উইলিয়াম শেক্সপিয়র, ক্রিস্টোফার মার্লো, বেন জনসনের মতো নাট্যকার বা জন মিল্টন, শেলি, কিটস, বায়রনের মতো কবি বা জোনাথন সুইফট, চার্লস ডিকেন্স, জেন অস্টিনের মতো লেখকরা বিশ্ব দরবারে ব্রিটিশদের জয়কেতনের ঝাণ্ডা তুলে রেখেছিলেন কয়েক শতাব্দী ধরে। কিন্তু এখন মূল ভূমি ইংল্যান্ড থেকে কি আগের মতো রথী-মহারথীরা বের হচ্ছে? এরকম প্রশ্ন অনেক নবীন সাহিত্য পাঠকদের মাথায় নাড়া দেয়।
নোবেল পুরস্কার যদিও সেরা সাহিত্যিকের একমাত্র মানদণ্ড নয় কিন্তু বিশ শতকের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত সাহিত্যের এ পুরস্কারটিকে অনেক মর্যাদা দেওয়া হচ্ছে। কতজন ব্রিটিশ সাহিত্যিক নোবেল পেলেন সেটা জানা মন্দ হয় না। প্রসঙ্গক্রমে এটা বলে রাখি এ লেখাটির শেষ পর্বে আমি দেখানোর চেষ্টা করব বিশ্বসাহিত্যের কত সব রথী-মহারথী নোবেল পুরস্কার পাননি কিন্তু সাহিত্যের দুনিয়ায় তাদের স্থানের একটুও স্খলন ঘটেনি। চলুন, জেনে নিই কোন কোন ব্রিটিশ সাহিত্যিক নোবেল পুরস্কার পেলেন—
রুডইয়ার্ড কিপলিং (১৮৬৪-১৯৩৬)
১৯০৭ সালে রুডইয়ার্ড কিপলিং ছিলেন প্রথম ব্রিটিশ নাগরিক, যিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। তিনি ইংরেজি ভাষায় প্রথম নোবেল বিজয়ীও বটে। আমাদের এই ভারতবর্ষের বম্বে নগরীতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং জীবনের একটা বড় অংশ কাটিয়েছেন এই ভারতবর্ষেই। এ জন্য তার লেখাতে ভারতবর্ষ ও ভারতবর্ষের প্রতি ইংরেজদের দৃষ্টিভঙ্গির ছাপ লক্ষ্য করা যায়। তার বিখ্যাত রচনাগুলো হচ্ছে— দ্য জঙ্গল বুক, কিম, দ্য হোয়াইট ম্যান বারডেন।
জন গালস্ওর্থি (১৮৬৭-১৯৩৩)
মৃত্যুর মাত্র এক বছর আগে নোবেল বিজয়ী এই সাহিত্যিক হচ্ছেন দ্বিতীয় ব্রিটিশ। ১৯৩২ সালে নোবেল বিজয়ী এই সাহিত্যিকের গুরুত্বপূর্ণ সৃষ্টিকর্ম হচ্ছে ‘দ্য ফোর্সিদ স্যাগা’, ‘অ্যা মডার্ন কমেডি’, ‘এনড অব দ্য চ্যাপ্টার’।
টি এস এলিয়ট (১৮৮৮-১৯৬৫)
জন্মসূত্রে আমেরিকান হলেও পরবর্তীকালে ব্রিটিশ নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন। এলিয়ট শুধু একজন শ্রেষ্ঠ ইংরেজ কবিই নয়; বরং তিনি বিশ্ব কবিতার একটি সোনালি ফসল। ইউরোপীয় সাহিত্যচিন্তা ও কবিতায় তার প্রভাব যেমন অনেক, তেমনি বাংলা কবিতার ত্রিশ ও চল্লিশের দশকে তিনি ছিলেন অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক। ত্রিশের দশকের কবিরা রবীন্দ্রনাথের মতো বটবৃক্ষের ছায়া ফেলে যেসব অতিকায় অশ্বথগাছের ছায়ায় আশ্রম গেড়েছিলেন, টি এস এলিয়ট তাদের অন্যতম। তার পূর্বসূরি এজরা পাউন্ডের সাথে মিলে তিনি আধুনিক কবিতায় অনেক বিপ্লবী পরিবর্তন নিয়ে আসেন। দুটি বিশ্বযুদ্ধের মাঝখানে কবিতায় সবচেয়ে সার্থক ভয়েস হচ্ছেন এলিয়ট। ১৯২২ সালে প্রকাশিত ‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড’ বিশ্বকবিতার একটি মাইলফলক। ‘দ্য হলো ম্যান’, ‘ফোর কোয়ার্টেট’ তার অন্য দুটি কাব্য। ‘ট্রাডিশন অ্যান্ড ইনডিভিজ্যুয়াল ট্যালেন্ট’ ইংরেজি গদ্য সাহিত্যের ইতিহাসে একটি উল্লখযোগ্য সংযোজন। ১৯৪৮ সালে সাহিত্যে নোবেল পেয়েছিলেন এলিয়ট।
বার্ট্রান্ড রাসেল (১৮৭২-১৯৭০)
রাসেলের নোবেল জয় সাহিত্যে নোবেল জয়ের কয়েকটি ব্যতিক্রমী ঘটনার একটি। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের ইতিহাস গ্রন্থ ‘হিস্ট্রি অব দ্য সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ার’-এর জন্য নোবেল বিজয় যেমন আমাদের বিস্মিত করে, তেমনি গত শতকের প্রখ্যাত দার্শনিক, গণিতবিদ বার্ট্রান্ড রাসেলের সাহিত্যে নোবেল বিজয় বিস্মিত করবে। তবে আপনার বিস্ময় পকেটে লুকিয়ে রেখে জেনে নিতে হবে রাসেল সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান ১৯৫০ সালে।
১৯৪৫ সালে প্রকাশিত ‘এ হিস্ট্রি অব ওয়েস্টার্ন ফিলোসফি’ এবং ‘ম্যারিজ অ্যান্ড মোরালস্’ (বিয়ে ও নৈতিকতা) নাম নেওয়া হয় নোবেল প্রদান উৎসবে। নোবেল পুরস্কার যদি না-ও পেতেন তার অবস্থান একটুও ক্ষুণ্ন হতো না। দুটি ভয়ংকর, আত্মঘাতী, ভাতৃঘাতী বিশ্বযুদ্ধের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ইউরোপের সংখ্যালঘু যুদ্ধবিরোধী পণ্ডিতদের সরদার ছিলেন রাসেল। এ জন্য তিনি যেমন প্রভূত সম্মান পেয়েছেন, তেমনি তার ভাগ্যে জুটেছে কারাবাস।
উইনস্টন চার্চিল (১৮৭৪-১৯৬৫)
ব্রিটেনের ইতিহাসে সবচেয়ে বিখ্যাত চরিত্র, শ্রেষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে স্বীকৃত উইনস্টন চার্চিল কেবল একজন দক্ষ যুদ্ধকালীন নেতাই ছিলেন না, ছিলেন একজন দক্ষ লেখক ও ঐতিহাসিক। তার শ্রেষ্ঠ লেখাগুলো হচ্ছে ‘হিস্ট্রি অব দ্য সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ার’, ‘অ্যা হিস্ট্রি অব দ্য ইংলিশ স্পিকিং পিপল’।
তার পূর্বপুরুষদের ইতিহাস নিয়ে লেখেন ‘মার্লবরো : হিজ লাইফ অ্যান্ড টাইমস্’। ১৯৫৩ সালে নোবেল পুরস্কার দেওয়ার সময় নোবেল কমিটি উল্লেখ করে, ‘his mastery of historical and biographical description as well as for brilliant oratory in defending exalted human values’.
উইলয়াম গোল্ডিং (১৯১১-১৯৯৩)
১৯৮২ সালে নোবেল বিজয়ী এই ইংরেজ লেখকের সবচেয়ে বিখ্যাত সাহিত্যকর্ম হচ্ছে— ‘লর্ড অব দ্য ফ্লাইজ’।
হ্যারল্ড পিন্টার (১৯৩০-২০০৮)
বিশ শতকের শেষ পঞ্চাশ বছর ইংরেজি নাট্যকলার মঞ্চ যে সবচেয়ে বেশি আলোকিত করে রেখেছিলেন, তিনি হ্যারল্ড পিন্টার। ২০০৫ সালে নোবেল বিজয়ী এই নাট্যকারের উল্লেখযোগ্য নাট্যকর্ম হচ্ছে— দ্য বার্থডে পার্টি (১৯৫৭), দ্য হোমকামিং (১৯৬৪), দ্য বিট্রেয়াল (১৯৭৮)।
ডরিস লেসিং (১৯১৯-২০১৩)
সবচেয়ে বেশি বয়সে নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিক ডরিস লেসিং হচ্ছেন এখন পর্যন্ত নোবেল বিজয়ী সর্বশেষ ব্রিটিশ। ২০০৭ সালে তিনি যখন সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান, তখন তার বয়স হয়েছিল ৮৮ বছর। ইরানে জন্মগ্রহণ করেছেন, বড় হয়েছেন জিম্বাবুয়েতে। সেখান থেকে আফ্রিকাতে চলে আসেন লেখালেখি করবেন বলে। তারপর আফ্রিকা থেকে দুই সন্তান ফেলে চলে আসেন লন্ডনে! ১৯৫০ সালে প্রকাশিত তার প্রথম উপন্যাস ‘দ্য গ্রাস ইজ সিঙ্গিং’-এর মাধ্যমে মহাসমারোহে সাহিত্য দুনিয়ায় প্রবেশ করেন। তার আলোচিত সৃষ্টিকর্মগুলোর মধ্যে রয়েছে— দ্য গোল্ডেন নোটবুক (১৯৬২), দ্য গুড টেরোরিস্ট (১৯৮৫), দ্য সুইটেস্ট ড্রিম (২০০১)।
ইংরেজি ভাষায় লেখার জন্য নোবেল বিজয়ীর তালিকা করলে সেটা অনেক বড় হবে ঠিকই কিন্তু জাতিতে ব্রিটিশ নোবেল বিজয়ীর সংখ্যা অতটুকুই।
এবার একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে কথাটা তুলি— আচ্ছা নোবেল বিজয় কি সেরা সাহিত্যিক মাপার একমাত্র প্যারামিটার? আবার অনেক বড় বড় সাহিত্যিক যারা নোবেল পাননি, তাদের কি মানহানি ঘটায় নোবেল পুরস্কারের অনুপস্থিতি? এই যেমন, টলস্টয়, মার্ক টোয়েন, আন্তন চেখভ, এমিল জোলা, ম্যাক্সিম গোর্কি। এছাড়া টমাস হার্ডি, জন আপডাইক, আর্থার মিলার, বার্টল্ট ব্রেখ্ট, অগাস্ট স্ট্রিনবার্গ, ফ্রান্জ কাফকা, জোসেফ কনরাড, গার্সিয়া লোরকা, ডি এইচ লরেন্স, হেনরি জেমস, হোর্হে লুই বোর্হেসদের নাম এই তালিকাটাকে কেবল দীর্ঘই করবে। পরের লেখাটিতে আমরা দেখবো কীভাবে বিশ্বসাহিত্যের এসব রথী-মহারথী নোবেল পাননি।