অপু, দূর্গা, নিশ্চিন্দিপুর, রেলগাড়ি, হরিহর, সর্বজয়া- এই কথাগুলো শুনলে মাথায় একটি নাম আপনাআপনিই চলে আসে- ‘পথের পাঁচালী’। পথের পাঁচালী পড়ে কাঁদেননি এমন পাঠক খুঁজে পাওয়া কঠিন। লেখকের জাদুকরী হাতে বানানো গল্পের এমনই ধাঁচ যে, এর প্রতি পরতে পরতে লুকিয়ে থাকা ঘটনাগুলো পাঠককে সেই ঘটনার একটি অংশ করে ফেলে খুব সহজেই। পথের পাঁচালীর স্রষ্টা বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়। শুধু পথের পাঁচালীই নয়, এর মতন এমন আরো বহু কালজয়ী সাহিত্যের জন্ম হয়েছে তাঁর হাতে।
বিভূতিভূষণের জন্ম সম্পর্কে তাঁর পিতার লেখা খাতায় যে বিবরণটি আছে সেটি নিম্নরূপ:
“১৩০১ সাল, ২৮শে ভাদ্র বুধবার দিবা সাড়ে ১০ ঘন্টার সময় আমার বিভূতিভূষণ পুত্রের জন্ম হয়। মুরাতিপুর গ্রামে। ইঙ্গরাজী ১৮৯৪ সাল, ১২ই সেপ্টেম্বর।”
তৎকালীন যশোর জেলার বনগ্রাম মহকুমার বারাকপুর গ্রামে এই প্রকৃতিপ্রেমী সাহিত্যিকের পিতৃনিবাস। ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের সময় বনগ্রাম মহকুমা ভারতের চব্বিশ পরগণা জেলার অন্তর্ভুক্ত হয়। বিভূতিভূষণের বাবা মহানন্দ বন্দোপাধ্যায় শাস্ত্রী ও মা মৃণালিনী। মহানন্দ সে অঞ্চলের একজন নামকরা কথক ও সংস্কৃত পণ্ডিত ছিলেন। তার ভ্রমণের নেশাও ছিলো প্রবল। কিছুটা কবিরাজি জানতেন। বিভূতিভূষণের প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় বাবার কাছেই। ছোটবেলায় প্রতিদিনই তার একটি করে বর্ণপরিচয়ের বই লাগতো। মানে সকালে নতুন বই দিলে বিকেলের মধ্যেই সেটা দফারফা করে দিতেন। বিভূতিভূষণের বাবাকে তাই একসাথে সারা মাসের বই কিনে রাখতে হতো।
বিভূতিভূষণের বাবা কিছুটা ভবঘুরে প্রকৃতির ছিলেন। ফলে সংসারে অভাব অনটন লেগেই থাকতো। বিভূতিভূষণ খুব ছোট থাকতেই তার বাবা মারা যান। ফলে অভাব আরো প্রকট হয়ে উঠে। বিভূতিভূষণকে খুব কষ্ট করে পড়াশোনা করতে হয়েছিলো। বনগ্রামে থাকার সময় তাকে বহুদূরের রাস্তা পাড়ি দিয়ে স্কুল করতে হতো। বালক বিভূতিভূষণ পল্লীগ্রামের রাস্তার দু’ধারের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভীষণ রকমের আচ্ছন্ন ছিলেন। পল্লীপ্রকৃতির প্রতি এই টান তার সৃষ্ট বিভিন্ন সাহিত্যকর্মে ফুটে উঠেছে। তাকে প্রকৃতির বরপুত্র বললে ভুল হবে না বোধ করি। তার প্রতিটি সৃষ্টির রূপ রস তিনি ছেনে এনেছিলেন প্রকৃতি থেকে, প্রকৃতির কাছাকাছি বাস করা মানুষদের জীবন থেকে।
১৯১৪ সালে বিভূতিভূষণ বনগ্রাম উচ্চ ইংরাজি বিদ্যালয় থেকে প্রবেশিকা এবং ১৯১৬ সালে কলকাতা রিপন কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। এরপর ১৯১৮ সালে রিপন কলেজ থেকেই বি. এ পাস করেন। জীবনের সিংহভাগ সময় বিভূতিভূষণ মূলত শিক্ষকতার কাজেই নিয়োজিত ছিলেন। তার প্রথম স্ত্রী গৌরী দেবী বিয়ের এক বছরের মাথাতেই মারা যান। এ সময়ই বিভূতিভূষণ হুগলির এক স্কুলের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। সেখানেই মূলত তার সাহিত্যচর্চা শুরু হয়। বিভূতিভূষণের প্রথম গল্প ‘উপেক্ষিতা’ প্রকাশিত হয় বাংলা ১৩২৮ সনের মাঘ মাসে।
বিভূতিভূষণের শ্রেষ্ঠ কাজগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ‘পথের পাঁচালী’। এটি বিভূতিভূষণের প্রথম উপন্যাস। পথের পাঁচালী তৎকালীন বিখ্যাত সাময়িকী ‘বিচিত্রা’য় মাসিক ভিত্তিতে প্রকাশিত হতো। মূলত পল্লীগ্রামের একটি পরিবারের নিত্যদিনের দুঃখ-সুখের কাহিনীই এই গল্পের মূল উপজীব্য। অপু আর দুর্গার সাহচর্য পাঠককে তার শৈশবে ফিরিয়ে নিতে বাধ্য। পথের পাঁচালীর ছত্রে ছত্রে বিভূতিভূষণ মূলত তার চোখে দেখা জীবনকেই ফুটিয়ে তুলেছেন। পড়তে গেলে তাই কোথাও অতিরঞ্জিত মনে হয় না। ‘দুর্গা’ চরিত্রটির ধারণা তিনি কোথা থেকে পেয়েছিলেন তার খানিকটা আভাস পাওয়া যায় বিভূতিভূষণের দিনলিপি ‘স্মৃতির রেখা’ থেকে। লাইনগুলো হুবহু তুলে ধরা হলো-
“আজ সকালে মাহেন্দ্র ঘাট থেকে স্টীমারে হরিহর ছত্রমেলা দেখতে গিয়ে কত কি দেখলাম। ভেটারীনারী হাসপাতালে জিনিসপত্র রেখে টমটমে বেরুলাম। কি ভিড়, ধূলো। সেই যে মেয়েটি ধূলায় ধূসরিত বেশ নিয়ে বসে আছে ভারি সুন্দর দেখতে। ”
-৭ নভেম্বর, ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দ
পথের পাঁচালীর জনপ্রিয়তা বাংলাভাষী ছাড়াও সমগ্র পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেওয়ার পেছনে সত্যজিৎ রায়ের অবদান অনস্বীকার্য।
সত্যজিৎ তার নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় পথের পাঁচালীকে তুলে ধরেছিলেন বিশ্ববাসীর সামনে। পথের পাঁচালীর সিক্যুয়েল হিসেবে বিভূতিভূষণ রচনা করেন ‘অপরাজিত’। অপরাজিততে পথের পাঁচালীর নায়ক অপুর বড়বেলাকে তুলে ধরা হয়। ‘অপরাজিত’ অবলম্বনে সত্যজিৎ নির্মাণ করেছিলেন ‘অপুর সংসার‘। অনেক সাহিত্য বিশারদ ও গবেষক মনে করেন, পথের পাঁচালী ও অপরাজিত বিভূতিভূষণের নিজের জীবনেরই প্রতিবিম্ব। কেননা দুটি রচনাতেই বিভূতিভূষণের ছেলেবেলা, বাবা-মা, ব্যক্তিগত জীবন সবকিছুর বেশ গভীর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। এ প্রসঙ্গে বিভূতিভূষণ নিজেই বলেছেন,
“পথের পাঁচালীর চিত্রগুলি সবই আমার স্বগ্রাম বারাকপুরের। জেলা যশোহর। গ্রামের নিচেই ইছামতী নদী।“
বিভূতিভূষণের সব লেখাতেই প্রকৃতির গভীর প্রভাব লক্ষ্যণীয়। বাঙ্গালি পাঠক বৈঁচির ঝোপ, ভাঁট ফুল, মেঠোপথ, রেলেরগাড়ি কিংবা তেলকুচার বনকে যেন তাঁর লেখাতেই নতুন করে চিনেছে। প্রকৃতির সাথেই থাকতে ভালোবাসতেন বিভূতিভূষণ। তার আরেক বিখ্যাত বই ‘আরণ্যক‘। আরণ্যকের কোনো বিশেষ গল্প বা কাহিনী নেই। বিহারের এক প্রত্যন্ত অঞ্চলের বিশাল আদিম অরণ্য আর সেখানকার সরল অথচ রহস্যময় মানুষ আর প্রকৃতির কথাই তার এই লেখায় বর্ণিত হয়েছে। চাকরির সুবাদে বিভূতিভূষণ তার জীবনের একটা অংশ বিহারের ভাগলপুর,আজমাবাদ, ভীমদাসটোলা সহ বেশ কিছু অঞ্চলে কাটিয়েছেন। সেখান থেকেই মূলত ‘আরণ্যক’ লেখার অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন বলে ধারণা করা হয়।
বিভূতিভূষণের লেখায় প্রকৃতিপ্রভাবের সবচেয়ে বড় কারণ তার ছেলেবেলা ও বড় হওয়ার সময়টুকু। এছাড়াও ১৯৪২-৪৩ সাল থেকে তার বন্ধু বিহারের বন বিভাগের কর্মকর্তা যোগেন্দ্রনাথ সিনহার সাথে ছোটনাগপুর বিভাগের সিংহভূম, হাজারীবাগ এবং রাঁচী ও মানভূম জেলার অরণ্যে বেশ কিছুসময় কাটান। এসব অভিজ্ঞতাই পরবর্তীতে তার লেখা বই ‘বনে পাহাড়ে’, ‘আরণ্যক’, ‘হে অরণ্য কথা কও’ এবং দিনলিপি ‘স্মৃতির রেখা’-তে তুলে এনেছিলেন। এছাড়াও জীবনের একটা সময়ে বিভূতিভূষণ ‘গোরক্ষিণী সভা’র ভ্রাম্যমাণ প্রচারক হিসেবে বঙ্গ অঞ্চল, আসাম, ত্রিপুরা ও মায়ানমার অঞ্চল ভ্রমণ করেন। সেই ভ্রমণের কাহিনী তার ভ্রমণ বিষয়ক রচনা ‘অভিযাত্রিক’-এ লিপিবদ্ধ আছে।
অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় বাঙ্গালি পাঠক মাত্রই ‘চাঁদের পাহাড়’ ভক্ত। চাঁদের পাহাড় পড়ে ‘শঙ্কর’ এর মতো হতে চায়নি এমন পাঠক পাওয়া মুশকিল। চাঁদের পাহাড় উপন্যাসের মূল উপজীব্য গ্রামের সাধারণ এক বাঙ্গালি তরুণ শঙ্করের আফ্রিকা অভিযানের রোমাঞ্চকর কাহিনী। ভাবলে অবাক হয়ে যেতে হয়, সাধারণ অজ পাড়াগাঁয়ে থেকেও একেবারেই না দেখে শুধুমাত্র কিছু তথ্য আর অসাধারণ কল্পনাশক্তির জোরে বিভূতিভূষণ কেমন করে আফ্রিকার সেই আদিম অরণ্যের জীবন্ত ছবি একেছিলেন। চাঁদের পাহাড় পড়লে প্রতিটি পাঠকই আফ্রিকার সেই আদিম ধূসর অরণ্যানী, রহস্যময় বাওবাব গাছ, বনের দেবতা, হিংস্র ব্ল্যাক মাম্বা কিংবা অদম্য দুঃসাহসী অভিযাত্রী আলভারেজকে চোখের সামনে দেখতে পাবে। চাঁদের পাহাড় থেকে তৈরি হয়েছে সিনেমাও।
বিভূতিভূষণের লেখা ছোটগল্পগুলো বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ। ‘মেঘ মল্লার’, ‘পুইমাঁচা’ কিংবা ‘অভিশপ্ত’ সহ বিভূতিভূষণের রচিত প্রতিটি ছোটগল্পই মানুষের জীবনের ছোট ছোট সুখ-দুঃখের জীবন্ত প্রতিবিম্ব। ‘স্মৃতির রেখা’ মূলত বিভূতিভূষণের লেখা দিনলিপি। জীবনের বিভিন্ন সময়ের চিন্তা, অনুভূতি আর ভ্রমণের কথা এখানে লিপিবদ্ধ আছে। স্মৃতির রেখা পড়লে এই শক্তিশালী মানুষটির চিন্তাশক্তি দেখে অবাক হয়ে যেতে হয়। যেমন স্মৃতির রেখার এক স্থানে লেখা আছে,
“কেবলই মনে হয় সৃষ্টির যিনি দেবতা এত দয়া তাঁর কেন? এই অনন্তের সুধা উৎস তিনি মানুষের জন্য কতকাল থেকে খুলেছেন? এই অন্ধকারে তবু হাতজোড় করে তাঁকে ধন্যবাদ দিই।”
।।১৮ই নভেম্বর, ১৯২৭।।
স্রষ্টাকে এত গভীর ভালোবেসে কজন উপলব্ধি করতে পেরেছে?
জীবনের শেষের দিকের সময়টুকু অতিপ্রিয় বারাকপুরেই কাটিয়েছেন এই প্রকৃতিপূজারী সাহিত্যিক। বাড়ির আচ্ছাদন ছিলো খড়ের। শুধুমাত্র প্রকৃতির কাছাকাছি থাকবেন বলেই জীর্ণ হওয়া সত্ত্বেও বাড়িটিকে পাকা করেননি। এখানে বসবাসকালীন সময়েই তার আরো কিছু বিখ্যাত উপন্যাস ‘অনুবর্তন’, ‘দেবযান’, ‘অশনিসংকেত’, ‘ইছামতী’ ইত্যাদী লেখা হয়। অশনিসংকেত নিয়েও সিনেমা বানিয়েছিলেন সত্যজিৎ।
১৯৫০ সালের ১লা নভেম্বর বিভূতিভূষণ মৃত্যুবরণ করেন। মাত্র ৫৬ বছর বেঁচেছিলেন প্রকৃতির এই বরপুত্র। কিন্তু তার রচনা আজও আমাদের বিমুগ্ধ করে, ফিরিয়ে নিয়ে যায় শৈশবে। আর নতুন করে চিনতে শেখায় প্রকৃতিকে, উপলব্ধি করতে শেখায় জীবনকে।