ল্য প্যতি প্যাঁস বা দ্য লিটল প্রিন্স বিশ্ব সাহিত্যের অন্যতম একটি ক্লাসিক। এটি অনূদিত হয়েছে বাংলা সহ প্রায় ২৫০টি ভাষায়। এর মোট বিক্রির পরিমাণ প্রায় ২৫০ মিলিয়ন কপি। মূল বই লেখা হয়েছিল ফ্রেঞ্চ ভাষায়। ফ্রান্সের সবচেয়ে পঠিত ও অনূদিত বই এই দ্য লিটল প্রিন্স বা ছোট রাজপুত্র।
বইটির লেখক অঁতোয়ান দ্য স্যাঁৎ-একজ্যুপেরি। তার নিজের জীবনের একটি ঘটনার সাথে বইয়ের কাহিনী লেখার অনুপ্রেরণা পান লেখক। বইটিতে দেখা যায়, একজন বৈমানিক বিশাল এক মরুভূমিতে বিমান দুর্ঘটনায় পতিত হন এবং তার সাথে ভিন গ্রহবাসী ছোট রাজপুত্রের দেখা হয়। ছোট রাজপুত্রের সাথে তার কথোপকথন, ছোট রাজপুত্রের অতীতের কাহিনী জানা ইত্যাদির মাধ্যমে এগিয়ে যেতে থাকে অসাধারণ এই বইটির গল্প।
অঁতোয়ান দ্য স্যাঁৎ-একজ্যুপেরি বৈমানিক ছিলেন। ১৯৩৫ সালের ৩০ ডিসেম্বর তিনি মরুভূমিতে সত্যি সত্যি বিমান দুর্ঘটনায় পতিত হয়েছিলেন। বিশাল রৌদ্রদগ্ধ মরুভূমিতে জলশূন্য অবস্থায় প্রায় তিন দিন তিনি এবং তার বন্ধু অবস্থান করেছিলেন। সেই অবস্থায় তাদের ভ্রম হতে শুরু করে। চতুর্থ দিনে সৌভাগ্যক্রমে একদল যাযাবর তাদের দেখতে পায় ও বাঁচায়।
ছোটরা ‘দ্য লিটল প্রিন্স’ বইটি পছন্দ করে প্রধানত ভিনগ্রহবাসী এক ছোট রাজপুত্র এবং বিভিন্ন গ্রহের অদ্ভুত অধিবাসীদের সাথে তার পরিচয়ের জন্য। এছাড়া বইয়ের ছবিগুলোও বেশ আকর্ষণীয়। বড়রা এটি পছন্দ করেন বইটির অন্তর্নিহিত গভীর অর্থবোধক জীবন দর্শনের জন্য। এই বইয়ের কিছু চমৎকার বিষয় এখানে তুলে ধরা হলো।
১. সমস্যা প্রথমে ছোট থেকেই শুরু হয়
অঁতোয়ান দ্য স্যাঁৎ-একজ্যুপেরি এই শিক্ষাকে বইয়ের প্রধান একটি শিক্ষা হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। হিটলারের উত্থান তিনি দেখেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের নাৎসি বাহিনীর বিরুদ্ধে তিনি যুদ্ধ করেছেন এবং সে যুদ্ধে মারাও যান তিনি। তিনি দেখেছেন, কীভাবে একটি সমাজে খুবই ছোট আকারে বিষাক্ত মতাদর্শ বিস্তার লাভ করে এবং একসময় এত বিশাল হয় যে, তখন তাকে আর সরানো যায় না।
ছোট রাজপুত্র বইতে রাজপুত্রের ছোট্ট গ্রহেও এমন এক সমস্যা ছিল। সেখানে বাওবাব নামে এক ধ্বংসাত্মক গাছের জন্ম হতো। প্রথমে ক্ষুদ্র লতার আকারে। নিয়ম করে ছোট রাজপুত্র এসব বাওবাব লতা উপড়ে ফেলতো সতর্কভাবে। কারণ, তা না হলে এ গাছগুলো দ্রুত বিশাল হয়ে উঠবে এবং পুরো গ্রহটিকেই ধ্বংস করে দেবে। লেখক এই রূপকের মাধ্যমে বড় একটি শিক্ষা দিয়েছেন। সেটি হলো, “সমস্যা ছোট আকারেই শুরু হয় এবং ছোট থাকতেই এর সমাধান করা উচিত।”
২. নিজের ভেতরের শিশুটিকে বাঁচিয়ে রাখুন, উদার মানসিকতা রাখুন
লেখক বইটি শুরুই করেছেন বড়দের সমালোচনা করে। যেসব মানুষ বড় হয়ে যায় তারা সব কিছু যুক্তি ও স্বার্থ দিয়ে দেখতে চান। তারা শিল্প বুঝতে চান না। লেখক বলছিলেন, তিনি ছোটকালে একবার বোয়া কন্সট্রিক্টরের (বিশাল আকৃতির সাপের প্রজাতি) ছবি এঁকেছিলেন। ছবিটি ছিল এমন যে, একটি বোয়া কন্সট্রিক্টর একটি হাতিকে খেয়ে ফেলেছে। কিন্তু তিনি যখন বড়দের ছবিটি দেখালেন, তারা বললো এটি একটি হ্যাটের ছবি। অর্থাৎ ছবিটির ভেতরের শিল্প তারা বুঝতে পারেনি। তারা বরং তাকে উপদেশ দিয়েছিল, ছবি আঁকা বন্ধ করে ইতিহাস, ভূগোল, গণিত ও ব্যাকরণে মনোযোগ দিতে।
লেখকের ভাষায়,
“আপনি যদি বড়দের বলেন, আমি একটি বাড়ি দেখেছি গোলাপী ইটের তৈরি, তার জানালায় জেরানিয়াম ফুল, ছাদে সুদৃশ্য পায়রার দল; তাহলে তারা সেই বাড়ি সম্পর্কে কিছু বুঝতে পারবে না। আপনাকে বলতে হবে আমি একটি বাড়ি দেখেছি যার মূল্য বিশ হাজার ডলার। তাহলে তারা অবাক হয়ে বলবে, আহ! কী দারুণ বাড়ি!”
লেখক বার বার এই কথা বুঝিয়ে দিতে চেয়েছেন যে, মানুষ বড় হয় যত, তত তার চিন্তা ভাবনা সংকীর্ণ হয়ে উঠে। সে তার কল্পনা ও হৃদয়কে ব্যবহার করতে চায় না। ছোট রাজপুত্রের মাধ্যমে লেখক বলিয়েছেন,
“সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেসব জিনিস আছে সেগুলো চোখে দেখা যায় না, হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে হয়।”
৩. বিভিন্ন মানুষ একই জিনিস ভিন্ন ভিন্ন ভাবে দেখে
সবার দেখার ভঙ্গি এক নয়। একই জিনিস ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তি বিভিন্নভাবে দেখতে পারেন। ছোট রাজপুত্র যখন বলে, আকাশে যখন সহস্র তারকারাজি উদিত হয়, তখন বিজ্ঞানী-গবেষকেরা এদের দেখেন সমস্যা হিসেবে, তারা এর সমাধান করতে চান। দূর এক গ্রহে থাকা ব্যবসায়ী লোকটি, যে তারাদের মনে করে নিজের সম্পদ, সে তারা গুণতে থাকে। যারা ভ্রমণকারী তারা, তারকাদের দেখে দিক চিনে নেয়। তারকারা তাদের কাছে দিক নির্দেশক। আবার সে যখন চলে যাবে নিজ গ্রহে, দূরের কোনো তারকায়, তখন তার বন্ধু লেখক আকাশে উদিত হওয়া সহস্র তারকাদের দেখতে দেখতে ভাববেন যে, ঐ অনন্ত তারকারাজির কোথায় এক অতি ক্ষুদ্র গ্রহে তার বন্ধু ছোট রাজপুত্র আছে। এই ভাবনা রাতের আকাশে উদিত হওয়া অযুত তারকাদের এক ভিন্ন অর্থ দেবে লেখককে।
৪. ভালোবাসার মানুষ কখনোই প্রতিস্থাপনযোগ্য নয়
দ্য লিটল প্রিন্স ভালোবাসা বিষয়ক এক গভীর অর্থবোধক বই। এখানে ছোট রাজপুত্র এবং তার গোলাপ ফুলের ভালোবাসার রূপকে লেখক ভালোবাসা সম্পর্কে তার অন্তর্দৃষ্টি তুলে ধরেছেন। ছোট রাজপুত্র যখন তার গ্রহে ছিল, তখন তার ভালোবাসার গোলাপ ফুলটির সাথে তার সামান্য কারণে সমস্যা হয়।
কিন্তু গ্রহ থেকে যখন সে পৃথিবীতে নেমে এলো, তখনো সে ফুলটিকে ভুলতে পারেনি। শেষে একবার পৃথিবীতে সে এক বাগানভর্তি গোলাপ ফুলের দেখা পেল। ফুলগুলো আনন্দে ও সৌন্দর্যে জ্বলজ্বল করছিল। প্রথমে ছোট রাজপুত্রের মন খারাপ হয়। কারণ ফুলগুলো তার গোলাপের মতোই। কিন্তু তার ফুলটি তাকে বলেছিল, এই মহাবিশ্বে তার মতো আর কোনো গোলাপ নেই।
এই ভেবে সে কাঁদতে থাকে। এরপর তার বন্ধুত্ব হয় শেয়ালের সাথে। শেয়ালের সাথে বন্ধুত্ব হবার পর সে বুঝতে পারে, আসলে পৃথিবীতে তো আরো অনেক শেয়াল আছে, যারা তার বন্ধু শেয়ালটির মতো দেখতে। কিন্তু তবুও তার বন্ধু শেয়ালটি তার কাছে বিশেষ কিছু, কারণ অজস্র শেয়ালের মধ্যে সেই একমাত্র তার বন্ধু। তখন ছোট রাজপুত্র প্রথমবারের মতো বুঝতে পারলো যে, তার ভালোবাসার গোলাপটি আসলে তার কাছে কেমন ছিল। সে আবার গেল বাগানে। বাগানের গোলাপদের দিকে তাকিয়ে কোনো ভালোবাসা অনুভব করল না, যদিও ফুলগুলো সুন্দর ছিল।
ছোট রাজপুত্র বলল,
“তোমরা সুন্দর কিন্তু শূন্য। কেউ তোমাদের জন্য মরতে চাইবে না। এটা ঠিক যে একজন সাধারণ পথচারী ভাবতে পারে আমার ফুলটি ঠিক তোমাদের মতো। কিন্তু আমার ফুল তোমাদের মতো শত সহস্র ফুলের থেকে উত্তম, কারণ, সে সেই ফুল যাকে আমি নিজ হাতে পানি দিয়েছি, আমি গ্লাস গ্লোব দিয়ে তাকে ঢেকেছি, আমি তাকে পর্দা দিয়ে ছায়া দিয়েছি, তার জন্য আমি শুঁয়োপোকা মেরেছি (দুয়েকটি বাদে, যাতে তারা প্রজাপতি হতে পারে), আমি শুনেছি তাকে যখন সে অভিযোগ করেছে, অহংকারে আত্মহারা হয়েছে অথবা যখন সে কিছুই বলে নি। কারণ, সে আমার গোলাপ।”
ছোট রাজপুত্রের এই কথা এই শিক্ষা দেয় যে, আপনার ভালোবাসার মানুষ প্রতিস্থাপনযোগ্য নয়। সে অনন্য। হয়তো তার মতো বা তার চাইতে বেশি সুন্দর বা প্রতিভাবান ব্যক্তি থাকতে পারে, কিন্তু আপনার ভালোবাসাই তাকে অন্য সবার চাইতে আলাদা করে তোলে।
৫. টাকা সব কিছু নয়
ছোট রাজপুত্র বিভিন্ন গ্রহে গিয়ে একেকজন অদ্ভুত মানুষের সাথে দেখা স্বাক্ষাত করে। তাদের কথোপকথনের মাধ্যমেই লেখক আমাদের কাছে তার জীবন সম্পর্কে ভাবনা পাঠকদের সামনে তুলে ধরেছেন। একপর্যায়ে ছোট রাজপুত্র একটি গ্রহে গিয়ে একজন ব্যবসায়ীর দেখা পায়। সে খুবই ব্যস্তভাবে তারকাদের গুনে চলেছে। সে মনে করে, সমস্ত তারকা তার সম্পত্তি; কারণ সে প্রথমবারের মতো এগুলো গুনতে শুরু করেছে।
এটি সত্য যে, প্রথম ব্যক্তিগত সম্পত্তির ধারণা এভাবেই এসেছে এবং এভাবেই পৃথিবীতে তৈরি হয়েছে এই সভ্য সমাজ। জাঁ জ্যাক রুশো তার ডিসকোর্স অন ইনইকুয়ালিটিতে বলেছেন,
“প্রথম যে লোকটা কোনো জমি দখলে নিয়ে দাবি করেছিল ‘এটা আমার জমি’ এবং অন্য লোকেরা তা বিশ্বাস করেছিল; সেই লোকটিই হলেন সিভিল সোসাইটির সত্যিকারের পিতা।”
ছোট রাজপুত্রকে ব্যবসায়ী লোকটি বলছিলো,
“যখন তুমি কোনো হীরার টুকরা পাবে যার মালিক কেউ না, এটি হয়ে যাবে তোমার। যখন তুমি কোনো দ্বীপ আবিষ্কার করবে যার মালিক কেউ না, এটা হয়ে যাবে তোমার। যখন তুমি কোনো আইডিয়া পাবে যা আগে কেউ ভাবেনি, এটি তুমি প্যাটেন্ট করবে এবং তা হয়ে যাবে তোমার। তাই আমার ক্ষেত্রেও, তারাগুলো আমার, কারণ আমার আগে কেউ তারাগুলোকে নিজের করে নেওয়ার কথা চিন্তা করেনি।”
লেখক এখানে বস্তুবাদী পৃথিবীতে অন্য সব কিছু ছেড়ে কেবল টাকার পেছনে ছুটতে থাকা উদ্ভ্রান্ত ধনী লোকদের সমালোচনা করেছেন।
বইটি ছোটদের জন্য লেখা হলেও এর মধ্যে এমন কিছু উক্তি আছে যা বড়দের জন্যও দরকারী। বলা হয়ে থাকে, ছোটদের বইয়ের মতো করে লেখা এটি বড়দের বই। তাই ছোট এবং বড় সবার কাছেই বিশ্বজুড়ে এই বইটি সমাদৃত।
ফিচার ইমেজ: Thelittleprince.com