Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

মানিক বন্দোপাধ্যায়: দারিদ্র্যের সাথে আজীবন যুদ্ধ করে যাওয়া এক সাহিত্যিক

দারিদ্র্যের প্রতিটি রেখাকে যেন কলমের ডগায় তিনি সুস্পষ্ট করে তুলতে পারতেন। পদ্মানদীর মাঝি’র কুবের-গণেশ-মালা কিংবা প্রাগৈতিহাসিকের ভিখু-পাঁচী, দারিদ্র্যের সে ভয়াল রূপ পাঠকদেরকে এতটুকু স্বস্তিতে থাকতে দেয় না। মানিক বন্দোপাধ্যায়ের লেখনী, জীবনকে সুন্দর মোড়কে মুড়িয়ে নিয়ে উপস্থাপন করে না, বরং সত্যিটাকে তার আসল চেহারায় দেখাতে চায় সবার চোখে আঙুল দিয়ে। হয়তো সে কারণেই তার কলমে উঠে এসেছিল, “ঈশ্বর থাকেন ঐ ভদ্রপল্লীতে, এখানে তাহাকে খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না।” 

পদ্মাতীরের মানুষের সুখ-দুঃখের গল্প ফুটে উঠেছে তার লেখনীতে; credit: Zainul Abedin

জীবনের শেষ প্রান্তে এসে ক্লান্ত-শ্রান্ত এই সাহিত্যযোদ্ধা বলতে বাধ্য হয়েছিলেন, ‘‘দেখো, দুটি ডাল-ভাতের সংস্থান না রেখে বাংলাদেশে কেউ যেন সাহিত্য করতে না যায়।’’ ঠিকই তো! শুধু কি সাহিত্যে পেট ভরে? এ সমাজে সৃজনশিল্পীদের নেই কোনো জীবনের নিশ্চয়তা, আর ওদিকে শিল্পপতির ঘরে অর্থের গলিত-পঁচিত ভাণ্ডার। এই সত্যটিকে মানিক তার সমগ্র জীবন দিয়ে বুঝেছিলেন। মারা যাবার পর রাশি রাশি ফুলের ভারে ন্যুব্জ হয় মৃতের দেহখানা, কিন্তু বেঁচে থাকতে দিনের পর দিন ক্ষুধার তাড়না তাড়া করে ফেরে তাকে।

সাহিত্যিকদেরও তাই দেখতে হয় বাণিজ্যের হাতছানি, রাখতে হয় বাণিজ্যিক আবদার। বিত্ত না থাকলে, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা না থাকলে একজন সাহিত্যিক শুধুমাত্র কলমের জোরে কতটুকুই বা টিকে থাকতে পারেন বা টিকিয়ে রাখতে পারেন নিজের সৃষ্টিকে? এ প্রশ্নটির উত্তর যেন জানা অজানা বহু সাহিত্যিকের কণ্ঠ হয়ে শেষমেশ বলে গিয়েছেন তিনি।

বিহারের দুমকা নামের একটি শহরে ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ মে জন্মগ্রহণ করেন মানিক বন্দোপাধ্যায়। বাবা হরিহর বন্দোপাধ্যায় এবং মা নীরদাসুন্দরী দেবী। চৌদ্দ ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন অষ্টম। সাহিত্যের পথে যাত্রাটা ছিল বেশ আত্মবিশ্বাসী। সাফল্যের খবর যেন জেনেই এসেছিলেন, এ পথে তাকে চলতে হবে আজীবন। প্রথম ছাপা গল্প ‘অতসী মামি’ও এই আত্মবিশ্বাসেরই ফসল। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে অনার্সে পড়ার সময় এক বন্ধুর সাথে অনেকটা চ্যালেঞ্জ ধরেই যেন লিখেছিলেন গল্পটি। ‘বিচিত্রা’ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল সেটি।

মানিক বন্দোপাধ্যায়; Source: anandabazar.com

প্রথমদিকে ভালো ফলাফল থাকলেও পরে আর পড়াশোনায় মন ছিল না। সে তো অনেকেরই থাকে না। কিন্তু মন নেই বলে দুম করে ছেড়ে দেবার মতো সাহস অনেকেই দেখান না। বাংলা সাহিত্যকে যিনি নিজের ধ্যান-জ্ঞান করে নিয়েছেন, তার পক্ষে আর বিজ্ঞানের হিসেব সইলো না। দাদাকে সোজাসাপ্টা জানিয়ে দিয়েছিলেন তার প্রচণ্ড দৃঢ় ও বিশ্বাসী বক্তব্য, “দেখে নেবেন, লেখার মাধ্যমেই আমি বাংলার লেখকদের মধ্যে প্রথম শ্রেণীতে স্থান করে নেব। রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্রের সমপর্যায়ে আমারও নাম ঘোষিত হবে

দাদা সুধাংশুকুমার বন্দোপাধ্যায় রীতিমতো বিজ্ঞানের পূজারী, ছোটভাইয়ের এহেন স্পর্ধা তাকে স্বভাবতই রাগিয়ে তুললো। টাকা দেওয়াও বন্ধ করে দিলেন। এদিকে সাহিত্যের সাথে যোগ হয়েছিল বাম-রাজনীতি। বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ের ক্লান্ত-রিক্ত পৃথিবীতে বিপ্লবী ধারার লেখনী উপহার দেওয়া সাহিত্যিকদের মধ্যে একজন ছিলেন মানিক বন্দোপাধ্যায়। মধ্যবিত্ত কপট জীবন ও আচরণ, ভোগবাদকে আঁকড়ে ধরার মোহময় প্রবণতা, শ্রমিক শ্রেণির শ্রান্ত দেহের পুষ্টিহীনতা- এসবকেই আশ্রয় করে তখন মানিকের কলম চলতে থাকে। তার রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত মতাদর্শ শক্তিশালী শব্দমালার মধ্য দিয়ে ফুটে ওঠে। বাস্তবতার বাস্তব চেহারা নিয়ে সমূলে আঘাত করতে থাকে পাঠকের বিবেকে। ১৯৪৪ সালে ভারতীয় কম্যুনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। সাহিত্যেও এর প্রভাব লক্ষ্যণীয়।

পুতুলনাচের ইতিকথা উপন্যাসটি লিখতে প্রায় ৪/৫ বছর সময় নিয়েছিলেন। এটি তার অন্যতম এক মাস্টারপিস। পুতুলনাচের ইতিকথা ও পদ্মানদীর মাঝি অনেকগুলো ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তার মৃত্যুর পরে প্রকাশ পায় মাঝির ছেলে (একমাত্র কিশোর উপন্যাস), শান্তিলতা (উপন্যাস), মানিক বন্দোপাধ্যায়ের কবিতা (একমাত্র কবিতা সংকলন), লেখকের কথা (প্রবন্ধ সংকলন), অপ্রকাশিত মানিক বন্দোপাধ্যায় (ডায়েরি ও চিঠিপত্রের সংকলন)।

মানিক বন্দোপাধ্যায়ের অন্যতম জনপ্রিয় উপন্যাস পুতুলনাচের ইতিকথার প্রচ্ছদ; Source: goodreads.com

বাঁশি বাজাতে খুব ভালোবাসতেন। যখন তখন বাঁশি নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন। কোনো খবরই পাওয়া যেতো না, থাকতো না তার ঘরে ফেরার কোনো তাড়া। তার এই বাঁশিপ্রীতির দেখা মেলে প্রথম গল্প ‘অতসী মামি’তেই। নদীও খুব ভালোবাসতেন। নদীর সাথে, তাকে ঘিরে গড়ে ওঠা জনবসতির সাথে মানিক অনুভব করতেন এক আত্মিক বন্ধন। মাঝি-জেলেদের সাথে গল্পে মজে থাকতেন, খাওয়া-দাওয়াও করতেন তাদের সাথে। সেই আত্মীয়তা থেকেই সৃষ্টি করেছিলেন তার সবচাইতে জনপ্রিয় রচনা ‘পদ্মা নদীর মাঝি’।

তার লেখায় মার্ক্সিজম ও ফ্রয়েডিজম বেশ প্রভাব রাখতো। এই দুই মতবাদের মিশেলে তিনি তার চরিত্রগুলো গড়তেন। শ্রেণিবৈষম্য ও যৌনতা তার লেখার পরিচিত উপাদান। কাহিনীর প্রয়োজনে অনেক রচনায়ই তিনি এই মতবাদগুলো উপস্থাপন করেছেন। জেলে পল্লীর উঁচু-নিচু শ্রেণি কিংবা কুবের-কপিলার সম্পর্ক, চতুষ্কোণের রাজকুমার ও সরসীর মধ্যকার আবেদন সহ আরো বহু জায়গায় তার মনস্তত্ত্বের এই দিকগুলো দেখা গিয়েছে।

ঠিকুজির নাম ছিল অধরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, বাবা রেখেছিলেন প্রবোধকুমার। কোনো নামই সময়ের ধোপে টিকলো না। গায়ের রং কালো বলে সবাই ডাকতো কালোমানিক বলে। সে থেকে তিনি নিজের নাম ছেঁটে নিলেন, মানিক। প্রথম গল্প ছাপার সময় থেকেই তিনি নিজেকে এ নামে পরিচয় দিয়ে এসেছেন, এবং এ নামেই বাংলা সাহিত্যের জগতে ভাস্বর হয়ে রয়েছেন।

সাহিত্য নিয়ে বরাবরই আত্মবিশ্বাসী ছিলেন তিনি; Source: anandabazar.com

একসময়ের কুস্তি লড়া এবং পাড়ার মাস্তানকে কাবু করা ডাকাবুকো শরীরটা ক্ষয়ে যেতে লাগলো যেন। একদিকে দারিদ্র্য, আরেকদিকে রাজনীতি ও সাহিত্যের প্রতি তুমুল সাধনা- একসাথে সবকিছু যেন সইতে পারেনি তার শরীর। মৃগীরোগ দেখা দিল। প্রায়ই ভুগতেন। ১৯৩৮ সালে তার বিয়ে হয়েছিল কমলা দেবীর সঙ্গে, স্ত্রীকে ডাকতেন ‘ডলি’ বলে। ‘অপ্রকাশিত মানিক’ গ্রন্থটি থেকে তাদের সংসারের দারিদ্র্যের কষাঘাত কী ভয়াবহ চেহারা নিয়ে ছিল, তার একটি উদাহরণ পাওয়া যায়। স্ত্রী মৃত সন্তান প্রসব করার পর মানিক বন্দোপাধ্যায় লিখেছিলেন, ‘‘বাচ্চা মরে যাওয়ায় ডলি অখুশি নয়। অনেক হাঙ্গামা থেকে বেঁচেছে। বলল, বাঁচা গেছে বাবা, আমি হিসেব করেছি বাড়ি ফিরে মাসখানেক বিশ্রাম করে রাঁধুনি বিদায় দেব। অনেক খরচ বাঁচবে।’’

স্বামীর সঙ্গে স্ত্রীও যে একটি প্রবল সংগ্রাম লড়ে গেছেন, তা স্বীকার না করে উপায় নেই। মানিকের জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তার সহযোদ্ধা হয়ে পাশে ছিলেন তিনি। মৃত্যুশয্যায় শুয়ে আছেন, সেসময়টায় বাড়িওয়ালা ভাড়া না দেবার অপরাধে মামলা ঠুকে দিয়েছিলেন। সবটুকুই সইতে হয়েছে বাংলা সাহিত্যের অত্যন্ত শক্তিমান এই লেখককে, কারণ সাহিত্যে পেট ভরে না!

সাহিত্যে পেট ভরে না বলেই তাকে চাকরির জন্য হন্যে হতে হয়েছে। কিছুদিন নবারুণ পত্রিকায় চাকরি করেন সহ-সম্পাদক হিসেবে। এরপর বঙ্গশ্রী পত্রিকায়ও একই পদে কাজ করেন। নিজের একটি প্রেস চালু করেছিলেন। কিন্তু অর্থাভাবে তা-ও বন্ধ হয়ে যায় কয়েকটা দিন যেতে না যেতেই।

দীর্ঘদিন রোগে ভুগেছেন। শেষমেশ ১৯৫৬ সালের ৩রা ডিসেম্বর মৃত্যুর আগমনের মাধ্যমে সকল ভোগান্তির অবসান ঘটে। শেষ ক’দিন তার সাথে ছিলেন আরেক সাহিত্যিক দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি তার সেদিনের স্মৃতিচারণে মানিকের জীবন-মৃত্যুর এক সত্য ও নির্মম ছবি তুলে ধরেছেন-

পালঙ্ক শুদ্ধু ধরাধরি করে যখন ট্রাকে তোলা হয় তখন একটা চোখ খোলা, একটা বন্ধ। শরীরের ওপর রক্তপতাকা বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। তার ওপরে ফুল। মুখটুকু বাদে সমস্ত শরীরটা ফুলে আর ফুলে ছেয়ে গেছে। উপচে পড়ছে দু’পাশে…। মাথা এবং পায়ের কাছে দেশনেতা এবং সাহিত্যিক! সামনে পেছনে, দুইপাশে বহু মানুষ। সর্বস্তরের মানুষ। মোড়ে মোড়ে ভিড়। সিটি কলেজের সামনে মাথার অরণ্য। কিন্তু কাল কেউ ছিল না, কিছু ছিল না… জীবনে এত ফুলও তিনি পাননি

ফিচার ইমেজ: Jamal

Related Articles