা।

তবে আলাদিনের মূল গল্পে চীনের নাম থাকলেও বর্ণনার মধ্যে তৎকালীন চীনের সাথে কোনো মিল পাওয়া যায় না। বরং গল্পের ভেতরে যাদের নাম উল্লেখ করা হয়, তাদের সবার নামই আরব। গল্পের রাজাকে সুলতান বলে সম্বোধন করা হয়। এমনকি যে রাজকন্যাকে ডিজনির কল্যাণে আমরা জেসমিন বলে চিনি, মূল গল্পে তার নাম ছিল আরবি নাম বদরুল বদর, যার অর্থ পূর্ণিমার পূর্ণ চাঁদ।

১৮৯০ সালে চীনা আলাদিন; Image Source: Thomas Dalziell/ ajammc.com

এসব কারণে আরাফাত আব্দুর রাজ্জাক মনে করেন, দিয়াব তার গল্পে চীন বলতে ভৌগলিক চীনকে বোঝায়নি। চীন দিয়ে সে বরং দূরের কোনো ভূমিকে বুঝিয়েছে। সে সময় আরবিতে দূরের দেশ বোঝাতে অনেক সময়ই চীনের নাম উল্লেখ করা হতো। উদাহরণ হিসেবে হাদিস হিসেবে পরিচিতি পাওয়া বিখ্যাত একটি আরবি প্রবাদে জ্ঞান অর্জনের জন্য যে চীন দেশে যেতে উৎসাহিত করা হয়েছিল, ধারণা করা হয় সেখানেও ভৌগলিক চীন না বুঝিয়ে দূরদেশে যাওয়ার কথাই বলা হয়েছিল।

আলাদিন তাই হতে পারে অষ্টাদশ শতাব্দীর আলেপ্পোর এক বালকের গল্প, যে এক গুপ্তধন শিকারীর মিথ্যা আশ্বাসে নিজের মাতৃভূমি ছেড়ে দূর দেশে পাড়ি জমিয়েছিল। সেখানে আরেক লেখকের সাথে পরিচিত হওয়ায় সে তার নিজের জীবনের গল্পকেই রূপকথার আদলে বর্ণনা করেছিল। কিন্তু বেচারা জানতও না, তার গল্পই শতশত বছর ধরে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ কমিক্স, কার্টুন, চলচ্চিত্র এবং ভিডিও গেম হিসেবে উপভোগ করে যাবে!

This article is in Bangla language. It is about the original writer and original source of the famous Arabian Nights story "Aladdin and the Magic Lamp". All the references are hyperlinked inside the text.

Featured Image: Disney

Related Articles