পঞ্চতন্ত্র, ঈশপের গল্পের মতোই জাতকের গল্পগুলো অসাধারণ সাহিত্যরসে ভরপুর। জাতকের কাহিনীগুলো বিভিন্ন বয়সী পাঠকদের কাছে আজও সমান জনপ্রিয়। তাই গল্পগুলো এখন আর বইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে কমিকের বইয়ে বা কখনও অ্যানিমেশন ছবিতে জীবন্ত হয়ে আছে। জাতকের কাহিনীগুলো এখনও নিয়মিতভাবে বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হচ্ছে।
জাতক কী?
‘জাতক’ শব্দের অর্থ জন্মগ্রহণকারী। জাতক হলো গৌতম বুদ্ধের বিভিন্ন জন্মের কাহিনী রচিত গল্প সঙ্কলন। শোনা যায়, বুদ্ধদেব নিজেই জাতকের কাহিনীগুলো শুনিয়েছিলেন। বুদ্ধদেবের পূর্বজন্মের নানা কাহিনী নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে জাতকের ৫৪৭টি গল্প। বুদ্ধত্ব লাভের পর গৌতম বুদ্ধ তার অতীত জীবনের কথা স্মরণ করার ক্ষমতা অর্জন করেন। তিনি শিষ্যদের সাথে ধর্মালোচনার সময় প্রাসঙ্গিক উদাহরণ হিসেবে তার পূর্বজন্মের নানা ঘটনার কথা উল্লেখ করতেন। সেসব ঘটনার সঙ্কলনই জাতক সাহিত্য হিসেবে পরিচিত।
পালি ভাষায় জাতকের এই কাহিনীগুলোকে বলা হয় ‘জাতকত্থ বন্ননা’। ধারণা করা হয়, সম্রাট অশোকের পুত্র মহেন্দ্র বৌদ্ধধর্ম প্রচারের জন্য যখন সিংহল পরিভ্রমণ করেন, তখন শিষ্যদের জ্ঞানদানের জন্য তার সাথে ছিল জাতকের কাহিনীগুলো। সেই মূল গ্রন্থটি এখন বিলুপ্ত। সিংহলি ভাষায় যে জাতক প্রচলিত আছে, বর্তমানের ‘জাতকমালা’ তারই অনুবাদ বলে অনেকেই মনে করেন। অনেকের মতে, ‘জাতক’ হলো পৃথিবীর সমস্ত ছোট গল্পের উৎস।
জাতকের সময়
জাতক গল্পের অধিকাংশই প্রাক-বুদ্ধ যুগের। পঞ্চতন্ত্রসহ বিভিন্ন ভারতীয় সঙ্কলনেও এইসব কাহিনীর কিছু কিছু পাওয়া যায়। দক্ষিণ এশিয়া ও মধ্য এশিয়ার বাইরেও জাতকের বেশ কিছু কাহিনীর অস্তিত্ব পাওয়া যায়। মানবজাতির জ্ঞান ও নৈতিকতা অর্জনের জন্য জাতক কাহিনীগুলো রচিত হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। জাতকের এই গল্পগুলো দীর্ঘকাল গুরুশিষ্য পরম্পরায় শ্রুতি থেকে স্মৃতিতে সংরক্ষিত ছিল।
খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে সম্রাট অশোকের পৃষ্ঠপোষকতায় অনুষ্ঠিত তৃতীয় বৌদ্ধ মহাসঙ্গীতি কালে জাতক গ্রন্থিত হয়। পালি ভাষাতেই জাতকের গল্পগুলো লিখিত হয়েছিল। বুদ্ধঘোষ রচিত জাতকত্থ বণ্ণনা নামক গ্রন্থে ৫৪৭টি জাতক কাহিনী অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৮৯৫ থেকে ১৯০৭ সাল পর্যন্ত জাতকের কাহিনীগুলো ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়। পরবর্তীকালে বাংলাসহ বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় তা অনূদিত হয়। বাংলা ভাষায় জাতকের কাহিনীগুলো অনুবাদ করেন ঈশান চন্দ্র ঘোষ।
বাংলা ভাষায় রচিত জাতকের গল্প সঙ্কলনেও ৫৪৭টি জাতক কাহিনী স্থান পায়। কিন্তু ত্রিপিটকের সূত্তপিটক মতে, বুদ্ধদেব ৫৫০ বার জন্ম নিয়েছিলেন। সে হিসেবে জাতক সংখ্যা ৫৫০টি হওয়া উচিত। কিন্তু জাতকের তিনটি কাহিনী সম্পর্কে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। আবার অনেকের মতে, জাতকে যে ৫৪৭টি গল্প আছে তার অনেকগুলোই পরবর্তী সময়ে সংযোজিত হয়েছে। তাই কোন জাতকগুলো প্রাচীনতম অর্থাৎ বুদ্ধেরই বলা, তা চিহ্নিত করা খুব কঠিন। তবে গবেষকগণ কিছু কিছু গল্পের ভাব ও ভাষা বিচার করে কয়েকটি কাহিনীকে চিহ্নিত করতে পেরেছেন।
জাতক গল্পের মূল বিষয়বস্তু
বুদ্ধদেব নির্বাণ লাভ করার অল্প কিছুদিন পর থেকেই তার অনুগামীরা জাতকের কাহিনী শোনাতেন। এসব কাহিনী তারাই চিরস্মরণীয় করার ব্যবস্থা করেন। আত্মজীবনীমূলক এই কাহিনীগুলোর নৈতিক মূল্য রয়েছে একজন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীর কাছে। গৌতম বুদ্ধের জীবনের বিভিন্ন ঘটনা, বৈশিষ্ট্য এবং পরিস্থিতি জাতকে বর্ণিত কাহিনীগুলো দিয়ে আংশিকভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। জাতকের গল্পে তিনটি বিষয়ের প্রাধান্য দেয়া হয়। এ কারণে একটি জাতক গল্পকে তিনটি অংশে ভাগ করা হয়।
প্রথম অংশে, গৌতম বুদ্ধ গল্পটি কোথায়, কখন, কাকে বলেছেন, তার নির্দেশনা থাকে। গল্পের এ ধরনের ভূমিকাকে প্রত্যুৎপন্ন বস্তু বলা হয়। গল্পের দ্বিতীয় অংশে অতীত জন্ম পটভূমিকা তুলে ধরে বুদ্ধ জাতকটি তার অনুসারীদের বলে থাকেন। এটি গল্পের মূল আখ্যান। গল্পের এ অংশকে বলা হয় অতীত বস্তু বা মূল বিষয়বস্তু। গল্পের শেষ অংশে অতীত জীবনের সাথে বর্তমান জীবনের যোগসূত্র স্থাপন করা হয়। এ অংশকে বলা হয় সমাধান তত্ত্ব।
গল্পে জাতকের যেসব নাম পাওয়া যায়
জাতকের গল্পগুলো বুদ্ধদেব তার পূর্বের জন্মগুলোতে কখনও মানুষ, কখনও বা পশু, আবার কখনও পাখি হয়ে জন্মেছেন। পূর্বজন্মের এসব কাহিনী নিয়েই সৃষ্টি হয়েছে জাতক। প্রচলিত গল্পগুলোতে আর যেসব চরিত্র পাওয়া যায়, তাদের মধ্যে অগস্ত্য, অপুত্রক, অধিসহ্য, শ্রেষ্ঠী, আয়ো, ভদ্রবর্ণীয়, ব্রহ্ম, ব্রাহ্মণ, বুদ্ধবোধি, চন্দ্রসূর্য, দশরথ, গঙ্গাপাল, হংস, হস্তী, কাক, কপি, ক্ষান্তি, কাল্মষ পিন্ডি, কুম্ভ, কুশ, কিন্নর, মহাবোধি, মহাকপি, মহিষ, মৈত্রীবল, মৎস্যমৃগ, মধ্যদেবীয়, পদ্মাবতী, রুরু, শত্রু, শারভ, শশ, শতপত্র, শিবি, সুভাস, সুপারগ, সূতসোম, শ্যাম, উন্মাদয়ন্তী, বানর উল্লেখযোগ্য।
নীতিবোধের অনুপ্রেরণা থেকে রচিত হয়েছে জাতক কাহিনী
জাতকের কাহিনীগুলো মানুষের মধ্যে মৈত্রী, ভ্রাতৃত্ববোধ, মানবতা, সৌহার্দ্যের মতো সম্পর্কগুলো গড়ে তুলেতে যেমন উদ্বুদ্ধ করে, তেমনি দয়াবান, সৎ ,আদর্শবান ও নীতিবোধসম্পন্ন মানুষ গড়ে ওঠার মতো নৈতিক শিক্ষা দিয়ে থাকে। পরমতসহিষ্ণু ও পরধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে শিক্ষা দেয়।
সাহিত্য হিসাবেও জাতকের গল্পগুলো কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। এর গল্পের গঠন এবং উপস্থাপনের ভঙ্গিমার কারণে সব বয়সী পাঠকদের কাছে জাতকের কাহিনীগুলো অবশ্যই সুখপাঠ্য।
শোনা যাক একটি জাতক কাহিনী
জাতকের বিভিন্ন কাহিনী পুনর্জন্মের সূত্রে গ্রথিত, যে পুনর্জন্মের পরিসমাপ্তি ঘটেছে বুদ্ধদেবের নির্বাণলাভের মাধ্যমে। পুনর্জন্ম কেন, তা ব্যাখ্যা করা যায় বুদ্ধদেবের নিজের জীবন ও লক্ষ্য দিয়ে। জাতকের প্রতিটি কাহিনীতেই পাপ-পুণ্য, ধর্ম-অধর্মের কথা বলা হয়েছে। সেই সারমেয় বা কুকুরের গল্পটা ধরা যাক। এই গল্পটাও জাতকের আর পাঁচটা গল্পের মতোই নীতিকাহিনী।
কুকুরটি ছিল গৃহহীন। পথেঘাটেই ছিল তার বাস। জাতকের এই কাহিনী থেকে জানা যায়, একবার বুদ্ধদেবের এরকম জন্ম হয়েছিল। কিন্তু নেতৃত্ব দেওয়ার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিল কুকুরটির। এই চরিত্রগুণেই সে একদিন রাস্তার সব কুকুরদের নেতা হয়ে যায়। কোনো একটি ঘটনার জন্য রাজার বিষনজর পড়েছিল রাস্তার কুকুরগুলোর ওপর। আর তাদের বাঁচানোর দায়িত্ব কুকুরদের দলনেতা নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিল।
রাজার রথের জন্য যে ঘোড়ার সাজ ব্যবহার করা হয়েছিল, তা রাজবাড়ির প্রাঙ্গণে খোলা আকাশের নিচে ফেলে রাখা হয়েছিল। রাতভর বৃষ্টিতে সাজ একেবারে ভিজে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। সাজের চামড়ার অংশটুকু হয়ে গিয়েছিল নরম আর সুসিদ্ধ। এক ঝাঁক শিকারি কুকুর ছিল রাজার। চামড়ার সাজ টুকরো-টুকরো করে সেই শিকারি কুকুরের দল ভোজনপর্ব সেরেছিল।
খবর গেল রাজার কাছে। কিন্তু প্রাসাদের ভৃত্যরা জানালো, রাস্তার কুকুরগুলো পয়ঃপ্রণালী দিয়ে প্রাঙ্গণে ঢুকে চামড়ার সাজ খেয়েছে। রাজা খুব ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন, আদেশ দিলেন, শহরের সমস্ত কুকুরকে নিধন করতে হবে। ভীতসন্ত্রস্ত ক্ষুদ্ধ কুকুরের দল ছুটে এলো সেই গৃহহীন কুকুরের কাছে। সেই কুকুর তার বিক্ষুব্ধ অনুগামীদের শান্ত করলো এবং প্রাসাদের পথে রওনা হলো।
সবসময় সত্যের ওপর ভরসা রাখার সহজ পথটি অনুসরণ করতো কুকুরটি। আর সেই সত্যের জোরেই সে পৌঁছে গেল রাজার কাছে। পথে কোনো নিপীড়নের শিকার হতে হলো না তাকে। রাজাকে বুঝিয়ে বললো সে। কুকুরটি রাজাকে তার নিজের শিকারি কুকুরদের ঘাস আর ঘোল খাওয়ানোর পরামর্শ দিল। রাজা সেইমতো আদেশ দিলেন। রাজার শিকারি কুকুরদের ঘাস আর ঘোল খাওয়ানোর সাথে-সাথে বমি করলো কুকুরের দল। বেরিয়ে এলো চামড়ার সব টুকরো।
কুকুরটি প্রমাণ করলো, তার অনুগামীরা একেবারেই নির্দোষ। ভবঘুরে কুকুরটির জ্ঞানবুদ্ধির পরিচয় পেয়ে রাজা তারই খাবার থেকে কুকুরটিকে নিয়মিত ভাগ দেওয়ার নির্দেশ দিলেন। কোনো প্রাণীকেই কখনও হত্যা করা হবে না, কুকুরটির এই অনুরোধ রাজা মঞ্জুর করলেন। এই কাহিনীর প্রধান চরিত্রটি যে স্বয়ং বুদ্ধদেব, তা আগেই বলা হয়েছে। আর রাজা হলেন তারই প্রধান শিষ্য আনন্দ।