তিনি লিখলেন, “একমাত্র হৃদয়ই জানে কীভাবে গান গাইতে হয়” (Only the soul knows how to sing…); আত্মজীবনী ‘মাই স্টোরি’তে তিনি অকপটে মেলে ধরলেন নিজেকে। বোঝালেন, নিজেকে উন্মোচিত করার ক্ষেত্রে এভাবেই হতে হয় সৎ ও সাহসী, হতে হয় সত্যনিষ্ঠ; আর সেই আত্মকথন মালাবার থেকে মন্ট্রিল তাবৎ রক্ষণশীল সমাজের ঝুঁটি ধরে টান মারলো। ব্যক্তিনাম, ভূমিকা, ধর্ম, ভাষা, জীবন ও যাপনপ্রণালীতে এভাবেই আজীবন কাটাছেঁড়ায় মত্ত ছিলেন যিনি, তিনি এই শতাব্দীর অন্যতম সাহিত্যব্যক্তিত্ব কমলা দাস, তিনি মাধবীকুট্টি, সুরাইয়া— তিনি কমলা সুরাইয়া।
ভারতের অগ্রগণ্য কবি কমলা দাসের জন্ম ১৯৩৪-এর ৩১ মার্চ, কেরালার ত্রিশুর জেলার পুন্যায়ুরকুলামে। এই কমলাই পরবর্তীতে পরিচিত হবেন ভারতীয় আধুনিক ইংরেজি কবিতার অন্যতম প্রধান কবি— ‘দ্য মাদার অফ মডার্ন ইংলিশ ইন্ডিয়ান পোয়েট্রি’ হিসেবে। কেরালার যে দু-একটি পরিবারের সাহিত্যজগতে অসামান্য অবদান, তার মধ্যে অন্যতম নায়ার পরিবার। এই পরিবারের সন্তান কমলার পিতা ভি. এম. নায়ার ছিলেন বিখ্যাত মালায়লম দৈনিক ‘মাতৃভূমি’র ম্যানেজিং এডিটর। মা নালাপ্পাত বালামণি আম্মা মালায়লম ভাষার প্রথিতযশা কবি। ‘নিবেদ্যম’, ‘সোপানম্’, ‘লোকান্তরঙ্গলিল’ প্রভৃতি গ্রন্থের প্রণেতা বালামণি আম্মাকে বলা হত মালায়লম সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি। কেউ কেউ তাকে বলতেন— ‘মাদার অফ মালায়লম পোয়েট্রি’।
সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য ভারতীয় সাহিত্যের সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘সরস্বতী সম্মান’-এ ভূষিত বালামণি আম্মার কন্যা কমলা যে কালে-কালে লেখক হবেন, তা খানিকটা প্রত্যাশিতই ছিল। বাবা সংবাদপত্রের সম্পাদক এবং মা বিখ্যাত লেখক হওয়ার সুবাদে তাদের বাড়িতে রাজনীতি ও সাহিত্যের রথী-মহারথীদের আনাগোনা লেগেই থাকত। কমলার বহির্মুখী হয়ে উঠার ক্ষেত্রে এসবই পরোক্ষে প্রেরণা যুগিয়েছিল। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, কমলার দাদু, বালামণি আম্মার কাকা নালাপ্পাত নারায়ণ মেননও একজন উল্লেখযোগ্য লেখক ছিলেন।
পিতার কর্মসূত্রে খুব ছোটোবেলায় কমলাকে চলে আসতে হল কলকাতায়। তার পিতা তখন ‘বেন্টলে’ ও ‘রোলস্ রয়েস’ গাড়ির বিক্রেতা ওয়ালফোর্ড ট্রান্সপোর্ট কোম্পানির উচ্চপদস্থ কর্মচারী। সারাদিন ব্যস্ততায় কাটে তার দিন। কলকাতায় থাকাকালীন মাত্র ছয় বছর বয়সে মুণ্ডুহীন ভাঙা পুতুল নিয়ে কবিতা লিখলেন কমলা। আর মাত্র পনেরো বছর বয়সে খানিকটা অপ্রত্যাশিতভাবে স্কুলের পাঠ চলাকালীনই রিজার্ভ ব্যাংক অফ ইন্ডিয়ার উচ্চপদস্থ আধিকারিক কে. মাধব দাস-এর সঙ্গে তিনি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলেন। পরের বছর অর্থাৎ ১৯৫০-এ জন্ম নিল তাদের প্রথম পুত্র এম. ডি. নালাপত। কমলার বয়স তখন মাত্র ষোলো, আর তার স্বামী মাধবের একত্রিশ। পরের দুই বছরে আরও দুই পুত্র। দাম্পত্যজীবন কিশোরী কমলার কছে তখন এক যন্ত্রণাময়, বিরক্তিকর দিনযাপন। পরবর্তীতে এক আলাপচারিতায় কমলা বলেছিলেন, “তৃতীয় পুত্রের জন্মের সময় আমি সাবালকপ্রাপ্ত হয়েছিলাম।”
স্বামী মাধব দাস ছিলেন অত্যন্ত স্নেহপ্রবণ উদার মনের মানুষ। কমলা লিখেছেন, ‘আমার তিন পুত্রের সঙ্গে তিনি আমারও পিতার মতো ছিলেন। ছেলেরা তার কাছে জামা কেনার জন্য বায়না করলে আমিও পোশাক কিনে দেওয়ার জন্য বায়না করতাম। আর তিনি তা হাসিমুখে মেনে নিতেন’। ঘরকন্নার কাজ সামলে ছেলেদের বড় করে তোলার পাশাপাশি শুরু হল সাহিত্যচর্চার কাজ। গভীর রাতে যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়ত, রান্নাঘরের সব্জি কাটার টেবিলটা পরিষ্কার করে সেখানে লিখতে বসতেন কমলা। এই সময়টাই ছিল তার একান্ত নিজস্ব সময়। সারারাত ধরে টাইপ রাইটারে খটাখট শব্দ তুলে অনলস লিখে যেতেন কমলা। একসময় দিনের আলো ফুটতো, শোনা যেত দুধওয়ালার সাইকেলের ঘণ্টাধ্বনি। টাইপ রাইটার আর লিখে ফেলা অসংখ্য পৃষ্ঠা গুছিয়ে তুলে রেখে অন্য এক সত্তায় মিশে যেতেন কমলা দাস ওরফে মাধবী কুট্টি। তখন তিনি মা, কিংবা পত্নী, কিংবা গৃহকর্ত্রী।
আর তার এই সাহিত্যচর্চায় অদম্য সাহস ও প্রেরণা যুগিয়েছেন যিনি, তিনি কে. মাধব দাস, তার স্বামী, সখা, সহমর্মী। এক সাক্ষৎকারে তাই কমলা দাস অকপটে বলেন, ‘তার সাহায্য ছাড়া আমি কখনোই লেখক হয়ে উঠতে পারতাম না। আমার লেখা নিয়ে, আমাকে নিয়ে তিনি খুবই গর্বিত ছিলেন’। তার সঙ্গে বয়সের বিস্তর ব্যবধান থাকায় এবং অফিসের কাজে মাধব দাস দিনরাত ব্যস্ত থাকায় পাছে কমলা একাকীত্ব বোধ করেন তাই তিনি সবসময় কমলাকে তার বয়সী লোকজনের সঙ্গে মেলামেশা করতে উদ্বুদ্ধ করতেন। তাই যখন কমলা লেখাকে পেশা হিসাবে গ্রহণ করতে চাইলেন, মাধব দাস হাসিমুখে সম্মতি জানালেন।
কমলা দাস লিখতে শুরু করলেন। ইংরেজি এবং মাতৃভাষা মালায়লম— দুই ভাষাতেই অনর্গল লিখে যেতে থাকলেন কমলা। ইংরেজি ভাষার পাঠক তাকে প্রথমে চিনলেন কবি হিসেবে। কে. দাস বা কমলা দাস নামে প্রকাশিত তার কবিতা পাঠকের কাছে অসম্ভব জনপ্রিয় হয়ে উঠল। কবিতায় পাঠককে তিনি চেনালেন গ্রামীণ অন্তজ মানুষের যাপনপ্রণালী, শোনালেন অন্তঃপুরচারী নারীদের গোপন ব্যথা। তাদের মনের গহনে চেপে রাখা ইচ্ছা, রক্ষণশীল সমাজের তীব্র প্রতিক্রিয়া এবং অপবাদের ভয়ে নিজ হাতে মেরে ফেলা নারীর তাবৎ লিপ্সা মূর্ত হয়ে উঠল তার কলমের ডগায়। এ এক অন্য কমলা। নিজের অভিজ্ঞতাকে পাঠকের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার পাশাপাশি তিনি ঢুকে পড়ছেন মানুষের অন্দরমহলে। অনায়াসে লিখে ফেলছেন গোপন যত কথা, অকপটে। ‘গেল গেল’ রব তুলছে রক্ষণশীল সমাজ, আর সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে তিনি লিখছেন—
‘…তাকে সব দাও
সেই সব যা তোমাকে নারী করেছে,
তোমার দীর্ঘ চুলের সুগন্ধ, স্তনের ভাঁজে জমে থাকা ঘামের কস্তুরী গন্ধও দাও
দাও রজঃকালীন রক্তের উষ্ণ ঝাঁকুনি আর
তোমার সব অনিঃশেষ মেয়েলি ক্ষুধা …
(…Gift him all,
Gift him what makes you woman, the scent of
Long hair, the musk of sweat between the breasts,
The worm shock of menstrual Blood, and all your
Endless female hungers.. ‘The Looking Glass’.
বাংলায় অনুবাদ: এন জুলফিকার)
কমলা জানতেন কীভাবে তীব্র অভিঘাত সৃষ্টি করতে হয়। মূলত নারীর জন্য তৈরি সামাজিক অনুশাসন, যা কিনা শোষণেরই নামান্তর, তাকে ধাক্কা দেওয়ার জন্য কমলা মাধ্যম হিসাবে তার কবিতাকে বেছে নিলেন। তিনি তার কবিতার মধ্য দিয়ে ভেঙে ফেলতে চাইলেন রক্ষণশীলতার বাঁধ, ছড়িয়ে দিলেন মুক্ত হাওয়া, যে হাওয়ায়, যে পরিবেশে মানুষ নতুন করে বাঁচবে, সত্যকথনের বলিষ্ঠ অধিকারে প্রাণভরে নিশ্বাস নেবে। আর তাই তার কবিতায় যৌনপ্রসঙ্গ, কামনাকে সরাসরি তুলে এনে তিনি পাঠকের মন থেকে মুছে ফেলতে চাইলেন অজ্ঞতার ভীতি, অবসাদের জড়তা।
কমলা দাস লিখতে শুরু করেছিলেন মাত্র ছয় বছর বয়সে। গদ্য এবং কবিতা দুই ধরনের লেখাতেই ছিল তার সমান দক্ষতা। কিন্তু মূলত কবিতার ক্ষেত্রেই তিনি সন্দেহাতীতভাবে এক সুনির্দিষ্ট স্বতন্ত্র ধারার প্রবর্তন করলেন। তার কবিতায় ব্যক্তিগত আবেগ, আকাঙক্ষা এক নতুন কন্ঠস্বর খুঁজে নিল। দাম্পত্যের ফাঁপা, লোকদেখানো বন্ধন তিনি হেলায় চূর্ণ করলেন তার কবিতায়।
মূলত প্রেম, ব্যক্তিগত সম্পর্ক এবং নারীর ইচ্ছা বারবার ফুটে উঠল কমলার লেখায়। কমলা দাসের কবিতার অনন্যতা বিবাহবহির্ভূত যৌন প্রসঙ্গের জন্য কিন্তু নয়, বরং তা আশুপরিবর্তনশীল ভাবনা, প্রতিরোধের নিত্য নতুন উপায়ের জন্য, যার মধ্য দিয়ে নারীর আপন সত্তা প্রতিভাত হয়। কমলার চোখে নারীত্ব হল অসংখ্য অভিজ্ঞতার (যার মধ্যে সিংহভাগই খারাপ) নিক্তিতে ছিন্নবিচ্ছিন্ন এক সত্তা, যে শুধু সমাজকে দিয়েই যায়; কিন্তু শত বঞ্চনা, অপমান, অত্যাচারেও মুখ খোলে না। কমলা চাইলেন তাদের সেই নীরবতাকে ছিন্ন করতে। চাইলেন সেই প্রতিবাদী স্বর যা এই পুরুষতন্ত্রের ভণ্ডামি আমূল চিনিয়ে দেবে। আর তাই তার কবিতায় বারবার ফুটে উঠল এক স্পষ্ট মুখাবয়ব, যে দ্বিধাহীন বলে ওঠে—
I am every woman who seeks love.
(An Introduction, Summer In Calcutta)
কমলা দাসের ‘সামার ইন ক্যালকাটা’ তার একটি বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ। প্রেম এবং প্রবঞ্চনা, আর তাই নিয়ে নারীর উদ্বেগ— এ সবই এই কাব্যগ্রন্থের মূল উপজীব্য। আর এমন অকপট লেখার জন্যই রক্ষণশীল সমাজ তার কবিতায় যৌনতার গন্ধ পেল। পুরুষের লেখায় নারীঙ্গের বর্ণনা বা নারীর কামনা সরাসরি ফুটে উঠলেও যে সমাজ চুপ করে না দেখার ভান করে থাকে, তারা এক নারীর লেখায় নারীর আকাঙক্ষাকে ফুটে উঠতে দেখে গেল, গেল রব তুলল। কমলা ভ্রূক্ষেপও করলেন না। তিনি লিখে গেলেন ‘দ্য লুকিং গ্লাস’, ‘দ্য ম্যাগটস’, ‘দ্য স্টোন এজ’-এর মতো কবিতা। তিনি লিখলেন—
তোমরা আমাকে জিজ্ঞাসা কর, জিজ্ঞাসা কর
সে আমার মধ্যে কী দেখেছে,
জিজ্ঞাসা কর কেন তাকে ‘সিংহ’ বলা হয়।
লম্পট তার হাত কেবলই দুলে ওঠে,
কেবলই ফণার মতো যোনিপীঠ জড়ায় …’
(The Stone Age. বাংলায় অনুবাদ: এন জুলফিকার)
আর এই সব কিছুকেই ছাপিয়ে যে গ্রন্থটির জন্য তিনি বিখ্যাত, জনপ্রিয়, নিন্দিত এবং নন্দিত হলেন তা তার আত্মজৈবনিক উপন্যাস ‘মাই স্টোরি’। ‘মাই স্টোরি’ প্রকাশিত হল ১৯৭৬–এ। এই আত্মজীবনী প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে চারিদিক থেকে প্রশংসা আর সমালোচনার ঝড় উঠল। ‘এন্তে কথা’ নামে প্রথমে এটি মালায়লম ভাষায় প্রকাশিত হয় ১৯৭৩-এ। তার আগে ১৯৭২ সালে লেখাটি ‘মালায়ালানাদু’ সাপ্তাহিকে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। ‘এন্তে কথা’ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশের সময় তার পরিবারের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা এর প্রকাশ বন্ধ করার জন্য চেষ্টার ত্রুটি করেনি। কিন্তু কমলা দাস এবং সম্পাদক ভি বি সি নায়ার ছিলেন অকুতোভয়।
ব্লিৎজ ও কিছু পত্রপত্রিকায় লেখা হল, ‘মহাত্মা গান্ধীর ‘মাই এক্সপেরিমেন্ট উইথ ট্রুথ’-এর পর সবচেয়ে সৎ এবং সাহসী আত্মজীবনী কমলা দাসের ‘মাই স্টোরি’। কিন্তু তার এই খোলামেলা স্পষ্টভাষী আত্মকথন মালায়লম সাহিত্যজগতে এবং ভারতীয় রক্ষণশীল সমাজে নানা বিতর্ক তৈরি করল। এ গ্রন্থে তার জীবন এবং সম্পর্কিত চরিত্রগুলি তিনি খোলা পাতার মতো তুলে ধরলেন পাঠকের কাছে। তার একাধিক বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক, স্বামীর সঙ্গে তার সম্পর্কের টানাপোড়েন, তার মেয়েবেলা, নারী হয়ে ওঠার বাঁকে বাঁকে ক্রমশ পুঞ্জীভূত হয়ে উঠা নানা অতৃপ্তি, নারীর পূর্ণ বিকাশের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সমাজের অসংখ্য সনাতন রীতি— সব কিছুকেই আণুবীক্ষণিক দৃষ্টিতে ক্রমশ উন্মুক্ত করে দিলেন কমলা দাস, তার এই আত্মজৈবনিক উপন্যাসে।
এই গ্রন্থ প্রকাশের পর শোভা ওয়ারিয়রকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তার ‘বহু পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক’ প্রসঙ্গে কমলা হাসতে হাসতে বলেছিলেন, ‘না, শোভা, আমি পুরুষদের খুব একটা দোষ দেখি না। আমিও তো রীতিমতো আকর্ষণীয়া ছিলাম’। এর ফলে কি স্বামীর সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হয়নি? না, কমলার স্বামী তাকে এ বই সম্পর্কে কিছুই জিজ্ঞাসা করেননি। দোষারোপ করা তো দূরের কথা। আর তাই তাদের দাম্পত্যেও কখনও চিড় ধরেনি। এ প্রসঙ্গে কমলার আর একটা যুক্তি হল, ‘…He didn’t care what I wrote really. He didn’t even read it… But he was very proud of me… There shall not be another person so proud of me and my achievements’.
‘মাই স্টোরি’ হলো সেই গ্রন্থ যার মাধ্যমে কমলা রক্ষণশীল সমাজের বাধা ডিঙোনোর পাশাপাশি ধর্মের অযৌক্তিক নাগপাশকেও চূর্ণ করতে চেয়েছেন। আর, এর ফলে পেয়েছেন অসংখ্য জনসমর্থন। এখন পর্যন্ত পনেরোটি ভাষায় ‘মাই স্টোরি’ প্রকাশিত হয়েছে। এই পরিসংখ্যানের মধ্য দিয়েই বোঝা যায় গ্রন্থটি কতখানি পাঠকপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। এই গ্রন্থের মধ্য দিয়ে তিনি সেই তাবৎ নারীদের স্বর হয়ে ফুটে উঠলেন, যারা নিজেদের ইচ্ছাকে অবদমন করে আছেন যুগ যুগ ধরে।
কমলা ছিলেন চিরকালই সোজাসাপ্টা, ডাকাবুকো। তার লেখায় যেমন কোনো ভণ্ডামি নেই, তেমনি ভণ্ডামি তিনি সহ্যও করতে পারতেন না। তাই বারংবার সমালোচিত হয়েও তিনি তার লক্ষ্যে অবিচল ছিলেন, আজীবন। এ দেশে কবিরা তাদের প্রাপ্য সম্মান পান না। কবিতা লিখে পেটের ভাত হয় না বলেই নানা উঞ্ছবৃত্তির (হীনজীবিকার) সাহায্য নিতে হয় তাকে। আর তাই কবিতা থেকে কথাসাহিত্যের আঙিনায় পা দেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বললেন, ‘শুধু কবি হয়ে টিকে থাকা খুব শক্ত, কারণ আমাদের দেশে কবিতা বিক্রি হয় না’ (It is difficult remaining a poet, because poetry does not sell in this country)।
তাই জীবিকার তাড়নায় তিনি ‘কলাম’ লিখতে শুরু করলেন। এবং এই ‘কলাম’ লেখক হিসেবেও তিনি আশ্চর্যরকম সফল। বিভিন্ন সংবাদপত্রে তার লেখা প্রতিবেদন প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে তিনি তাদের কাছেও জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন, যারা সাধারণত সাহিত্য বা সাহিত্যবিষয়ক পত্রপত্রিকা পড়েন না। আমজনতার কাছে কমলা হয়ে উঠলেন এক প্রতিবাদী লেখক, যিনি সমাজের যত অসাম্য, শঠতা, সব ‘রোগ’কে চিনিয়ে দিচ্ছেন। আর এই জনপ্রিয়তার জন্যই তিনি পরবর্তীতে হয়ে উঠলেন ‘সিন্ডিকেট কলামিস্ট’। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, ‘সিন্ডিকেট কলামিস্ট’ হলেন তারা, যাদের একটি লেখা একই সঙ্গে একাধিক পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
ইংরেজির কমলা দাসের পাশাপাশি মালায়লম ভাষার পাঠকের কাছে তার যে আর এক লেখক সত্তা, সেখানে তিনি মাধবীকুট্টি; বালামণি আম্মা এবং নালাপাত নারায়ণ মেননের এক সার্থক উত্তরাধিকারী। মালায়লম ভাষায় লেখা গল্প–উপন্যাসে তিনি তুলে ধরলেন দুই প্রজন্মের মানসিক দ্বন্দ্ব, বিবাহ–পরবর্তী জীবনে নারীর অসহায় জীবন, তাদের স্বাধীন সত্তা হারানো দ্বন্দ্বজীর্ণ আপসের গার্হস্থ্য আখ্যান। তার সময়কালে যা অকল্পনীয় তাই তিনি তুলে ধরলেন তার গদ্যে। নারীর স্বাধীনতা, যৌনতার ক্ষেত্রে নারীর স্বাধীন চিন্তা, পরাধীনতার বৃত্তে ছটফট করতে থাকা নারীর দিনযাপনের গ্লানি মাধবীকুট্টির লেখায় জীবন্ত হয়ে উঠল।
মালায়লম সাহিত্যের সামাজিক–সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটকে আমূল বদলে দিলেন তিনি। সাহিত্য ক্রমশ আধুনিক হয়ে উঠল। আর গল্পকার হিসেবে মাধবীকুট্টি মালায়লম সাহিত্যে এক স্বতন্ত্র লেখক হিসাবে চিহ্ণিত হলেন। কারণ মালায়লম গদ্যে তিনি নিয়ে এলেন সহজ, স্বতঃস্ফূর্ত অথচ প্রতীকের আড়ালে এক তীব্র ব্যঞ্জনার কাব্যময় সুষমা। তার গল্প মানুষের অন্তর্জগৎকে সঠিকভাবে চিত্রিত করার পাশাপাশি গল্পে বক্ষ্যমাণ রূপক তাকে পৌঁছে দেয় এক সার্বজনীন প্রাসঙ্গিকতার শীর্ষবিন্দুতে। অনেকের মতে, ‘পক্ষীয়ুদে মানাম’ মালায়লম সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ একটি গল্প। তার অন্যান্য গল্পগুলির মধ্যে বিখ্যাত কয়েকটি হল— পুন্যায়ুরকুলাম, নেপায়াসাম, চন্দনা মারাঙ্গল এবং থানুপ্পু।
কমলা দাসের লেখায় এক বিপুল বৈচিত্র্য লক্ষ করি আমরা। যে বৈচিত্র্যের মধ্যে প্রতিবাদী কণ্ঠ খুঁজে যায় প্রেম এবং ব্যক্তিসত্তার সার্বিক স্বাধীনতা। তার লেখা ইংরেজি গ্রন্থগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল— দ্য সিরেনস (কবিতা, ১৯৬৪), সামার ইন ক্যালকাটা (কবিতা, ১৯৬৫), দ্য ডিসেন্ড্যান্টস্ (কবিতা, ১৯৬৭), দ্য ওল্ড প্লে হাউস অ্যান্ড আদার পোয়েমস্ (কবিতা, ১৯৭৩), মাই স্টোরি (আত্মজীবনী, ১৯৭৬), অ্যালফাবেট অফ লাস্ট (উপন্যাস, ১৯৭৭), দ্য আন্নামালাই পোয়েমস (কবিতা, ১৯৮৫), পদ্মাবতী দ্য হারলট অ্যান্ড আদার স্টোরিজ (গল্পগ্রন্থ, ১৯৯২), ওনলি দ্য সোল নো’জ হাউ টু সিঙ্গ (কবিতা, ১৯৯৬) এবং ইয়া আল্লাহ (কবিতা, ২০০১)।
আর মালায়লম ভাষায় লেখা তার গ্রন্থগুলি হল— পক্ষীয়ুদে মারানাম (গল্প, ১৯৬৪), নারিচিরুকল পারাক্কুম্বল (গল্প, ১৯৬৬), থানুপ্পু (গল্প, ১৯৬৮), বাল্যকাল স্মরণকাল (বাল্যস্মৃতিকথা, ১৯৮৭), বর্ষনগলক্কু মুম্বু (১৯৮৯), পলায়ন (উপন্যাস, ১৯৯০), নেপায়াসাম (গল্প, ১৯৯১), দায়ারিক্কুরিপ্পুকাল (উপন্যাস, ১৯৯২), নির্মথলম পুথা কলম (উপন্যাস, ১৯৯৪), চেক্কেরুন্না পক্ষিকাল (গল্প, ১৯৯৬), নাস্তাপেত্তানীলাম্বরি (গল্প, ১৯৯৮), চন্দনা মারাঙ্গল (উপন্যাস, ২০০৫), মাধবী কুট্টিয়ুদে উনমাক্কাধাকাল (গল্প, ২০০৫) এবং বন্দীক্কালাকাল (উপন্যাস, ২০০৫)।
ইংরেজি ও মালায়লম সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য কমলা অসংখ্য সাহিত্য সম্মান ও পুরস্কারে ভূষিত। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল এশিয়ান পোয়েট্রি প্রাইজ, কেন্ট অ্যাওয়ার্ড ফর ইংলিশ রাইটিং ফ্রম এশিয়ান কান্ড্রিজ, এশিয়ান ওয়ার্ল্ড প্রাইজ, এজুথাচান অ্যাওয়ার্ড, সাহিত্য আকাদেমি, ভায়ালার অ্যাওয়ার্ড, কেরালা সাহিত্য আকাদেমি এবং মুত্থাতু ভারকে অ্যাওয়ার্ড। এর পাশাপাশি কেরালা সাহিত্য আকাদেমির সহ–সভাপতি, কেরালা চিলড্রেন্স ফিল্ম সোসাইটির সভাপতির পদ অলংকৃত করেন কমলা। তিনি কিছুদিনের জন্য পোয়েট ম্যাগাজিনের সম্পাদক এবং ইলাস্ট্রেটেড উইকলি অফ ইন্ডিয়ার কবিতা বিভাগের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকও হয়েছিলেন।
আমন্ত্রিত কবি হিসেবে কমলা পৃথিবীর নানা দেশে ঘুরেছেন, বক্তৃতা দিয়েছেন বিশ্বের নানা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এর ফলে তার খ্যাতি দেশ ছাড়িয়ে প্রসারিত হয়েছে পৃথিবীর নানা প্রান্তে। আর তাই অধিকাংশ ভারতীয় ভাষায় তার গ্রন্থ অনূদিত হওয়ার পাশাপাশি ফ্রেঞ্চ, জার্মান, রাশিয়ান, জাপানিজ, স্প্যানিশ–সহ পৃথিবীর প্রায় পনোরোটি ভাষায় তা প্রকাশিত হয়েছে।
তার লেখা গল্প ও কবিতায় যেভাবে বারবার অভিঘাত সৃষ্টি করেছিলেন কমলা, ঠিক সেভাবেই জীবনের শেষ অভিঘাতটি তিনি রচনা করলেন তার অগণিত পাঠক, রক্ষণশীল মালায়লম সমাজ এবং আত্মীয়–বন্ধুদের জন্য। স্বামীর মৃত্যুর মাত্র কয়েক মাস পরে ১৯৯৯–এর ডিসেম্বরে ৬৭ বছর বয়সে কমলা তার আজন্মলালিত হিন্দুধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। কমলার সঙ্গে যুক্ত হল ‘সুরাইয়া’— হলেন কমলা সুরাইয়া। মালায়লম–ভাষীদের কাছে শুধুই ‘সুরাইয়া’। কিন্তু কেন এই ধর্ম পরিবর্তন? সুরাইয়া বললেন, কারণ হল— ‘ইসলাম ধর্মে নারীর সুরক্ষা’। ‘কিন্তু ইসলাম ধর্ম কী আপনার বিতর্কিত অতীতকে মেনে নেবে?’ কমলা সুরাইয়া বললেন, ‘ধর্ম কখনই কারো সৃষ্টিকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করতে পারে না। আর আল্লাহ তো পরম করুণাময়। আমার মন বলছে, আল্লাহ আমার সব পাপ মাফ করে দেবেন’।
ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘ রোগভোগের পর মালায়লম এবং ইংরেজি ভাষার সবচেয়ে বিতর্কিত লেখক কমলা সুরাইয়া ২০০৯–এর ৩১ মে পুনের একটি সরকারি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। শেষকৃত্যের জন্য পুনে থেকে কেরালার তিরুবনন্তপুরমে তার মরদেহ নিয়ে আসা হয়। জাতি–ধর্ম নির্বিশেষে হাজার হাজার মানুষ তার এই শেষযাত্রায় শামিল হয়ে তাকে শেষ বিদায় জানান। কমলা সুরাইয়ার ইচ্ছানুসারে তাকে পালায়ম মসজিদ সংলগ্ন গুলমোহর গাছের নিচে সমাহিত করা হয়।
কমলার অসম্ভব জনপ্রিয়তার কারণে পালায়ম মসজিদ কর্তৃপক্ষ প্রথা ভেঙে নারী ও অন্য ধর্মাবলম্বীদেরও গোরস্তানে প্রবেশ করে তার কবরে মাটি দেওয়ার অনুমতি দেন। আর এভাবেই এক অসাধারণ বর্ণময় জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে। যার জন্ম মাধবী কুট্টি হিসাবে, জীবনকে যিনি পরিপূর্ণভাবে উপভোগ করেছেন কমলা দাস রূপে আর প্রকৃত অর্থেই তার ভক্ত পাঠকদের মূক করে রেখে কমলা সুরাইয়া হিসাবে তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন। রেখে গেলেন তিন পুত্র— মনু দাস নালাপাত, চিন্নন দাস, জয়সূর্য দাস; এবং সেইসব বিতর্কিত রচনাবলি— যার মাধ্যমে পাঠককে, সমাজকে ভাবিয়েছেন তিনি, মানুষকে শুনিয়েছেন— প্রতিবাদী হৃদয়ের গান।