Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

হেমেন্দ্রকুমার রায়: বাংলা রহস্য রোমাঞ্চ কাহিনীর এক অনবদ্য শিল্পী

“খাসিয়া পাহাড় পার হয়ে রূপনাথ নামের এক গুহা অতিক্রম করে পঁচিশ ক্রোশ পশ্চিমে এগিয়ে যেতেই চোখে পড়বে একটি উপত্যকা। সেই উপত্যকার মাঝেই রয়েছে অনেক কাল আগের পুরনো এক বৌদ্ধ মঠ। সেই মঠের কোনো এক জায়গায় এক রাজা শত্রুদের চোখ এড়িয়ে লুকিয়ে রেখেছিলেন তার সমস্ত ধন-সম্পদ। কথিত আছে, সেই ধনরত্ন এখনো উদ্ধার হয়নি। রাজা তার সম্পদ কোথায় লুকিয়ে রেখেছেন কেউ নাকি তার সন্ধান বের করতে পারেনি। সে মঠে নাকি সারাজীবন ধরে খুঁজলেও রাজার সেই সম্পদ কারো খুঁজে বের করার জো নেই। সে সন্ধান দিতে পারেন কেবল এক সন্ন্যাসী। সেই সন্ন্যাসীর ঝোলাতে রয়েছে একটি মড়ার মাথার খুলি আর তাতেই রয়েছে লুপ্ত ধনরত্ন খোঁজ পাওয়ার সন্ধান…”

এই গল্পের প্লট আমাদের অনেকেই চেনা। গল্পটি বিখ্যাত সাহিত্যিক হেমেন্দ্রকুমার রায়ের ‘যকের ধন’ গল্পের অংশবিশেষ। বাংলা সাহিত্যে ছোটদের জন্য অ্যাডভেঞ্চার কাহিনী লেখার সূত্রপাত ঘটে এই গল্পের মধ্য দিয়ে, পরবর্তী বাংলা সাহিত্যে যা এক জনপ্রিয় ধারা হিসেবে পরিচিতি পেতে থাকে। হেমেন্দ্রকুমার রায়ের হাত ধরেই অ্যাডভেঞ্চার কাহিনীগুলো পাঠকদের এক অন্য জগতে নিয়ে যায়।

হেমেন্দ্রকুমার রায় বাংলা শিল্পজগতে এক বর্ণময় চরিত্র। সাহিত্যের বিভিন্ন ধারায় তার ছিল অবাধ বিচরণ। তিনি একাধারে ঔপন্যাসিক, কবি এবং গীতিকার। কিশোর সাহিত্যে তার ছিল অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তা।

সহিত্যিক হেমেন্দ্রকুমার রায়; Image Source:anandabazar.com

হেমেন্দ্রকুমার রায় ১৮৮৮ সালের ২ সেপ্টেম্বর কলকাতার পাথুরিয়াঘাটা অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন। তার পারিবারিক নাম ছিল প্রসাদদাস রায়। তিনি মাত্র ১৪ বছর বয়সে সাহিত্যচর্চা শুরু করেন। ১৯০৩ সালে বসুধা পত্রিকায় তার প্রথম গল্প ‘আমার কাহিনী’ প্রকাশিত হয়। ১৯১৫ সালে নতুন রূপে প্রকাশিত ‘ভারতী’ পত্রিকায় তিনি যোগ দেন এবং সেখানে তার নিয়মিত লেখা প্রকাশিত হতে থাকে। এছাড়া ১৯২৩ সালে ‘মৌচাক’ পত্রিকায় লিখতে শুরু করেন এবং এ পত্রিকায় তার বিভিন্ন ধরনের লেখা নিয়মিত প্রকাশিত হতে থাকে।

ছদ্মনামে জনপ্রিয় হলেন যেভাবে

রবিঠাকুরের দিদি স্বর্ণকুমারী দেবী তখন ‘ভারতী’ পত্রিকার সম্পাদক। তরুণ প্রসাদদাস রায় এ সময় নিয়মিত লেখক হিসেবে ভারতীতে লিখে চলেছেন। একদিন এই তরুণ লেখক সম্পাদকের কক্ষে গিয়ে বঙ্কিম যুগের বাঙালিদের নিয়ে একটি ধারবাহিক প্রবন্ধ লিখতে সম্পাদকের কাছে অনুমতি চাইলেন। স্বর্ণকুমারী দেবী প্রসাদ সম্পর্কে বেশ অবগত ছিলেন। তিনি এই তরুণ লেখককে লেখার অনুমতি দিলেন। তবে প্রসাদ দাস রায় নামে লেখাটি ছাপা হবে না বলে সম্পাদক তাকে আগেই জানিয়ে দেন। সম্পাদক লেখককে এই লেখার জন্য একটি ছদ্মনাম বেছে নিতে বললেন। বয়সে তরুণ বলে বিভিন্ন জায়গা থেকে লেখাটি নিয়ে প্রতিবাদ আসতে পারে ভেবে ভীত ছিলেন স্বর্ণকুমারী দেবী।

 ভারতী পত্রিকার সম্পাদক স্বর্ণকুমারী দেবী; Image Source:wikimedia commons

সম্পাদকের কথামতো প্রসাদ দাস রায় ছদ্মনামেই ধারাবাহিকভাবে লিখে চললেন একের পর এক প্রবন্ধ। তার এই প্রবন্ধগুলো বেশ প্রশংসিত হতে লাগলো সুধি মহলে। শেষে ছদ্মনামেই এত বিখ্যাত হয়ে গেলেন যে বাবার দেয়া ‘প্রসাদ’ নামটি হারিয়ে গলে চিরতরে। সেই থেকে তার নাম হয়ে গেল হেমেন্দ্রকুমার রায়।

অ্যাডভেঞ্চার সাহিত্য লেখার শুরু যার হাত ধরে

লেখালেখির একপর্যায়ে হেমেন্দ্রকুমার ‘মৌচাক’ পত্রিকার সম্পাদক সুধীরচন্দ্র সরকারের সম্মতি নিয়েই ছোটদের অ্যাডভেঞ্চার কাহিনী লিখতে শুরু করেন। এই পত্রিকায় তার প্রথম অ্যাডভেঞ্চার গল্প ‘যকের ধন’ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে থাকে। এই গল্পের সাফল্যের পর থেকেই ‘মৌচাক’ পত্রিকার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠলো অ্যাডভেঞ্চার ও রহস্য গল্প। অ্যাডভেঞ্চার ও গোয়েন্দা গল্পের কারণে ‘মৌচাক’ পত্রিকার জনপ্রিয়তা দেখে সমকালীন অন্যান্য নামীদামী লেখকেরা এ ধরনের গল্প লিখতে উৎসাহিত হন।

একটি গুপ্ত সংকেতের অর্থ উদ্ধার করে দুর্গম জঙ্গল এবং পার্বত্য অঞ্চলে অভিযান পরিচালনার জমজমাট এক গল্প হেমেন্দ্রকুমারের প্রথম অ্যাডভেঞ্চার কাহিনী ‘যকের ধন’। গল্পের নায়ক দুই উদ্যমী তরুণ কুমার এবং বিমল। মৌচাকে প্রকাশিত হেমেন্দ্রকুমারের দ্বিতীয় কাহিনী ছিল কল্পবিজ্ঞানের, নাম ছিল ‘মেঘদূতের মর্ত্যে আগমন’। মঙ্গলগ্রহের অধিবাসীদের পৃথিবী আক্রমণ এবং মঙ্গলগ্রহ অভিযান ছিল গল্পটির বিষয়বস্তু। এভাবে তিনি লিখে গেছেন জনপ্রিয় সব অ্যাডভেঞ্চার কাহিনী।

  হেমেন্দ্রকুমারের প্রথম অ্যাডভেঞ্চার কাহিনী ‘যকের ধন’ ; Image Source:shishukishor.org

হেমেন্দ্রকুমারের অ্যাডভেঞ্চার কাহিনীর মধ্যে তার প্রিয় বিষয় ছিল গোপন সংকেত, কঠিন ধাঁধাঁ বা জটিল হেঁয়ালির সমাধান করে গুপ্তধনের অনুসন্ধান। এ ধরনের কাহিনীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ‘যকের ধন’, ‘আবার যকের ধন’, ‘যক্ষপতির রত্নপুরী’, `সূর্যনগরীর গুপ্তধন’ ইত্যাদি। তার কাহিনীর নামই মূলত পাঠককে আকৃষ্ট করতো। তার এই অ্যাডভেঞ্চার কাহিনীর পেছনে ছিল শুধুমাত্র অজানাকে জানার, অদেখাকে দেখার আর বিপদসঙ্কুল পথকে সাহস আর বিক্রমের সাথে জয় করার এক দুঃসাহসী প্রচেষ্টা।

 ‘যকের ধন’ গল্পের সাফল্যের পর এর সিকুয়্যাল ‘আবার যখের ধন’ও বেশ প্রশংসিত হয় ; Image Source:shishukishor.org

তাই বিমলের মুখে শোনা যায়, 

“গুপ্তধনের ওপরে আমাদের কোনো লোভ নেই, আমরা খালি চাই বিপদকে! সে বিপদ হবে যত ভয়ানক, আমাদের আনন্দ হবে তত বেশি!” সঙ্গী কুমারও বলেছে, “বিপদ না থাকলে মানুষের জীবনটা হয় আলুনি আলুভাতের মতন।”

কুমার এবং বিমল ছাড়াও হেমেন্দ্রকুমার তার গল্পে আরো যেসব নায়ক চরিত্রের সৃষ্টি করেছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম সত্যসন্ধানী জয়ন্ত। জয়ন্ত এবং তার বন্ধু মানিককে নিয়ে লেখা হেমেন্দ্রকুমারের প্রথম উপন্যাস ‘জয়ন্তের কীর্তি’। এই উপন্যাসটি প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথেই দারুণ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। 

 হেমেন্দ্রকুমার রায় রচিত সফল গোয়েন্দা কাহিনী জয়ন্ত মানিক; Image Source:amarbooks.com

হেমেন্দ্রকুমারের আরেকটি গোয়েন্দা সিরিজ ছিল হেমন্ত-রবিন। জয়ন্ত-মানিকের মতোই এটা সে সময় বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। এই গোয়েন্দা হেমন্ত যেন লেখক নিজেই। তিনি শুধুমাত্র গোয়েন্দাই নন, বুদ্ধিমান বিজ্ঞানীও। সহকারী বন্ধু রবিনের সহায়তায় এক দুষ্টু বিজ্ঞানীর কারবার ফাঁস করেছিলেন ‘অন্ধকারের বন্ধু’ গল্পে। এসব গল্পে আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রের দেখা মেলে, তা হলো সতীশ বাবু নামের একজন পুলিশ ইন্সপেক্টরের।

    Image Source:shishukishor.org

বিদেশী ছায়া অবলম্বনে রচিত জনপ্রিয় কিছু রচনা

হেমেন্দ্রকুমার বিদেশী রহস্য রোমাঞ্চ কাহিনীর যথেষ্ট খোঁ খবর রাখতেন, যা তার লেখায় বেশ স্পষ্ট। বিদেশের নানা ক্রিমিনোলজি এবং ফরেনসিক সায়েন্স বিষয়ক নানা আবিষ্কারের নতুন নতুন সব তথ্য তিনি অবলীলায় তার কাহিনীতে ব্যবহার করে পাঠকদের চমকে দিতেন। বাংলার পাঠকদের জন্য বিদেশী নানা রহস্য রোমাঞ্চ কাহিনীকে বাংলার স্থান-কাল-পাত্রের উপযোগী করে লিখেছেন বেশ কিছু রচনা। এসব কাহিনীর মধ্যে ‘বিশালগড়ের দুঃশাসন’ (ব্রাম স্টোকারের ‘ড্রাকুলা’), ‘নিশাচরী বিভীষিকা’ (আর্থার কোনান ডয়েলের ‘দ্য হাউন্ড অফ দ্য বাস্কারভিলস’), ‘হারাধনের দ্বীপ’ (আগাথা ক্রিস্টির ‘টেন লিটল নিগারস’) ইত্যাদি বিশেষ উল্লেখযোগ্য।

     আগাথা ক্রিস্টির ‘টেন লিটল নিগারস’ গল্পের ছায়া অবলম্বনে রচিত উপন্যাস ‘হারাধনের দ্বীপ’; Image Source:shishukishor.org

অ্যাডভেঞ্চার কাহিনী ছাড়া সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায়ও তার পদচারণা ছিল উল্লেখ করার মতো। ইতিহাসভিত্তিক রচনা লেখায় তিনি বেশ বৈচিত্র্য দেখিয়েছেন, লিখেছেন নানা বই। ‘আলো দিয়ে গেল যারা’, ‘ভগবানের চাবুক’ ইত্যাদি তার ইতিহাসভিত্তিক গ্রন্থ। তার লেখার বিষয়বস্তু অবাক হওয়ার মতোই। ‘আলোকচিত্রের নবধারা’, ‘রোদ্যার শিল্পচাতুর্য’, ‘মিশরের আর্ট’, ‘মানুষখেকো গাছ’ ইত্যাদিতে বিষয় বৈচিত্র্যে ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়।

তার লেখা ‘তারা তিন বন্ধু’-তে মানবিকতার এক উজ্জ্বল ছবি ফুটে উঠেছে। তার অসম্ভব জনপ্রিয় আরেক গ্রন্থ ‘দেড়শো খোকার কান্ড’। এসব রচনার মধ্যে তার বিভিন্ন বিষয়ে পান্ডিত্য, বিভিন্ন চরিত্রের রুপায়ণে সূক্ষ্মবোধ এবং গল্প নির্মাণের গভীরতা প্রবলভাবে উপলব্ধি করা যায়। তার ২৭ খন্ড রচনাবলী প্রকাশিত হওয়ার পরও বহু লেখা এখনো অগ্রন্থিত রয়ে গেছে এবং কালের গর্ভে হারিয়েও গেছে বহু সৃষ্টি।

 হেমেন্দ্রকুমারের জনপ্রিয় আরেক গ্রন্থ ‘দেড়শো খোকার কান্ড’; Image Source: shishukishor.org

বিভিন্ন পত্রিকার সম্পাদনা

বিভিন্ন পত্রিকায় শুধু লেখালেখির কাজেই হেমন্দ্রকুমার রায় নিজেকে ব্যস্ত রাখেননি, নতুন নতুন পত্রিকা সম্পদনা করা, নতুন প্রতিভাধর লেখক খুঁজে বের করা সবই হয়েছে তার হাত ধরে। ১৯২৫ সালে তিনি সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘নাচঘর’ এবং ‘ছন্দা’ নামের পত্রিকা সম্পাদনা করেন। ‘নাচঘর’ ছিল একটি অতি উঁচু মানের শিল্প-সাহিত্য-বিনোদন সংক্রান্ত পত্রিকা। এই পত্রিকায় অনেক স্বনামধন্য লেখকের হাতেখড়ি হয়।

অন্য এক হেমেন্দ্রকুমার

হেমেন্দ্রকুমারের আরেকটি গুণের কথা অনেকেই জানেন না। তিনি ছিলেন একজন সার্থক গীতিকার এবং সুরকার, এককথায় বলা চলে বহুমুখী প্রতিভাসম্পন্ন একজন মানুষ। শচীন দেববর্মণ, কৃষ্ণচন্দ্র দে’র মতো প্রখ্যাত শিল্পীরাও গেয়েছেন তার গান। সে সময়ের বাংলা মঞ্চ এবং গ্রামাফোনে গাওয়া গানের প্রচলিত ধারা এবং রুচির আমূল পরিবর্তন নিয়ে এসেছিলেন তিনি। তার রচিত অনেক গান তৎকালীন সময়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।

চলচ্চিত্র সমালোচক হিসেবে হেমেন্দ্রকুমার রায়ের বেশ খ্যাতি ছিল। বাংলায় শিল্প সমালোচনার ক্ষেত্রে তাকে অন্যতম পথিকৃৎ হিসেবে ভাবা হয়। চলচ্চিত্র সমালোচনা লিখতে লিখতে চলচ্চিত্র জগতেও প্রবেশ করেন কাহিনীকার হিসেবে। ১৯৩৫ সালে জ্যোতিষ মুখার্জী পরিচালিত ‘পায়ের ধুলো’ ছবির কাহিনীকার ছিলেন হেমেন্দ্রকুমার। ১৯৩৯ সালে তার গল্প ‘যকের ধন’ চলচ্চিত্রে রূপ দেওয়ার জন্য গল্পের পরিমার্জনে তাকেই বেছে নেয়া হয়। গল্পের সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে বেছে নেয়া হয় শচীন দেব বর্মণকে। এছাড়া ১৯৫১ সালে তার লেখা নিশীথিনী বিভীষিকা অবলম্বনে বাংলা চলচ্চিত্র জিঘাংসা এবং হিন্দিতে বিশ সাল বাদ এবং ১৯৫৯ সালে তার রচিত দেড়শো খোকার কান্ড নির্মিত হয়।

‘যকের ধন’ গল্পের চলচ্চিত্রে রূপ ; Image Source:BengalBuzz.com

শিশু-কিশোরদের জন্য হেমেন্দ্রকুমার রায় ৮০টিরও বেশি বই লিখেছিলেন। এর মধ্যে কী নেই? কবিতা, নাটক, হাসি ও ভূতের গল্প, অ্যাডভেঞ্চার, গোয়েন্দা কাহিনী, ঐতিহাসিক উপন্যাস সবকিছুতেই তার ছিল সরব পদচারণা। তার অসাধারণ সব চরিত্র বিমল, কুমার, জয়ন্ত (গোয়েন্দা) ও সহকারী মানিক, পুলিশ ইন্সপেক্টর সুন্দরবাবু, ডিটেকটিভ হেমন্ত বাংলা কিশোর সাহিত্যে বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে।

পঁচাত্তর বছর বয়স পর্যন্ত একটানা লিখে গেছেন হেমেন্দ্রকুমার রায়। সারা জীবন এত লিখেছেন যে একসময় তার ডান হাতের তর্জনীতে কড়া পড়ে গিয়েছিল। সাহিত্যিক হওয়ার বাসনা এত তীব্র ছিল যে সরকারি চাকরির নিশ্চিত জীবন ছেড়ে অনিশ্চিত সাহিত্যকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। জীবনের একসময় এমন অর্থাভাব দেখা দিয়েছিল যে খুব অল্প টাকায় প্রকাশকের কাছে বেশ কয়েকটি বইয়ের কপিরাইট বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন।

লেখক হিসেবে জীবনে যেমন সুনাম কুড়িয়েছেন, তেমনি অপমানও কম সইতে হয়নি। প্রথম জীবনে অনেক বড় নামী সাহিত্যিক মুখের ওপর না করে দিয়েছেন, পরবর্তীতে তারাই সম্পাদক হেমেন্দ্রকুমার রায়ের কাছে নিজের লেখা ছাপানোর অনুরোধ করতে আসলে তিনি তাদের ফেরাননি। ‘কুসুম’ নামের একটা গল্প লেখার পর নিম্নমানের লেখা বলে অনেক পত্রিকা থেকে তিরস্কৃত হয়েছিলেন। বারো বছর পর সেই গল্পই যখন জার্মান ভাষায় অনুদিত হয়ে বিপুল প্রশংসা পায়, তখন সেসব পত্রিকার সম্পাদকদের সাহিত্য বিচারের দক্ষতা দেখে অবাকই হতে হয়। এ লেখা নিয়ে বিখ্যাত ভাষাতত্ত্ববিদ রাইনহান্ড ভাগনার প্রশংসাসূচক একটি চিঠি লেখেন হেমেন্দ্রকুমার রায়কে। প্রত্যাখাত সেই গল্পের এমন প্রশংসামূলক চিঠিটি তার মৃত্যুর তেইশ বছর পর প্রকাশ করা হয়।

১৯৬৩ সালের ১৮ এপ্রিল সাহিত্যের দিকপাল হেমেন্দ্রকুমার মৃত্যুবরণ করেন। বড়দের লেখক হিসেবে তিনি পাঠকদের কাছ থেকে হারিয়ে গেলেও শিশু ও কিশোর সাহিত্যিকদের মধ্যে তিনি আজও অমলিন। তার ভক্তরা এখন পর্যন্ত তার হাত ধরেই পাড়ি দিয়ে থাকেন বিপদসংকুল অজানা দুর্গম গন্তব্যে, তার লেখাই পাঠককে স্মরণ করিয়ে দেয় তার অমর সৃষ্টির সন্ধান।

লেখক শিবরাম চক্রবর্তী হেমন্দ্রকুমার রায় সম্পর্কে বলেছিলেন,

“বাংলা শিশু-কিশোরদের সাহিত্যকে সেই আদ্যিকালের বেঙ্গমা-বেঙ্গমীর জগত থেকে আধুনিক পর্যায়ে নিয়ে এসেছিলেন হেমেন্দ্রকুমারই। তারপরে আমরা সবাই তারই অনুবর্তী।”

ফিচার ইমেজ- banglapdf.net

Related Articles