রূপকথা ভালোবাসে না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। যতই বাস্তববাদী হোন না কেন, কখনো না কখনো কোনো না কোনোভাবে আপনিও রূপকথায় ডুবে যেতে চেয়েছেন। রূপকথার মোহনীয়তাই যে এমন! ছোটবেলা থেকে বাবা-মা, পরিবারের বড়রা বাচ্চাদেরকে গল্প শোনান, গল্প পড়তে শেখান। আর এসব গল্পের বেশিরভাগই থাকে রূপকথা!
ভালোর সাথে সবসময় ভালো আর মন্দের সাথে হয় মন্দ, এ শিক্ষাই রূপকথা আমাদের দিয়ে এসেছে গল্পের ছলে। তাই আজ যতই পৃথিবীর নির্মম বাস্তবতার সাথে ঠোকর খাই না কেন, তারপরও হয়তো মনে হয়, জীবনটা যদি রূপকথার মতো হতো! মানুষ সবসময় দুটো সত্ত্বার মধ্য দিয়ে দিন কাটায়, একটি যুক্তির আর অপরটি বিশ্বাসের। রপকথার গল্পগুলো কোথাও না কোথাও আমাদের বিশ্বাসের দিকটিকে আলোকিত করে রেখেছে এই “যদি রূপকথার মতো হতো!” ভাবিয়ে।
আজ আমরা হাজির হয়েছি বিশ্ববিখ্যাত কিছু পশ্চিমা রূপকথার চরিত্র নিয়ে যাদের আমরা জানি ‘Fairy Tales Character’ হিসেবে। গল্পে কখনো না কখনো আপনিও শামিল হয়েছিলেন আর যারা আপনার বেড়ে ওঠার দিনগুলোতে ছড়িয়ে দিয়েছিলো গল্পের জাদু! চলুন একবার খোঁজ নিই তাদের।
পিনোকিও (Pinocchio)
আপনি কি মিথ্যেবাদী? এর উত্তরে নিশ্চয়ই একটু ভেবে সবাই বলবেন, “এ যুগে মিথ্যেবাদী নয় কে? মিথ্যে বলা কি আর এখন কোনো দোষ?” রূপকথার চরিত্র পিনোকিও-ও কিন্তু তাই ভাবতো! কিন্তু… হ্যাঁ, এই গল্পে রয়েছে বেশ বড় একটি ‘কিন্তু’!
পিনোকিও ছিলো একটি অতি দুষ্টু কাঠের পুতুল। আর তার দুষ্টুমি এতই নাছোড়বান্দা ছিলো যে পিনোকিও খুব ভালো কিছু করতে গেলেও সবসময় এই দুষ্টুমির জন্য বেশ বিপদে পড়ে যেতো। আর মিথ্যের পর মিথ্যে বলা তো তার প্রিয় কাজ। কিন্তু পিনোকিওকে নীল পরী দিয়েছিলো তার সুন্দর শাস্তি।
সে যখনই একটি মিথ্যে কথা বলতো, সাথে সাথে তার কাঠের নাকটি একটু করে লম্বা হয়ে যেতো, এমন করতে করতে একদিন অদ্ভুতুড়ে আকার ধারণ করলো পিনোকিও’র নাক, আর তারপর যা হয় তাই আর কী! কান্নাকাটি করে নাক কাটাতে হলো, শপথ করলো আর কখনো মিথ্যের ধারেকাছেও যাবে না, কারণ সে আর পুতুল হয়ে থাকতে চায় না। পিনোকিও একটি সত্যিকারের ছেলে হতে চায়, কিন্তু এর জন্য যে তাকে খুব ভালো হতে হবে, সবার আগে ছাড়তে হবে মিথ্যে বলা!
পিনোকিও কি পেরেছিলো মিথ্যে বলা ছাড়তে? সে কি কখনো তার কাঠের শরীর থেকে মুক্তি পেয়েছিলো?
সিনডারেলা (Cinderella)
সে ছিলো এক ছাইকন্যা, থাকতো ছাইয়ের গাদায়। ‘Cinder’ অর্থ ‘ছাই’, তাই তার দুই সৎ বোন তার নাম দিয়েছিলো সিনডারেলা। সৎ মা আর বোনদের নিয়মিত অত্যাচারে জর্জরিত হতো সিনডারেলা। সারাদিন ঘরের সব কাজ আর মা-বোনের সেবা, দিনশেষে একটু ভালো খাবারও জুটতো না বেচারির। কিন্তু তাতে কী হবে, রূপথার নায়িকা কি রূপবতী না হলে চলে? সিনডারেলাও ছিলো খুব রূপবতী, এমনকি তার বোনদের চেয়েও।
সিনডারেলার জীবন দুঃখে ভরা হলেও তার ছিলো কিছু সত্যিকারের বন্ধু। বনের পশুপাখি সবাই আর এক পরী মা সিনডারেলাকে খুব ভালোবাসতো। তাই যেবার রাজপ্রাসাদ থেকে ডাক এলো বল নৃত্যের, সিনডারেলাকে পরী মা দিলেন এক বর! সেও যেতে পারবে রাজপুত্রের আহবানে! কিন্তু ফিরে আসতে হবে রাত ১২টার মধ্যেই! সিনডারেলা কি পারবে এই বর দিয়ে রাজরাণী হতে? নাকি আবার তাকে ফিরে আসতে হয় সেই ছাইয়ের গাদায়?
প্রিন্স চার্মিং (Prince Charming)
প্রতিটি মেয়েই কোনো না কোনো সময় চায় ঘোড়ায় চড়ে তার স্বপ্নের রাজকুমার আসবে, আর তাকে নিয়ে যাবে সঙ্গে করে। রূপকথার প্রিন্স চার্মিং এই ধারণারই একটি ফসল। বেশ কিছু রূপকথায় প্রিন্স চার্মিংকে আসতে দেখা যায় এবং প্রায় প্রতিবারই সে তার রাজকন্যাকে মন্ত্রমুক্ত করে বন্দিদশা থেকে মুক্তি দেয়।
প্রিন্স চার্মিং মানেই সে একাধারে রুপবান, গুণবান ও রোমান্টিক হবে! পুরো গল্প জুড়ে নায়িকা যার অপেক্ষা করতে থাকে, সে তো প্রিন্স চার্মিং! মজার জিনিস হলো ‘প্রিন্স চার্মিং’ কোনো রাজকুমারের নাম নয়, প্রতি গল্পে তার অন্য একটি নাম থাকে অথবা কোনো নাম থাকেই না! কিন্তু এটি একটি চিরায়ত ধারণা, যে প্রিন্স চার্মিং- সে যে রাজকুমারই হোক, একদিন রাজকন্যাকে তার বন্দিদশার অবসান ঘটিয়ে নিয়ে যাবে টগবগ করে ঘোড়া ছুটিয়ে!
স্নো হোয়াইট (Snow White)
“আয়না, আয়না,
দেয়ালের আয়না,
কে সবচেয়ে রূপসী, তুমিই বলো না?”
রাণী প্রশ্ন করছেন তার জাদুর আয়নাকে, শুনতে চাচ্ছেন শুধুই নিজের নাম। কিন্তু হায়! আয়না তো তার কথা বলছে না, সে যে বলছে রাণীরই সৎ কন্যা স্নো হোয়াইটের কথা! স্নো হোয়াইট, যার চুল জানালার আবলুস কাঠের মতো কৃষ্ণবর্ণ, যার ঠোঁট রক্তগোলাপের ন্যায় রক্তবর্ণ এবং যার ত্বক শ্বেত তুষারের মতোই শুভ্রতাপূর্ণ- জাদুর আয়না তার কথাই বলেছে।
স্নো হোয়াইটের রূপ যেন হলো ‘আপনা মাংসে হরিণা বৈরি’র মতো নির্দয়! রাণী তাকে হত্যা করতে পাঠালেন এক শিকারিকে, কিন্তু গল্পের নায়িকা কি এত সহজে গল্প থেকে চলে যায়? এরপর শুরু হয় সাত বামনের সাথে তার এক অন্য জীবন, এর ফাঁকে এই গল্পের প্রিন্স চার্মিংয়েরও দেখা মেলে বটে!
পিটার প্যান (Peter Pan)
অন্য এক জগত থেকে পৃথিবীর বুকে সুন্দর এক শহরে নেমে আসে পিটার প্যান, সাথে প্রিয় পরী টিংকারবেল। দেখা হয় পৃথিবীর মেয়ে উইন্ডির সাথে, অনেক ভাবও হয়। উইন্ডি যত দেখে ততই অবাক হয় পিটার প্যানকে নিয়ে। পিটার প্যান, যার বয়স কখনো বাড়ে না। সে উপভোগ করছে তার কখনো না শেষ হওয়া শৈশবকে।
সে থাকে নেভারল্যান্ড (Neverland) নামে একটি দ্বীপে, যেখানে হারিয়ে যাওয়া একদল শিশুর দায়িত্বে সে নিয়োজিত। তাদের রক্ষা করে সে জলদস্যুদের কাছ থেকে, যখন তখন অভিযানে বেরিয়ে পড়ে পিটার প্যান, সাথে নিয়ে তার সবসময়ের বন্ধু টিংকারবেলকে। তার এই অদ্ভুত জীবনের মাঝে যখন উইন্ডির প্রবেশ ঘটে, পিটার প্যান যেন অন্যরকম জীবনের উপস্থিতি টের পায়।
তাহলে তার মনেও কি তখন বড় হবার সাধ জাগে?
রাপাঞ্জেল (Rapunzel)
“রাপাঞ্জেল, রাপাঞ্জেল, তোমার কেশ নামিয়ে দাও যাতে আমি স্বর্ণকেশের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে পারি”
কে গাইছে এ গান? কোনো বন্ধু? না, এ রাপাঞ্জেলকে চুরি করে আনা এক ডাইনী গান গাইছে! ছোটবেলায়ই সে রাজা-রাণীর কাছ থেকে চুরি করে এনেছে রাপাঞ্জেলকে। কেন? তার সোনালী কেশের জন্য, এতে আছে সঞ্জীবনী গুণ! এর উপর সম্পূর্ণ অধিকার লাভের জন্য রাপাঞ্জেলকে ডাইনী বুড়ি করেছে আজন্ম বন্দিনী।
হ্যাঁ, এও এক বন্দিনীরই গল্প, তবে ভয় নেই। একদিন তার জন্যও আসবে তার প্রিন্স চার্মিং! বাইরের যে পৃথিবীর প্রতি রাপাঞ্জেলের চির আকর্ষণ, একদিন সেও হয়ে উঠবে তার অংশ, তার প্রিন্স চার্মিং এসে উঁচু প্রাচীর ভেদ করে নিয়ে যাবে রাপাঞ্জেলকে তার স্বপ্নের দুনিয়ায়!
রূপকথা সত্য হোক বা না হোক, রূপকথার চরিত্রগুলো আমাদের ভালোলাগার একটা বিশেষ জায়গা জুড়ে আছে। মানুষ মুগ্ধ হতে ভালোবাসে এবং রূপকথা একটি মুগ্ধতার নাম। ভালো থাকুক রূপকথা, ভালো থাকুক রাজকন্যা-রাজপুত্তুরেরা ঐ রঙিন মলাটে বাঁধা মুগ্ধ করা বইয়ের পাতায়!