অষ্টগ্রাম। মিঠামইন। নিকলী হাওর। শোলাকিয়া ঈদগাহ। ঐতিহাসিক জঙ্গলবাড়ী। উপেন্দ্র কিশোর রায়। সুকুমার রায়। চন্দ্রাবতী। নামগুলো চেনা চেনা লাগছে কি পাঠক? কিছু অনুমান করা যাচ্ছে কি? দর্শনীয় স্থান বলুন, আর খ্যাতনামা ব্যক্তিত্বই বলুন, নামগুলো বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জ জেলার সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে সম্পর্কিত। প্রতিভাবান সন্তান প্রসবে কিশোরগঞ্জ জেলা বরাবরই উচ্চাবস্থানে আসীন। আজকে আমরা কথা বলব কিশোরগঞ্জ জেলার অন্যতম মেধাবী একজন ব্যক্তিত্বকে নিয়ে, দুর্ভাগ্যজনকভাবে যিনি আমাদের চিন্তা-চেতনার দৈন্যের দরুন বিস্মৃতপ্রায়।
নীরদ চন্দ্র চৌধুরী। ১৮৯৭ সালের ২৩ জানুয়ারি ব্রিটিশশাসিত ভারতবর্ষের পূর্ব বাংলার কিশোরগঞ্জ জেলায় তার জন্ম। তিনি মৃত্যুবরণ করেন ১৯৯৯ সালের ১ আগস্ট ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ডে। নীরদ চৌধুরীকে নিয়ে এককথায় বলতে গেলে তিনি ভুল সময়ে ভুল জায়গায় জন্ম নিয়েছিলেন। সময়ের চেয়ে অগ্রগামী, পরস্পরবিরোধী বক্তব্যে বিশ্বাসী, দ্বান্দ্বিক এক জীবনদর্শনে আস্থা রাখা এই তুমুল আলোচিত-সমালোচিত ব্যক্তিকে নিয়েই আজকের এই লেখা।
নীরদ পৃথিবীর আলো দেখেছিলেন এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে। অথচ তার আত্মজীবনী লেখা হয়েছিল মাত্র ৫৩ বছর বয়সে- ‘দ্য অটোবায়োগ্রাফি অভ অ্যান আননোন ইন্ডিয়ান’। আধুনিক ভারতের প্রসিদ্ধ ইতিহাস গবেষক ডেভিড লেলিভেল্ড নীরদকে নিয়ে বলেন,
নীরদ মূলত একজন আগাগোড়া উদ্ধত, ভয়ানক, দ্বন্দ্বমুখর ব্যক্তিত্ব, যিনি একইসাথে সাম্রাজ্যবাদী সাহিত্যের ঝাণ্ডাধারী। কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ হওয়ার পর সামরিক বাহিনীর অ্যাকাউন্টস বিভাগে ক্লার্ক পদে যোগ দেন। বাকিটা জীবন তিনি কাটিয়েছেন ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের নানা দিক নিয়ে আলোচনা করে। ইংরেজদেরকে তিনি তাদেরই তৈরি করা খেলায় হারিয়েছেন- নীরদের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব এখানেই।
ভি এস নাইপল নীরদের আত্মজীবনীকে ভূয়সী প্রশংসা করে বলেছেন,
ইন্দো-ইংলিশ প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে উঠে আসা সর্বোৎকৃষ্ট সাহিত্য হলো নীরদের আত্মজীবনী। ভারতীয় উপমহাদেশে পশ্চিমা সংস্কৃতির আধিপত্যের প্রতি এমন বলিষ্ঠ জবাব মেলা ভার।
নীরদের শক্তিশালী উপস্থিতির মূল তার হতাশায় নিমজ্জিত এবং এ হতাশাও অনেকটাই পরস্পরবিরোধী। ১৭৫৭ সাল থেকে ব্রিটিশ শাসনের সমাপ্তি এবং তারই ফলাফল হিসেবে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের উদ্ভব নীরদকে দারুণভাবে পীড়িত করে। ব্রিটিশ শাসনের পরিসমাপ্তির মধ্য দিয়ে কোলকাতাকেন্দ্রিক ‘বাঙালি বাবুদের’ অধ্যায় শেষ হয়ে যাবে, এ ভাবনা তাকে দুঃখ ভারাক্রান্ত করে দেয়। তিনি চেয়েছিলেন, এই বাঙালি বাবুরাই যুগ-যুগান্তে আধুনিক ভারতের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক নেতৃত্বের শীর্ষে থাকুক। বাঙালি রেনেসাঁর সর্বশেষ উদ্বর্তী আমিই”; যে বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনের শুরুটা করেছিলেন রামমোহন রায় আর সর্বশেষ দায়িত্ববান ব্যক্তি ছিলেন এশিয়ার সর্বপ্রথম সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নিজেকে নিয়ে নীরদের ভাবনা ছিল এমনটাই।
নীরদ তার প্রথম বই উৎসর্গ করেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে। তিনি তার আত্মজীবনীতে আন্তরিক ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন ব্রিটিশদেরকে, ভারতবর্ষে তাদের দু’শো বছরের শাসনের জন্য। বইটি প্রকাশের চার বছর পর ব্রিটিশ কাউন্সিলের একটি গ্র্যান্টের কারণে নীরদ প্রথমবারের মতো বিলেত ভ্রমণের সুযোগ লাভ করেন। তার এ ভ্রমণের সমুদয় অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি ১৯৫৯ সালে লিখেন ‘প্যাসেজ টু ইংল্যান্ড’ বইটি। নীরদের প্রথম বাংলা বই প্রকাশিত হয় ১৯৬৮ সালে। প্রকাশকের তরফ থেকে প্রকারান্তরে উপঢৌকন পেয়ে তিনি লিখেছিলেন ‘বাঙালি জীবনে রমণী’ বইটি। ১৯৭০ সালে তিনি আবারও ইংল্যান্ডে যান। এবারের উদ্দেশ্য ছিল সংস্কৃত বিষয়ক বিখ্যাত পণ্ডিত ম্যাক্স মুলারের জীবনী রচনা।
কোলকাতার ছেলে অমিত চৌধুরী নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন বেশ হতাশার সাথে। সুদীর্ঘ সময় ধরে তিনি ক্যামব্রিজে কমনওয়েলথ সাহিত্য বিষয়টি পড়িয়েছেন। তিনি বলেছেন,
দীর্ঘকালের অধ্যাপনা জীবন থেকে আমি বুঝতে পেরেছি যে, ভি এস নাইপলের মতোই নীরদ চোধুরী এবং আর কে নারায়ণকে লোকে পড়তে চায় না। শিক্ষার্থীদের কাছে এটি পড়ার মতো কিছু নয় আর শিক্ষকদের কাছে এটি পড়ানোর মতো নয়। ঔপনিবেশিক পরবর্তী সাহিত্যকর্মগুলো মানুষের কাছে খুব জটিল ঠেকে, অথবা বলা যেতে পারে অতি কল্পনাপ্রবণ। চৌধুরী, নাইপল, নারায়ণের লেখাগুলো এমনই এক সাংকেতিক সাহিত্য হিসেবে বর্তমান প্রজন্মের কাছে আবির্ভূত হয়, যার অর্থ ভেদ করার মতো হাতিয়ার তাদের কাছে নেই।
নীরদের লেখাগুলো সাহিত্যের ভুবনে খ্যাতি পাওয়ার পরেও জনপ্রিয়তার মানদণ্ডে কেন উত্তীর্ণ হলো না, তা একটি ভাববার মতো বিষয়। তার অধিকাংশ রচনাবলীতে বিমর্ষতা হল এই প্রশ্নের উত্তর। নীরদের সাহিত্যকর্মে বিমর্ষতার লক্ষণগুলো অতটা সুস্পষ্ট নয়; অর্থাৎ, তাকে মূলধারার বিমর্ষ সাহিত্যিকদের কাতারে ফেলা যাবে না। নীরদের চাঁছাছোলা গদ্যরীতি আর বিমর্ষতা তার সাহিত্য চর্চায় সম্ভবত এক ধ্রুপদী প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। এর সপক্ষে সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলো তার আত্মজীবনীতে নিজেকে তিনি যেভাবে হাজির করেছেন।
নীরদের আত্মজীবনীতে তার নিজস্ব গদ্যরীতির আড়ালে ঢাকা পড়ে যায় তার বিমর্ষতার প্রতি অনুরাগ। নীরদের এই প্রায় জীবনব্যাপী বিষণ্ণতার উৎস ছিল তার জীবনে বহু কিছু হারানোর বেদনা। এই বিমর্ষতার সাথে মিল খুঁজে পাওয়া যায় বাংলা সাহিত্যের তিন প্রবাদপ্রতিমের। এদের সকলেই নীরদের খুব কাছের মানুষ ছিলেন। প্রমথ চৌধুরী ও বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাথে নীরদের ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল এবং রবিঠাকুরের সাথে ছিল তার মেধার লেনাদেনা।
নীরদের সবচেয়ে বড় শক্তি কী ছিল? নীরদের প্রতাপের সুলুকসন্ধান করতে গেলে যে অবধারিত উত্তরটি মেলে, তা হলো বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা। নীরদ বরাবরই অপ্রতিরোধ্য ছিলেন। কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীবিশেষ কর্তৃক তিনি দমে যাবার পাত্র ছিলেন না, এমনকি ছিলেন না ভাগ্যের পরিহাস বলে জীবনকে সকরুণভাবে চিত্রায়িত করে সহমর্মিতা আদায়ের পক্ষেও। তার নিজস্ব, একান্তই নিজস্ব বিকাশের জন্য বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা তার জন্য ভীষণভাবে জরুরি ছিল, যা তাকে সাহায্য করেছে সাহিত্যচর্চায় স্বনামধন্য হতে। স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় ফেল করে তিনি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে বিদায় জানালেন। দ্বিতীয়বার পরীক্ষায় বসতে তিনি অস্বীকৃতি জানালেন।
তখন তার কোনো আয় রোজগারের ব্যবস্থাও ছিল না। তৎকালীন কোলকাতায় একজন স্নাতকোত্তর ফেল যুবক যার আবার কোনো অর্থকড়িরও যোগান নেই, তাকে কী অপরিসীম মানসিক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিল, তা চিন্তা করাও কঠিন। যুবক বয়সে বেকার তকমা গায়ে লেগে যাওয়ার মতো এত বড় অভিশাপ এখন তো নেই-ই; বোধ করি সে আমলেও ছিল না। এ পরিস্থিতিতেও নীরদ তার ধীশক্তির স্ফূরণ থামাননি।
শেষ করব একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কথা বলে। যদি বলা হয়, মাইকেল মধুসূদন দত্ত এবং নীরদ চন্দ্র চৌধুরী অন্তত একটি জায়গায় সহাবস্থান করেন, তাহলে সেটি কী? বিদেশী ভাষায় সাহিত্য চর্চা, তবে একথাও স্মর্তব্য যে, মাতৃভাষা বাদ দিয়ে ভিনদেশী ভাষায় নিজের বুদ্ধিবৃত্তির প্রচারণা চালানোর প্রেক্ষাপট এই দুই কিংবদন্তিসম সাহিত্যিকের ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন। নীরদ রাজনীতি, দর্শন ইত্যাদি বহুবিধ বিষয়ে তিনি লিখেছেন। একজন আপাদমস্তক সাহিত্যিক যদি সাহিত্যচর্চা করতে যান, তার ক্ষেত্রে মাতৃভাষাকে বেছে নেওয়াটাই স্বাভাবিক ও সহজাত।
নীরদ স্রেফ একজন সাহিত্যিক ছিলেন না। তার মননের ভুবনে তিনি এমন সব বহুমুখী বিষয়ে বিচরণ করেছেন, যাতে মাতৃভাষা বাংলা ভাব প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে আদর্শতম ছিল না। ইংরেজি ভাষা তাকে রাজনীতি, দর্শন, ইতিহাস ইত্যাদি নানারকম দেশীয় ও আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে লিখে বৃহত্তর পরিসরে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিল। ভারতবর্ষ তো বটেই, এমনকি আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও নীরদের আজকের প্রভাবশালী অবস্থানের পেছনে ইংরেজি ভাষার অবদান অনস্বীকার্য।