Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

শুভ্র: হুমায়ূন আহমেদের সৃষ্ট স্নিগ্ধতম নায়ক

একশো ভাগ শুদ্ধ মানুষ কি আছে? হয়তো নেই। কিন্তু লেখকরা তো কল্পনাবিলাসী। তারা তাদের অনুভূতির ডানায় পাখা মেলে নানা কল্পনা এঁকে যান। কল্পনায় আঁকা এমনই একটি চরিত্র হলো শুভ্র। কল্পনার জাল হুমায়ূন আহমেদের মতো করে খুব কম লেখকই বুনতে পেরেছেন। মানুষের নানা দিক নিয়ে তিনি আলাদা আলাদা চরিত্র তৈরি করেছেন। মানুষের কল্পনাবিলাসী দিক নিয়ে তৈরি করেছেন হিমু। বিশ্লেষণধর্মী দিক নিয়ে তৈরি করেছেন মিসির আলী। আর মানুষের ভেতরকার নিষ্পাপ সত্ত্বাকে নিয়ে তৈরি করেছেন শুভ্র।

শুভ্র হুমায়ূন আহমেদের ব্যতিক্রমধর্মী এক চরিত্র। যে পৃথিবীর সব পাপ-পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত। একজন পাঠক যখন শুভ্র পড়েন তখন তিনি উপলব্ধি করেন তার মাঝেও একটা শুভ্র বাস করে। কিন্তু বাস্তবতার অজুহাতে, বেঁচে থাকার তাগিদে কিংবা নিছক লোভে পড়ে সেই শুভ্রকে ধীরে ধীরে অন্ধকার কালোয় ঘিরে ফেলি।

হুমায়ূন আহমেদ শুভ্র চরিত্রকে নিয়ে ছয়টি বই লিখেছেন। বইগুলো হলো মেঘের ছায়া, দারুচিনি দ্বীপ, রুপালী দ্বীপ, শুভ্র, এই শুভ্র এই শুভ্র গেছে বনে। একেকটি বইয়ে আমরা শুভ্রের নতুন রূপ দেখতে পাই। এখানে আমরা বইগুলো থেকে খুঁজে বের করবো শুভ্রকে। এতে নিজেদের ভেতরকার শুভ্রকেও হয়তো আমরা দেখবো কোথাও কোথাও।

মেঘের ছায়া

শুভ্রের বাবা বিশাল সম্পত্তির মালিক। তার জীবন তাই অভিজাত্যের চাদরে ঢাকা। কিন্তু আভিজাত্যের কালিমা তাকে স্পর্শ করেনি। এত জটিলতার মধ্যেও তার সরল মন সজীব রয়ে গিয়েছে। অসম্ভব সুদর্শন এ যুবকের সবচেয়ে সুন্দর হলো তার চোখ। কিন্তু শুভ্রের চোখ ধীরে ধীরে খারাপ হয়ে যাচ্ছে। সে অপেক্ষা করছে কখন সে পুরোপুরি অন্ধ হয়ে যাবে। সেজন্য সে চায় চোখ অন্ধ হওয়ার আগে যত বেশী সম্ভব বই পড়ে নিতে।

শুভ্রের কোনো বন্ধু কখনো তার বাড়িতে আসে না। শুভ্রই তাদের বাড়ি যায়। তার একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু হলো জহির। জহির কেয়া নামের এক মেয়েকে ভালোবাসে। সে তাকে বিয়ে করতে যাচ্ছে। কিন্তু শুধুমাত্র টিউশনি ছাড়া তার সম্বল নেই। কারণ সে বি.এ. তে থার্ড ডিভিশন পেয়েছে। জহির মনে করে সে কখনো চাকরি পাবে না। সে শুভ্রকে বলেছে যাতে তাকে একটা গাড়ি দিয়ে সাহায্য করে। জহিরের বিয়ের দিন শুভ্র তার চশমা খুঁজে পায় না। পরে দেখা যায় তার মা-ই চশমা লুকিয়ে রাখে যাতে করে সে জহিরের বিয়েতে যেতে না পারে। এই স্বভাবটি শুভ্রের মা-বাবার উভয়ের মধ্যে দেখা যায়। তারা দুজনই মনে করে শুভ্র এখনো বোধ তৈরি হয়নি। তাদের কাছে শুভ্র এখনো ছোট। এজন্যই তার বাবা-মা শুভ্রের ছাব্বিশ বছর হওয়ার পরেও তার বন্ধু-বান্ধব মহলকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। শুভ্র কিন্তু বুঝে ফেলেছিলো তার মা-ই চশমা লুকিয়ে রেখেছিলো।

“মা তুমি আমারা চশমাটা লুকিয়ে রেখেছিলে, যাতে আমি আমার বন্ধুর বিয়েতে যেতে না পারি। তুমিও চাও না আমি আমার দরিদ্র বন্ধুদের সাথে মিশি। ওরা কিন্তু মা, আমাকে পছন্দ করে। আমিও ওদের পছন্দ করি। তোমাকে যতটা করি ততটা করি না, কিন্তু করি. . .”

মেঘের ছায়ার প্রচ্ছদ; Source: goodreads.com

শুভ্রের বাবারও শুভ্রের প্রতি আস্থা কম। তাই তিনি বলেন, “একা একা ঘুরে বেড়ানোর মতো অবস্থা তোমার না। আমার ধারণা, তুমি একা একা চিটাগাং থেকে ঢাকাও যেতে পারবে না।” শুভ্র তার আরেক বন্ধু সাবেরের বাসায় প্রায়ই যায়। সাবের আই.এ. পাশ করার পর মারা যায়। শুভ্র সেখানে গিয়ে সাবেরের বাবার সাথে কথা বলে। সাবেরের বাবা প্যারালাইসিসে আক্রান্ত। তবে শুভ্র সেখানে যায় অন্য কারণে। সাবেরের বড় বোন নীতুকে সে ভালোবাসে। যাওয়ার সময় সাবেরের বাবার জন্য সিগারেট নিয়ে যায়। এত সহজ সরলতার ভেতরেও শুভ্রের ভেতর কেমন জানি রহস্য আছে। এই জন্যই তো জহির বলেছে, “তুই মোটামুটি একটা স্ট্রেঞ্জ চরিত্র” আবার, শুভ্রের সরলতার প্রমাণও পাওয়া যায় জহিরের কথায়। “তুই কত যে একটা ভালো ছেলে তা কি জানিস?”

জহির আর কেয়ার থাকার কোনো জায়গা নেই। জহিরের মামা তাদের ঘর থেকে বের করে দিয়েছে। শুভ্র তাদের জন্য তাদের জয়দেবপুরের বাগানবাড়ি দিতে চায়। প্রথমে তার বাবা ইয়াজউদ্দিন রাজি না হলেও পরে রাজি হন। শুভ্র এক সময় নীতু আপাকে তার মনের কথা বলে। কিন্তু নীতু আপা তার সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে দেয়। কারণ তিনি শুভ্রকে তার ছোট ভাইয়ের মতোই দেখতেন।

দারুচিনি দ্বীপ

কয়েকজন দুরন্ত যুবক-যুবতী প্রবাল দ্বীপে যাবে। তার মধ্যে একজন হচ্ছে শুভ্র। কিন্তু এজন্য তার বাবা ইয়াজউদ্দিনের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে। ইয়াজউদ্দিন শুভ্রকে স্বভাবতই বালক হিসেবে ধরে কথা বললেন। শুভ্রের বন্ধু-বান্ধবমহল ইয়াজউদ্দিনের খুব একটা পছন্দ নয়। তবুও শেষমেষ শুভ্রকে যাওয়ার অনুমতি দেন। কিন্তু শুভ্রের বন্ধুরা তাকে নিতে উৎসাহী নয়। বরং শুভ্র না গেলেই যেন তারা বাঁচে। নিতান্ত চক্ষু লজ্জাতেই তারা শুভ্রকে যেতে বলেছে। এর কারণ হলো শুভ্র চশমা ছাড়া দেখে না। তারা ভাবছে চশমা হারিয়ে গেলে শুভ্রকে নিয়ে তাদের ঝামেলা হবে।

দারুচিনি দ্বীপ-এর প্রচ্ছদ; Source: enedao.com

শুভ্রের বাবা চায় শুভ্রের একটা আধিপত্য থাকুক দলের উপর। তাই তিনি ট্রেনে প্রথম শ্রেণীর কামরা ঠিক করে রেখেছেন। মাইক্রোবাস ঠিক করে রেখেছেন। কিন্তু শুভ্র এসব চায় না। সে সবার মতোই ভ্রমণ উপভোগ করতে চায়। যদিও শেষ পর্যন্ত তার বন্ধুদের অনুমান ঠিক হয়েছিলো। স্টেশনে গিয়ে শুভ্রের চশমা ভেঙ্গে যায়। তাকে এ যাত্রায় উদ্ধার করে জরী।

রূপালী দ্বীপ

রূপালী দ্বীপ মূলত দারুচিনি দ্বীপের পরবর্তী পর্ব। দারুচিনি দ্বীপ উপন্যাসটি শেষ হয়েছিলো ট্রেন স্টেশনে। দারুচিনি দ্বীপের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরুতেই এই উপন্যাস শেষ হয়েছিলো। কারণ হুমায়ূন আহমেদ নিজেও তখন সেন্ট মার্টিন যাননি।  হুমায়ূন আহমেদ সেন্ট মার্টিন যাওয়ার পরে লিখলেন রূপালী দ্বীপ।  দারুচিনি দ্বীপ-এর পরের গল্প আছে রূপালী দ্বীপ উপন্যাসে।  যাওয়ার পথে তাদের নানা ধরনের ঝামেলায় পড়তে হয়। কারণ জরী বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে আসলে তার হবু স্বামী তাদের পুরো দলের উপর মামলা করে। ফলে সেন্ট মার্টিনের পুরো দলটিকে পুলিশ হাজতে নিয়ে আসে। এই মুহূর্তে শুভ্রের বাবার ক্ষমতা তাদের কাজে আসে। আমরা রূপালী দ্বীপে শুভ্রের অন্য একটা দেখতে পাই। এখানে শুভ্র তার বন্ধুদের চাপাচাপিতে পরে সিগারেট খায়। কিংবা ট্রেনের বুফে কারের ম্যানেজারের সাথে ঝামেলায় জড়িয়ে যায়। কারণ সে তার গায়ে থুতু দেয়। এরকম অনেক কাজই শুভ্র করে যা তার সাথে এমনিতে যায় না।

‘রূপালী দ্বীপ’ বইটির প্রচ্ছদ; Source: amarbooks.com

শুভ্র

সাদা মনের শুভ্র। যে কিনা পৃথিবীর সব পঙ্কিলতা থেকে দূরে। হঠাৎ যেন তাঁকে পৃথিবীর সব পঙ্কিলতা আঁকড়ে ধরলো। শুভ্রের বাবা মারা যাওয়ার পর সে আবিষ্কার করলো তাঁর বাবা অনেক ধরনের ব্যবসা রেখে গেছেন। তার মধ্যে একটা হলো পতিতা ব্যবসা। তার বাবা এটা পেয়েছিলেন শুভ্রের দাদার কাছ থেকে। বাবা মারা যাওয়ার পর শুভ্র যখন হঠাৎ এটা আবিষ্কার করলো তার সারা পৃথিবী যেন হঠাৎ করে উলট পালট হয়ে গেলো।

এম.এস.সি-তে শুভ্র কালি নারায়ণ স্কলার হয়। ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান তাকে রেজাল্টের দিনই যোগদান করতে বলেন। কিন্তু শুভ্র এই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়। সে তার শিক্ষককে বলে তার বাবার বেশ্যালয় ব্যবসা রেখে গেছে। তাকে সে ব্যবসা দেখতে হবে। তাই সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়। তার কাছে বেশ্যালয়ে মেয়েদের কষ্ট খুবই নিদারুণ মনে হয়। তাই সে তাদের কাছে গিয়ে তাদের দুঃখের কথা বুঝতে চায়। তাই সে আসমানীর ঘরে থাকে। বেশ্যালয়ের মেয়েদের পনেরো হাজার টাকা দিয়ে বেশ্যালয় বন্ধ করে দিতে চায়। কিন্তু দেখা যায় এ কাজ ততো সহজ নয়।

শুভ্র-এর প্রচ্ছদ; Source:allbanglaboi.com

এ উপন্যাসে শুভ্রের এক নতুন রূপ দেখা যায়। অফিসের লোকদের সাথে সে খুব চাতুরীর সাথে কথা বলে। মদ খায়। এতদিনের চেনা শুভ্রকে নিয়ে আমরা সন্দেহে পড়ে যাই। বিনুর মতো আমাদেরও মনে হয় শুভ্র হয়তো বোকার অভিনয় করে কিন্তু আসলে সে বোকা নয়। শেষ পর্যন্ত শুভ্র সিদ্ধান্ত নেয় যেসব দুঃখী মেয়েদের যাবার কোনো জায়গা নেই তাদের জন্য সে একটা আশ্রম বানাবে। যেন সব পঙ্কিলতার মাঝেও শুভ্র তার হৃদয়ের শুভ্রতাকে হারায় না।

এই শুভ্র! এই

শুভ্র অপেক্ষা করছে সে কবে অন্ধ হবে। সে জন্য তার আগাম সব প্রস্তুতি। চোখ বন্ধ করে সে কফি বানানোর চেষ্টা করে যাতে অন্ধ হয়ে গেলে তার সমস্যা না হয়। সময় থাকতেই সে চায় সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্যগুলো দেখে নিতে। যাতে করে সে অন্ধ হয়ে গেলেও সুন্দর সুন্দর স্বপ্ন সে দেখতে পারে। এ উপন্যাসে শুভ্রকে অনেকটা খামখেয়ালী রূপে দেখানো হয়। সে সবাইকে যেন একটু চমকে দিতে ভালোবাসে। বাসায় বসে নানা অদ্ভুত কাণ্ড করে তার সময় কাটে। নতুন নতুন ম্যাজিক ট্রিক শিখে সে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয়।

এই শুভ্র! এই-এর প্রচ্ছদ Source: goodreads.com

তাকে এই উপন্যাসে অসম্ভব বুদ্ধিমান এক যুবক হিসেবে পাওয়া যায়। সে তার মায়ের কাছে ইচ্ছে করে বোকার অভিনয় করে। কারণ তার মা তাকে বোকা ভাবতে পছন্দ করে। কিন্তু সে আসলে বোকা নয়। কারণ সে চিন্তা করে বের করেছে সে তার মা-বাবার আসল সন্তান নয়। জাহানারার প্রথম সন্তান মৃত্যুর পর তাকে দত্তক নেয়া হয়েছে। কিন্তু সে সত্যকে খুবই স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করেছে। যেন সত্যের সাথেই শুভ্রের সখ্যতা।

শুভ্র গেছে বনে

শুভ্র গেছে বনের Source: goodreads.com

এ উপন্যাসে শুভ্রকে দেখা যায় একদম অন্য রূপে। রাস্তায় পাওয়া অসহায় মেয়েকে সাহায্য করার জন্য সে বাড়িতে নিয়ে আসে। মেয়েটিকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হলে সে-ও বের হয়ে যায়। কারণ সে মনে করে মানবজাতি এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। একজনের কিছু হলে আরেকজনকে এগিয়ে আসতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। বাড়ি থেকে বের হয়ে সে এক পতিতার সাথে পরিচিত হয়। যে তাকে ভাই ডাকে। তার সাথে সে পদ্মায় জেগে উঠা নতুন পাড়ে চলে যায়। চরের কোনো নাম এখনও দেয়া হয়নি। শুভ্র সেখানেই থাকে। সেখানে সে একটা স্কুল গড়ে তুলেছে। প্রতি সপ্তাহে সে সায়েন্সের বক্তব্য দেয়। চরের মানুষ তাকে ভালোবাসে। সবাই তাকে ডাকে ধলা মিয়া। গায়ের রঙ ফর্সা বলে এই নাম। ধীরে ধীরে এই চরের নাম হয়ে উঠে ‘শুভ্রর চর’। একজন অজানা মানুষ কীভাবে সবার এতো আপন হয়ে উঠলো যে তার নামই হয়ে গেলো চরের নাম। মনের শুভ্রতার বুঝি এমনই শক্তি। এভাবেই হুমায়ূন আহমেদের সৃষ্ট ‘শুভ্র’ আমাদের ভেতরকার কিছু একটা কোথায় যেন নাড়া দিয়ে যায়।

ফিচার ইমেজ: Youtube.com

Related Articles